অনুবাদ গল্প ।। শেষ হাসি ।। বাংলা রূপান্তর : চন্দন মিত্র
শেষ হাসি
(চিনা লোককথা )
বাংলা রূপান্তর : চন্দন মিত্র
একসময় চিনে হাস্যপ্রিয় তিন বুড়োসাধুর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁরা খ্যাতিমান হলেও তাঁদের নাম-পরিচয় কেউই জানত না। নিজেদের পরিচয় ফলাও করে বলার ইচ্ছাও সম্ভবত তাঁদের ছিল না। কারণ তাঁরা ছেঁদো বাবাজিদের মতো নিজেদের নাম ভাঙিয়ে ব্যবসা করতে চাননি। তিন সাধু দীর্ঘদিন ধরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন। তাঁরা কাউকে কোনো উপদেশ দেওয়া তো দূরের কথা, কোনো কথাই বলতেন না। কেবল তিনজন সমস্বরে হাহা হিহি হোহো করে লোকজনকে হাসাতেন। তাঁদের সেই হাসি ছিল সংক্রামক। রামগরুড়ের ছানারাও তাঁদের পাল্লায় পড়লে নির্ঘাত হার মানত। হাসির জাদুবলে তিন বুড়ো সাধুর সংস্পর্শে আসা লোকজনের মন ভালো হয়ে যেত, তারা আবার হৃত জীবনীশক্তি ফিরে পেয়ে চনমনে হয়ে উঠত।
একবার তিনবুড়ো খবর পেলেন একটা গ্রামের লোক খুব সমস্যায় আছে। সমস্যাটা আর কিছুই নয়, সেই গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা হাসতে ভুলে গেছে। তিনবুড়ো হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলেন সেই গ্রামে। হাসতে ভুলে গেলে যা হয়, গ্রামবাসীদের চোখেমুখে কেমন যেন মিইয়ে পড়া ভাব। যেন সব এক একটা দম দেওয়া কলের পুতুল। গ্রামের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অপরাহ্নবেলায় তিন সাঙাতে শুরু করলেন সমবেত অট্টহাস্য। তাঁদের হাসির ধরন পালটাতে লাগল সময় সময়। গ্রামের কোনো ঘরে আর লোক থাকল না, সবাই সমবেত হল তিনবুড়োর চারপাশে। হাসি সংক্রমিত হল সকলের মধ্যে। গোটা গ্রাম হাসিতে কেঁপে উঠল। মানুষগুলো অনুভব করল তাদের বুকের থেকে উদবেগের ও দুশ্চিন্তার পাথর নেমে গেছে, তারা এমন হালকা হয়ে গেছে যে, চাইলে পাখির মতো উড়তে পারে।
তিনবুড়ো সেই গ্রামে ক-দিন থেকে গেলেন। একদিন সন্ধ্যাবেলায় তিনবুড়োর মধ্যে যিনি বয়োজ্যেষ্ঠ তিনি মারা গেলেন। শোক-সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে। সকলে সেই জ্ঞানী মানুষটিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে তৎপর হয়ে উঠল। তারা গিয়ে দেখল, একজন বুড়ো শুয়ে আছে আর তাঁর দিকে তাকিয়ে দুই বুড়োসাধু উবু হয়ে বসে সমানে হেসে চলেছেন। অনেকেরই সন্দেহ হল, বোধহয় শুয়ে থাকা সাধুটি মারা যাননি, একটু পরে তিনিও হাসিতে যোগ দেবেন। কেউ কেউ এসেছিল হাস্যপ্রিয় সাধুদের কান্না দেখে মজা নিতে। কাউকে কাঁদতে না-দেখে তারা আশাহত হল। গ্রামের মানুষ যখন বুঝল শুয়ে-থাকা-সাধু সত্যিই মারা গেছেন, তখন একজন গ্রামবাসী ভর্ৎসনার সুরে বলল— 'দীর্ঘদিনের সঙ্গীর মৃত্যুতে হাসাহাসি করে আপনারা মৃতব্যক্তিকে অসম্মান করছেন। আপনাদের মতো জ্ঞানী ব্যক্তিদের এমন আচরণ অসমীচীন!' তখন হাসি থামিয়ে একজন সাধু কথা বলে উঠলেন। তিনি দীর্ঘ বছর পরে মুখ খুললেন— 'আসলে আমাদের সঙ্গীটি জিতে গেছেন, আমরা হেরে গেছি। তাই তাঁর জিতে যাওয়াকে আমরা হাসির মাধ্যমে অভিনন্দিত করছি।' উপস্থিত লোকজন সাধুর কথার মর্ম বুঝে উঠতে না-পেরে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। এবার দ্বিতীয় সাধু মুখ খুললেন— 'আসলে ও আমাদের সঙ্গে বাজি ধরেছিল ও আগে মরবে। ব্যাটা মরেও জিতে গেল।' কথা শেষ করে দুই সাধু মিলে আবার হাহা হোহো হিহি শুরু করে দিলেন। গ্রামবাসীরা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিল। তারা রীতি অনুযায়ী মৃতের শরীর থেকে পোশাক খুলে স্নান করিয়ে নতুন পোশাক পরানোর প্রস্তাব দিল। দুই সাধুই মাথা নেড়ে অসম্মতি জ্ঞাপন করলেন। তাঁদের একজন আবারও মুখ খুললেন— 'আমাদের বন্ধুটি মরার আগে আমাদের প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছেন, তাঁকে যেন আমরা এরকম অবস্থাতেই চিতায় তুলি।' গ্রামের মানুষ অনিচ্ছা সত্ত্বেও সাধুদের কথা মেনে নিলেন।
মৃত সাধুকে তাঁর পোশাকপরিচ্ছদসহ চিতায় শুইয়ে দেওয়া হল। অগ্নি সংযোগের কিছুক্ষণের মধ্যেই অলৌকিক ঘটনা ঘটতে লাগল। হঠাৎ চিতার আগুন বর্ণময় হয়ে উঠল, তারপর শুরু হল চটপট, ঠুসঠাস, চড়বড়াবড়— আকাশে ছুটে বেড়াতে থাকল নানা রঙের আলোকমালা। সে অভাবনীয় দৃশ্য দেখে দুই বুড়ো সন্ন্যাসীর কী হাসি। তাঁদের সেই সংক্রামক হাসিতে সামিল হল সারা গ্রাম। আসলে মৃতসন্ন্যাসী তাঁর পোশাকের মধ্যে ভরে রেখে ছিলেন নানা ধরণের আতশবাজি।
=============================
চন্দন মিত্র
ভগবানপুর (হরিণডাঙা)
ডায়মন্ড হারবার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা