বিপর্যয়ের আধারে ঢেকে গেছে চারপাশ। প্রত্যাশার আলো যেন ভাতঘুম দিয়েছে। দিন যাপনের স্বপ্নগুলো এভাবেই একে একে নদীর ভাঙ্গনের মতো চুরমার। তবুও বাঁচার আকাঙ্ক্ষায় মননে ধাক্কা মার উদ্দীপনার জোয়ার। এভাবেই সুখ দুখ ঘাত প্রতিঘাত আশা নিরাশা বিবিধ প্রতিবন্ধকতার দ্বান্দ্বিকতায় চূর্ণ-বিচূর্ণ দেহ মন প্রাণের নাজুক অনুভূতিগুলো। আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চাপগুলো একেবারেই জীবনকে দুর্বিষহ ও নিষ্পেষিত করছে। মাঝে মাঝেই মনে হয় এই বুঝি জীবনের যবনিকা পাত। না হাল ছেড়ো না বন্ধু। সামনে তোমাকে এগিয়ে যেতে হবে। পড়ে আছে সুদূর পথ। অনেকটা আব্বাসের বেঁচে থাকাটা এভাবেই রোজনামচায় পরিণত হয়েছে। অনেক স্বপ্ন বুক ভরা আশা নিয়ে শিক্ষকতার পরীক্ষায় সে পাস করেছিল। ইন্টারভিউ টাও চাকরি পাওয়ার মতোই দিয়েছিল। কিন্তু প্যানেল বের হওয়ার পর দেখা গেল তার নামটা অপেক্ষমান প্রার্থীদের প্রথমদিকে তালিকাভুক্ত। অথচ তার থেকে নিচু নিম্ন মেধা সম্পন্নরা চাকরি পেয়ে মহানন্দে আয়েসের জীবন অতিবাহিত করছে। বরাবর মেধাবী ছাত্র আব্বাস স্কুল কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি প্রতিটি পরীক্ষাতেই আশানুরূপ নম্বর পেয়ে তার জাত বুঝিয়েছে। তাকে নিয়ে প্রত্যেক শিক্ষকের চরম প্রত্যাশা। তারা আব্বাসকে দৃঢ় চিত্তে বরাভয় দিয়েছিল-" তুই একদিন প্রতিষ্ঠিত হয়ে সমাজের কাজেই নিজেকে নিয়োজিত করবি। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো প্রত্যেক সমাজবদ্ধ জীবের আবশ্যিকতা"।
দেখতে দেখতে চোখের পলকে কষ্ট যাতনা লড়াই সংগ্রামকে আঁকড়ে ধরে এক বছর কেটে গেল। এদিকে অপেক্ষমান প্রার্থীদের স্কুল সার্ভিস কমিশন আর ডাকছেই না। পরিসংখ্যান মতে প্রথম প্যানেলের বেশ কিছু অনুপস্থিত প্রার্থী থাকায় অপেক্ষমানরা ইন্টারভিউ এর ডাক পাবে। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও কমিশন প্রয়োজন বোধ করেনি তাদেরকে ডাকা। সেক্ষেত্রে কারণ দেখাচ্ছে আইনি জটিলতা। অথচ সদিচ্ছা ও নিয়োগ করার মানসিকতা থাকলে আইনি জটিলতার সরলীকরণে আব্বাসের মত অপেক্ষমানরা আজ শিক্ষকতার বিষয় নিযুক্ত হয়ে মানুষ গড়ার কারিগর রূপে নিজেদের সর্বান্তকরণে মেলে ধরতো। আর পাঁচটা প্রেশার থেকেই শিক্ষকতা টাকাই সেই প্রচন্ড ভালোবেসেছিল যার নেপথ্যে যথার্থ শিক্ষাদানের মধ্যে দিয়ে সুকোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মানুষ করে তোলা। কারণ তাদের মধ্যেই মনুষ্যত্বের বিকাশে সৃষ্টি হবে দেশ গঠনের নাগরিক। কত ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা ভালোলাগা মননের গহনে তুলে রাখা ছিল। প্রতিমুহূর্তেই ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়াতে জীবনটা আজ বড় এলোমেলো। সহসা থই হারিয়ে পৌঁছে যাই নাম না জানা দেশে যেখানে নেই কোন হিংসা-বিদ্বেষ অশান্তি সংঘাত দুর্নীতি লোভ-লালসা আছে শুধু একরাশ ভালোলাগা আর উজাড় কারা প্রশান্তি।
আববাসের বাবা তাকে প্রায় সই প্রশ্ন করে-" বাবা মাস্টারের চাকরিটা তুই কবে পাবি? একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি শুনতে শুনতে তার উত্তর দেবার ক্ষমতা হারিয়ে গেছে। মরুভূমির মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে যেন তপ্ত বালু রাশিতে নিদারুণভাবে দগ্ধ হচ্ছে। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না বহু প্রতীক্ষিত মরুদ্যান। জীবনটা যেন একেবারেই অর্থহীন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। নিজেকে কিছুটা প্রস্তুত করে সবিনয়ে উত্তর দেয় বাবা আর কিছুটা অপেক্ষা করো। অপেক্ষমান প্রার্থীদের ডাকলে আমি অবশ্যই শিক্ষকতার চাকরিটা পাবো। কিছুটা বিরক্তির স্বরে বাবা বলে-" মাসের পরে বছর কেটে গেল বাবা তোর এত কষ্ট পরিশ্রম করে পড়াশোনা মূল্যটা তুই পেলি না। শুনেছি মাস্টারির চাকরিটা যেন আজকে পয়সা দিয়ে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। তোদের মত অসহায় ভালো ছেলেদের আর কিভাবে চাকরি হবে?
বাবাকে থামিয়ে দিয়ে আব্বাস বলতে থাকে--"
তুমি ওইসব কোথায় কান দিও না। ইন্টারভিউ হলে আমি নিশ্চিত আমার স্বপ্নের শিক্ষকতার চাকরিটা পেয়ে যাব।
আজ একটি একটি করে দীর্ঘ পাঁচ বছর অতিক্রান্ত। ২৩ এর আব্বাস ২৮ শে পা দিয়েছে। আইনি জটিলতা জিলাপির প্যাঁচে পরিণত হয়েছে। জট খুলছে না। মন্ত্রীরা অনেক গাল ভরা অঙ্গীকারের কথা বললেও সবকিছুতেই দায়সারা ভাব।সাংসারিক চাপ বেড়ে চলেছে। বাবার স্বাস্থ্যের অবনতিতে আব্বাসকে রীতিমতো চিন্তার সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছে। ভেবে শিউরে উঠছে কিভাবে সংসারের হাল ধরবে। স্বপ্নগুলো যেন আজ দুঃস্বপ্ন পরিণত। তিলে তিলে গড়ে তোলা ভাবনা পরিকল্পনা আজ যেন একেবারেই আবোল তাবোল। এক অদ্ভুত রহস্যময় অনুভূতি আব্বাসের দেহ মন প্রাণকে আবিষ্ট করেছে। বাঁচার প্রত্যাশা উদ্দীপনা সব যেন আজ শূন্যতার গভীরে হাবুডুবু খাচ্ছে। দিনরাত বিদ্যা আরাধনা করে ভালো ফলাফলের শংসাপত্র অর্জন করে অবশেষে আপন যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতির পাকে চক্রে পড়ে আটকে গেছে তার শিক্ষকতার চাকরিটা। ক্রমশ তীব্রভাবে বিদ্ধ হতে থাকে অবচেতন মননে। ভরে গেছে দুর্নীতির আগাছাতে চারপাশ। মেধাগুলো বিধ্বস্ত বিপন্ন অবরুদ্ধের কারাগারে ছটফট করছে।দুঃসময়ের অবসানে ফিরে আসবে স্থিতিশীলতা। সামাজিক ন্যায় নীতির ভারসাম্যে দূর হবে অনাচার নৈরাজ্যতা। আদর্শের ভাবনাকে আঁকড়ে ধরে নিরন্তর স্বপ্ন দেখে। বৃথা আশা মরিতে মরিতেও যেন মরে না।
=============================
রচনা -পাভেল আমান
গ্রাম ও পোস্ট- হরিহর পাড়া
জেলা- মুর্শিদাবাদ
পিন- ৭৪২১৬৬