-- ''ওই তোমার খুড়ো'' -- মেজোখুড়ি বলে। তাকিয়ে বিশ্বাস হয় না।সেই তাগড়াই চেহারা,বাবরি চুলের ঝাড়,সাপ-নাচানো বাইসেপস..... কিছুই তেমন নেই।চোখে ছানি-কাটানো চশমা,কোচকানো মুখ,হাত-পায়ের চামড়া কুমিরের মতো,মন ভরে যায় বেদনায়। কিশোরবেলা যেন ডুকরে কেঁদে ওঠে। এই তাদের হিরো জগাখুড়ো! মেলা, যাত্রা বা সিনেমা যেখানেই গাড়ি যাক তাদের হাফবুনো মোষের গাড়ির গাড়োয়ান সেই খুড়ো।আসলে সে ছিলো গাড়োয়ান - কাম - পালোয়ান।সরষের তেল মাখানো পোড়ানো বাঁশের লাঠি ছিলো তার বিশ্বস্ত অস্ত্র।
সেই ছোটোবেলায় একদিন ইন্দাস কমলা টকিজে সবাই গেছিলাম ন্যায়দণ্ড সিনেমা দেখতে।সুপারহিট ছবি, সবাই তৃপ্ত। হল থেকে বেরিয়ে কিছুটা এসে মিষ্টির দোকান পেটভরে নোনতা ও মিষ্টি নানান সুখাদ্য খেয়ে যখন বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু হলো রাত তখন প্রায় দশটা।রাস্তা কম নয় প্রায় আট কিমি।মাটির বাঁধানো রাস্তা গরুর গাড়ির চাকায় লিক পড়ে গ্যাছে, তার উপর দিয়েই গাড়ি ছুটবে।ঝাঁকুনি কমার কোনো ব্যবস্থা নেই,কেবল উঁচু করে খড় পেতে তার উপর পুরু করে শতরঞ্জি পাতা।
রাস্তাঘাট খুব নিরাপদ নয়,রাত্রে মাঝেমাঝে ছিনতাইয়ের খবর শোনা যায়।যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য ছবি শুরু হতে ঘণ্টাখানেক দেরি হয়েছিল।এদিকে সমস্যা মায়ের গায়ে গয়না খুব কম ছিল না,বাবার জামায় সোনার বোতাম আর মানিব্যাগ সবসময় ভরতি,তাই সবার মুখে চিন্তার ছাপ।আমরা তিনভাই জুলজুল তাকিয়ে আছি।
জগাখুড়ো অদ্ভুত কায়দায় একটা লন্ঠন জ্বেলে গাড়ির নীচে ঝুলিয়ে দিয়েছে।
আমি বলি,''খুড়ো এই আলোয় মোষগুলো দেখতে পাবে?''
-- ''ওরা চারপেয়ে জীব বাবু,রাত্রে ভালো দেখতে পায়।আলোটা আমাদের দেখার জন্য।''
বাবা বললেন, '' আমার বোতাম আর তোর বৌদির গয়নাগুলো কী করবো রে জগা? আর মানিব্যাগটা?''
-- ''কোনো ভয় নাই ডাক্তারদা,আমি আছি আমি থাকতে কেউ কাছেই আসতে পারবে না।''
আমরা এ-ওর মুখের দিকে তাকাই,বুক দুরদুর করে।
প্রায় অর্ধেক রাস্তা পার হয়ে গেছি, জিনকড়ার খাল পার হয়ে উপরে উঠতেই অন্ধকার ফুঁড়ে চারটে মুখ জেগে উঠলো, উদ্ধত গলায় বললো, ''এই দাঁড়াও!''
আমরা ভয়ে কেঁপে উঠি।
জগাখুড়ো বলে,''কী চাই তোমাদের ? আমাদের কাছে কিছু নাই।''
-- ''বিড়ি আর দেশলাই আগে দে,তারপর দেখি কী আছে আর না আছে!''
বাবা এক প্যাকেট সিগারেট এগিয়ে দিলেন,তিনি চেন স্মোকার।
-- ''বাবু খুব বড়োলোক মনে হচ্ছে !একেবারে সিগারেট!''
লোকগুলোর চোখ খুশিতে নেচে উঠলো।তাদের হাতের লাঠি আর বল্লম তখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
জগাখুড়ো বললো,''দাঁড়াও লণ্ঠনটা নামাই।''
গাড়ি থেকে নেমে লন্ঠন খুলে তাদের এগিয়ে দিতে গিয়ে ইচ্ছা করেই ফেলে দিল জগাখুড়ো, আর পলকে কীভাবে যেন লাঠিটা টেনে প্রচণ্ড ঘা মেরে লোকগুলোকে মাটিতে শুইয়ে দিল।তারপর চিৎকার। সবাই চিৎকার করছি।তিন-চারটে গ্রামের মানুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে ছুটে এলো।তারপর গণধোলাই আর থানায় খবর।সব মনে আছে,সে রাতের পরিত্রাতাকে
ভোলার কোনো প্রশ্নই নেই।
সে ছিল আমাদের বাড়ির দুজন বাঁধা মুনিষ মানে মজুরের একজন, গ্রামের ভাষায় মাইন্দার বা চাকর,সারাবছরের নির্দিষ্ট মাইনে,দু-বেলা খাওয়া আর দশকাঠা নিষ্কর জমি।সেবছর বেতন ছিল এগারোশো টাকা,দুটি ধুতি আর দুটো গামছা।
পরের দিন সকালে এই বীরত্বব্যঞ্জক কাজের জন্য আমার দাদু মানে ঠাকুরদা খুশি হয়ে তাকে
পঞ্চাশ টাকা বকশিশ দিলেন।আমাদের বৈঠকখানায় তখন লোক উপচে পড়ছে টাকাটা নেবার সময়
তার লজ্জানত মুখ দেখে ভেতরের বীরকে চেনা যায় না।
বহুবছর কাজের সুবাদে সে আসলে বাড়িরই একজন হয়ে উঠেছিল।
তখন গ্রামে প্রতিবছর কাবাডি শিল্ড খেলা হতো।আটদলের খেলা।দূর-দূরান্ত থেকে কাবাডি টিম খেলতে আসতো, কিন্তু কুশমুড়ির টিমে খুড়ো থাকায় কোনো টিমই জিততে পারতো না।সে ডাক নিয়ে গেলে তাকে না পারে কেউ ধরে রাখতে আবার ডাক দিতে এসে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় তার হাতে ধরা পড়লে আর নিস্তার নেই।
মাঠে যেন মেলা বসে যেত।আমরা ভয়ে ভয়ে শুধু ভাবতাম,এবার জগাখুড়োর কারিকুরি মনে হয় শেষ।অথচ ফাইনাল খেলার পর চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ও বেস্ট প্লেয়ারস ট্রফি হাতে শেষ হাসি হাসতো সেই।
একবছর খেলায় অনেক ভালো টিম যোগ দিয়েছে, কোন দল যে জিতবে এই নিয়ে জোর তর্ক বেধেছে।
ফাইনালে কুশমুড়ি ভার্সাস ফাদিলপুর খেলা,মাঠ ভরতি দর্শক।দুটো টিমই উনিশ-বিশ খেলছে।বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়েরা
গায়ে তেল জাতীয় কিছু মেখেছে মনে হয়,ওদের মেইন খেলোয়াড়কে কেউ ধরেই রাখতে পারছে না।খুড়োও ধরছে কিন্তু রাখতে পারছে না।সেই খেলোয়াড় গামছার খুঁট থেকে কী যেন বার করে দুহাতে মেখে নিচ্ছে।অনেকক্ষণ দেখার পর খুড়ো "জয় মা! " বলে দুহাতে মাঠের মাটি ঘষে নিয়ে নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়লো।এরপর জয় আসতে খুব দেরি হয়নি।কিন্তু একটা সমস্যা হয়ে গ্যালো,বিরোধীপক্ষের খেলোয়ারেরা হার মেনে নিতে পারলো না,শেষ বাঁশি বাজার
পরই তারা একসঙ্গে অন্ধ আক্রোশে জগাখুড়োর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে মাটিতে ঠেসে ধরলো।প্রায় দমবন্ধ অবস্থা হয়েছে তার,সবাই হতচকিত। কেউ ছাড়াবার চেষ্টা করার আগেই সে প্রচণ্ড জোরে দশ-বারোজন লোককে শূন্যে তুলে ছুঁড়ে দিল।আর তাতেই একজন আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।
চোখে-মুখে বারবার জল ছিটিয়েও তার জ্ঞান ফিরছে না দেখে সবচেয়ে কষ্ট পেল সেই জগাখুড়ো। গাড়িতে চাপিয়ে ইন্দাস ব্লক প্রাইমারি হেলথ সেন্টারে নিয়ে যাওয়া,সারারাত জেগে থেকে পরের দিন তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দেওয়া ইত্যাদি সব কিছু করে হিরোর মতোই সে ফিরে আসে।
গ্রামের সবাই তাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়ে গলায় মালা দিয়ে ব্যান্ড বাজিয়ে গ্রামের মানুষ গ্রাম প্রদক্ষিণ করে।
সেইসব সোনালি স্মৃতি ঝালিয়ে নিতে যে আনন্দ তা বোধহয় আর কিছুতেই নেই।মাঝেমাঝে তার দু-চোখে উথলে ওঠে জল,আমিও আবেগ সামলাতে পারি না।
সে আমাদের কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে,আমরা ভালো আছি জেনে তার কী আনন্দ!
আমার দুঃখ,তাদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি,এখনো খুড়ো ভাঙা মাটির বাড়িতে থাকে,আয়ের সংস্থানও তেমন নেই।ফেরার সময় তার হাতে কিছু টাকা দিতে গেলাম,সে কিছুতেই নেবে না।মেজোখুড়ি বোঝানোর পর নিল।
ফেরার পথে দেখা হয়ে গেল বন্ধু দ্বিজেনের সঙ্গে,পাশের গ্রামে বাড়ি। সে এখন পঞ্চায়েত সমতির সভাপতি। তাকে জগাখুড়োর সমস্যার কথা বললাম খুব কড়া ভাষায়।সে কথা দিল।মোবাইল নম্বর নিলাম।দুটো কাজ সে করে দিয়েছে, আবাস যোজনায় বাড়ি ও বার্ধক্যভাতা।এবার ওদের কষ্ট কমবে ভেবে একটু শান্তি পাই।
দুবছর পর আবার সময় পেলাম গ্রামে যেতে।জগাখুড়োর নতুন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সানন্দে ডাকি, "ও জগাখুড়ো!"
উত্তর আসে না,পাশের বাড়ির এক কাকিমা একটা চেয়ার এনে বসতে বলে।তারপর ডাকে মেজোখুড়িকে।তার বিধবার বেশ দেখে আমার হতভম্ব অবস্থা।কান্নায় সব তেতো হয়ে যায়।বহুকষ্টে ফিরি গ্রাম থেকে।চাপড়ার মাঠের পাশ দিয়ে আসার সময় বুকে ধাক্কা লাগে।পিছন থেকে কেউ ডাকে,"ও মেজোবাবু!"
চমকে পিছনে তাকাই,দেখি দূরে সাপনাচানো পেশিতে জগাখুড়ো কাবাডি খেলছে।এই ছবিটাই আমার সবচেয়ে প্রিয়।
তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলাম,আমিও তো এত ভালো কাবাডি খেললাম,তাকে এত জোরে আঁকড়ে ধরলাম কিন্তু তাকে ধরে রাখতে পারলাম কই ?! পরাজয়ের গ্লানি আর বেদনা সম্বল করে মাঠ পার হয়ে যাই।মন সেই মাঠেই পড়ে থাকে যেখানে জগাখুড়ো ডাক নিয়ে যাচ্ছে, " কাবাডি কাবাডি কাবাডি..... "
===================
গোপেশ্বরপল্লি,বিষ্ণুপুর।
বাঁকুড়া।