ব্রীজের ওপর ট্রেন
প্রতীক মিত্র
পাসাংএর তিনচাকার টেম্পো ধুধু শুকনো নদীর বালিভরা বুক চিড়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দুরে ব্রীজ দিয়ে ঝনঝন করে যান্ত্রিক শব্দ করতে করতে চলে যাচ্ছে ট্রেন। ওই ব্রীজে মাঝে মাঝে ওঠে পাসাং। ওপর থেকে এই নদীর আশপাশ দুরের জঙ্গল পাহাড় দেখতে দারুণ লাগে। ট্রেন যখন যায় ও দ্রুত কামরাগুলোর ভেতরটা এক ঝলক দেখে নেওয়ার চেষ্টা করে। বিশেষ করে কাঁচে ঢাকা যেগুলো।ওতে এসি চলে।অনেক সময়ই পর্দা দেওয়া থাকে বলে দেখতে পায় না। তবু চেষ্টা করে। তেমনই একটা ট্রেন দেমাক দেখিয়ে চলে যাচ্ছে। আজ আর অবশ্য ওর সময় নেই ট্রেনের দিকে তাকানোর। মালিক পুরো টেম্পো লোড করতে বলেছে। এদিকে সন্ধ্যে নামতে বেশি বাকি নেই। সন্ধ্যে হলেই একটা-দুটো পুলিশ মাঝে মাঝে চলে আসে। মালিকের চেনা। তবু বলা তো যায় না মাথায় ওদের যে কি ঘুরপাক খায়!আর বালি তো ও একা নিচ্ছে না। কত্ত আছে!বাঙালী, বিহারি এমনকি কিছু তো ব্যাটা ভুটান থেকে আসা মালও আছে। ধরুক ওগুলোকে। পাসাং বেশি কিছু বলে না। ও একটু তোতলায় তো। বললে লোকে যদি হাসে তাই। জলদি কাজ শেষ করে। ছোটো মামার ঘর হয়ে ফিরতে হবে। পুজো আছে। জম্পেশ খাওয়া-দাওয়া। এবার জঙ্গলে যে এত গরম পড়েছে। বৃষ্টি প্রায় নেই। চা-বাগান সব পুড়ে যাচ্ছে। পাসাং সুযোগ পেলে বাজারের মিষ্টির দোকানে গিয়ে বাঁচানো পয়সা থেকে লস্যি খায়। ও ওর মালিককে বলে রেখেছে। কলকাতায় কোনো কাজ থাকলে যেন বলে। ও যাবে। ওর বড়রা যাই বলে বলুক, ওর কোলকাতা শুনলে বেশ লাগে। থাক সেখানে গরম, থাক সেখানে ভীড়; তবু যাবে। এই ট্রেনগুলোই যত নষ্টের গোড়া, যখনই অমন দেমাক দেখিয়ে যায়, পাসাংএর কাজকারবার সব চৌপাট হয়ে যায়। আজ তাকে একটু বেশি খাটতে হবে। সময় কম। ওদিকে মামার ঘর হয়ে ফেরা। খুব রাত করা যাবে না। জঙ্গলে আজকাল হাতির সাথে চিতাও খুব বেরোচ্ছে। মালিককে বলেছিলো টেম্পোটাকে ওকে বেচতে।মালিক বেচেনি। ফলে ওই রাতে সাইকেল করেই ফেরে সে। গা ছমছম করে। ট্রেন বেরিয়ে গেলে পাসাং গাড়ি থামায়। এবার বালি তুলতে হবে।ও অবশ্য জানতে পারে না, জঙ্গল ছেড়ে কোলকাতার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেওয়া ট্রেনের তাও এমনি নয় ওই কাঁচে মোড়া কামড়া থেকেই কেউ একজন ওকে দ্যাখে আর কষ্ট পায়। সে পাসাংকে চেনে না। তবু কষ্ট পায়।কেননা সে কাজের সুত্রে প্রবাসী। ফলে জঙ্গল ছেড়ে যাওয়ার দুঃখ তাকে কাঁদায়। আরো বেশি করে যখন দ্যাখে পাসাং জনৈক এবং যেমনভাবেই হোক এই চত্বরে সে থেকে যেতে পারছে এই জঙ্গল এই পাহাড় এই আদিমতার মধ্যে। না পাসাং এইসব জানতে পারে না। পাসাং কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ভীষণভাবে ব্যস্ত।
===========================
প্রতীক মিত্র
কোন্নগর,
পশ্চিমবঙ্গ।