সৌরভ কর
দিনটা ছিল ১২ ই ডিসেম্বর ২০২৩ মঙ্গলবার, ডক্টর শুভ্রদীপ গাঙ্গুলির সাথে গেলাম এক রোগীর বাড়িতে। স্যার বয়স্ক রোগীকে দেখলেন এবং রোগীর মেয়েকে বললেন যে আপনার বাবার ফিজিওথেরাপি শুরু করা হবে। স্যার আমার কথা বললেন সৌরভ এখন থেকে এসে আপনার বাবাকে ফিজিওথেরাপি করাবে, তাহলে কবে থেকে শুরু করলে আপনাদের ভালো হয়, তখন রোগীর মেয়ে একটা ছড়া কেটে বললেন যে-মঙ্গলে ঊষা বুধে পা- যথা ইচ্ছা তথা যা, তো কাল বুধবার কাল থেকেই শুরু হোক। দ্বিতীয় দিন যখন একা গেলাম রোগীর সাথে একটু পরিচয় করলাম, জানলাম যদিও রোগী কিছুই বলতে চাইছিলেন না, উনার বয়স ৯২ বছর , হাই প্রেসার, সাথে সুগার, ও সি ও পি ডি, এছাড়াও তিনটে স্টেন বসানো, তার ওপর সাপোর্ট ছাড়া হাঁটতে পারেন না, আর শুয়ে শুয়ে দিন কাটানোর ফলে শরীর ও মন দুই দিক থেকেই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন, তৃতীয় দিন যখন গেলাম, আগের দিনের তুলনায় ঐদিন অল্প কথা বলছিলেন, আসলে ওনার স্ত্রী ও অসুস্থ, আর মেয়ে স্কুলের ম্যাডাম তাই একা একাই শুয়ে দিন কাটতো,
কথা বলার মত কেউ ছিল না শুধু যে কথা বলার নয় ,কথা শোনার মত কেউ ছিল না, তারপর আস্তে আস্তে এক্সারসাইজ করতে করতে খুব কথা বলাও শুরু করলেন। আমি গেলেই কথা বলা শুরু হয়ে যেত, আর আমাকে নাম দিয়েছিলেন মাস্টারমশাই , গেলেই বলতেন মাস্টারমশাই এসে গেছে ,আর ওনার মেয়ে আমাকে বলতেন তোমার ছাত্র খেতে চাইছেন না কথা শুনছেন না একটু বকা দিয়ে যেও তো ,এই ভাবেই দিন কয়েক কাটল, আর রোগী একদিন বলল তুমি বিয়ে করোনি তো তাই ভালো আছো, না হলে বুঝতে কি জ্বালা, এইভাবেই আস্তে আস্তে রোগী খুব কথা বলতে শুরু করেন, তারপর এক্সারসাইজ করাতে করাতে মনে হতো ওনার বয়স নাম মাত্রই ৯২ মনের দিক থেকে কিংবা কথা শুনে বা হাসি দেখে মনে হতো ওনার বয়স সবে ২০, এই ভাবেই অনেকটা সুস্থ হতে শুরু করলেন, একদিন ওনার মেয়ে বলল সৌরভ তোমার ছাত্র অনেকদিন পর আজ নিজে নিজে মুখ ধুয়েছেন, শুনে খুব খুশি হলাম, এই ভাবেই চলল আরো কয়েকদিন, আর উনি বলতেন আমি কবে যে বাইরে গিয়ে নিজে নিজে হাঁটবো কে জানে..? একদিন বাইরে নিয়ে গেলাম ও সাপোর্ট ছাড়া হাঁটালাম, ঐদিন উনি এবং উনার মেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন, যাইহোক এটাই মনে হয় ওনার শেষ ইচ্ছে ছিল, না জেনে ই শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করেছিলাম। তারপর একদিন ওনার মেয়ে কল করে বললেন আজ আসতে হবে না সৌরভ । বাবার ইউরিন এর সমস্যা হয়েছে একবার হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। ফিরে আসলে তোমায় কল করে ডেকে নেব। আমি বললাম ঠিক আছে। তার একদিন পর হঠাৎ উনার মেয়ে সকাল সকাল কল করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন সৌরভ বাবা আর নেই। আমি ভাবতেই পারিনি সকাল-সকাল এমন একটা খবর পাব। তো তারপর ওনার মেয়ে বলল জানো সৌরভ কাল সারাদিন হাসপাতালে বাবা শুধু তোমার কথাই বলে গেছেন আর শুধু বলছিলেন সৌরভ কে নিয়ে আই । সৌরভ কে ডাক। তখন আমি বাবাকে বুঝিয়ে বললাম বাবা তুমি সুস্থ হয়ে বাড়ি চলো তারপর আবার সৌরভকে ডাকবো ও এসে তোমার গল্প শুনবে এক্সারসাইজ করাবে। এটা শোনার পর আমার চোখ দিয়ে জল এসে গেল, মুখ দিয়ে কথা ও আটকে যাচ্ছিল, আমি জিজ্ঞাসা করলাম আপনার বাবা এখন কোথায়? উনি বললেন তুমি আসলেও আর দেখতে পাবে না ওনাকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে, জীবনে হয়তো অনেক রোগী দেখব কিন্তু ওনাকে কোনদিন ভুলতে পারবো না শুধু স্মৃতির পাতাতেই নয় মনের মধ্যেও অমর হয়ে থেকে গেলেন উনি। রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও যে ভালো সম্পর্ক হয় এটা তার বড় উদাহরণ। সত্যিই এটা আমার কাছে অনেক বড় পাওয়া। উনার কথা মনে হলেই চোখ দিয়ে জল এসে যায়। খুব মনে পড়ে এই ভাবেই যেন রোগীর মনের সাথে নিজেকে কানেক্ট করতে পারি। আমাদের হাতে তো কিছুই করার নেই। সবি ভগবানের হাতে ,আমরা যতটা পারি যথাসাধ্য চেষ্টা করি ,রোগীকে সুস্থ করে তোলার,উনি যেখানেই থাকুন সুস্থ থাকুন ওনার আত্মার শান্তি কামনা করি।
______________
সৌরভ কর
Village+ post:- joteghanashyam
District:- poschim medinipur
Police station:-duspur
West Bengal