নয়াযুগের নবী বিমল কর
রমলা মুখার্জী
বাংলা গল্পসাহিত্যে পুরাতন রীতি পরিবর্তন করে তাকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় উদ্ভাসিত করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক বিমল কর। খ্রিষ্টীয় পদ্ধতিতে আত্মন্মোচনের কথা, পাপ স্বীকারোক্তি ইত্যাদি বারবার উঠে এসেছে তাঁর কাহিনি মালায়, ঠিক যেন কাহিনিকার নিজের কাছে নিজেকেই উন্মোচন করছেন। চিরাচরিত প্রথা ভেঙে নবরূপে তিনি আধুনিক মননের গল্প পাঠকসমাজের কাছে হাজির করলেন। সত্য উচ্চারণের অসীম স্পর্ধা বিমল করের গল্পে প্রতিফলিত হয়ে গল্পকে চরম বাস্তবমুখী করে তুলেছে।
বিমল করের জন্ম ১৯২১ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর তাঁর মামারবাড়ি টাকীতে। তাঁর স্ত্রীর নাম গীতা কর। স্নাতক হওয়ার পর বিমল করের প্রথম গল্প 'অম্বিকা নাথের মুক্তি' প্রবর্তক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করার সময় তাঁর প্রথম বই 'ছোটদের শরৎচন্দ্র' প্রকাশিত হয়। এরপর সত্যযুগে সাংবাদিকতা করাকালীন 'দ্য স্নেক পিট' সিনেমার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি লিখেছিলেন প্রথম উপন্যাস 'হ্রদ'। ১৯৬৭ সালে রচিত 'যদুবংশ' উপন্যাসে তিনি দুই সমকামী নারী চরিত্র সৃষ্টি করে যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর লেখা ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৮১ সালের গল্পগুলি যেমন 'সে', 'ওরা', 'নিগ্রহ' ইত্যাদিতে সত্তর দশকের রাজনীতি, সমাজ, অশান্ত সময়ের ছবি সুচারুরূপে উঠে এসেছে। বিশেষ করে তাঁর 'দেওয়াল' উপন্যাসে রাজনৈতিক সচেতনতা স্পষ্টতই লক্ষনীয়। চীন-ভারতের সংঘর্ষ নিয়ে রচনা করেছিলেন 'সায়ক' নাটকটি।
১৯৭৫ সালে 'অসময়' উপন্যাসের জন্য বিমল কর একাদেমী পুরষ্কার লাভ করেছিলেন। 'অবিন' ও 'মোহিনী' এই দুই প্রধান চরিত্রের মানসিক ওঠাপড়া ও সম্পর্কের জটিলতায় আবৃত এই অসময় উপন্যাসটি। নতুন প্রজন্মকে উৎসাহ দানের জন্য তিনি 'গল্পপত্র' নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছিলেন।
বিমল করের কিছু উপন্যাস ও গল্প নিয়ে চলচ্চিত্রও নির্মাণ হয়েছে যেমন 'বালিকাবধু', 'বসন্তবিলাপ' ইত্যাদি। তাঁর 'খড়কুটো' উপন্যাস নিয়ে 'ছুটি' সিনেমাটি হয়েছিল।
বিমল করের গল্প-উপন্যাসে ঘুরেফিরে মৃত্যু চলে আসার করণ হল শৈশবে খেলতে গিয়ে নিজের বোনকে হারানোর মর্মস্পর্শি বেদনা। বিমল করের শেষ উপন্যাস 'ইমলিগড়ের রূপকথা'।
'একাদেমী' পুরষ্কার ছাড়াও বিমল কর ১৯৮১ সালে পেয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়' পুরস্কার এবং ১৯৮২ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'নরসিংহ দাস' পুরস্কার। তিনি দুবার 'আনন্দ' পুরস্কারও লাভ করেন। ২০০৩ সালের ২৬শে আগষ্ট ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সাংবাদিক বিমল করের প্রয়াণ ঘটে। কিন্তু বিখ্যাত লেখকরা তো তাঁদের অমর সৃষ্টির সম্ভারে চির উজ্বল। বিমল করের গল্প উপন্যাসের নতুনত্ব পাঠকের মনে গভীর রেখপাত ঘটিয়ে তাঁকে অমরত্ব এনে দিয়েছে। ২০২১ সালে তাঁর জন্মশতবর্ষ পালিত হল; নয়া যুগের নবী বিমল করকে জানাই অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা ও প্রণাম।
======================
ডঃ রমলা মুখার্জী,
বৈঁচী, হুগলী, পিন 712134,