কল্পবিজ্ঞানের গল্প ।। তৃণা ।। স্তুতি সরকার
ছবিঋণ- ইন্টারনেট।
তৃণা
স্তুতি সরকার
২০২০ সালের শুরুতেই শুনতে পাচ্ছিলাম বিষ বিষ। কেউ কেউ বলছিলেন বিষে বিষেক্ষয়। কিন্তু সম্পূর্ণ চমকে উঠে দেখলাম পৃথিবীর সবকিছুই যেন সম্পূর্ণ অন্যরকম ভাবে চলছে। আগেকার জীবনের সঙ্গে এখনকার জীবনের কেনো মিলই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সারা পৃথিবীর। তারপর..
২০২০র বেশ কিছুদিন পরে এই গল্পের শুরু। নায়িকা তৃণা ১১ বছরের একটি ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে।
এখনকার মানব জাতি থাকে সম্পূর্ণ একক জীবনে। তাদের শরীর মাথা থেকে পা পর্য্যন্ত সম্পূর্ণ ভাবে আবৃত থাকে কঠিন বর্মের মতো জামাকাপড়ে আবৃত। তার ভিতরে অক্সিজেন সরবরাহ হয় বিশেষ পদ্ধতিতে। বাইরে একটা নলের সাহায্যে বর্জ্য পদার্থ নিগত হয় একটা এটাচড কন্টেইনারে। খাওয়া দাওয়া হয় - ট্যাবলেট ফর্মের , একপ্রকার বড়ির সাহায্যে ক্ষিদে মেটে। কথা বলার জন্য জামার মুখে মাউথপীস আর কানে শোনার জন্য জামায় লাগানো থাকে হিয়ারিং এড যন্ত্র। এই স্বয়ং সম্পূর্ণ পোষাকটা দেখতে যতটা খটমটো , ভিতরটা কিন্তু বেশ আরামদায়ক। এই ড্রেস আবার বিভিন্ন ডিজাইনের পাওয়া যায়। মানুষ নিজেদের পছন্দমতো ও বানিয়ে নিতে পারেন।
এটা একটা নবজাগরণের যুগ। পুরানো সবকিছু পরিত্যাগ করে শিক্ষাব্যবস্থা, দৈনন্দিন চালচলন সব কিছুতেই পরিবর্তন এসেছে। এখনকার দিনে পড়াশুনা, গান বাজনা প্রভৃতি শিক্ষাব্যবস্থা চীপ্ এর মাধ্যমে মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। যার যেমন ইচ্ছে সে তেমনই শিখতে পারে। কোনো বাধ্যবাধকতা নেই । যার যেমন ইচ্ছে সে তেমনই নিজের ইচ্ছায় নিজের গুণের অধিকারী হতে পারে। তবে কঠোর নিয়মে বাধা এখনকার জীবন। কোনো ঝগড়া-ঝাটি, অশান্তি কি জিনিষ তা তারা জানে না। তারা দৈনন্দিন কাজ করেন, খেলা ধুলা, খাওয়া দাওয়া ইত্যাদি সবই স্বাধীনভাবে করতে পারে। তবে কোনোও একটা ইচ্ছা শক্তি যেন তাদের চালিত করে। এখানে মানুষরা নিজেদের ছোটো ছোটো গোষ্ঠীর মধ্যে নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ করে রাখে। তাদের বিয়ে ও হয় নিজের গোষ্টীর ভিতরে। প্রত্যেক গোষ্ঠীর নিয়ম কানুন স্বতন্ত্র। শোনা যায়, দূর কোনো গ্রহ থেকে তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত হয়। ইন্সট্রাকশন আসে বিভিন্ন চীপ্ এর মাধ্যমে।
তৃণা ছোট্ট থেকে একটু দুরন্ত প্রকৃতির। সে নিজেদের এই নিয়মের মধ্যে বাধা থাকতে চায়না। ছটফটে তৃণা কেবল লাইব্রেরী ঘরের মধ্যে যখন তখন ঢুকে বিভিন্ন ধরনের চীপ্ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে। এই করতে করতে সে নিজের অজান্তেই নানা বিষয়ের ওপর অপরিসীম জ্ঞানলাভ করতে থাকলো। এই চীপ্গুলো যেকোনো বয়সের মানুষের উপযোগী করে মানুষকে পড়া বুঝিয়ে দিতে পারে।
লাইব্রেরী ঘরের দেওয়ালে যে বড় স্ক্রিন কম্পিউটারটা রয়েছে, এখন তৃণা এতোটাই জ্ঞানলাভ করে ফেলেছে যে চীপ্ নির্দেশ দিল সেই বড়ো কম্পিউটারের কাছে যেতে। এরপর..
নতুন কিছু জানবার আনন্দে ছুট্টে গিয়ে চীপের ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী নির্দিষ্ট চেয়ারের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে ফেললো সে। এবার চীপের নির্দেশে সে ১, ২, ৩, ৪ প্রভৃতি নম্বরের চীপগুলি কম্পিউটারের বিভিন্ন স্থানে বসিয়ে দিতেই এক অদ্ভূত কাণ্ড ঘটতে লাগলো। চারিদিকে নানা রকমের আলো জ্বলতে আর নিভতে থাকলো। চেয়ারটা যেনো সামান্য দুলেও উঠলো। এবার এই চেয়ারের চারিদিকে থেকে আরোও অনেক বোতাম দেওয়া বেল্ট বেরিয়ে এসে তৃণাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে খাপে খাপে বসে গেলো। ওর হাত পা নাড়াবার উপায় রইলো না। আর কোনো কিছু ভাবার আগেই কম্পিউটারের বিরাট স্ক্রিনের মধ্যে নীল আলো জ্বলে উঠলো। দেখা গেল চারিদিকে তারাভরা আকাশ - রাত্রিবেলা। হঠাৎ চেয়ারটা ওকে নিয়ে যায়গা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে স্ক্রিনের মধ্যে দিয়ে ঢুকে শূণ্যে মিলিয়ে যেতে লাগল। মাথায় ট্রান্সপারেন্ট ঢাকনা এঁটে বসে গেছে ততক্ষণে। চেয়ার যানের মধ্যে ঠাণ্ডা বাতাস বইতে আরম্ভ করেছে। কিছুক্ষণের জন্য তার কোনো অনুভূতিই থাকলো না। ধীরে ধীরে সম্বিত ফিরে পেতে চীপ্ এর নির্দেশে টুং টাং এমন হরেক রকমের শব্দ সে পেতে শুরু করলো। সঙ্গে সঙ্গে সে তৎপর হয়ে ওঠে। ২ টো হাত, পা ২ টো ও মুখের সাহায্যে যেখানে যেমন সুইচ টেপার কথা বলছে চীপ্ সেগুলো টিপসপতে লাগল। এখন প্রচণ্ড গতি তার চেয়ার যানের। উড়ুক্কু
চেয়ার যান তাকে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগল প্রচণ্ড গতিতে। সমস্ত কিছু একলা হাতে কন্ট্রোল করা অভ্যাস হয়ে গেলো যখন, তখন উপলব্ধি থেকে তৃণা বুঝতে পারলো কোন অজানা শক্তি তাকে বলছে তার নিজস্ব উপলব্ধির কথা মনের কম্পিউটারে উঠিয়ে নেবার জন্য। সে এই ব্যাপারে অনেক দিন ধরে একটা কোর্স করেছে, অবশ্যই চীপ এর মাধ্যমে। খুব সোজা ব্যাপার এখন তার কাছে এটা। প্রথমে ভেবে নিতে হবে একটা নম্বর যেখানে সে এই উপলব্ধির কথা জমা রাখবে আর ভবিষ্যতে দরকারে চীপ এর মধ্যে দিয়ে পরবর্তী
প্রজন্মের জন্য রক্ষিত রাখবে।
এখন অবধি যা কিছু ঘটনা ঘটেছে তার সবটাই সে মনে মনে দ্রুত আলোচনা করে নিলো। নাম্বারটা ইনসার্ট করে নিলো মনে মনে - আর সঙ্গে সঙ্গে যেন তার অনুভূত হতে থাকলো কেমন যেন সরু সরু ধোঁয়া হয়ে মাথার মধ্যে কোন গভীরে কোথায় যেন সড় সড় করে সেঁধিয়ে যাচ্ছে তার চিন্তা ভাবনা গুলো। এ যে একটা গুপ্ত কোটোর তৈরী হয়ে গেলো তার ব্রেণের মধ্যে, তৃণা বুঝতে পারলো। যারপর নাই আনন্দ ভয় যুগপৎ বিস্ময়ে তার মন পুলকিত হয়ে উঠল। তার শিক্ষা সার্থক। এখন বাস্তবে শুধুমাত্র কাজে লাগাচ্ছে।
কখন যেন তার এই জার্ণির সমাপ্তি ঘটলো। প্রচণ্ড গতি শ্লথ হতে থাকলো। চীপ্ ইন্স্ট্রাক্সান দিতে থাকলো এখন কোন কোন বাটন টিপতে হবে। ধীরে ধীরে চেয়ার যান তৃণাকে এনে ফেলল এক নতুন জগতে। যার সম্পর্কে তৃণার আগে থাকতে কোনোও ধারণা ছিল না। সেখানে বেলুনের মতো গোলগোল কাঁচের মতো বড়ে ছোটো নানা রকমের বাড়ী। বাইরে থেকে ভিতরটা সব দেখা যায় । বিরাট সহর এটা একটা। সেটা চীপই তাকে জানিয়ে দিলো। আসলে সহরটা সবটাই একটা আবরণের মধ্যে রয়েছে যেটার সবটাই একটা স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো। বাড়ী, ঘর, সরোবর সবই তাকে আকর্ষন আর মুগ্ধ করতে লাগলো। এখানে তাপমাত্রা সব যায়গাতেই সমান। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, কোনো কিছুরই অনুভূতি নেই এখানে।
চেয়ারটা তাকে উড়িয়ে এক চক্কর শহরটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে যেন জিজ্ঞাসা করতে চাইল, কোথায় সে ঘর বাঁধতে চায় অর্থাৎ কোন যায়গাটা তার ভালো লেগেছে! মনে মনে একটা যায়গার ছবি ভেসে উঠতেই চীপটা যেন তার মনের কথা বুঝতে পারলো। আর সেই মতোই গড়ে উঠতে লাগলো তার ঘর বাড়ী। যখন বাড়ী তৈরী সমাপ্ত হল, তখন তৃণা এগিয়ে এসে ঢুকে গেলো স্ফটিক স্বচ্ছ গেটের মধ্যে দিয়ে নিজের বাড়িতে। ঝাঁচকচকে শহর । কোনো ধূলোবালি কিছুই নেই এখানে। এখানে সেখানে রাস্তার ধারে ধারে ফুটে রয়েছে নানা জাতের ফুল গাছ, ভরন্ত ফল গাছ রুচি সম্মত ভাবে সাজানো। সরোবরে ফুটে রয়েছে পদ্ম। নানা নাম না জানা হাঁস জাতীয় পাখি সরোবরে চরে বেড়াচছে। নাম না জানা কতো সুন্দর দেখতে পাখী তাদের সুরেলা শিষে চরাচর মুখরিত করে তুলেছে। এখন বোধহয় সূর্যাস্তের সময়।
আগেই চেয়ার যান তৃণাকে মুক্তি দিয়েছে তার অক্টোপাসের বাঁধন থেকে। খুশি মনে তৃণা গেটের ভিতর দিয়ে বাড়িটিতে প্রবেশ করলো। ভিতরে ঢুকে দেখল এই বাড়ী সে যেন আগে থেকেই চিনতো। হঠাৎ টুং টাং করে মনের দূরাভাসে বাজনা বেজে উঠল। তৃণা কথা কইবার জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠে। একটু যেন লজ্জা একটু যেন জড়তা তাকে পেয়ে বসলো। কিন্তু যিনি কথা বললেন তৃণার সঙ্গে, তৃণার সব আড়ষ্টতা পালিয়ে গেল তাঁর আন্তরিকতায়। তৃণা নিশ্চিত মনে কথোপকথন চালিয়ে যেতে লাগল অজানা প্রাণীর সঙ্গে। এই নতুন গ্রহ সম্পর্কে কিছু তথ্য আদান প্রদান করলেন উনি। তারপর কিছু প্রয়েজন আছে কিনা জিজ্ঞেস করে অবশেষে বললেন - 'তোমার টেবিলের পাশের ড্রয়ারে যে সাদা চীপটা আছে, সেটা যায়গা মতো লাগাও। ওখানে তোমার প্রয়োজনীয় সব তথ্য পেয়ে যাবে।'
নিত্যকর্ম সেরে আজকের মতো তৃণার রেস্ট।
॥২।।
নিশ্চিন্ত একটা ভালো ঘুমের পরে সকালে জেগে উঠেছে তৃণা। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল নতুন যায়গায় আসার কথা। গতকালের সমস্ত কথা। বাড়ীর কথা। মনের টেলিফোনের ঘণ্টা তখন বাজছে। 'সুস্বাগতম তৃণা। আশাকরি রাত্রে ভালো ঘুম হয়েছে। শরীর নিশ্চয় ঝরঝরে ফিট লাগছে এখন'। তৃণা হ্যাঁ বলল। এতো আন্তরিক কথেপকথন করতে লাগলেন অজানিত মানুষ না কে তৃণা সেটা বুঝতে পারলো না। কিন্তু সে জিজ্ঞাসা ও করতে পারলোনা - 'আমি কার সঙ্গে কথা বলছি জানতে পারি কি?' কারণ সে জানে এই চীপের দুনিয়াতে প্রয়োজন ছাড়া বাড়তি একটা শব্দও উচ্চারণ করতে নেই। অহেতুক ভাবনা ভেবে মাথাটাকে ভারাক্রান্ত করতে নেই। সে জানে, যেমন যেমন কথা হবে তেমন তেমন উত্তর দেওয়া দরকার আর এতেই সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে এতোদিনে , লাইব্রেরী ঘরে যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা থাকতো এবং চীপের সাহায্যে নতুন কিছু জানবার চেষ্টা করতো।
অত:পর অপর প্রান্ত থেকে নির্দেশ
আসলো, বাথরুমের সামনে ড্রেসিংরুমের ওয়াড্রবে আজকের পরার ড্রেস আছে। কিচেনের ফ্রীজে দেখবে অনেক প্রকার তরল আছে গ্লাসে। যেকোনো একটা থেকে নিজের ইচ্ছে মতো খেয়ে ড্রেস পরে বাইরের খোলা বারান্দায় এসে ডোমের মতো যে ছোটো স্বচ্ছ যানটি দাঁড়িয়ে আছে, সেটাতে উঠে বসো পরবর্তী নির্দেশ শোনার জন্য।
আজ্ঞা পালন করে তৃণা স্ফটিক স্বচ্ছ যানে উঠে বসতেই নতুন গলা শোনা গেল , যেন যানটাই তার সঙ্গে কথা বলছে। 'সুপ্রভাত বন্ধু। এখন আমি তোমাকে নিয়ে যাব আমাদের মহানুভব দাদুর সঙ্গে দেখা করতে'। যান চলতে থাকলো। কতো পাহাড় পর্বত, নদী নালা পার হয়ে পৌঁছালো এক অতি আশ্চর্য গোলাকার প্রাসাদে। যথারীতি স্ফটিক স্বচ্ছ পাহাড়ের ওপর ততোধিক স্ফটিক স্বচ্ছ প্রাসাদ। তার গোলাকার যানটাই তাকে নিয়ে স্বচ্ছ রাস্তার মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন টানেল, উঁচু নীচু টীলা পার করে প্রাসাদের মধ্যে ঢুকে গেল। আর একবারও না থেমে প্রাসাদের ভিতরের নানা অলিন্দে ঘুরপাক খেতে খেতে এসে পৌঁছলো এক বিশাল বড় ময়দান সদৃশ্য খোলা মেলা হলঘরে। ভিতরে ঢুকতেই হলের পিছনে কাঁচ সম দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। তৃণার যান তাকে বললো এই হলো আমাদের মহানুভব দাদুর সভাঘর। ওই উঁচু যায়গাটায় তাকিয়ে থাকো। দাদু আবির্ভূত হবেন এখনই। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সম্মোহন সূচক হাল্কা মিউজিক সহযোগে খুব হাল্কা হাল্কা মনভোলানো রঙের সমন্বয়ে চারিদিক উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে থাকলো। এতোরকমের অদ্ভুত ধরনের আলোর খেলা তৃণা আগে কখনও দেখেনি। আলোগুলো কখনও নদী, কখনও বা পাহাড় , কখনও বা গুহা হয়ে উঠতে লাগলো ও মিলিয়ে যেতে লাগলো। এরপর একঝাঁক করে বিন্দু বিন্দু আলো বিভিন্ন রঙের ঝাঁকে ঝাঁকে আবির্ভূত হতে থাকলো। ক্রমে সেগুলো এক যায়গায় জড়ো হতে হতে একটা বিশাল স্থান দখল করে নিয়ে ঘুর্ণাবর্তে ঘুরতে থাকলো- ক্রমে ক্রমে তারা ছোট বড় নানা আকৃতি নিতে নিতে হঠাৎই যেন একযায়গায় এসে স্থির হয়ে রইল আর তার পিছন থেকে একটা খুব বড় গোল বলয় এসে তার মধ্যখানে স্থির হয়ে দাঁড়ালো। স্বচ্ছ গোলোকের ভিতরে স্বচ্ছ সিংহাসনে বসে রয়েছেন সাদা আলখাল্লা ধরণের নানা রকমের স্ফটিক স্বচ্ছ ছোটো ছোটো বলয় দ্বারা সৌখিন কাজ করা বস্ত্র পরিহিত সৌম্য দর্শন
এক ব্যক্তি। হাত নাড়লেন তিনি তৃণাকে দেখে। যানের ভিতর থেকে অবিকল একই ভঙ্গিতে তৃণা ও অভিবাদন করলো। ওর যেন জানাই ছিলো কিভাবে অভিবাদন করতে হয় আর গ্রহণ করতে হয়। সহবৎ শিক্ষা তৃণা ছোট থেকে শিখে এসেছে। কঠোর পরিশ্রমী ও নিয়মানুবর্তিতার দ্বারা বেষ্টিত জীবনে সে অভ্যস্ত। অত:পর..
দাদু বললেন, 'তৃণা মা, স্বাগতম তোমাকে - আমাদের পরিবারে তোমাকে যুক্ত করে নিতে আমরা আগ্রহী। তুমি চাইলে আমাদের এখানে থেকে যেতে পারো, আমাদের সৃষ্ট এই গ্রহে। আর যদি তুমি ফিরে যেতে চাও তোমার পৃথিবীতে তো যখনই তুমি ইচ্ছা করবে ফিরে যেতে পারো। আমাদের কাছে নিজের ইচ্ছে শক্তিকে প্রাধাণ্য দেওয়া হয়। এখন তোমাকে আমাদের বিষয়ে জানাবো। আর তোমার কাছ থেকেও পৃথিবীর বত'মান অবস্থা সম্পর্কে জানবো।'
দাদু বললেন, 'পৃথিবীর সেচ্ছাচারী মানুষেরা একদিন নিজেদের ক্ষমতায় এতোটাই মত্ত হয়েছিলো যে প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে তারা নিজ নিজ ইচ্ছে অনুযায়ী উন্নত বিজ্ঞানের সাহায্যে পরিকল্পনাহীন ভাবে যেখানে সেখানে বাঁধ দিয়ে নদী বেঁধে ফেললো। চাষ আবাদের জলসেচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রভৃতি করতে সক্ষম হল। ক্রমে আরোও নানা বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠতে লাগলো। এরপর লোভ আর লালসা তাদের অন্ধ করে দিলো। শেষে অনিবার্য ভাবে আসলো ক্ষমতা দখলের লড়াই। দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে সংঘাত বেঁধে গেল। পরস্পর পরস্পরকে চরম অবিশ্বাস করতে লাগলো। দেশে নৈরাজ্য আসলো। কোনো দেশ হয়ে উঠলো ধনী, কোনো দেশ দারিদ্র্যের অতলে তলিয়ে যেতে লাগল। যত বিভেদ বাড়তে থাকলো, তত প্রভেদ এসে পড়ল জনজীবনে। এখন আর মিশাইল নতুন কোনো মারণাস্ত্র নয়। আরোও নতুন কিছু আবিস্কার করতে হবে । যাতে গোপনে প্রয়োজনীয় দেশের সর্বনাশ
করে ফেলা যায় । অথচ নিজেরা নিরাপদ দুরত্বে সুস্থ থেকে সভ্য সমাজের উচ্চ শিখরে থেকে প্রভুত্ব করতে পারে। চলল গবেষণাগারে নানা রকমের গবেষণা। সাফল্য এলো অবশেষে কিছু ভাইরাসের হাত ধরে। যে বিজ্ঞাণী এটা আবিষ্কার করলেন, উনি বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে বিশদে সাবধান বাণী লিখে রাখলেন। কিন্তু দেশে তো গুপ্তচরের অভাব নেই। অন্য দেশের গুপ্তচর সেই ভাইরাস খানিকটা গোপনে সংগ্রহ করে আনতে পেরেছিলেন এবং অতি গোপনে অন্য দেশকে বিক্রী করে, প্রচুর অর্থের বিনিময়ে। সেই দেশ কাল বিলম্ব না করে একটা নির্জন দ্বীপের কিছু নিরীহ আদিবাসীর ওপর প্রয়োগ করে অজানা এই রোগের কতটা বিস্তার হয় সেটা দেখতে চাইলো। কিন্তু সামান্য একটুখানি ভাইরাস সেই দ্বীপের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে বাতাসে ভর করে দিক দিগন্তে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। অর্ধেক পৃথিবী যখন ধ্বংস প্রায় তখন বিজ্ঞানীদের নজরে আসলো ব্যাপারটা । তড়িঘড়ি করে যখন দেখল ভাইরাসের এন্টিভাইরাস তৈরি করেও তাকে মারা যাচ্ছে না - অপ্রতিরোধ্য তার ক্ষমতা। একটা মাত্র ভাইরাস ঢুকলে শরীরে প্রথম সাতদিন কিছুই বোঝা যাবে না।
তারপর থেকে খুসখুসে কাশি অল্প জ্বর মাথাব্যথা সামান্য পেট খারাপ সাধারণ মামুলি সিম্পটম দেখা দেবে। ততক্ষনে সেই একটাই ভাইরাস শত সহস্র লক্ষে জন্ম নিয়েছে শরীরের মধ্যে আর প্রতিটি অণু-পরমাণুতে ছড়িয়ে পড়ে ব্লক করে দিচ্ছে সমস্ত রন্ধ্র পথ। ধীরে ধীরে ফুসফুসকে কব্জা করে নিলেই সারা শরীরের সব কোষ একসঙ্গে ফেটে গিয়ে গোল গোল রক্তের ফোঁটা বেরিয়ে এসে একটা তাল মাংসপিন্ডে পরিনত করে দিচ্ছে সমস্ত শরীরটাকেই। এই অসহ্য যন্ত্রণার থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো ওষুধ নেই। অবশেষে হার্ট ব্লক করে মেরে ফেলেছে মানুষকে। কিন্তু ততক্ষণে এই একটা শরীর থেকেই কোটি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে হাওয়ার সাহায্যে দ্রুত সুস্থ মানুষদের আক্রমণ করতে।
বিজ্ঞানীদের একাংশ যেমন এই দুর্নিবার ভাইরাস প্রতিরোধের প্রচেষ্টায় ব্রতী রইলেন , আর একাংশ অন্য পৃথিবীর মতো আবহওয়া যুক্ত বাসযোগ্য গ্রহে পাড়ি দেবার লক্ষ্যে গবেষণা শুরু করে দ্রুত নিষ্পত্তি লাভের জন্য নানা পরিকল্পনা মাফিক কাজ করে যেতে লাগলো।
তৃণা মা তোমাকে যতটা সহজ ভাবে বলে গেলাম ততটা সহজ ছিল না কিন্তু'। তৃণা বলল 'আমি উপলব্ধি করতে পারি দাদু।' দাদু আবার গলা খাকারি দিয়ে বলতে শুরু করলেন 'আজ যে লাইব্রেরী তোমরা দেখছো এরকম লাইব্রেরি আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় খুব দ্রুত স্থাপন করে আমাদের সমস্ত জ্ঞান কম্পিউটারের মধ্যে সংরক্ষণ করলাম ভবিষ্যৎ প্রজন্মের যদি কোন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে , আর এই লাইব্রেরী যদি কোনো ভাবে ব্যবহার করে তারা বিশেষ জ্ঞান লাভের অধিকারী হয়ে ওঠে , তাহলে তুমি যেমন এখানে আসলে তেমন ভাবে আমাদের কাছে তাদের উঠিয়ে নিয়ে আসতে পারবো।
সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তরে নানারকম শস্য বীজ ছড়িয়ে রাখা হলো এমন ভাবে যাতে বছর বছর আপনি ফসল তৈরি হয় আর বীজ থেকে পরের বছর ফসল আবার তৈরি হয় যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মানুষ খেতে পারবে। চীপের মধ্যে দিয়েও চাষাবাদের বিস্তারিত জ্ঞান ভান্ডার জমা রাখা হলো পৃথিবীর নানা প্রান্তে।'
'সম্পূর্ণ অন্য একটা গ্রহে বসবাস করতে হলে কত কি জিনিস লাগে সেদিকেও একদল বৈজ্ঞানিক নিরলস পরিশ্রম করে জোগাড় যন্ত্র করে রকেটের মাধ্যমে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট গ্রহে পাঠানো শুরু করে দেওয়া হলো সঙ্গে একদল বিশেষজ্ঞ ও প্রথম স্তরে নির্মাণের জন্য। এইভাবে দ্বিতীয় স্তর , তৃতীয় স্তর ও সর্বশেষ স্তরে সম্পূর্ণ হলো আমাদের আধুনিক গ্রহ নির্মাণ। পৃথিবীর দিকে আমাদের নজর রাখার জন্য স্যাটেলাইট ব্যবস্থা রাখা হলো অটোমেটিক ভাবে যা আমাদের জানতে সাহায্য করবে।
এতসব করতে করতে যে কদিন সময় নষ্ট হল তাতে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ আর অবশিষ্ট রইল। পৃথিবীতে এখন যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্য মজুদ। প্রকৃতি সুশীতল , জনসংখ্যা কম বলেই । কলকারখানা সমস্ত বন্ধ। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বৈজ্ঞানিক সকলেই প্রায় মরে গেল। বাকিদের মধ্যে একদম বেছে বেছে খুব সুস্থ মানুষদের নিয়ে সমাজ গড়বার আশায় কিছু ডাক্তার বৈজ্ঞানিক ইঞ্জিনিয়ার কিছু সুস্থ সাধারণ মানুষ দুধেলা গরু ছাগল মহিষ প্রভৃতি নানা জাতের প্রাণী শস্যদানা গাছ ফুল প্রভৃতি বহুবিধ জিনিস নিয়ে আমাদের নবসৃষ্ট এই গ্রহে আমরা জনবসতি স্থাপন করতে এলাম রকেট চেপে। এই যে গ্রহ তুমি দেখছো, তোমার পছন্দ হয়েছে তো, মা? '
তৃণা বাক্য রহিত হয়ে সমস্ত অজানা তথ্য শুনছিল। এখনকার চীপের জগতের ছেলেমেয়েদের ভাবাবেগ একেবারেই নেই। সেটা যে কি তাও তৃণা জানেনা। কিন্তু তবুও কিছু সময়ের জন্য যেন অন্যমনষ্ক হয়ে সে অতীতের পিতৃপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করল। অজান্তে চোখের কোন চকচক করে উঠলো । জল নাকি চোখে? আবেগ তাড়িত হয়ে তৃণ ভাবাবেগ সামলে বলল, 'দাদু আমি গর্বিত যে আমাদের কোন পূর্বপুরুষ যারা পৃথিবী থেকে এতটা দূরে এসে বসতি স্থাপন করেছেন তাদের দেখা পেয়ে। 'দাদু বললেন , 'মা তৃণা এবার আমার সঙ্গে চলো আমার প্রাসাদে অন্ন গ্রহণ করার জন্য।'
বিশাল প্রাসাদ । বিশাল তার চালচলন , রুচিসম্মতভাবে সাজানো। কিন্তু পৃথিবীর মতোই সাদা সরু চালের ভাত ডাল মাছ মাংস তরকারি চাটনি মিষ্টির প্রাচুর্য দেখে তৃণা অবাক হয়ে গেল। কী সুস্বাদু এসব খাবার । নতুন কিছু খাবার ও চোখে পড়লো।
খাওয়া দাওয়ার পরে দাদু নিজের কিছু কাজ সারতে চলে গেলেন আর তৃণা পরিচিত হতে লাগল প্রাসাদের মানুষজনের সঙ্গে। তারই মত দুটো হাত দুটো পা একটা মাথা - সম্পূর্ণ মানুষ আর পরিধান বস্ত্র অতি উন্নত ও সৌখিন। সে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল তার বয়সী কিছু ছেলে মেয়েকে পেয়ে। খেলাধুলো কত রকমের। পৃথিবী এখন যেসব খেলা ভুলে গেছে শুধুমাত্র চিপ এর জগতে রয়েছে, এরা এখন এখানে সেই সব পুরনো পৃথিবীর খেলা খেলে। তৃণা এইসব খেলা শিখতে থাকলো। সন্ধ্যেবেলায় নিজস্ব স্ফটিক যানে তৃণা নিজ ঘরে এসে প্রবেশ করল। পেট পুরে খেয়ে তো এসেছিলই। এখন জামাকাপড় চেঞ্জ করে বেডে ধপাস।
পরদিন আবার দাদুর প্রাসাদের অতিথি তৃণা। অতীত পৃথিবীর যত আচার-আচরণ খেলাধুলো আমোদ-প্রমোদ এমনকি তাস লুডো ক্যারাম সবেতেই হাতে খড়ি হতে লাগল তার। এভাবে বেশ কয়েকদিন কেটে গেল । ইতিমধ্যে দাদুর সঙ্গে আর দেখা হয়নি তৃণার। এবার দাদু দেখা করলেন তৃণার সঙ্গে । পৃথিবীর বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা ছিল তাঁর। তবুও প্রত্যক্ষদর্শী তৃনাকে জিজ্ঞাসা করলেন , 'অধুনা পৃথিবীর সম্পর্কে কিছু বলো তৃণা। '
তৃণা বলল , 'দাদু , আপনি তো সবই জানেন পৃথিবীর সম্বন্ধে । বিশেষ কিছু আর আমার বলার নেই। এখানে বারো মাসে বারো রকম আবহাওয়া । সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে নানা রহস্য । আমরা এখনো তার কিছু কিনারা করতে পারিনি। আমরা মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ এক জায়গায় বাস করি। আমার জ্ঞানী পূর্বপুরুষ এই লাইব্রেরির ব্যবহার সম্বন্ধে আমাদের মোটামুটি জ্ঞান অর্জন করিয়ে দিয়েছিলেন । তবে আমাদের কোনো বাধা নেই এই লাইব্রেরী প্রবেশ বা প্রস্থানের ক্ষেত্রে। সুবিশাল লাইব্রেরী কক্ষ আপনারা যেমন রেখে এসেছিলেন তেমনি আছে। চিপ দেখে বর্তমানে সামান্য কিছু চাষাবাদ হচ্ছে। গাড়িগুলো যা ছিল সব পুরনো অকেজো হয়ে গেছে । আজকাল আর ট্রেন হাওয়াই জাহাজ চলে না । নৌকো চলে লেকে । আমরা চীপ দেখে গাড়ি ঘোড়া সম্বন্ধে সাম্যক জ্ঞান লাভ করেছি। এছাড়া ভালই আছি আমরা। আপনারা যে অটো লাইট এর ব্যবস্থা করে দিয়ে এসেছিলেন সেগুলো তেমনি জ্বলে এখনো। ঘোড়ায় চড়ে দূর-দূরান্তে যাতায়াত। '
দাদু বললেন, 'তৃণা তুমি কি আবার পৃথিবীতে ফিরে যেতে চাও? '
তৃণা সহসা কি জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারল না। ওকে চুপ থাকতে দেখে দাদু জিজ্ঞাসা করলেন , 'কুণ্ঠাবোধ করো না তৃণামা , তুমি চাইলে এখানে সারা জীবন থেকে যেতে পারো। কিন্তু আমার একটা পরিকল্পনা আছে, যদি তুমি সম্মতি দাও তাহলে বলি।' তৃণা তাকিয়ে রইল দাদু বলে চললেন, 'আমি চাইছি তুমি এই কদিনে যেসব আদব-কায়দা শিখলে, যেসব খেলা , খাওয়া দাওয়া শিখলে সব আমাদের পুরনো পৃথিবীর আদব কায়দা। এগুলো তুমি যদি পৃথিবীতে গিয়ে সকলকে শেখাও ? এখানে তোমার অবারিত দ্বার। যখন ইচ্ছা তুমি আসবে যাবে । কি রাজি?' তৃণা খুশির সঙ্গে রাজি হয়ে গেল।
যাবার দিনক্ষণ স্থির। এত্তো গিফট সমেত একটা রকেট প্রস্তুত তৃনাকে পুরনো পৃথিবীতে ফিরিয়ে দিতে।
কিছু ইঞ্জিনিয়ার , কিছু শিক্ষক ইত্যাদি বিভিন্ন শ্রেণীর বিভিন্ন পেশার মানুষ তৈরি তৃণার সঙ্গে গিয়ে অধুনা পৃথিবীর মানুষকে শিক্ষিত করে তৈরি করে দিয়ে আসার জন্য। উন্নত মানের প্রযুক্তির বাড়িঘর তৈরি , আসবাবপত্র, গাড়ি তৈরি , সর্বোপরি, সোলার সিস্টেমের লাইট ব্যবস্থা গড়ে তোলা। তৃণা হাত নেড়ে বিদায় জানালো সকলকে। ফিরে চলল পৃথিবীর উদ্দেশ্যে।
=============================================