বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

অণুগল্প ।। মূল্যবোধ ।। দীনেশ সরকার


                                                    


  

 ছবি - সংগৃহীত ।

    মূল্যবোধ

 

                                                  দীনেশ সরকার

 

 

              কর্মজীবন থেকেই রবিবারে দোকান-বাজার করাটা আমার অভ্যাস। অবসর গ্রহনের পরেও সেই ধারা অব্যাহত। আসলে রবিবারে ভিড়ভাট্টা যেমন বেশী তেমনি শাক-সবজি-মাছের আমদানিও বেশী। তাছাড়া রবিবারে অনেক চেনামুখের সাথে দেখা হয়ে যায়। যেদিন ওষুধ কেনার থাকে বাজারে গিয়ে ওষুধের দোকানে প্রেসক্রিপসনটা দিয়ে ওষুধগুলো রেডি রাখতে ব'লে বাজার করতে যাই। এদিন দেখি ওষুধের দোকানে ভালই ভিড়। আমার সামনে জনা চারেক লোক ওষুধ নিচ্ছে । তারমধ্যে বছর দশেকের একটা ছেলেও আছে। ছেলেটি ওষুধের দোকানের মালিককে কাকুতি-মিনতি করছে,'ও কাকু, দিন না ওষুধগুলো। আমার মায়ের খুব জ্বর। মা সুস্থ হয়ে কাজে গেলেই আমি আপনার সব ওষুধের দাম দিয়ে যাবো। ও, কাকু ওষুধগুলো ধারে দিন না।'

              দোকানের মালিক প্রেসক্রিপসনটা ছুড়ে দিয়ে বললো, 'যা যা। ঝামেলা করিস্‌ নে। এখানে ধারে ওষুধ বিক্রি হয় না। এই ওষুধ সব আমার টাকা দিয়ে কিনে আনা, বুঝেছিস্‌। যা যা, বিরক্ত করিস নে। যত্তোসব!'

             পাশ থেকে আর একজন খরিদ্দার বললো, 'যা বাড়ি যা। টাকা যোগাড় করে নিয়ে আয়, তারপর ওষুধ নিস্‌।'

               আর একজন কোট-প্যান্টপরা ভদ্রলোক বললো, 'পকেটে পয়সা নেই, ওষুধ কিনতে এসেছে!'

              আমার খুব খারাপ লাগলো। আমি দোকানের কর্মচারীটির হাতে আমার প্রেসক্রিপসনটা ধরিয়ে দিয়ে ছেলেটিকে ডেকে দোকানের বাইরে নিয়ে এলাম। ছেলেটির দুচোখ দিয়ে জল ঝরছে, হাতে প্রেসক্রিপসন। আমি জিজ্ঞেস করলান, 'কি হয়েছে আমায় বল তো বাবা।"

             ছেলেটি বললো, 'আমার মার খুব জ্বর। বেহুঁস হয়ে আছে। ডাক্তারবাবুর হাতেপায়ে ধরে ডেকে এনেছিলাম। ডাক্তারবাবু এই ওষুধগুলো খাওয়াতে বলেছেন। এতে না কমলে হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেছেন। ডাক্তারবাবুর ফিস্‌ও পুরো দিতে পারিনি।  ওষুধগুলো ধারে নিতে এসেছিলাম।'

              আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'স্কুলে যাস্‌?'

             'হুঁ, আমি ফোরে পড়ি।'

             'বাবা কি করে?'

             ' বাবা নেই। মা দু-তিন বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে।

              'বাড়িতে আর কে কে আছে?'

             ' আমার ছোট একটা বোন আছে। টুতে পড়ে।'  

             আমি ছেলেটিকে নিয়ে দোকানের ভিতরে গিয়ে দোকানের কর্মচারীটিকে বললাম, 'এর  ওষুধগুলোর কত দাম হবে?'

               কর্মচারীটি যোগ করে বললো, '৬৩৪ টাকা।'

             'ওকে ওষুধগুলো দিয়ে দাও আর ভালো করে লিখে দিও কখন কোনটা খাবে। টাকাটা আমিই দিয়ে দেবো।'

              ওষুধগুলো হাতে পেতে ছেলেটির চোখ খুশিতে চিক্‌চিক্‌ করে উঠলো। আমি বললাম, 'যা, তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে যেমন লিখে দিয়েছে সেইভাবে মাকে ওষুধগুলো খাওয়াগে যা।' ছেলেটি  ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটলো।   

              মাছ কেনা আর হ'লো না। অল্প কিছু সবজি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। গিন্নি মাছের কথা জিজ্ঞেস করতে ছেলেটির ওষুধ কেনার কথা বললাম। আমি জানতাম, দয়ার শরীর আমার গিন্নির। গিন্নি খুশি

 হবেই। আমি বললাম, 'এ মাসের বাকি চারদিন আমরা নিরামিষ খাবো। ১লা তারিখে পেনসন তুলে মাছ নিয়ে আসবো।'

 

              তিন-চার মাস পরে বাজারে একটা ছেলে ঢুপ করে আমাকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালো। দেখি সেই ছেলেটি। জিজ্ঞেস করলাম, 'কি রে, তোর মা কেমন আছে?'

              'মা ভালো হয়ে গেছে। ওই ওষুধেই মা সেরে উঠেছে। এখন রোজ কাজে যাচ্ছে। সেদিন আপনি ওই ওষুধগুলো কিনে না দিলে আমার মা হয়তো মরেই যেত।'

             'ওভাবে বলতে নেই রে।' 

             ' আমি গত রবিবারেও বাজারে আপনাকে খুঁজেছি। আপনাকে পাইনি।'

             'কেনো রে খুঁজেছিলি কেন ?'

            'আপনার টাকাটা ফেরত দেবো বলে।' ছেলেটি হাফপ্যান্টের পকেট থেকে একটা কাগজের মোড়ক বার করে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো, 'এটা আপনাকে নিতেই হবে।'

              আমি ধমক দিয়ে উঠলাম, 'রাখ ওটা। পকেটে রাখ।'

            ছেলেটি কাচুমাচু মুখ করে বললো, 'না, আপনাকে নিতেই হবে। মা বলেছে কারও ধার রাখতে নেই।'

            'ওই টাকায় তোর মাকে ফল কিনে খাওয়াস্‌।'

            তবু ছেলেটি নাছোড়বান্দা, 'না, এটা আপনাকে নিতেই হবে। না নিলে মা আমাকে বকবে। মা খুব কষ্ট পাবে।  আমি আপনার পায়ে ধরছি।'

             'এই কি করছিস্‌, ওঠ।'

             বাজারের দু-একজন ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে  বুঝতে পারলাম। আমি খুব অপ্রস্তুতের মধ্যে পড়লাম। আবার বললাম, 'টাকাটা তুই রাখ, পরে তোর কাজে লাগবে।'

             কিন্তু ছেলেটি নাছোড়বান্দা।  অগত্যা আমাকে নিতেই হ'লো।

            ঘরে ফিরে কাগজের মোড়কটা খুলে দেখি, ৬৩৪ টাকা। ছেলেটির মায়ের ঝিগিরি করা টাকা।

           গিন্নিকে ডেকে বললাম, 'জানো গিন্নি, আমরা তথাকথিত ভদ্রলোকেরা হয়তো মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলেছি কিন্তু অশিক্ষিত গরিবলোকদের মূল্যবোধ আজও বজায় আছে।    

                                                                      ******************************************************************

 

দীনেশ সরকার

১৪০ ডি, হিজলি কো-অপারেটিভ সোসাইটি,

প্রেমবাজার, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর।
 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.