বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

গল্প ।। অন্তরালে ।। আরতি মিত্র


 ছবি - সংগৃহীত ।

 

অন্তরালে 

আরতি মিত্র

     
       কয়েক মাস হল সুমনার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, দুশ্চিন্তার অন্ত নেই তার।
নিজের মনেই ভাবল, "রুমির বাবা বেঁচে থাকলে আমার কি এত চিন্তা করতে হতো? তিনিই সব দিক সামলে নিতেন।
       রুমির ভাবী বরের নাম তুষার মিত্র। যদিও রুমির ভাবী বরকে সুমনার দেখা হয় নি। কত দিকে আর সে ছোটাছুটি করবে?
সুমনার এক বন্ধুই ছেলেটির সঙ্গে যোগাযোগ করে সব ঠিক করেছে। অবশ্য গয়না তৈরী করা আছে। কিন্ত খাওয়া খরচ, অনুষ্ঠানের খরচ --
ওহ্, আর ভাবতে পারছে  না সে। একা একা কতদিক সামলাবে সে  এত অসহায় লাগছে তার।
             সুমনা সেদিন  দাদাদের সঙ্গে কথা বললো, ওরা বললেন,"দেখ বোন, আমাদেরও তো ছেলেমেয়ে আছে, তাদেরও বিয়ের খরচা রয়েছে, দশহাজারের বেশী দিতে পারব না রে।"
বোনের  দ্বারস্থ হতে সে জানতে চাইল, "দাদা কত দিয়েছে রে?
 সুমনা জানাল, "দাদা মাত্র দশ হাজার দেবে বলেছে।"
          বোন তা শুনে বলল, "কি আর করি বল, ঐ পাঁচ/সাত হাজারের বেশী আমিও দিতে পারব না রে ।"

         সুমনার একটা কাজ অনেক দিন ধরে হচ্ছিল না। বারবার পোস্ট অফিসের দরজায় দরজায় ঘুরছিল, কিন্ত আজ আশার আলো দেখতে পেল।
         পোস্ট মাষ্টার জানালেন যে তার মৃত স্বামীর টাকাগুলো সুমনার নামে করা গেছে।

         বাসরাস্তার পাশেই পোস্ট অফিস। তাই আসা যাওয়ার পথে অনেকের সাথেই দেখা হতো। এতদিন যাতায়াত করতে করতে কারও  কারও সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে। তাদেরই দু একজন জিজ্ঞেস করলেন, "কি বৌদি কিছু হলো?"
সুমনা বলল," হ্যাঁ দাদা সবকিছু হয়ে গেছে"
একজন বলল, "এবার তাহলে মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করুন।"

         টাকাটা পেয়ে যে কি উপকারটাই না হল। সে নিজেও জানতো না যে লাখ টাকার বেশী পাবে। নিজের আনন্দে এতই মত্ত হয়েছিল যে  তার চারপাশে কি হচ্ছে খেয়ালই করে নি।
       হঠাৎই শুনতে পেল, কেউ একজন টাকা তুলতে এসেছেন কিন্ত সই মেলাতে পারছেন না।
ভদ্রলোকেের বয়স সম্ভবত ৮০/ ৮৫ বছর হবে। শরীরটা সামনের দিকে ঝুঁকে গেছে।
তিনি বললেন," সইটা করতে পারছি না, একটু সাহায্য করবেন দিদি ?"

        সুমনা কিংকর্তব্যবিমূঢ়  হয়ে পড়ল। কি করবে ভেবে পেল না, শেষে অনেক ভেবেচিন্তে একটা সাদা কাগজে, ওনার নাম সই  করে, দেখে দেখে করতে বলল। উনি তো খুব খুশি।
বারবার কৃতজ্ঞতা জানাতে লাগলেন। তারপর হঠাৎই সুমনার কানে এল, ভদ্রলোক তাঁর পরিচারিকাকে বলছেন, "চলো আজ রিক্সো করে যাই ?" কিছুটা যেন আবদারের মতোই শোনালো তার কথাটা। কিন্ত যাকে বললেন তার উত্তরটা বড়োই রূঢ় লাগলো শুনতে , "না হেঁটে চলুন বাবুর বারণ আছে।"
         বৃদ্ধ মানুষটির দুটো পা চলতেই চাইছে না, বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে গেছে শরীর। নিতান্তই অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁকে চলতে হচ্ছে। অথচ টাকাটা তাঁর নিজস্ব অবসরকালীন ভাতা। সুমনার আশ্চর্য লাগল। এতে তো তাঁর সর্বৈব অধিকার, তবে কেন এমন ব্যবহার ?
সঙ্গের পরিচারিকার আড়ালে ভদ্রলোক বললেন,"সারাজীবন অকৃতদার থেকে গেছি। ভাইয়ের সংসারে থাকি। ভ্রাতুষ্পুত্র প্রায় সবটাই আত্মসাৎ ক'রে নেয়, সামান্যই আমার প্রাপ্য তাতে যাহোক করে দিন গুজরান হয়।"
তাঁর কথা শুনে সুমনার অজান্তেই দুচোখের কোণ ভিজে গেল। বাবার কথা মনে পড়ে গেল।
সকলের কতই না আদর যত্নে বাবার শেষ জীবন কেটেছিল। মনে মনে নিজে ভাবল, "নিজের সন্তান না থাকলে কি এমনই হয়? একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা বুকের ভিতরে পাক খাচ্ছিল। ভাবল, মানুষ তো সবাই, কিন্ত মনুষ্যত্ব সবার থাকে না কেন? তাহলে তো বৃদ্ধ মানুষদের এত কষ্ট ভোগ করতে হত না।"
   
          টাকাটা পেয়ে একটু একটু করে বিয়ের যোগার যন্ত্র করতে লাগল সুমনা।
 একদিন হঠাৎই মনেহল, "আচ্ছা, রুমির যার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে, তাকে তো একবার দেখা দরকার। রত্নাদিকে ফোন করে বলি, এই ভেবে ফোনটা নিয়ে রত্নাদির নম্বরে কল করতেই  ওপাশ থেকে  দিদি বলল,"কি রে সুমনা, কি ব্যাপার?"
 "রত্নাদি, তুমি যদি কিছু মনে না করো একটা কথা বলব গো?"  
- "হ্যাঁ, বলনা শুনি। কি বলবি বল" 
  সুমনা ইতস্তত করে বলল " রত্নাদি আমি জানি তুমি রুমির উপযুক্ত পাত্রই ঠিক করেছ, আমার না একবার দেখতে মন চাইছে"
- "ওরকম করে বলছিস কেন রে, তুই তো ওর মা। তোর তো ইচ্ছে হওয়াটাই স্বাভাবিক। 
-  'কার হাতে মেয়েকে তুলে দিচ্ছিস একবার দেখবি না?' ঠিক আছে কবে যাবি বল?"
- "তুমি  যেদিন নিয়ে যাবে"
রত্নাদি বলল, "দেরী করার প্রশ্নই আসে না, চল, আগামীকাল বিকেলে যাই।"

          পরদিন সকাল থেকেই সুমনার মনের ভেতরটা অস্থির লাগছিল, এতোদিন পর মেয়ের জন্য নির্দিষ্ট পাত্রের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে সে। সব ঠিকঠাক হবে তো, কে জানে?
এসব ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে দৈনন্দিন কাজকর্ম সেরে নিচ্ছিল সুমনা। মেয়েকে এখন আর সে কোন কাজ করতে দেয় না। শ্বশুরবাড়ি কেমন হবে কে জানে? সেখানে তো বসিয়ে রাখবে না।
যে কদিন স্নেহের আঁচল দিয়ে আগলে রাখা যায়। বাপমরা মেয়ে, বাবার বড়ই সাধ ছিল, তাঁর আদরের মেয়েকে সাজিয়ে গুছিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবার। কিন্ত ভাগ্য বিরূপ। সে সাধ পূর্ণ হল না।
এখন সুমনাকেই বাবা, মা দুজনার দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাই একটু বেশিই ভাবনা হচ্ছে তার।

         বিকেল বেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে সুমনা, রত্নাদির সঙ্গে একটা রিক্সা নিয়ে নয়াবাঁধ গিয়ে পৌঁছাল। রিক্সা থেকে নেমে কিছুটা হেঁটে যেতেই বাড়িটা চোখে পড়ল তাদের। সেখানে পৌঁছে, দরজায় কলিংবেল বাজাতেই, দরজা খুলে দিল যে, তার মুখটা সুমনার চেনা চেনা মনে হল। কোথায় যেন দেখেছে তাকে। ঠিক মনে করতে পারল না।
     রত্নাদি তাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকল। ঢুকে পাশের বারান্দায় যে বৃদ্ধকে বসে থাকতে দেখল সুমনা, তাঁকে দেখে চিনতে অসুবিধা হল না তার। এ সেই বৃদ্ধ, যাকে সেদিন সে একটা কাগজে, 'নিবারণ মিত্র' নাম লিখে তা দেখে তাঁকে সই করতে বলেছিল। সুমনা তার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো, "নিবারণ বাবু আপনি? আমায় চিনতে পারছেন।" বৃদ্ধ ভদ্রলোক তাকে দেখে চমকে উঠলেন। তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, "আপনি সেদিন পোস্ট অফিসে... "
- "হ্যাঁ।"
ততক্ষণে রত্নাদি সুমনার কাছে এসে দাঁড়িয়েছ, তিনি বললেন, "তুই ওনাকে চিনিস নাকি সুমনা?
ওনার একমাত্র ভাইপোর সঙ্গেই তো তোর ... "
সুমনা তার কোন কথা না শুনেই বলল, "রত্নাদি তুমি চলো। এ বিয়ে হবে না। "
- "কেন? "রত্না দি আতকে উঠলেন।
- "তুমি এ'বাড়ি থেকে আগে চলো। পরে  তোমায় বলব। " বলেই সুমনা গটগট করে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।
 সুমনার এমন ব্যবহারে, রত্নাদি ভাবলেন, তাহলে কি তুষারের জ্যাঠার সাথে সুমনার আগে থেকেই আলাপ পরিচয় ঘনিষ্টতা ছিল?
------------------------------------------------
 
 
Arati Mitra. 
267/3 Nayabad. 
Garia.
Kol. 700094

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.