'আমি তোমাদের দেশে বেড়াতে এসেছিলাম '
(স্মৃতির পাতায় প্রয়াত প্রখ্যাত প্রতিভাধর পরিচালক , প্রযোজক ,কবি ও লেখক বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়।)
জয়শ্রী ব্যানার্জি
"ডাকছে আমায় ফাঁকা বন্দর , ডাকছে আমায় সব রাস্তা
অন্য এক ঠিকানার খোঁজে,
তোমার থেকে অনেক দূরে , ফিরবো না আর এই শহরে
তোমার থেকে অনেক দূরে ফিরবো না আর তোমার কাছে!" ( বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়)
খুব জানতে ইচ্ছা করে যিনি লিখেছিলেন কথা গুলো তিনি কোন নতুন ঠিকানায় গেছেন ! কেমন সে জায়গা! নাহ্ উত্তর মেলেনি । হেমন্তের এক অবেলায় ঝরাপাতার মতো ঝরে গেছেন কিন্তু যে কটা দিন ছিলেন পৃথিবীতে, কাছের মানুষদের সাথে , নিজের সাথে আর কাজের সাথে সেখানে তিনি তাঁর অনুভূতি কাজ, ভাবনা চিন্তা দিয়ে বুঝিয়ে গেছেন তিনি কে ! যেন বলেন ,কে বলে আমি নেই ! এই তো আছি আমি তোমাদেরই মাঝে আমার কাজের মাঝেই আমি আছি । আছি আমি, আমি আছি ।
না আমার সেই সৌভাগ্য হয়নি ওনার মুখোমুখি হবার , আমি প্রথম ওনাকে জানি ওনার পরিচালিত চলচ্চিত্র দেখেই । কাগজে ওনার কথা পড়েই। বই পড়া আর ভালো সিনেমা দেখার ঝোঁক আমার বরাবরই ছিল ।মাঝে মাঝেই অন্য পরিচালক সিনেমা দেখার সাথে সাথে ওনার ছবি ও কিছু কিছু দেখতাম । অন্য রকম লাগতো আর সেটাই টানতো ওনার সিনেমা দেখাতে।
বাংলা চলচ্চিত্রে চিত্রপরিচালনায় তিনি যখন ছাপ ফেলতে শুরু করেছিলেন , ঠিক তখনই চরম দুর্ঘটনা ঘটে যায় ওনার পরিবারের সাথে । সংবাদটি জেনে ভীষণই মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেছিল কারণ আমি না দেখলেও সত্যি ওনাকে শ্রদ্ধা করতাম ও করি এখনও ।
কিছু কিছু মানুষ বোধ হয় মৃত্যুর পর আর ও গভীর হয়ে আবিষ্কৃত হন । তাঁর কাজ কথা চিন্তা লেখা তিনি কেমন ছিলেন আস্তে আস্তে যত বের হয় জানার ইচ্ছা যেন আরো বেড়ে যায় ! তিনি এমনই একজন!
অনেক লেখাতে পড়েছি তাঁর কথা । বুঝতে চেষ্টা করেছি তাঁকে । ওনার ভাই প্রিয় বন্ধু রাজাদিত্যর কাছেও শুনেছি ওনার সম্পর্কে অনেক গল্প , স্মৃতি কথা । আজ সেই মানুষটি কে নিয়ে , সেই দাদা কে নিয়ে মন চায়লো কিছু জানা অজানা কথা লিখতে ...
আগেকার বেশ কিছু পরিচালক দের সিনেমা মনে জায়গা করে নিয়েছিল। সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা তাঁদের ব্যক্তিত্ব ভীষণ পছন্দের , পরবর্তী কালে পছন্দের তালিকায় বাপ্পাদিত্য ব্যানার্জি ও রাজাদিত্য ব্যানার্জির নামও যুক্ত হয় । কারণ একটা সিনেমা কি তথ্যচিত্র বানালেই হয়না তার জন্য পড়াশোনা করতে হয়। গবেষণা করতে হয় । নিজেকে ওয়ার্ল্ড সিনেমার স্টুডেন্ট বানাতে হয় একটা শিক্ষা রুচির ছাপ রেখে যাওয়া কাজ গুলো এনাদের মাঝে খুঁজে পাই । বাপ্পাদিত্য বাবুর বাবা সাংবাদিক ,কথা সাহিত্যিক কবি ,ফিল্মমেকার আনন্দমেলার প্রাক্তন সম্পাদক দেবাশিস ব্যানার্জি নিজেও গুণসম্পন্ন তথ্যচিত্র নির্মাণ করে গেছেন ।
যদিও সেগুলো দেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি আমার এখনও ।
এই নোংরা সস্তা রুচির ওয়েব সিরিজের যুগে মন চায় মুগ্ধতা নিয়ে অন্য রকমের সিনেমা দেখতে ,যেখানে দর্শক কিছু শিখবে ,তাদের ভাবাবে স্টেপ নিতে বাধ্য হবে কিংবা দেখে প্রাণখোলা আনন্দ পাওয়া যাবে বা সেই সিনেমা যেখানে সাহসের অর্থ ভুল সিস্টেমের প্রতিবাদ করা , কি হয়েছিল ,কি হচ্ছে, কি হবে কি দরকার তা জানানো । সাহস মানে কি যেখানে পরিচালক আর নায়ক নায়িকা অনাবশ্যক ভালগার পোষাক আর রগরগে যৌণ দৃশ্য দিয়ে বোঝাতে আসবে না । তার কাহিনী উদ্দেশ্য প্রেজেন্টেশন এ থাকবে সিনেমাটি কতটা পরিণত!
অন্য ধারার সিনেমা বানানো খ্যাতির পরিচালক ও এক গুণী কবি বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় এক অনন্য প্রতিভার নাম । পড়াশোনায় মাষ্টার ডিগ্রী করতে করতে ফিল্ম লাইনে আসা , বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চরাচর সিনেমার সহকারী পরিচালক হিসাবে যাঁর কাজ শুরু, যিনি তাঁর সিনেমা কবিতার মধ্য দিয়ে কিছু কথা বলতে চেয়েছিলেন, প্রতিবাদ রাখতে চেয়েছিলেন , বাস্তবতা পরাবাস্তবতার মিশেলে কারো বিরুদ্ধে বা অনেকের বিরুদ্ধে কিংবা কোনো সিস্টেমের বিরুদ্ধে ,বা সমাজের বিরুদ্ধে সেই সব রোজকার প্রতিদিন কার জমা সুখ দুঃখ, কষ্ট যন্ত্রণা ,হাহাকার হতাশা ব্যর্থতা, সফলতা অভিমান, বিচ্ছেদ, লোভ ,রাগ , ক্ষোভ, ঈর্ষা চাওয়া না পাওয়া সেই সব নীরব কি সরব প্রতিবাদ আর ভাবনা গুলো জানাতে চেয়েছিলেন ।
তাঁর সিনেমা গুলির দিকে যদি তাকাই দেখতে পাই তিনি বি.এফ.জে.এ ( বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশন ) দ্বারা 2003 সালে সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল পরিচালক হিসাবে পুরস্কৃত হন । তার দ্বিতীয় সিনেমা শিল্পান্তর (কালারস অফ হাঙ্গার) যেটি কে বাংলা ছবির ইতিহাসে মাস্টারপিস বলা চলে , সোফিয়া ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল , বুলগেরিয়াতে এর প্রিমিয়ার হয়েছিল। চলচ্চিত্রটি 2003 সালে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ব্রাতিস্লাভা প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে নির্বাচিত হয়েছিল। এটি 2003 হেলসিঙ্কি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নির্বাচিত দেবদাস ছাড়া একমাত্র ভারতীয় চলচ্চিত্র ছিল । দেবশ্রী রায় চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছিলেন । শুভাশিস মুখার্জিকে তিনি ই প্রথমে অন্য ভাবে দর্শকদের সামনে নিয়ে এসেছিলেন, অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন শুভাশিস মুখার্জি।
বাপ্পাদিত্য বন্দোপাধ্যায়ের প্রথম ফিচার ফিল্ম সম্প্রদান (দ্য অফারিং অফ দ্য ডটার) ষষ্ঠ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, 2000-এর প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে নির্বাচিত হয়েছিল। চলচ্চিত্রটি সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী, সেরা পার্শ্ব অভিনেতা এবং সেরা মহিলা প্লেব্যাকের বিভাগে তিনটি প্রধান পুরস্কার জিতেছিল। সে বছর বি.এফ.জে.এ অ্যাওয়ার্ডে গায়ক হিসেবে এটি সেরা সঙ্গীত পরিচালক বিভাগে দিশারী পুরস্কারও জিতেছিল।
তৃতীয় ফিচার ফিল্ম দেবকী , ইংরেজি ও হিন্দিতে 2006 সালে মুক্তি পায়। ছবির কাহিনী নারীকেন্দ্রিক ।বাস্তবে ঘটেও ছিল । ছবিটি ৭তম ওসিয়ানের সিনেফ্যান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ইন্ডিয়ান ওশান বিভাগে নির্বাচিত এবং প্রদর্শিত হয় । ছবিটি টেমেকুলা ভ্যালি ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এবং আইডাহো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রতিযোগিতা বিভাগে ছিল । এটি অ্যাশেভিল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা ফিচার ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডও জিতেছিল।
কাঁটাতার ওনার পরিচালিত চতুর্থ ফিচার ফিল্ম। এটি ৭তম ওশিয়ান সিনেফ্যান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের এশিয়ান প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত হয়েছিল। ছবিটি লন্ডনের রেইনড্যান্স ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও প্রদর্শিত হয়েছিল ।
উনি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল আলফা বাংলার জন্য কলকাতার স্থাপত্য ইতিহাসের উপর একটি টেলিভিশন সিরিয়াল, আনন্দনগরীর কথকতাও পরিচালনা করেছিলেন। উপজাতীয় মুখোশের উপর তার তথ্যচিত্র দূরদর্শন দ্বারা সম্প্রচারিত হয়েছিল ।
তাঁর বাকী সিনেমাগুলি হলো কাল, এলার চার অধ্যায়, কাগজের বউ, নায়িকা সংবাদ ,হাউসফুল , সোহরা ব্রিজ ।
এর মধ্যে বিশেষ করে উল্লেখ করতেই হয় শেষ মুক্তি প্রাপ্ত সিনেমা সোহরা ব্রিজ নিয়ে ! সোহরার গল্প লুকিয়ে আছে চারদিকে – এর নদীতে, ক্যাসকেড এবং কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়ের চূড়ায় সূর্যাস্তে...! রাজনৈতিক ভাবে অস্থির , উত্তর পূর্ব ভারতে স্বেচ্ছায় নিখোঁজ এক পিতাকে তার কন্যার সন্ধান আর একটু একটু করে তাঁকে আবিষ্কার আর আর সেই পিতা কন্যার সম্পর্ক এর বুনিয়াদ বুনন ছিল মূল কাহিনী । দক্ষ পরিচালকের হাতে গড়া ইউরোপীয় ঘরানার ছবিটিতে গল্প বলার শৈল্পিক কৌশল, অভিনয় সিনেমাটোগ্রাফি , মন ছোঁয়া লোকেশন , সঙ্গীত ,অভিজ্ঞতা সব কিছুই ছিল সুন্দর অসাধারণ অভিজ্ঞতা । স্মৃতি কল্পনা বাস্তবতার মিশেলে কবিতাটি ,চুপ কথার কোনো রুপকথা যেন !
গোয়ায় আয়োজিত ইন্টার ন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অফ ইন্ডিয়া তে সিনেমাটি দেখানো ছাড়াও বিদেশের কিছু চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিয়েছিল সিনেমাটি।
নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাক্তন ছাত্র আশুতোষ কলেজে সমাজতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করা স্বল্প ভাষী ব্যক্তিত্ববান মানুষটি ছিলেন পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল।
তাঁরই কাজের ধারা অনুসরণ করতেন। ঋত্বিক ঘটকের প্রতি সেই শ্রদ্ধা তিনি জানিয়েছিলেন 'হাউসফুল' ছবিতে। বাপ্পাদিত্য বাবু এই ছবিতে নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় চরিত্রের মধ্যে নিজেকে এবং ঋত্বিক ঘটককে একসঙ্গে মিলিয়েছিলেন নিজস্ব শৈল্পিক মুন্সিয়ানায়। নিজের ব্যক্তিগত পছন্দ গুলো নিখিলের সাথে বাপ্পাদিত্য বাবু দারুণ মিলিয়ে দিয়েছেন । নিখিলের ঘরে ঋত্বিক ঘটকের ' যুক্তি তক্কো গপ্প ' পোষ্টার রেখেছিলেন তিনি, যা ছিল তাঁর নিজের খুব প্রিয়।
ঋত্বিক ঘটকের যেমন পরিশীলিত এবং পূর্বনির্দিষ্ট চিত্রনাট্য থাকত না, তেমনি থাকত না বাপ্পাদিত্য বাবুরও। তাঁর একটা চিত্রনাট্য থাকত বটে; তাতে অনেক সময়ই অধিকাংশ সিনের ডায়লগ লেখা থাকত না। দৃশ্যগ্রহণের ঘন্টাখানেক আগে হয়তো সেটা লেখা হল—এমন ঘটনা বাপ্পাদিত্য বাবুর কাজেও প্রায় ঘটত।
হাউসফুল' ছবিতে দেখানো হয়েছে , আদর্শবাদী পরিচালক নিখিল বক্স অফিসে ব্যর্থ হয়েও বাজারে ছেয়ে যাওয়া সাউথ রিমেকের ধারে না গিয়ে ভালো বাংলা ছবি তৈরির যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন,। সিঙ্গল স্ক্রিন একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তাঁর ছবি হল পাচ্ছে না। পেলেও দেখা যাচ্ছে যে, প্রেক্ষাগৃহে গুটিকয় দর্শক , বসুশ্রী সিনেমা হলে যখন এই সিনেমার শ্যুটিং চলছিল , এই সিনটা টেক করতে গিয়ে দেখা গেল যে, বসুশ্রী সিনেমার পেছন দিকে কালিকা সিনেমা ভাঙা হচ্ছে। সেটা মাথায় রেখে বাপ্পাদিত্য বাবু সঙ্গে সঙ্গে নতুন সিন লিখে ফেললেন। তাতে ডিস্ট্রিবিউটার সেই কালিকার ভগ্নস্তুপের সামনে দাঁড়িয়ে ফোন করছে নিখিলকে, জানাচ্ছে সিঙ্গল স্ক্রিন ভেঙে ফেলার কথা। , ছবিতে এই সিনটা একটা ভীষন রকম এর ছাপ ফেলেছে।
তবে তিনি বাজেট সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত সচেতন হয়েই যা করার করতেন ।
তাঁর ভাই রাজাদিত্যর কাছে কথায় কথায় জানতে পারি ঋত্বিক ঘটক ছাড়া fredrico fellini ও ওনার পছন্দের পরিচালক ছিলেন । ভালোবাসতেন বাবা দেবাশিস ব্যানার্জির লেখা পড়তে। ওনার বাবার কথা আগেই বলেছি ।যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনা মূলক সাহিত্যে তিনি ছিলেন স্বর্ণ পদক প্রাপ্ত । সুতরাং দেবাশিস বাবুর লেখার মান উঁচু দরের হবে স্বাভাবিক ।
এ ছাড়া মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রিয় সাহিত্যিক । তিনি নিজে অনেক পড়াশোনাও করতেন । একটা ভাল সিনেমা বানানোর জন্য পরিচালককে যে খাটতে হয় তাতে তিনি উজাড় করেই দিতে চায়তেন । ছিলেন চে ভক্ত ও।
দুই ভাই এর সম্পর্ক ছিল গভীর বন্ধুত্বের। ভাই এর মেন্টর ছিলেন তিনি । দাদার কথা স্মরণ করে ভাই রাজাদিত্য স্বাভাবিক ভাবেই আবেগ প্রবন হয়ে পড়েন ।
একসময় ইউরোপে বসবাস করা ভাই রাজাদিত্য নিজেও একজন প্রখ্যাত মূলত থিয়েটার অভিনেতা ,পরিচালক প্রযোজক কবি ও লেখক। তাঁর নির্মিত সিনেমা , তথ্যচিত্র দেশে বিদেশে খ্যাতি পেয়েছে । পুরস্কৃত হয়েছে ।
মা মনীষা ব্যানার্জি স্কুল শিক্ষিকা ও একজন বিদুষী মহিলা । তিনিও কবিতা লিখতেন যদিও মুদ্রিত ভাবে এগুলো প্রকাশিত হয়নি । অর্থ্যাৎ বাড়িতে প্রথম থেকেই উচ্চ শিক্ষা, পড়াশোনা সাহিত্য সিনেমা সংস্কৃতি বিষয়ক চর্চা ছিল আছে এখনও । বাবা দাদা যে জিনিস এর ছাপ রেখে গেছেন রাজাদিত্য যোগ্য উত্তরাধিকারী রূপে সেই জিনিস সম্মানের সাথে বহন করে চলেছেন।
তথাকথিত কমার্শিয়াল ছবির বাইরে অন্যধরণের ছবি করতে এসে চিত্রপরিচালক বাপ্পদিত্য বাবুকে অনেক লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কত সময় প্রযোজক পাননি, ডিস্ট্রিবিউটার পাননি, হল পাননি; এমনও হয়েছে ডিস্ট্রিবিউটার অজ্ঞতার সুযোগে তাঁকে ঠকিয়েছেন , তবু ভেঙে না পড়ে যুদ্ধটা জারি রেখেছিলেন , যখন পেরেছেন নিজে প্রযোজনা করেছেন, অতি অল্প বাজেটে ছবি করেছেন। হাল ছাড়েননি। ধৈর্য নিয়ে সুসময়ের জন্য অপেক্ষা করেছেন। কোনো কোনো ছবির বক্স অফিসের ব্যর্থতা তাঁকে বিচলিত করেনি । তিনি আবার উদ্যমী হয়ে এগিয়েছেন ।
, বাণিজ্যিক ছবির বাজারে তুফান তুলতে যখন বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তে দক্ষিণী সিনেমার কপি চলছিল ,তখন আদর্শের জলাঞ্জলি দিয়ে বাজার ধরতে তিনি স্রোতের মুখে নেমে পড়েননি। বরং লড়াই করতে করতে স্রোতের বিপরীতে হেঁটেছেন নিজস্ব ধীর ভঙ্গিতে। নাটক-সিরিয়ালের অনেক ভালো অভিনেতারা সিনেমায় আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছিলেন ওনার মধ্য দিয়েই।
বাপ্পাদিত্য বাবু তাঁর চলচ্চিত্রজীবনে মোট দশটি ছবি পরিচালনা করেছেন। এই দশটি ছবিতেই তাঁর সম্পাদক দীপক মণ্ডল ও চিত্রগ্রাহক রাণা দাশগুপ্ত। অকৃত্রিম বন্ধুতা দিয়ে গড়ে উঠেছিল তাঁদের এই জুটি, যা শেষ ছবি পর্যন্ত অক্ষুন্ন ছিল। এই জুটিতে পরে সুরকার হিসেবে যুক্ত হয়েছিলেন বিশিষ্ট শিল্পী অভিজিৎ বসু।
ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির নোংরা রাজনীতিতে তিনি থাকতেন না, তাঁর মতো ব্যক্তিত্বের মানুষ যে কাউকে তোষণ করে উঁচুতে উঠবেন না সেটাই স্বাভাবিক । তিনি তাঁর প্রতিভা নিয়ে সাদা পথে এগোতে চেয়েছিলেন হয়তো সেই কারণেই তাঁর অনেক শত্রুর জন্ম হয়েছিল তাঁকে বার বার তারা দমাতে চেয়েছিল কিন্তু তিনি রবীন্দ্রনাথের ' রাজকাহিনী'র বাপ্পাদিত্য র মতো তরবারি হাতে সেনাপতি হয়ে এগিয়ে গেছেন। ওনার শ্রদ্ধেয়া মা'র নাম রাখা বোধহয় সার্থক ছিল । যতদিন জীবন ততদিন তলোয়ারের খেলা ! মায়া নিয়ে চলে যায় মৃতরা।
তাঁর ছবির তে আমরা কখনো ওনার নিজের লেখা, কখনো বাবা দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের, কখনো বা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, রবি ঠাকুর এর গল্প পাই। তিনি নিজে কবিতা লিখতেন। 'এ ছাড়া আধুনিক চলচ্চিত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি নিয়মিত লিখতেন।
পোকাদের আত্মীয়স্বজন' নামে তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থও রয়েছে। ছবির ইমেজারিতে, আবহে, ছোট্ট ছোট্ট অনুষঙ্গে তাই কবিতা লগ্ন হয়ে ছিল তাঁর ছায়াছবিতে।
যেমন দেখি 'হাউসফুল' (২০০৯) ছবিতে যে জোকারটা খুন করে বেড়ায়, সে খুনের পর ছড়িয়ে দিয়ে যায় হলুদ রঙের লিফলেট। নিবিষ্ট দর্শক দেখতে পান, তাতে লেখা একটি গদ্য কবিতা। যে কবিতা, এই সময়ের ক্ষতের কথা বলে।
" পাশ থেকে কে প্ররোচনা দেয় আত্মহত্যার ?
গুলি চলে ..
লাশ পড়ে থাকে রেল লাইনের ধারে,
ধান ক্ষেতে,শাল বনে
রাস্তার ধারে পড়ে থাকে লাশ ,
পাশ দিয়ে মানুষ চলে যায়
অটো চলে যায় মুকুন্দ পুরের দিকে ..
হোর্ডিং এর বিজ্ঞাপন, খবরের কাগজ
প্ররোচনা দেয় আত্মহত্যার।"
সোহরা ব্রীজে ও এমন পাই বরুণ চন্দ অভিনীত প্রতিবাদী লেখক সন্দীপ চট্টোপাধ্যায় চরিত্র টিতে।
যিনি অনেক দূরে নির্জনতায় অনেক কিছু থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন।
আমি সারা রাত বাড়ি ভাড়া খুঁজি,
পেছনে পড়ে থাকে কিছু ভাঙা কাঁচের টুকরো
রক্তের দাগ ,তোমার সব অভিশাপ!"
(বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়)
এক অদ্ভুত নীরবতা বয়ে চলে যেন!
ভালো সৎ মানুষ দের বৃত্ত বোধহয় ছোটো হয় । কারণ সেখানে মিথ্যা বাস করতে পারে না তাঁর ও বোধ করি তাই ছিল ,নিজেকে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অংশ বলে মনে করতেন না কারণ তিনি বুঝেছিলেন ভিতরে কি খেলা চলে !
চারদিকে মিথ্যা আর হতাশাময় জীবন তাঁর আক্ষেপ
"আমাদের জীবনে কোনো উৎসব নেই শুধু গান বেজে ওঠে "!
কিংবা যে সব সম্পর্ক গুলো আত্মহত্যার মতো ধুঁকছে ...
'শুধু আলো জ্বলে ওঠে শোবার ঘরে, আলো নিভে যায়
একে কি ভালোবাসা বলবে তুমি ? বলবে বিবাহ ?"
কিংবা রোজ আমরা যারা হারিয়ে যাচ্ছি ,তলিয়ে যাচ্ছি একটু একটু করে পোকাদের মত , রোজ যেমন অসংখ্য পোকাদের মৃত্যু ঘটে তেমনই আমাদের বহু স্বপ্ন আশা গুলোর রোজ রোজ মৃত্যু ঘটে , আত্মীয়রা দাঁড়িয়ে থাকেন সেই মৃত্যু হওয়া স্বপ্ন গুলোর লাশ নিতে। যাদের জীবন পোকার মতোই ...!
পোকাদের আত্মীয়স্বজন
কয়লার আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছো তুমি চিরদিনের মতো।
এখানে উৎসব সারারাত হ্যাজাকের আলো ঘিরে—
সকালবেলার সৎকার সমিতির গাড়িতে আমরা তুলে দিতে এসেছি
মৃত পোকাদের
মর্গের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি আমরা পোকাদের আত্মীয়স্বজন
বীরভূমের ভূমি পুত্র ,সিউড়ি থেকে আসা ও কোলকাতায় বেড়ে ওঠা চিত্র পরিচালক বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা চলচ্চিত্রে যখন বিশিষ্ট নাম হয়ে উঠেছিলেন ঠিক তখনই জনপ্রিয় ফুলটি একা হতে চেয়ে না জানি কোন কোন আলোকবর্ষের গ্রহের দেশে ফুটতে চলে গেলেন !
তিনি, ২০১৫ সালে, ২৮ আগস্ট, মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে নিউমোনিয়ায় ভুগে অকালে চলে গেলেন এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে ! সেই ট্রমা কাটাতে তার পরিবারের বহু কষ্ট হয়েছে । সেই বিয়োগ ব্যথা সত্যিই কঠিন ছিল তাঁর মা বাবা ভাই এর কাছে । এর সাথে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে এক চরম ক্ষতি হলো । এক প্রতিভা ঝরে গেলো হঠাৎ করে । যাঁরা ওনার অন্য ধারার ছবি পছন্দ করতেন তাঁরাও হারালেন তাঁকে ।
বাংলা চলচ্চিত্রে উনি নিজস্ব একটি গল্পবলার রীতি তৈরি করেছিলেন; যেখানে বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ দের সাথে ঘটে চলা গল্প গুলো থাকতো , যেখানে মাটির গন্ধ এসে মিশতো। কুয়াশা সরিয়ে আলো উঁকি দিত ,যেখানে থাকতো লোককথার পাঁচালী ও সংস্কৃতি, পথের গল্প , যেখানে থাকতো সেই গল্পের খাঁজে ভাঁজে পরাবাস্তবতার ব্যঞ্জনা আর বাস্তবতার ছোঁয়ার মিশেল।
তিনি নেই কিন্তু তিনি আবার আছেনও । বড়ো মন খারাপ করে এমন করে কেউ চলে গেলে কিন্তু ভাগ্যের হাতে আমরা সবাই অসহায় । শারীরিক ভাবে উপস্থিত না থাকলেও তিনি তাঁর সৃষ্টিতে রেখে গেছেন তাঁর অস্তিত্ব। ভালো থাকুন তিনি যেখানেই আছেন । আন্তরিক শ্রদ্ধা ও প্রণাম আমার ক্ষণজন্মা মানুষটিকে ,দাদাকে ।
ছবি - সংগৃহীত
-----------------------------------------------
জয়শ্রী ব্যানার্জি, পাল্লারোড,পূর্ব বর্ধমান।