ছবি - সংগৃহীত ।
ভালোবাসার চোখ
সুনির্মল বসু
কখন ৪২ নম্বর বাসটা বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াবে, সে কথা ভেবে ইতিমধ্যে আমি তিনটে চার মিনার সিগারেট শেষ করে ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে আছি।
বাস এলো।
বুলবুলি কলেজ থেকে ফিরছে। চোখে কালো চশমা। উড়ু উড়ু চুল। আকাশী রঙের শাড়িতে ভারী অপরূপা। আমার চোখে ও তখন যেন রমেশ পালের সরস্বতী ঠাকুর। আমি কি ওকে আমার প্রেমিকা ভাববো, নাকি ওর সৌন্দর্যকে পুজো করবো! বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
আমি ওকে ভালবাসতাম। এই কথাটা কোনদিন মুখ ফুটে বলতে পারিনি। অথচ, প্রতিদিন বিকেলে শুধু ওকে একবার চোখের দেখা দেখবো বলে, ঠাঁয় বাস স্ট্যান্ডের পাশে ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থেকেছি।
কৃষ্ণা, বীথি বলতো, তমোঘ্ন খুব অহংকারী। ও মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতেই চায়না।
অথচ, কেউ জানে না, বরাবর সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে আমি ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়ি।
সুযোগ এসেছিল, অনেক পরে।
বাঙালি বাড়ির ছেলে কলেজ লাইফে হয় রাজনীতি করবে, না হয় সাহিত্য করবে, অথবা প্রেম করবে, এটাই স্বাভাবিক ঘটনা।
আমরা কজন সাহিত্য নিয়ে মেতে উঠেছিলাম। প্রথমে হাতে লেখা দেওয়াল পত্রিকা বের করতাম। সজল, প্রশান্ত, বুলবুলি আর আমি। প্রশান্ত বরাবর ফার্স্টবয়। মুক্তোর মত হাতের লেখা ওর। লেখা মনোনয়নের পর, আর্ট পেপারের উপর লিখে ও পাড়ার মোড়ে প্রতিমাসে পত্রিকা বোর্ডে টানিয়ে দিত। অনেকে পড়তেন। অনেকে ব্যঙ্গ করতেন। বলতেন, সবাই সুনীল গাঙ্গুলী, বুদ্ধদেব গুহ হতে চায়!
সজল বি.কম অ্যাকাউন্টেন্সি অনার্স পড়তো। প্রশান্ত রাজাবাজার সাইন্স কলেজে রিসার্চ করছিল। বুলবুলি ইতিহাসে অনার্স পড়তো। আর আমি বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ি।
হাতে কয়েকটা টিউশনি এলো। সজলের বাড়ির অবস্থা ভালো। নিজেদের জলের ফ্যাক্টরি আছে। সবাই মিলে ঠিক হলো, এবার থেকে দেওয়াল পত্রিকা আর নয়, পুজোয় আমরা শারদ সংখ্যা ছাপিয়ে বের করবো।
ঠিক হলো, বুলবুলি কবিতা লিখবে। প্রশান্ত লিখবে প্রবন্ধ। রম্যরচনা সজল লিখবে। আর আমি গল্প লিখবো।
প্রশান্ত বলল, পত্রিকা যদি বিক্রি করতে হয়, তাহলে নামী লেখকদের লেখা চাই। আমাদের লেখা কে পয়সা দিয়ে কিনে পড়বে?
সজল বলল, ঠিক বলেছিস। কিন্তু নামী লেখকদের লেখা কিভাবে পাওয়া যাবে?
বুলবুলি ভিক্টোরিয়া গার্লস কলেজে পড়ে। রেগুলার কফি হাউসে যায়। ও বলল, আমি শক্তি, সুনীল, সৌমিত্র চ্যাটার্জির কবিতা জোগাড় করে এনে দেবো।
প্রশান্ত বসুমতী পত্রিকা অফিসে গিয়ে লেখক প্রাণতোষ ঘটকের লেখা গল্প এনে দেবে জানালো।
সজল ওর কলেজ থেকে ফণি ভূষণ আচার্যের একটা ছোট গল্প জোগাড় করে এনে দিল।
শারদ সংখ্যা প্রকাশিত হলো। সুন্দর ছাপা। গল্প কবিতা প্রবন্ধ রম্য রচনা, সবকিছু নিয়ে পত্রিকা সকলের ভালোবাসা অর্জন করলো।
চেনা পরিচিতরা পত্রিকা কিনলেন। উৎসাহ দিলেন। পরের সংখ্যায় নরেন্দ্রনাথ মিত্র, বুদ্ধদেব গুহ, সুনীল গাঙ্গুলী লেখা দিলেন।
বন্ধুরা সবাই ব্যস্ত বলে, ছাপাখানার কাজ, বিশেষ করে প্রুফ দেখার কাজ আমাকেই করতে হোত।
মাঝে মাঝে সেই সূত্রে বুলবুলির সঙ্গে অল্প স্বল্প কথা হতো। ওকে দেখলেই আমার মন ভালো হয়ে যেত।
সজল ওর সঙ্গে মাঝে মাঝে ঠাট্টা ইয়ার্কি করতো। প্রশান্ত একটু গম্ভীর প্রকৃতির। গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত।
ভারী গলায় পত্রিকা সম্পর্কে নির্দেশ দিত।
বুলবুলি একদিন বলল, শারদ সংখ্যায় তোমার আঁকা প্রচ্ছদটা দারুন হয়েছে। মা দুর্গার মুখটা তুমি দুর্দান্ত এঁকেছো।
বলে ওর সেই দুর্দান্ত হাসিটা উপহার দিল। আর আমি গভীর ভালোলাগায় ডুবে গেলাম।
একদিন বলল, এবার শুধু কবিতা নিয়ে একটা কবিতা সংখ্যা বের করো। ২৫ শে বৈশাখে একটা রবীন্দ্র সংখ্যা বের করলে হয়!
সবাই এই প্রস্তাব মেনে নিল।
আমাদের পড়াশোনা শেষ হয়ে আসছিল। এবার চাকরি-বাকরি চেষ্টা চলতে লাগলো। আমরা যে যার মতো জীবন সমুদ্রে নৌকা ভাসিয়ে দিলাম।
পত্রিকা অনিয়মিত ভাবে হলেও, বের হচ্ছিল। পাশ করবার পর, সজল ব্যাংকে চাকরি পেল। প্রশান্ত কলেজে অধ্যাপনার কাজ পেল। আমি স্কুলে বাংলার শিক্ষক হলাম।
একদিন সন্ধ্যায় প্রশান্ত প্রজাপতি আঁকা বিয়ের কার্ড নিয়ে আমার কাছে এলো। ও বুলবুলিকে সামনের মাসে বিয়ে করবে।
ঘটনাটা জেনে আমি খুবই আশ্চর্য হলাম। কবে কিভাবে ওদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, আমি জানতাম না। অথবা, বুঝতে পারিনি।
বুলবুলির উপর আমার খুব অভিমান হতে লাগলো। সারারাত ঘুম এলো না। পরে নিজেকে বোঝালাম, আমি যে বুলবুলিকে পছন্দ করি, সে কথা কোনদিন ওকে বলিনি। তাহলে ওর উপর অকারণে অভিমান করা চলে না।
সজল বলল, তোদের বিয়ের মেনু চার্টটা এবার বল দেখি দোস্ত?
প্রশান্ত বলল, আমি একটা নামী ক্যাটারারকে দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছি।
ওদের বিয়েতে গেলাম। একটা খুব দামী বেনারসী শাড়ি নিয়ে। অগ্নিসাক্ষী করে ওদের বিয়ে হতে দেখলাম।
বিয়ে মিটে গেলে, ওদের কাছ থেকে বিদায় নেবার জন্য কাছে এগিয়ে গেলাম।
প্রশান্ত তখন ওর অধ্যাপক বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছিল।
বধূ বেশে বুলবুলি আমার কাছে এগিয়ে এলো। বলল, এই শাস্তি তোমার প্রাপ্য ছিল, তমোঘ্ন!
আমি চমকে গেলাম, বললাম, কোন্ শাস্তি?
ও বলল, যাকে ভালোবাসো, তাঁকে মুখ ফুটে বলতে পারোনি কেন?
পরাজয়ের গ্লানিতে আমি মাথা নিচু করে ফেললাম।
শুধু বললাম, তুমি কি করে বুঝলে, বুলবুলি?
বুলবুলি আমার কাঁধের উপর হাত রাখলো। বলল, সত্যিকার ভালোবাসার চোখ মেয়েরা ঠিক চিনতে পারে!
-------------------------------------------------------------
ঠিকানা, সুনির্মল বসু। নবপল্লী, বাটানগর,
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, কলকাতা,৭০০১৪০.