বিকাশকলি পোল্যে
বারান্দায় চুপচাপ বসে আছেন মাধবীলতা। নিচু স্বরে গান বাজছে - 'আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ'।রবি ঠাকুরের গান।
টগর এখনও কাজে আসেনি। সে থাকে ক্যানিংয়ে।রোজ ভোরবেলা বেরিয়ে ক্যানিং লোকাল ধরে টগর আসে যাদবপুরে। সকাল সাতটার মধ্যে ঢুকে পড়ে টগর।
আজ আটটা বেজে গেল এখনো টগরের দেখা নেই। কিছু হল না তো আবার। শরীর খারাপ টারাপ কিংবা রাস্তাঘাটে অন্য কিছু। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটার কথা ভাবতেই গা টা শিউরে উঠল মাধবীলতার।
দশ বছর আগেকার ঘটনা। শেখর ব্যাংক থেকে সবে অবসর নিয়েছে। তার এক বছর আগেই বাবলির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সে বরের সঙ্গে চলে গিয়েছে কানাডা।আদিত্য সেখানে সেটেলড। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সি ই ও।
মাধবীলতার তখন সুখের সময়।দেখাশোনা করে ভালো ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে হয়েছে।যেমন তেমন ছেলে নয়।এম বি এ করা ছেলে।তাঁরা দুজন এখন ঝাড়া হাত পা।গল্প গুজব করে, টিভিতে সিরিয়াল দেখে বেশ সময় কেটে যাচ্ছিল মাধবীলতার। তাকে কাজে সাহায্য করার জন্য ছিল ঠিকা কাজের মেয়ে টগর।কতদিন হয়ে গেল টগর এ বাড়িতে কাজ করছে।তখন বাবলি ক্লাস ফোর না ফাইভ।সে কথা মনে করতে পারলেন না তিনি। শেখর খুব একটা টিভি দেখত না।পুরোনো দিনের সিনেমা হলে দেখত দু একটা। টিভিতে খবরও দেখত না।খবরের কাগজটাও পড়ত না পর্যন্ত ।শেখর বলত,'চারিদিকে যা ঘটছে তা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে পারলে তবেই শান্তিতে থাকা যাবে।' কথাটা অবশ্য খারাপ বলেনি শেখর। মাধবীলতা এখন তাই করেন।তিনি এখন আর টিভি দেখেন না।খবর তো নয়ই।তবে তিনি নিয়মিত গান শোনেন।রবি ঠাকুরের গান।
আগে প্রায়দিন কানাডা থেকে ফোন করে খোঁজ নিত মেয়ে।এখন খুব একটা ফোনটোনও করে না।সময় পায় না বোধহয়।শেখরের বই পড়ার নেশা ছিল খুব। অবসর সময়ে সে সবসময় বই পড়ত। গল্প উপন্যাসের বই। রমানাথ রায় ছিলেন তাঁর প্রিয় গল্পকার।মাধবীলতার বই পড়তে ভালো লাগে না।
নিয়ম করে প্রতিদিন ভোরে হাঁটতে বের হত শেখর। হেঁটে বাড়ি ফেরার সময় যাদবপুর বাজার থেকে টাটকা সবজি মাছ কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরত। একদিন কাল হল। বাজার নিয়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে একটা বাইক এসে ধাক্কা মারল সজোরে।শেখর ছিটকে পড়ল ফুটপাতে।মাথায় আঘাত লেগেছিল।লোকজন একটা ভ্যানে করে তাকে নিয়ে গিয়েছিল হাসপাতালে। ইমার্জেন্সিতে ডাক্তাররা দেখে বলেছিল,'হি ইজ নো মোর।'মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল মাধবীলতার।কপালে তার সুখ সহ্য হল না।
কানাডা থেকে এসেছিল মেয়ে জামাই।বাবলিও খুব ভেঙে পড়েছিল।তার চিন্তা হয়েছিল মা একা থাকবে কি করে। মাধবীলতা বলেছিলেন,'আমি ঠিকই থাকব। আমার জন্য অত চিন্তা করিস না।'মেয়ের চিবুক ধরে বলেছিলেন,'তোর গর্ভে তোর বাবা ফিরে আসুক।' মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল বাবলি।
আদিত্য টগরকে অন্যান্য বাড়ির কাজ ছাড়িয়ে এই বাড়িতে চব্বিশ ঘন্টায় রাখতে চেয়েছিল। মাধবীলতা রাজি হন নি।জামাইকে বলেছিলেন,'টগরের নিজের সংসার আছে।বাড়িতে তার বর আছে। অসুস্থ মেয়ে আছে।তার পক্ষে চব্বিশ ঘন্টা আমাকে দেখাশোনা করা সম্ভব নয়।আমার কোনো অসুবিধা হবে না বাবা।তোমরা অত চিন্তা কোরো না আমি ঠিক থাকব।'বাবলিকে নিয়ে কানাডায় ফিরে গিয়েছিল আদিত্য।
সেই থেকে টগর মাধবীলতার বারো ঘণ্টার সঙ্গী।টগর সকাল সাতটার মধ্যে ঢুকে পড়ে।সারাদিন থাকে। সন্ধ্যাবেলায় মাধবীলতার জন্য দুটো রুটি করে দিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।মাধবীলতা তাকে অনেকবার বলেছে,'তুই তো দুপুরে রুটি দুটো করে রাখতে পারিস।তাহলে সকাল সকাল বাড়ি চলে যেতে পারিস।' কিন্তু কে শোনে কার কথা। মাঝেমধ্যে রাতে টগর থেকেও যায় মাধবীলতার সঙ্গে।তাদের এখন মা মেয়ের সম্পর্ক।রক্তের নয়।সে সম্পর্ক আত্মার।টগর নিজের দুঃখের গল্প বলে মাধবীলতাকে।বলে যেন একটু হাল্কা হয়। কি অসহনীয় দুঃখের জীবন টগরের।তবু মুখে সবসময় হাসি। কি করে যে এমন হাসিখুশি থাকে মেয়েটা তা বুঝে পায়না মাধবীলতা।
আজ টগরের আসতে দেরি হচ্ছে দেখে বড় উতলা হয়ে উঠেছেন মাধবীলতা। বারান্দায় বসে রাস্তা দিয়ে পরিচিত কাউকে যেতে দেখলেই ডেকে জিজ্ঞাসা করছেন,'আমাদের টগর কে দেখলে বাজারে?' কেউ হ্যাঁ সূচক উত্তর দেয় না। মাধবীলতার চিন্তা বাড়তে থাকে।
প্রতিদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর ঘুমোন না মাধবীলতা। তিনি টগরের সঙ্গে গল্প করেন।
-কি করিস টগর?
-এই যে মা, আর দুটো বাসন মাজলেই আমার হয়ে যাবে।
আগে মাধবীলতাকে বৌদি বলে ডাকত টগর।এখন তার কি হয়েছে কে জানে।সে প্রায়ই তাকে মা ডাকে।মা ডাক শুনতে মাধবীলতার অবশ্য ভালোই লাগে।
-দুটো লোক খাই।এত বাসন হয় কি করে?
-তুমি শুয়ে একটু ঘুমাও না মা।
-দুপুরে ঘুমুব কিরে!তোর সঙ্গে বসে দুটো গল্প করব না?
হাত মুছতে মুছতে মাধবীলতার বিছানার কাছে চেয়ার টেনে বসে মাধবীলতা। বিছানায় বসে বসে কিছু একটা সেলাই করতে থাকেন তিনি।এই হয়েছে এক নেশা। সেলাই করার নেশা।
-তোর বরের খবর কি?
-তার কথা আর বোলো না মা।কাল কাজে যায়নি। সারাদিন নেশা করে বাড়িতে পড়েছিল। -মেয়েরা কি বলে?
-মেয়েরা আর কি বলবে মা? দীর্ঘশ্বাস ফেলে টগর।
টগরের দুই মেয়ে।বড় মেয়েটার বিয়ে হয়নি।তার মৃগী রোগ আছে। ছোট মেয়েটার বিয়ে হয়েছিল। একজন দোজবরের সঙ্গে। কিন্তু তার ঘর হয়নি। সে স্বামীর ঘর ছেড়ে টগরের সঙ্গেই থাকে।মায়ের সঙ্গে শহরে আসে বাবুদের বাড়ির কাজে।
-আর মেয়েদের কথা বোলোনি মা।আমার কপালটাই খারাপ।
সত্যিই টগেরর কপাল পোড়া। তার দুটি ছেলে। দুটি ছেলেই নিজেদের মতো বিয়ে করে আলাদা থাকে। টগর এর সঙ্গে থাকে না। সম্পর্কও রাখে না। তারা তাদের মত থাকে।
টগরের চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন মাধবীলতা।তিনি বারান্দায় পায়চারি করতে থাকেন।'আমার মুক্তি আলোয় আলোয়।'তখনও রবি ঠাকুরের গান বেজে চলেছে। রবি ঠাকুরের গানগুলো এই বয়সে নতুন করে উপলব্ধি করেন মাধবীলতা।বারান্দা থেকে দেখলেন পাশের বাড়ির বোস বাবু বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরছেন।মাধবীলতা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন,'আমাদের টগর কে বাজারে দেখলেন?'
-না তো বৌদি।কই দেখলাম না তো! কেন কিছু হয়েছে?
-না কিছু হয়নি ।এত বেলা হল। মেয়েটা এখনও এল না।তাই ভাবছি।
-দেখুন ট্রেনের গন্ডগোল ফন্ডগোল হয়েছে হয়তো। নিজের বাড়িতে ঢুকে গেলেন বোস বাবু।
টগরের ফোনটা খারাপ হয়েছে বেশ কয়েকদিন। দোকানে সারাতে দেওয়া হয়েছে।দোকানদার বলেছে ফোনটার মাদারবোর্ড পাল্টাতে হবে। তবে তাতে যা খরচা হবে তার থেকে একটা নতুন ফোন কিনে নেওয়া ভালো। নতুন ফোন এখনও কেনা হয়নি।ফোনটা থাকলে সুবিধা হত। আবার চিন্তায় পড়ে গেলেন মাধবীলতা।বাঁশ বাগানের বখরা নিয়ে আবার কিছু অশান্তি হল না তো!মার দাঙ্গা কিছু!কালকেই তো টগর বলছিল বাঁশ বাগানের ভাগাভাগি নিয়ে জায়েদের সঙ্গে তার ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে। একটু বোকা টাইপের মেয়ে টগর।সরল সাদাসিধে। তার উপর ওর বর কাজ করে না। প্রায় সময়ই মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকে। তার দেওর জারা বলেছে তোমার বর ভাগের বাঁশ বাগান বিক্রি করে মদ খেয়ে সব উড়িয়ে দিয়েছে।সে কথা টগরের মন মানতে চায় না ।এই নিয়েই যত ঝামেলা।চুল ছেঁড়াছেঁড়ি।
বড় চিন্তা হয় মাধবীলতার।কোনো ঝামেলায় আবার জড়িয়ে পড়ল না তো মেয়েটা। এত কষ্টের জীবন,এত বঞ্চনার জীবন তবুও মেয়েটার মুখ কখনো মলিন হয় না।তার মুখে সবসময় একটা মিষ্টি হাসি লেগেই থাকে।স্বচ্ছলতার মধ্যে থেকেও এরকম সুন্দর হাসি লোকে হাসতে পারে না।
মাধবীলতা ঠিক তখনই দেখলেন দ্রুত পায়ে টগর হেঁটে আসছে। দূর থেকেও তার মুখের হাসিটা স্পষ্ট দেখতে পেলেন তিনি।
==================================