ছবিঋণ- ইন্টারনেট।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সংস্কৃতি চর্চার
গতি-প্রকৃতি
-- চিত্তরঞ্জন দাস
মারাঠা শব্দভাণ্ডার থেকে নেওয়া 'সংস্কৃতি' শব্দটিকে ইংরেজি শব্দ CULTURE -এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রথম প্রস্তাব দেন ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই প্রস্তাব অনুমোদন করলে ১৯২২ সাল থেকে ইংরেজি শব্দ CULTURE- এর প্রতিশব্দরূপে বাংলায় 'সংস্কৃতি' শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়।
এখন প্রশ্ন হল সংস্কৃতি কথাটির অর্থ কী? সংস্কৃতি শব্দের অর্থ অত্যন্ত ব্যঞ্জনাপূর্ণ ও ব্যাপক। বিভিন্ন ভাষা ঐতিহাসিকদের মতামতের ভিত্তিতে সাধারণভাবে বলা যায় -- কোন স্থানের মানুষের আচার ব্যবহার, জীবিকা, সংগীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাটক, চিত্রাঙ্কন, ধর্মীয় রীতিনীতি, শিক্ষা দীক্ষা ও সামাজিক সম্পর্ক ইত্যাদির মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় তাই হলো সংস্কৃতি।
কেমব্রিজ ইংলিশ ডিকশনারী বর্ণনা অনুসারে -- নির্দিষ্ট একটি সময়ে, নির্দিষ্ট একদল মানুষের সাধারণ প্রথাসমূহ, বিশ্বাস এবং জীবন যাপনের পন্থাই হল তার সংস্কৃতি।
'সংস্কৃতি' শব্দের ব্যাপকতা এত বিস্তৃত যে সামগ্রিকভাবে সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা এককথায় অসম্ভব ব্যাপার। তাই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সংস্কৃতিচর্চা বলতে মূলত: সংগীত- চিত্রাঙ্কন -মূর্তি নির্মাণ- যাত্রাপালা-নৃত্য- এই সব পারফরমিং আর্ট নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুলাই মিরজাফর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে একটি চুক্তি করে ২৪টি মহলের জমিদারি সত্ত্ব কোম্পানির হাতে তুলে দেয়। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দের লর্ড হেস্টিংস এই ২৪টি মহল একত্রিত করে নামকরণ করেন ২৪ পরগনা। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ অখণ্ড চব্বিশ পরগনাকে ভেঙ্গে ৯৯৬০ ব: কিমি আয়তন বিশিষ্ট দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলাটি গঠিত হয়। এই জেলার একদিকে আছে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী শহর কলকাতা এবং অন্যদিকে আছে ম্যানগ্রোভ অরণ্য ও নদীবিধৌত সুন্দরবন অঞ্চল। তাই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা হল একটি মিশ্র সংস্কৃতির পীঠস্থান।
এই জেলা যে চারটি মহকুমা নিয়ে গঠিত, সেই মহকুমাগুলির মধ্যেও সংস্কৃতিচর্চার পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। আলিপুর সদর মহকুমাটি কলকাতার অন্তর্গত। বাঙ্গালীদের সঙ্গে বিহার, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ প্রভৃতি বিভিন্ন জেলার মানুষ এই মহকুমাটিতে বসবাস করেন। তাই তাদের মধ্যে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক সংস্কৃতি চর্চার পার্থক্য দেখা যায়। বারুইপুর মহকুমায় পূর্বতন জমিদার এবং প্রভাব- প্রতিপত্তিশালী মানুষের বসবাস। তাই এই মহকুমার সংস্কৃতি চর্চায় একটা আভিজাত্য লক্ষ্য করা যায়। অন্যদিকে ক্যানিং এবং কাকদ্বীপ মহকুমা সুন্দরবন অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত। এই দুই মহকুমার বেশিরভাগ মানুষই এখানকার ভূমিপুত্র নয়। হাওড়া, হুগলি, মেদিনীপুর, বর্ধমান, বাংলাদেশ প্রভৃতি বিভিন্ন স্থানের ভাগ্যান্বেষী হতদরিদ্র ছিন্নমূল কিছু মানুষ এই এলাকায় বসতি স্থাপন করেছেন। বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন ধর্ম ও বিভিন্ন রীতিনীতিতে বিশ্বাসী এইসব মানুষরাই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সংস্কৃতি চর্চার ধারক ও বাহক।
*সঙ্গীতচর্চা :*
ব্রিটিশ শাসন শুরুর সাথে সাথে জমিদারি ব্যবস্থার ফাটল, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার যুগে সান্ধ্যকালীন আসরে সদ্য গজিয়ে ওঠা নব্যবাবুদের মনোরঞ্জনের জন্য একশ্রেণীর নগরবাসী মানুষের চেষ্টায় শুরু হয় কবিগান, তরজা, টপ্পা, আখড়াই প্রভৃতি সংগীতের। পরবর্তী সময়ে সংগীতের এই সব ধারা বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাও এর ব্যতিক্রম নয়। রামায়ণ, মহাভারত এবং বেদ-পুরাণের কাহিনী নিয়ে রচিত হেঁয়ালি বা প্রহেলিকাধর্মী ছড়াগান হল তরজার বিষয়বস্তু। মথুরাপুরের ভীমচন্দ্র সরদার ওরফে ভীম ওস্তাদ, গোবিন্দ অধিকারী, গোষ্ঠ চন্দ্র মন্ডল (বারুইপুর), সহদেব জানা (বামানগর,কাকদ্বীপ), প্রমুখ ছিলেন প্রখ্যাত তরজা, লোকগীতি,বাউল, কীর্তন শিল্পী ও পুতুলনাচ শিল্পী। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুর, জয়নগর, মগরাহাট, ফলতা, ডায়মন্ড হারবার, কাকদ্বীপ প্রভৃতি এলাকায় প্রাচীন এইসব সংগীত ধারা সর্বাধিক বিকশিত হলেও বর্তমানে চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তা প্রায় অবলুপ্ত।
১৮ শতকের শেষ ভাগে আমাদের জেলায় নিধু গুপ্তের টপার হাত ধরে আধুনিক গানের সূত্রপাত ঘটে, লোকসংগীত, বাউল, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, কীর্তন গানের পথ অতিক্রম করে রবীন্দ্র সংগীত, দ্বিজেন্দ্রগীতি, শ্যামা সংগীত, অতুলপ্রসাদী, নজরুল গীতি এবং সবশেষে কাব্যগীতির আবির্ভাব ঘটেছে। একসময় গায়ক-গীতিকার ও সুরকার হিসেবে আমাদের জেলার আধিপত্য ছিল দেখার মতো। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (জয়নগর - বহুড়ু), নির্মলা মিশ্র (জয়নগর- মজিলপুর), সলিল চৌধুরী (দক্ষিণ বারাসত, বেলিয়াডাঙ্গা), জগন্ময় মিত্র (মালা-মহিরামপুর) প্রমূখ এই জেলার সংগীত সাধনাকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। বিভিন্ন সংগীত শিক্ষা কেন্দ্র, যেমন -ডায়মন্ড হারবারের কড়ি ও কমল (নীলাঞ্জন রায় চৌধুরী), নামখানা গনেশ নগরের ক্ষুদিরাম স্মৃতি সংগীত ও সাহিত্য একাডেমী (শ্যামসুন্দর জানা), পাথরপ্রতিমার জি প্লট ব-দ্বীপে গীতাঞ্জলি মিউজিক কলেজ (মানিক দাস) প্রভৃতি জেলার মধ্যে ছড়িয়ে থাকা বহু প্রতিষ্ঠান সংগীতের প্রসারে নিয়ে যে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে।
সত্যি বলতে একসময় সমস্ত সম্ভ্রান্ত বাড়িতেই গানের চর্চা চলত। বাড়ির ছেলেমেয়েদের সংগীত শিক্ষা দেওয়া হত। কিন্তু বর্তমানে পাড়ার বা গ্রামের কোন অনুষ্ঠানে উদ্বোধন সংগীত গাওয়ার লোক পাওয়া যায় না। আসলে মানুষ জীবন-জীবিকা নিয়ে এখন এতটাই ব্যস্ত যে তাদের কাছে সংগীতচর্চা একান্তই মূল্যহীন। পড়াশোনার চাপ, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার উদগ্র বাসনা সেই সঙ্গে টি.ভি, মোবাইল প্রভৃতি ইলেকট্রিক মিডিয়ার দৌলতে মনোরঞ্জনের বিভিন্ন নতুন নতুন দিক খুলে যাওয়ায় বর্তমানে মানুষের সুকুমার প্রবৃত্তিগুলি শুকিয়ে যেতে বসেছে।
*পালাগান:*
লৌকিক দেব-দেবতার কাহিনী সেইসঙ্গে কিছু কেচ্ছা কাহিনীকে নির্ভর করে শুরু হয় দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার পালাগান। ডঃ দেবব্রত নস্কর তাঁর "চব্বিশ পরগনার লৌকিক দেবদেবী : পালা গান ও লোকসংস্কৃতি" গ্রন্থে লিখেছেন -- "লৌকিক দেব-দেবতা নির্ভর পালাগানকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন - ১) দেবীপালা -- (শীতলামঙ্গল, মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল) ২) দেবপালা -- (চাঁদ সদাগরের পালা, বসন্ত রায়ের পালা, শনি ঠাকুরের পালা) ৩) বিবি পালা -- (বনবিবির পালা, ওলা বিবির কাহিনী) এবং ৪) পীর ও গাজী পালা -- (মানিক পীরের কাহিনী, সত্য পীরের কাহিনী, মোবারক গাজির কাহিনী) প্রভৃতি।
এইসব পালাগানের পথ ধরে যাত্রার উদ্ভব। 'যাত্রা' শব্দের অর্থ হলো -- শোভাযাত্রা। উৎসব অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে নাচ গানের মাধ্যমে বর্ণাঢ্য সভাযাত্রাকেই 'যাত্রা' নামে অভিভূত করা হয়। দেড় দুশো বছর আগে গ্রামের জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় সখীদের খেউড় গান, বাইজি নাচ, সতী ময়না পালা, দুঃখে যাত্রা, কালীকথা প্রভৃতি কাল্পনিক সংলাপের মজলিস বসত। পরে চৈতন্য পরবর্তী যুগে সংলাপধর্মী অভিনয় শুরু হয়। কিছুদিন আগে পর্যন্ত শীতলা পূজা, মনসা পূজা, প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হতো ধর্মীয় যাত্রাপালা। হ্যাজাক ও ডে লাইট-এর উজ্জ্বল আলোতে উদ্ভাসিত রঙ্গমঞ্চে লক্ষীন্দর-বেহুলার করুন কাহিনী শুনতে শুনতে বুক ভেসে যেত চোখের জলে। পরবর্তী সময়ে সংগীতবহুল এইসব পালাগানের বাইরে বেরিয়ে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার পাড়ায় পাড়ায় মানুষকে আনন্দদানের জন্য গজিয়ে ওঠে সৌখিন যাত্রা দল। প্রথম দিকে এইসব যাত্রায় নারী ভূমিকায় পুরুষরাই অভিনয় করত। পরে অবশ্য নারীরাও যাত্রায় অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। দক্ষিণ গড়িয়ার বিখ্যাত নাট্যাভিনেতা দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়নগর মজিলপুররের চিত্রনাট্যকার নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চক্রবর্তী প্রমুখ ছিলেন আমাদের জেলার গর্ব। এছাড়া মথুরা পুরের নিকটবর্তী শাসনের নাট্যকার প্রসাদকৃষ্ণ ভট্টাচার্য (আনন্দ আশ্রম, পৃথিবীর পাঠশালা, কৃষ্ণ শকুনি, এযুগের সাবিত্রী), মথুরাপুরের বিশ্বজিৎ পুরকায়স্থ (সোনার গায়ের সোনা মেয়ে, বউ কথা কও) শাসনের অন্য নাট্যকার সৌরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (নবাব সিরাজউদ্দৌলা), পাথরপ্রতিমার দূর্বাচটির বিখ্যাত নাট্যকার ভগীরথ গিরি (স্বপ্নে দেখা স্বাধীনতা, সংসার তোর পায়ে নমস্কার, ঈশ্বরের চোখে জ্বলছে আগুন, লাল সিন্দুরের নকল বউ, ভালোবাসার ফেরিওয়ালা) প্রমূখ দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার বলিষ্ঠ নাট্যকার।
পাথরপ্রতিমার গদামথুরার তরুণ অপেরা (প্রভাত মন্ডল), দুর্বাচটির মিলন অপেরা (শ্রীনিবাস মন্ডল ও সুধীর চন্দ্র ভূঁইয়া), সূর্যপুরের শ্রী হরিনাট্য কোম্পানি, কুয়েমুড়ির শক্তি অপেরা, জি-প্লট সীতারামপুরের ভোলানাথ অপেরা (কানাই দাস), মাথুরের অন্তরঙ্গ নাট্য সংস্থা (সুবীর মন্ডল), বাসন্তীর গৌরাঙ্গ অপেরা (অনুমতি ঘরামী), মানখন্ডের নতুন মুখ নাট্য সংস্থা (রামপ্রসাদ হালদার), সাগরের সুকান্ত যাত্রা ইউনিট (প্রদীপ মাইতি) এবং লক্ষীনারায়ণ নাট্য কোম্পানি (অজয় মিদ্দা), নামখানার নারায়ণপুর শ্রী দুর্গা যুব সংঘ, শিরাকোলের বিশালক্ষী নাট্য সমিতি, অনন্তরামপুরের তরুণ নাট্য সমাজ, বজবজের ভ্রাতৃসংঘ, জয়নগরের বন্ধুসংঘ, আগড়াপুঁজির মা অষ্টমী নাট্য সংস্থা, মানখণ্ডের নবচেতনা নাট্য সংস্থা প্রভৃতি এক সময় সুনামের সঙ্গে যাত্রা পরিবেশন করেছে বা এখনো প্রায় নিয়মিত নাট্যমঞ্চস্থ করছে। এই জেলার দক্ষিণাংশে শক্তিধর নন্দ (কুয়েমুড়ি), যাদুকর পাত্র (সূর্যপুর), পূর্ণচন্দ্র মুনিয়ান (বনশ্যামনগর), বাণীকুমার (১৫ নম্বর লাট ),(অরুণ মাইতি ও সোনালী মাইতি (গদামথুরা), সাগরদ্বীপের প্রদীপ মিদ্দ্যা, শংকর বেরা, দেবজিৎ মাইতি, জব্বর সাহা, কৃপাসিন্ধু গোস্বামী, গোবিন্দপুরের বরুন গায়েন,শিখারায় (কুশবেড়িয়া), কবিতা গায়েন (কৃপারামপুর), অরুময় গায়েন (আগড়াপুঁজি), সুব্রত পুরকায়েত (মানখন্ড), উপেন মালিক (মহেশতলা), ভক্তরাম মন্ডল (বহড়ু), সতীশ চন্দ্র দাস (বজবজ), বাবলু ভট্টাচার্য (বিড়লাপুর),
প্রমুখ উল্লেখযোগ্য যাত্রা শিল্পী। বিভিন্ন যাত্রা দলে সুনামের সঙ্গে অভিনয় করেছেন অনল চক্রবর্তী (সরশুনা), কলকাতার মাখন নট্টের সুবিখ্যাত নাট্য কোম্পানির একসময়ের নায়িকা ছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার রায়দিঘির বাঁশবেড়ে-র সীতা ঘোষ।
বর্তমানে এই যাত্রা শিল্প ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার কারণ গ্রাম গঞ্জের মানুষের হাতে অতিরিক্ত সময় আর অবশিষ্ট নেই। তাছাড়া দামী সাউন্ড সিস্টেম, উন্নত লাইটিং প্রভৃতির খরচ বহন করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। কলকাতার নামী যাত্রাদলের গ্রামগঞ্জে পৌঁছে যাওয়াও গ্রামীণ যাত্রা শিল্প ধ্বংসের একটি কারণ। তবে গ্রামগঞ্জে যাত্রাশিল্প হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জেলার বিভিন্ন শহর ও শহরতলীতে বর্তমানে নাটকের দল কিছুটা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। যেমন- কথকতা (সোনারপুর), মহেশতলা প্রেক্ষাপট (মহেশতলা), লোনা থিয়েটার (কাকদ্বীপ), ঐক্যতান (সন্দেশখালি) প্রভৃতি নাট্যদলগুলি নিয়মিত নাটক উপস্থাপন করছে। তবে মানুষের রুচির পরিবর্তন ঘটায় এখন আমরা দেখি পালাগান বা যাত্রার পরিবর্তে সস্তায় সর্বত্র চলে ডান্স হাঙ্গামা এবং স্বল্প পোশাকে শরীর ঢেকে সারারাত ব্যাপী বিচিত্রানুষ্ঠানের নামে অশ্লীল বেলেল্লাপনা!
*খেলাধুলা :*
মানুষের রোজকার জীবনে খেলাধুলার ভূমিকাকে কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না। কেবল বিনোদন নয়, বর্তমানে খেলাধুলা শরীরচর্চার এক অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। লোকায়ত জীবন যাত্রার সুখ-দুঃখ, আবেগ-অনুভূতি, সাফল্য-ব্যর্থতা ও হাসি-কান্নার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে রয়েছে বলে বৈচিত্র্যময় লোকক্রীড়াও সংস্কৃতির একটি বিশেষ অংশ। সময় পেলেই একসময় গ্রাম-গঞ্জের কম বয়সের ছেলে মেয়েরা এক্কা-দুক্কা, কানামাছি, কুমির ডাঙ্গা, ডাঙ্গ-গুলি, বস্তা দৌড়, মোরগ লড়াই, লাফান দড়ি, লুকোচুরি, চোর পুলিশ, বউ বসান্তি, হুঁশ ধাপ্পা, গাজী কোট, প্রভৃতি খেলে আনন্দ পেত।
শিশুদের শৈশব ক্রমশ হারিয়ে যাওয়ায় এখন এইসব খেলাধুলা আর তেমন চোখে পড়ে না। কিছুদিন পরে নতুন প্রজন্মের কাছে এগুলি রূপকথার গল্প বলেই মনে হবে। এখন এইসব লোকক্রীড়ার পরিবর্তে ক্রিকেট, ধাবাস বল, ব্যাডমিন্টন প্রভৃতির আবির্ভাব ঘটেছে; যে খেলাগুলি যথেষ্ট ব্যয় সাপেক্ষ এবং সকলের পক্ষে অংশ নেওয়া অসম্ভব। ছোট থেকে বড় সবাই এখন মোবাইলে গেম খেলায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
*চিত্রাঙ্কন :*
মনে করা হয় আজ থেকে ৪৫ হাজার বছর আগে ইন্দোনেশিয়ার সুলাওসি দ্বীপের গুহায় বন্য পশুর অঙ্কিত চিত্র হলো পৃথিবীতে মানুষের আঁকা প্রথম চিত্র। মনের ভাব প্রকাশের অতি উত্তম উত্তম মাধ্যম হলো চিত্রাঙ্কন। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসা কিংবা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ভারতমাতার ছবি আমাদের সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বর্তমানে চিত্রাঙ্কন খুবই জনপ্রিয়। জেলায় বহু অঙ্কন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তবে আমার মনে হয় অনেক অভিভাবক ছেলেমেয়েদের অবশিষ্ট সময়ে দুষ্টামি বন্ধ করার জন্যই আঁকায় বসিয়ে দেন। এ কথা বলছি তার কারণ, শৈশবে যত সংখ্যক শিশু অঙ্কন শেখে, উচু ক্লাসে উঠলে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই অঙ্কন শেখা ছেড়ে দেয়। কিন্তু বর্তমান দিনে অঙ্কন যে জীবিকার জন্য একটি মাধ্যম হতে পারে তা অনেকেই বোঝেন না। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় (বেহালা), মৃণাল কান্তি গায়েন (কাকদ্বীপ), সাদিক হোসেন (মহেশতলা) প্রমূখ সুনামের সঙ্গে এই শিল্পকলার উৎকর্ষ বৃদ্ধি করেছেন বা করে চলেছেন। অঙ্কনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভাস্কর্যশিল্প। ভাস্কর্যকলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষার্থী উভয়েই সংখ্যায় খুব কম। উচ্চমানের কল্পনা শক্তি, একাগ্রতা, ধৈর্য এবং অনুরাগ না থাকলে অঙ্কনশিল্পী হওয়া যায় না। তবুও কে.জি স্কুল এবং অঙ্কন শিক্ষা কেন্দ্রগুলোর দৌলতে শিশুদের মধ্যে বর্তমানে অঙ্কনের একটা ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার শহর থেকে গ্রাম-গঞ্জ সর্বত্রই একাধিক অঙ্কন শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে এবং সেগুলোর মাধ্যমে বহু শিশু শিক্ষার্থী অঙ্কন শিখছে।
*নৃত্য শিল্প :*
প্রায় আড়াই হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে প্রাপ্ত নৃত্য ভঙ্গিমায় নারী মূর্তি প্রমাণ করে আমাদের দেশে নাচের ইতিহাস কত সুপ্রাচীন! তাই সংস্কৃতির কথা উঠলে নৃত্য বা নাচের প্রসঙ্গ আসবেই। এই নাচ বা নৃত্য এমন একটা শিল্প মাধ্যম, যার মাধ্যমে শুধু গান, সুর বা তাল নয়, শিল্পীর অঙ্গ সঞ্চালনের সাথে সাথে তার দৈহিক সৌন্দর্যও দর্শকদের সমানভাবে আকর্ষণ করে থাকে। তাই যেকোন রকম নাচ হলেই দর্শকদের ভিড় জমে যায়।
ভারতে প্রায় ১৫ ধরনের নৃত্য প্রচলিত আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছয়টি নৃত্য হল -- ভরতনাট্যম (তামিলনাড়ু ), কত্থক (উত্তর-পশ্চিম মধ্যভারত), কথাকলি (কেরল), মণিপুরী (মনিপুর), কুচিপুড়ি, ওডিসি (ওড়িষ্যা)। তবে এইসব ক্লাসিক্যাল নাচের বাইরে কিছু আঞ্চলিক নাচ আছে যেমন ছৌ (পুরুলিয়া), বিহু (আসাম), ভাংরা (পাঞ্জাব) প্রভৃতি। এখন আবার এইসব নাচের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সৃজনশীল নৃত্য। হাত পা ছুড়ে, ডিগবাজি খেয়ে হৃদকম্প সৃষ্টিকারী এই সৃজনশীল নৃত্যই এখন সর্বপেক্ষা জনপ্রিয়। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে নৃত্যানুষ্ঠান জনপ্রিয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামগঞ্জে নাচের আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার একাধিক নৃত্যশিল্পী রিয়েলিটি শো-তে অংশগ্রহণ করে সাফল্য পেয়েছে। ক্যাজুয়াল ড্রেসে সৃজনশীল নৃত্য পরিবেশন করে হাততালি পাওয়া যায় বলেই এইসব নাচের দিকে সহজেই ছেলেমেয়েরা আকৃষ্ট হয়। যদিও নৃত্যে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের অংশগ্রহণ খুব কম।
বিভিন্ন নৃত্য শিখন কেন্দ্র, যেমন -- রাহুল ড্যান্স একাডেমী (দোস্তপুর), নৃত্যায়ন ডান্স একাডেমী (ডায়মন্ডহারবার), এরকম আরো বহু নাচের স্কুল ছেলেমেয়েদের নিয়মিত নাচ শিখিয়ে চলেছে।
পরিশেষে বলা যায় সংস্কৃতিচর্চা বলতে কিন্তু শুধু নাচ-গান-নাটক কিংবা খেলাধুলাকে বোঝায় না, বিষয়টি আরো অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। আবৃত্তি, কুইজ, যন্ত্রসংগীত, পুতুল নাচ, মৃৎশিল্প, জাদু প্রদর্শনী, বিভিন্ন ধরনের বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিযোগিতা, প্রদর্শনীও সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে পড়ে। কিন্তু দুঃখের বিষয় সারা দেশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জেলাতেও এই সংস্কৃতিচর্চা ক্রমশ কমছে। সহৃদয় মানুষজনের সহযোগিতার অভাবে আয়োজক সংস্থাগুলি আজ মৃতপ্রায়। জেলা ব্যাপী সংস্কৃতি পরিমণ্ডল গড়ে তোলার দায়িত্ব যাদের, সেই সব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বা ক্লাব সংগঠন বর্তমানে নীতি-আদর্শ হারিয়ে সস্তা মনোরঞ্জনের পথে হাঁটছে। বিদ্যালয় ধ যেভাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো, বর্তমানে তা হচ্ছে না। এখন বরং হাজার হাজার বা লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে প্রথিতযশা বলিউড বা টলিউড শিল্পীদের এনে ফাংশন করার প্রবণতা বেড়েছে। ফলে গ্রাম বাংলার সংস্কৃতিচর্চা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।
সংস্কৃতিচর্চা শুধু যে জ্ঞান বৃদ্ধি করে তাই নয়, এই চর্চার মাধ্যমে মানুষ তার মনের খোরাক সংগ্রহ করে। তাই সংস্কৃতিচর্চাকে হারিয়ে যেতে দিলে চলবে না। মানুষকে কলের পুতুল না বানিয়ে, তাদের মনের সুকুমার প্রবৃত্তিগুলো যাতে সঠিকভাবে বিকশিত হয় তার জন্য কী গ্রাম, কী শহর -- সর্বত্রই সংস্কৃতিচর্চা বজায় রাখার দায়িত্ব সচেতন নাগরিকগণকেই গ্রহণ করতে হবে।
========================
তথ্যসূত্র :
১) নাট্যকার ভগীরথ গিরি (দূর্বাচটি) ও সত্যজিৎ সাঁতরা (সাগর )
২) যাত্রাশিল্পের ইতিহাস -- গৌরঙ্গপ্রসাদ ঘোষ (পুষ্প প্রকাশনী, বাঙ্গূর এভিন্যু)
৩) বাংলা যাত্রা ও ব্রজেন কুমার দে -- ডঃ রতন কুমার মন্ডল ( পুস্তক বিপনী, ২৭ বেনিয়াটোলা লেন)
.... .. .... .... ..... ......
প্রেরক : চিত্তরঞ্জন দাস
গ্রাম ও ডাক : মাথুর
থানা - রামনগর
জেলা - দক্ষিণ ২৪ পরগনা