প্রবন্ধ ।। অনুবাদ ও দ্বিভাষিক কবিতা ।। রণেশ রায়
অনুবাদ ও দ্বিভাষিক কবিতা
রণেশ রায়
অনুবাদ সাহিত্য সাহিত্য জগতে একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে থাকে। এক ভাষা থেকে কোন গল্প কবিতা বা সাহিত্য কর্মকে ভাবটা বজায় রেখে অন্য ভাষায় রূপান্তরিত করে পরিবেশন করলে তাকে অনুবাদ সাহিত্য বলা হয়। অনুবাদ কবিতা অনুবাদ সাহিত্যের অঙ্গ। অনুবাদ কবিতা সৃষ্টি হয় সাধারণত একটা ভাষায় লেখা কবিতাকে অন্য ভাষায় রূপান্তরিত করে তুলে ধরার মধ্যে দিয়ে। একে ভাষান্তরিত কবিতাও বলা হয় যেখানে অনুবাদকের স্বাধীনতা কিছুটা সীমাবদ্ধ থাকে অনুবাদকের সংযত আচরণের মধ্যে। অনুবাদককে খেয়াল রাখতে হয় যাতে মূল লেখকের ভাবনায় মৌলিক পরিবর্তন না আসে। অবশ্য এটা মানতেই হয় যে অনুবাদ কবিতায় অনুবাদকের অজান্তে হলেও তাঁর ভাবনার প্রভাব তাঁর অনুবাদ কাজের ওপর পড়ে। এখানেই অনুবাদ সাহিত্য তথা অনুবাদ গল্প কবিতা উপন্যাস এক স্বতন্ত্র মাত্রা পায়। নেহাত তাকে অনুবাদ বলে অগ্রাহ্য করার সুযোগ থাকে না। তবুও অনুবাদক দাবি করেন না যে কবিতার ভাবনাটি তাঁর নিজস্ব বা অনুবাদিত কবিতাটি তাঁর মৌলিক কোন লেখা।আমরা আমাদের আলোচনায় ইংরেজি কবিতার বাংলায় অনুবাদকে কেন্দ্র করে আমাদের আলোচনায় আসব।অনুবাদ কবিতা নিয়ে প্রথমে আলোচনা করে দ্বিভাষিক কবিতা নিয়ে আমি আমার ভাবনাটা তুলে ধরব।
বিভিন্ন ভাষার কবিতার অনুবাদে অনুবাদের সঙ্গে অনুবাদকের ভাবের সমন্বয় ঘটে। ভাবানুসারে বাংলায় লেখা অনুবাদ কবিতায় সেটা অব্যাহত থাকবে সন্দেহ নেই। ইংরেজি শব্দগুলোর সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ সবসময় পাওয়া যায় না। অনেক শব্দ কবিতায় চলতি অর্থে ব্যবহৃত হয় না। পুরো লেখাটা ধরে তার অর্থ বুঝে নিতে হয়। আমরা যারা অনুবাদ করি তারা শব্দ ধরে করি না । ভাবটা ধরে অনুবাদ করতে হয় । ভাবটাকে ধরে রাখার জন্য সঠিক শব্দ চয়ন জরুরি। কবিতা বুঝতে হয় তার ভাব দিয়ে। শব্দের আভিধানিক অর্থ দিয়ে সবসময় সেটাকে উপলব্ধির স্তরে নিয়ে যাওয়া যায় না। ভাবটা বজায় রেখে যে কবিতা লেখা হয় তাতে লেখকের সৃজনশীলতা প্রকাশ পায়। আর এই আত্মস্ত করার প্রক্রিয়াটা সম্পূর্ণ হয় মাতৃ ভাষায়। তাই আমরা বলি বিদেশী ভাষা নিয়ে সাহিত্য চর্চা করতে গেলে তার রস পেতে গেলে মাতৃভাষার চর্চা করতে হয় ।
বলেছি যে কোন কবিতার ভাষান্তর করা হলেও যিনি এটা করেন তাঁর ভাবনাটা নিজের অজান্তে হলেও জুড়ে যায় ভাষান্তরিত কবিতাটিতে কবির ভাবের সঙ্গে। কবিতাটি অন্য মাত্রা পায়। স্বাদটা বদলায়। এখানে যিনি ভাষান্তর করেন তাঁর স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সেটা আরও ভালো হতে পারে আবার কারও ভালো নাও লাগতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় সাহিত্য সৃষ্টিতে দুটো সংস্কৃতির মধ্যে বিরোধ ও মিলনের মধ্যে দিয়ে এক নতুন সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়।এক ভাষাভাষীর মানুষ অন্য ভাষাভাষীর মানুষের সঙ্গে মননের দিক থেকে একাত্ম হয়। বিভিন্ন কবির অনুবাদ ধর্মী তথা ভাষান্তরিত অভিন্ন ভাবধর্মী কবিতায় সেটা আমরা পাই। বোধ হয় এটাকেই সংস্কৃতায়ন বলা হয়। ইংরেজিতে একে সিন্থেসিস বলা চলে। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন কবিতায় কম বেশি কখনও শেলী কখনো ওয়র্ডসওয়ার্থ বা কখনও কিটসের প্রভাব তাঁর স্বকীয়তায় প্রস্ফুটিত।তবে সেগুলো অনুবাদ কবিতা নয়।মধুসূদনের কবিতার ভান্ডারও এই স্বকীয়তায় সমৃদ্ধ। নজরুলের কবিতায় উর্দু ভাষার অসাধারণ সমন্বয় ধরা পড়ে।তাঁদের নিজস্ব এই লেখাগুলি স্বকীয় ভাবে লেখা।সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'জেলখানার চিঠি' তুরস্ক কবি নাজিম হিকমতের কবিতার অসাধারণ ভাষান্তর। আমরা যারা রাজনৈতিক কারণে জেলে ছিলাম তাদের এই কবিতাটা হৃদয় স্পর্শ করে যায়। মনে হয় আলিপুর প্রেসিডেন্সি বা বহরমপুরের কোন জেলে বসে আমাদের কোন কমরেড এই কবিতা লিখে গেছেন। এখানেই ভাষান্তরিত অনুবাদ কবিতার তাৎপর্য, সার্থকতা। সাহিত্যের আন্তর্জাতিকরণের মাধ্যম হলো এই ধরণের কবিতা। আন্তর্জাতিকতাবাদের সাংস্কৃতিক ভিত্তি এটা। একে নেহাৎ অনুবাদ কবিতা বলে নকল বলে উপেক্ষা করার একটা প্রবণতা অনেক উন্নাসিক ব্যক্তির মধ্যে আছে। তাঁরা এর মধ্যে লেখকের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব দেখেন না। সাহিত্যকে মানবতার মহাসাগরের মোহনায় মিলতে দেখেন না। এটা খুব দুর্ভাগ্যের। এক ধরনের ভূয়া অহং এর পেছনে কাজ করে।
আন্তর্জাতিক স্তরে সাহিত্যের আন্তর্জাতিকরনে অনুবাদ সাহিত্যের ভূমিকা অনন্য সন্দেহ নেই। অনুবাদ সাহিত্যের দৌলোতেই আমাদের পরিচিতি ঘটে আন্তর্জাতিক স্তরে খ্যাত কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে। তা না হলে আমাদের হতে হত কুঁয়োর ব্যাঙ। অনুবাদ কবিতার সঙ্গে এই আন্তর্জাতিকরণের কাজটা অনেকটাই পালন করতে পারে দ্বিভাষিক কবিতাও । উপরন্তু দ্বিভাষিক কবিতা একই লেখকের দুটো ভাষায় একই বিষয়ের ওপর লেখা বলে সেটাতে লেখকের স্বাতন্ত্র বজায় থাকে। সেখানে সাবলীল ও স্বাধীনভাবে উপস্থাপনার সুযোগ অনেক বেশি। তিনি লেখা দুটিরই মৌলিক লেখক বলে স্বীকৃতি পান।অনেক বেশি স্বতন্ত্রতায় তা পরিবেশিত হতে পারে।একজন ইংরেজি জানা ফরাসি লেখককে যেমন ইংরেজিতে একই কবিতা লিখতে দেখা যায় তেমনি ফরাসি জানা ইংরেজ কবিকে নিজের ইংরেজি ভাষা ছাড়া ফরাসি ভাষায় একই বিষয় নিয়ে লিখতে দেখা যায়। উর্দু জানা এমন অনেক বাঙ্গালী কবি আছেন যারা বাংলায় লেখা নিজের কবিতা উর্দুতে লেখেন। মধুসূদন দত্তকে দেখা যায় একই ভাব নিয়ে লেখা কবিতা বাংলা আর ইংরেজিতে লিখতে। দ্বিভাষিক কবিতায় একই বিষয় নিয়ে দু'টি ভাষায় লেখা কবিতায় শব্দ চয়ন ছন্দ ও উপমা ব্যবহারে কবি অনেক বেশী স্বাধীনতা ভোগ করেন ।
সাধারণত কোন সাহিত্যিক প্রধানত তাঁর মাতৃভাষায় সাহিত্য চর্চা করেন। গল্পকার বা প্রবন্ধকার মাতৃভাষায় গল্প প্রবন্ধ লেখেন। কবি মাতৃভাষায় কবিতা লেখেন। কবি মাতৃভাষাতেই নিজের কল্পকথাকে কথামালায় সাজিয়ে নান্দনিক করে তুলতে পারেন, তাঁর লেখা রণনিত হতে পারে ঝঙ্কৃত হতে পারে মাতৃ ভাষাতেই। তবে মাতৃভাষায় তিনি নিজের লেখায় নিজেকে অন্য ভাষাভাষী মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারেন না। সেটার জন্য দরকার হয় লেখকের লেখা ভিন্ন ভাষায় ভাষান্তর তথা অনুবাদ করে দেওয়ার। সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অন্য কেউ করে দেন। সেক্ষেত্রে অনুবাদকের ভাবনা যুক্ত হয়ে যায় মূল লেখকের ভাবনার সঙ্গে। ফলে মূল লেখক যেভাবে বলতে চান সেভাবে লেখাটি প্রতিভাত না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই অবস্থায় লেখক একাধিক ভাষা জানলে নিজে একই ভাবনা একই বিষয়বস্তু নিয়ে একাধিক ভাষায় গল্প কবিতা বা প্রবন্ধ লিখতে পারেন, দুটো ভাষায় একই ভাবনা লেখকের মনোমত সেজে উঠতে পারে। আমরা যারা দুটো ভাষা জানি যেমন ইংরেজি আর বাংলা তারা একই বিষয় দুটো ভাষায় লিখতে পারি আবার একটা থেকে আরেকটা অনুবাদ করতে পারি। কিন্তু যে কোন অনুবাদকের অনুবাদ করা কবিতা বা গল্প কখনও তার নিজস্ব মৌলিক লেখা বলে গণ্য হয় না। একটা আরেকটার নেহাত অনুবাদ বলে বিবেচিত হায়। কিন্তু দুটি ভাষায় একই ভাবনায় দুটো লেখাই যাকে আমরা দ্বিভাষিক কবিতা বলছি তা লেখকের দু'টো নিজস্ব লেখা বলে গণ্য হয়।
ভারতের মত একটা বহুভাষিক দেশে বিষয়টা বিশেষ গুরুত্ব পূর্ণ। শুধু বিদেশবাসি নয় একই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যোগসূত্র গড়ে তুলতে এই দ্বিভাষিক সাহিত্যচর্চা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে আজও ভারতে ইংরেজিকেই অনেক রাজ্যে দ্বিতীয় ভাষা বলে মনে করে। এমন কি ইংরেজিকে প্রথম ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার বিকল্প রাখা হয় যার প্রতি বহু মানুষের একটা আনুগত্য আছে। অনেক সময় দেখা যায় বিদেশী কোন ভাষা দীর্ঘদিন চর্চার ফলে কোন একটা গোষ্ঠীর কাছে সেটা মাতৃ ভাষার মত হয়ে যায় তা আর বিদেশী ভাষা থাকে না। আমাদের দেশে শিক্ষিত সমাজে ইংরেজিকে প্রথম ভাষা হিসেবে গণ্য করার একটা প্রবণতা আছে। এই অবস্থায় দ্বিভাষিক সাহিত্য চর্চার একটা আলাদা তাৎপর্য থাকে। সেটা আলোচনা করে নেওয়া যেতে পারে সাহিত্য চর্চার বিষয়টা সামনে রেখে।
এবার আসা যাক দ্বিভাষিক কবিতা প্রসঙ্গে। দ্বিভাষিক কবিতা যেন একটি পাখির দুটি ডানা। একটি মাতৃভাষা একটি বিদেশী ভাষা। আমার আজকের আলোচনার কেন্দ্র বিন্দু বাংলা আর ইংরেজি ভাষায় একই লেখকের লেখা কবিতা। দুটি ভাষায় কোন সাহিত্যিকের সাহিত্য চর্চা যেন দুটি ডানা---- ডানা মেলে ওড়ে আকাশে। গেয়ে চলে সুর ছন্দ লয়ে। আলোচনা প্রসঙ্গে অনুবাদ কবিতার বিষয়টিও এসে পরবে।
একই লেখকের লেখা একই ভাবনায় সমৃদ্ধ কবিতাকে দুটি ভাষায় পরিবেশন করা হলে তাকে আমরা দ্বিভাষিক কবিতা বলে উল্লেখ করছি। একে ঠিক অনুবাদ কবিতা নয় বরং নিজের ভাবনায় লেখা দু'টি ভাষায় দু'টি কবিতা বলা চলে যাকে আমরা দ্বিভাষিক কবিতা বলছি। এর ওপর আলোচনা সম্পর্কে আমার পড়াশুনা করা নেই । জানি না বিষয়টা নিয়ে আগে কোথাও কোন আলোচনা হয়েছে কী না। বিষয়টা নিয়ে আমি যেভাবে ভেবেছি তাই লিখছি। আমার এই প্রচেষ্টাকে কেন্দ্র করে বিস্তারিত আলোচনার দরজা খুলে যাক। বিষয়টা নিয়ে বিতর্ক উঠুক আমি চাই কারণ সাহিত্যের বৃহত্তর স্বার্থে সেটা জরুরি। এই প্রসঙ্গে অনুবাদ কবিতা আর দ্বিভাষিক কবিতার মধ্যে আমি পার্থক্যটা যেভাবে ভেবেছি সেটা তুলে ধরছি। সাহিত্যের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দ্বিভাষিক কবিতার গুরুত্বটা বোঝার চেষ্টা করব।
প্রথমেই বলে রাখি এই বিরাট ভারতের একটা প্রদেশের কোন এক ভাষাভাষীর বেশীর ভাগ মানুষ অন্য প্রদেশের সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের চেনেই না, নামও শোনেনি। এমনকি একটা ভাষায় সাহিত্য চর্চা করা সাহিত্যিক অন্য ভাষায় সাহিত্য চর্চা করা মানুষকে চেনেন না বা তারাও এই সাহিত্যিককে চেনে না। তাই ভারতের মত দেশে সাহিত্য চর্চা সমগ্র দেশের পরিপ্রেক্ষিতে খণ্ডিত সাহিত্য চর্চা হিসেবে থেকে যায়। তা দেশীয় চরিত্র পায় না, সংকীর্ণ প্রাদেশিকতার সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে। এখনও ভারতে বাস্তবত একক কোন ভাষা দেশীয় ভাষা বলে বিবেচিত হয় নি যদিও হিন্দিকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।প্রতিটি প্রদেশে প্রাদেশিক ভাষা চর্চার সঙ্গে ইংরেজি ভাষা চর্চা প্রাধান্য পায়। তাই দ্বিভাষিক কবিতার ক্ষেত্রে প্রাদেশিক ভাষার সঙ্গে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য চর্চাই প্রধান ভারতের ক্ষেত্রে। দ্বিভাষিক কবিতা চর্চায় সেটাই প্রাধান্য পায়। আজকেও দেখা যায় আন্তর্জাতিক স্তরে তো বটেই ভারতের মত দেশে দেশের মধ্যেও সাহিত্যিক থেকে যান একান্ত নির্জনে তার ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। অঞ্চলের বাইরে তাকে পরিচিত হতে গেলে তার সাহিত্যের অনুবাদ দরকার যা নিয়ে তিনি বিশ্ব সাহিত্যের প্রাঙ্গণে উপস্থিত হতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন গীতাঞ্জলির মাধ্যমে নোবেলের দরবারে উপস্থিত হয়েছেন। সেখানে তিনি নিজের কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। ঠিক অনুবাদ না বলে দ্বিভাষিক কবি হিসেবে অবতীর্ণ হন বলে মনে করা যেতে পারে। বিশ্ব সাহিত্যের ক্ষেত্রে নামকরা বিশ্ব সাহিত্যিকদের গল্প উপন্যাস কবিতা ভিন্ন ভাষায় উপস্থাপিত হয় যা সাহিত্যিককে বিশ্বের দরবারে হাজির হতে সাহায্য করে। আঞ্চলিক সাহিত্য আন্তর্জাতিক চরিত্র পায় যা সাহিত্যের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটাতে সাহায্য করে, সাহিত্যের আন্তর্জাতিকরন ঘটে।
আমার সাহিত্য চর্চায় স্বরচিত কবিতা ছড়ার সঙ্গে বেশ কিছু অনুবাদ কবিতা আর দ্বিভাষিক কবিতা গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছে। অন্তত আমার পরিশ্রমের অনেকটাই এদের ঘিরে।এর গুণগত মান বিচার করবেন পাঠকবৃন্দ। সমস্যা হল অনেকে একটাকে অন্যটার অনুবাদ বলে ভাবেন। দ্বিভাষিক কবিতার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আমার কাছে তা নয়। আমার যদি কোন ভাবনা মনে আসে তখন ইংরেজিতে লেখার ইচ্ছে হলে ইংরেজিতে লিখি। কিন্তু ভাবনাটা আমার সঙ্গে এমন মেলবন্ধনে আবদ্ধ যে অন্য কোন সময়ে মনে ভাবনাটার আবার উদ্রেক হওয়ায় স্বপ্রণোদিত হয়ে সাবলীলভাবে ইংরেজীটা সামনে না রেখেই তা বাংলায় লিখি।এ ব্যাপারে নিজেকে অন্যের ভাবনায় তার লেখাকে ধরে রেখে সংযত হওয়ার তাগিদ বোধ করি না। শব্দ চয়নে উপমা ব্যবহারে অনেক বেশি স্বাধীনতা পাই। আবার একই ভাবে বাংলায় লেখা কবিতাকে ইংরেজি কথামালা সুর ছন্দে সাজাবার চেষ্টা করি।
উল্লেখযোগ্য যে আমার এই দ্বিভাষিক কবিতা লেখার ব্যাপারে যে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ যুগিয়েছে সে হল বন্ধুবর লেখক মুকুল ভট্টাচার্য। সত্যি কথা বলতে কী ইংরেজিতে আমার শব্দ ভান্ডারের দৈন্যতার জন্য প্রথমে আমি একটা আধটা লিখে আর লিখতে ভরসা পাচ্ছিলাম না। মুকুল আমাকে বলে তোমার ইংরেজি লেখায় একটা সাবলীলতা আছে একটা স্বতস্ফূর্ততা দেখা যায় যা তোমাকে ইংরেজিতে কবিতা লিখতে সাহায্য করে।কাজেই তুমি চালিয়ে যাও। আমার পড়াশুনার জীবনে আরেকটা প্রতিবন্ধকতা ছিল অভিধান দেখে শব্দ বাছাইয়ে অনীহা।আমি মুকুলের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে অভিধানের সাহায্যে শব্দ বাছাইয়ে মন দিই। আমি অনুবাদ কবিতার সঙ্গে দ্বিভাষিক কবিতা লেখায় আগ্রহী হয়ে উঠি।গুগল এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করে সন্দেহ নেই। এই প্রসঙ্গে আমি আমেরিকাবাসী বান্ধবী জয়ন্তী আর বন্ধু অভিজিতের নাম করতে গর্ব বোধ করছি। জয়ন্তী একজন বাঁচিক শিল্পী। অভিজিৎ ভালো আবৃত্তি করে। আমার খেয়াল বশত বন্ধুবর সব্যসাচী দেবের লেখা বিখ্যাত বাংলা কবিতা 'কৃষ্ণা'র ইংরেজিতে অনুবাদ করা কবিতাটা জয়ন্তী আবৃত্তি করে যা আমার কানে অনুরণিত হয় কবিতাটির ছন্দ আর ধ্বনিতে । আমার আত্মবিশ্বাস বাড়ে। ভাবতে থাকি আমি পারি। কয়েকটা বাংলা কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করার পর দ্বিভাষিক কবিতা লেখায় মন দিই যার ফলশ্রুতি আজের এই বই। ইতিমধ্যে আমি শেক্সপিয়রের যুগ থেকে আজকের লেখা বিভিন্ন ইংরেজি কবিতার অনুবাদ করি। এর মধ্যে কয়েকটির ক্ষেত্রে অনুবাদ নয় কবিতার ভাবান্তর ঘটে। উল্লেখযোগ্য যে আমাদের পছন্দ না করা অনেক বিষয়ের মধ্যে ভালো কিছু দিক থাকে যা আমরা আমাদের চর্চায় অজান্তে হলেও স্বীকার করে নিই বা নিতে বাধ্য হই। যেমন আমার দ্বিভাষিক কবিতায় ইংরেজি ভাষার ভূমিকা। ব্যক্তিগত ভাবে আমি ব্যবসার জগতে কর্পোরেট স্বার্থে শিক্ষার জগতে ইংরেজিকে চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধী। আর এর চাপে বাংলা ভাষা চর্চার অধগতিকে মেনে নিতে পারি না। আমার মনে হয় বিদেশী ভাষাকে আত্মস্থ করতে সাহিত্যে তার ভূমিকাকে তুলে ধরতে গেলেও মাতৃ ভাষার নিবিড় অনুশীলন দরকার।শেষ জীবনে মাইকেল মধুসূদনের উপলব্ধিতে সেটা ধরা পড়ে। তিনি মাতৃভাষায় সাহিত্য চর্চায় ফিরে আসেন। আন্তর্জাতিক স্তরে মাতৃ ভাষাকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার ব্যাপারে ইংরেজি লাতিন উর্দু ভাষার ভুমিকা অস্বীকার করা যায় না। তাছাড়া ভাষা নিজেই বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায়। শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন দিক যেমন শব্দ ছন্দ তাল লয় মাতৃভাষার সঙ্গে মেল বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ভাষা বহুমাত্রিক হয়ে দাঁড়ায়। যেমন আজকের বাংলা ভাষায় সংস্কৃত উর্দু হিন্দি ইংরেজি ল্যাটিন শব্দের প্রচলন সমধিক। আর দ্বিভাষিক সাহিত্য চর্চা এই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ভাষা আর দেশ কালের গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। অঞ্চলের গন্ডি ছাড়িয়ে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সাহিত্যের আঙিনায় প্রবেশ করে যা সমাজ মুক্তির পথ খুলে দেয়।
নিচে একটা কবিতার মাধ্যমে ওপরে আলোচিত দ্বিভাষিক কবিতা নিয়ে আমার ভাবনাটা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম:
আমার ভাবনার ছন্দ লয়ে
দুই বন্ধু অকৃত্রিম বন্ধনে
ডানা মেলে ওড়ে আকাশে,
আমার কবিতা সে যে।
অবিরাম চলা তার, পথিক সে-----
পথে পথে বাতি জ্বালে
সে ভেসে চলে উজানে
এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে
ভাষা থেকে ভাষান্তরে
দেশ থেকে দেশান্তরে।
ফুলের পাপড়ি ডানা মেলে,
রামধনু রঙে রঞ্জিত সে;
জন কোলাহলে গানে গানে
দু'টি ডানায় কবিতা আমার
নেচে চলে সমুদ্রের ঢেউ এ ঢেউ এ।
ওপরে আলোচনায় আমরা অনুবাদ কবিতা আর দ্বিভাষিক কবিতার মধ্যে পার্থক্যটা তুলে ধরেছি।অনেকেই হয়তো এই পার্থক্য করার বিষয়টা মানবেন না। তাঁরা মনে করতে পারেন একটা ভাষায় লেখা কবিতা ধরে অন্য ভাষায় তাকে রূপান্তরিত করা হয়েছে। বিষয়টা অনুবাদ ছাড়া কিছুই নয়।কিন্তু আমি মনে করি অনুবাদ আর দ্বিভাষিক কবিতার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে আমি যেটা স্বল্প পরিসরে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয় ব্যাপ্তিতে ও গভীরতায় দ্বিভাষিক কবিতা অধিকতর ব্যাপ্ত ও গভীর। দ্বিভাষিক কবিতায় লেখকের বিচরণ ক্ষেত্র অনেক প্রসারিত। একই ভাবনা নিয়ে লেখা হলেও দ্বিভাষিক কবিতায় লেখকের কল্প কথা প্রসারিত হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি।লেখকের মৌলিক ভাবনা ফুটে উঠতে পারে, তার ভাবনার বৈচিত্র্য ধরা পড়ে। কিন্তু অনুবাদ কবিতায় কবিকে সংযত থেকে তাকে সীমিত রাখতে হয়। তাঁর স্বাধীনতা সীমিত।
আমার এই সীমিত আলোচনায় এর অন্য বিভিন্ন দিকগুলো নিয়ে সবিস্তার আলোচনার সুযোগ নেই। এখানেই ইতি টানতে হলো।