বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

মুক্তগদ্য ।। স্মরণে ১৯ মে র বরাক উপত্যকার ভাষা শহীদ দিবস।। পাভেল আমান

 

 

 ছবি - সংগৃহীত ।

 

 স্মরণে ১৯ মে র বরাক উপত্যকার 

ভাষা শহীদ দিবস

 পাভেল আমান

     

প্রতিবছর ভাষা শহীদ দিবস পালিত হয় ১৯শে মে। একপ্রকার নীরবে নিভৃতে কিছু অনুষ্ঠান স্মৃতিচারণার মধ্যে দিয়েই এই গুরুত্বপূর্ণ দিনটি আপামর বাঙালি মনন থেকে বিদায় নেয়। আমরা যেভাবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে মর্যাদা ও সম্মাননা দিয়েছি পক্ষান্তরে ১৯ মে র ভাষা শহীদ দিবস নিয়ে আমরা অনেকটাই নির্বিকার। খুব একটা জানা চর্চা ও আলোচনার অনুভব বোধ করি না। বাঙালি হয়েও যেন আমরা আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যের বাঙালি শহীদদের প্রতি কিছুটা অসচেতন ও উদাসী। জীবনের মৃত্যুকে তুচ্ছ করে বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও ব্যবহারকে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা রক্ষার্থে এক ঝাঁক বাঙালি সত্তায় জাগরিত বাঙালি চেতনায় গর্বিত বাঙালি সংস্কৃতিতে জারিত ও সম্মানিত রক্তে মাংসে গড়া আমার আপনার মত বাঙালিরা সেদিন শাসকের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল। প্রকৃতপক্ষে কাজ করার অধিকারের দাবিতে বাঙালি একদিন রাস্তায় নামে। সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র জাতি বাঙালি যে নিজের ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রাণ দিতে দ্বিধাবোধ করেনি। একথা নিঃসংকোচে ব্যক্ত করা যায় তারাই প্রকৃত বাঙালি তারাই প্রকৃত বাঙালি সংস্কৃতি ঐতিহ্যের ধারক বাহোক অর্থাৎ বাংলা মায়ের যোগ্য সন্তান। মায়ের মতই তারা বাংলা ভাষাকে ভালোবেসেছে লালন পালন করেছে সঠিক চর্চা উপসারের জন্য । তারাই প্রকৃত ভাষা সৈনিক সংগ্রামী ও শহীদ। বাঙালিদের আন্দোলনের চাপে ইউনেস্কো ২১ শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু আমরা ভুলে গেছি ১৯৬১ সালের ১৯ শে মে দিনটিকে আর এক ভাষা দিবস।আজ উনিশে মে! ভাষা শহীদ দিবস! উনিশের সঙ্গে যে আমাদের আত্মার নিবিড় সম্পর্ক, তা ভোলার সাধ্যি নেই বাঙালি মাত্রেরই! স্বজন হারানোর ব্যথায় বরাক উপত্যকার আজ প্রতিটি বাঙালি স্মরণ করেছে একাদশ শহীদদের।         আমাদের জীবনের সমস্ত কিছু তিনটি জিনিসকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় ভাষা, চিন্তন ও জগৎ। ভাষা ছাড়া আমরা চিন্তা করতে পারি না। মাতৃভাষায় আমরা চিন্তা করি, কল্পনা করি, স্বপ্ন দেখি। ভাষা ছাড়া চিন্তন অসম্ভব। চিন্তনের একটি মূল জায়গা হল জগৎ বা 'ওয়ার্ল্ড'। ভাষার উপর আঘাত হানতে পারলে চিন্তার জায়গাকে ক্ষতবিক্ষত করা সম্ভব হবে, আর সেটা সম্ভব হলে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক জগতকে বুঝতে পারবে না মানুষ। সে পঙ্গু হয়ে পড়বে। প্রশ্ন করবে না, শাসিত ও শোষিত হবে বিনা প্রশ্নে।ভাষার এই সংগ্রাম শুধু বাঙালিদের একচেটিয়া, এরকম মনে হতে পারে। না। তামিল, কন্নড়, মালয়ালম, কোঙ্কনি ভাষা নিজেদের অধিকারের জন্য দশকের পর দশক আন্দোলন করেছে। সংবিধানে স্বীকৃত ভাষার তকমা পেতে মৈথিলি, কোঙ্কনির বহু সময় লেগেছে। সাঁওতালিকে জনজাতি ভাষার মর্যাদা দিতেও দেরি করা হয়েছে অনেক।এ কথা গর্ব করেই বলা যায়, বাঙালি হল এমন এক জাতি, যারা মাতৃভাষা রক্ষার্থে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। অথচ বরাক উপত্যকার সেই ভাষা আন্দোলনের কথা কতটুকু আমরা জানি? বাংলা ভাষার জন্য, মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে বাঙালিরা জীবনে আপস করতে শিখেনি। প্রয়োজনে নিজের প্রাণ দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। বাংলা ভাষা আন্দোলন তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। আজও আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ১৯ মে বাংলা ভাষা শহীদ দিবস পালন করে। 

    ১৯৬১ সালের এইদিনে ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচরের এগারো জন বাঙালি মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য তথা বাংলায় কথা বলার জন্মগত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন। ১৯৫২ সালে বাংলাদেশে অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব বাংলায় মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য যে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল এবং প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন সালাম, রফিক, সফিক, বরকত ও জব্বার। সেই ভাষা আন্দোলনের নয় বছর পরে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য এমন আরো একটি আন্দোলন হয়েছিল এবং সে আন্দোলেনে একজন নারীসহ এগারোজন বাঙালি বুকের রক্ত দিয়ে প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন আসামের বরাক উপত্যকার শিলচরে, সে কথা আমাদের অনেকের এখনো হয়তো অজানা রয়ে গেছে। পৃথিবীতে একই ভাষার জন্য দুটি আলাদা রাষ্ট্রে এবং আলাদা সময়ে প্রাণ দেয়ার অনন্য ইতিহাস এটি।অসমীয়া বাঙালিদের প্রতি অসমীয়া ভাষাকে চাপিয়ে দিতে ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর তৎকালীন অসমের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা অসমীয়া ভাষাকেই একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপরেই বাঙালি অভিবাসীদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়তে থাকে। এই ঘটনা ক্রমেই সহিংসতার রূপ নিলে উত্তেজিত অসমীয়ারা অভিবাসী বাঙালিদের ওপর আক্রমণ করে বসে। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে প্রায় পঞ্চাশ হাজার বাঙালি পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে আসেন। তবে উত্তর করিমগঞ্জ-এর বিধায়ক রণেন্দ্রমোহন দাস সরকারের এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন।বাংলা কে সরকারি ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী কাছার গণ পরিষদ গঠিত হয়।অসম সরকারের এই হঠকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ১৪ এপ্রিল তারিখে শিলচর, করিমগঞ্জ এবং হাইলাকান্দির মানুষেরা সংকল্প দিবস পালন করেন। কাছার গণ পরিষদের পক্ষ থেকে বরাক উপত্যকার মানুষদের মধ্যে মাতৃভাষার অধিকার নিয়ে চেতনা জাগরণের জন্য উপত্যকাজুড়ে সপ্তাহব্যাপী পদযাত্রা করা হয়। পদযাত্রা শেষে পরিষদের সভাপতি রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেছিলেন, যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা না হয় তবে ১৯ মে ব্যাপক হরতাল করবেন তারা।১৮ মে অসম আন্দোলনের তিনজন নেতা নলিনীকান্ত দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন ও বিধুভূষণ চৌধুরী(সাপ্তাহিক যুগশক্তির সম্পাদক) কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বাংলা ভাষাকে সরকারি স্বীকৃতি না দেওয়ায় আন্দোলনকারীরা ১৯ মে শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে হরতাল ও পিকেটিং শুরু করে। এদিন বিকেল ২:৩০ নাগাদ নয়জন সত্যাগ্রহীকে কাটিগোরা থেকে গ্রেপ্তার করে ট্রাকে করে নিয়ে যায় অসম রাইফেলস।আন্দোলনকারীরা তাদের দলের লোকেদের গ্রেপ্তার হতে দেখে তীব্র প্রতিবাদ করতে থাকেন। অশনাক্ত এক ব্যক্তি ওই ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দিলে সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা প্যারামিলিটারি বাহিনী আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে ১৭ রাউন্ড গুলি চালায়। পুলিশের নৃশংস গুলিতে ভাষা আন্দোলনরত অবস্থায় প্রাণ হারান কমলা ভট্টাচার্য,শচীন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, কানাইলাল নিয়োগী, চন্ডিচরন সূত্রধর, সত্যেন্দ্র দেব, হীতেশ বিশ্বাস, কুমুদরঞ্জন দাস, তারিণী দেবনাথ, সুনীল সরকার এবং সুকুমার পুরকায়স্থ।এঁদের মধ্যে কমলা ভট্টাচার্য পৃথিবীর একমাত্র নারী ভাষা শহীদ যিনি মাত্র ষোলো বছর বয়সে ভাষার আন্দোলনে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। কিন্তু খুবই দুঃখের ও পরিতাপের বিষয় আমরা ভুলে গেছি আমাদের বিকশিত ঐতিহ্য স্মরণীয় ঘটনা বলি যা বাঙালি জাতির উত্তরণ ঘটিয়ে সম্মুখে এগিয়ে নিয়ে গেছে। আমরা বুকের রক্তে ঝরা বাংলা ভাষাকে রক্ষার্থে অসমের শিলচরের বরাক উপত্যকার বাঙালি শহীদদের কথা ভুলে গেছি যারা ১৯শে মে মায়ের ভাষা মাতৃভাষা ভাব প্রকাশের অনন্য মাধ্যমের  সম্মান মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠার রক্ষার্থে তাদের বহুমূল্য প্রাণীর বিসর্জন দিয়েছিল। আজকে চারিদিকে যখন মাতৃভাষা বাংলা ভাষার ব্যবহার চর্চা গুরুত্ব কমে যাচ্ছে পাশাপাশি বাংলা সংস্কৃতি ঐতিহ্য উৎসব পাল পার্বণ বর্তমান প্রজন্মের কাছে আগ্রহের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে না তারা যেন প্রত্যেকেই পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও ইংরেজি ভাষার প্রতি নিবেদিত প্রাণ। চারিদিকে গজিয়ে উঠছে একের পর এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বিপ্রতীপে তালা বন্ধ হচ্ছে বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো। এই করুণ চিত্র বাংলা ভাষা বাংলা সংস্কৃতি বাংলা চেতনা বাংলা বিকাশের অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাধা প্রাপ্ত হচ্ছে। এখন প্রত্যেকেই ভেবে নিয়েছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে না পড়লে ইংরেজি ভাষাটাকে ভালো করে না জানলে জীবনের ক্যারিয়ার টাই অনাকাঙ্ক্ষিত থেকে যাবে। কিন্তু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সম। অর্থাৎ আমরা যদি মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করি ভালোভাবে না জানি তাহলে আমাদের জ্ঞানের সম্পূর্ণতা ঘটবে না। মায়ের ভাষা জন্মগত অধিকার সূত্রে পাওয়া বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের প্রত্যেকের এক চিরন্তন টান অনুভূতি যা কখনোই ছেদ করা যায় না। আসুন আমরা প্রত্যেকে ভাষা শহীদ দিবসে আসামের বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার স্বাধিকার রক্ষার্থে প্রাণ উৎসর্গকৃত শহীদদের স্মৃতির প্রতি বিনম্র চিত্তে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ ও সম্মাননা প্রদর্শন করে শপথ গ্রহণ নিই প্রাত্যহিক জীবনে আমরা বাংলা ভাষা বাংলা সংস্কৃতির চর্চ  ও প্রসারের প্রতি দায়িত্বশীল ও কর্তব্য নিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে  নিজেদের বাঙালি সত্তাকে জাগ্রত করি। এটাই হোক এবছরের ভাষা শহীদ দিবস পালনের সদর্থক বার্তা ও অঙ্গীকার। 

---------------------------

পাভেল আমান 

হরিহরপাড়া- মুর্শিদাবাদ

 

 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.