হিটলার : ইতিহাসের এক বিতর্কিত চরিত্র
জয়শ্রী ব্যানার্জি
ক্ষমতা দখলের পর থেকে অ্যাডলফ হিটলার (Adolf Hitler) হয়ে ওঠেন এক দুর্দমনীয় অত্যাচারী শাসক। তারই পরিণতিতে জার্মানির দিকে গড়ে ওঠে বন্দিশালা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। হিটলার বিরোধী এই একটি মাত্র অভিযোগ তা সত্য হোক বা মিথ্যা হোক কারো বিরুদ্ধে উচ্চারিত হলে এবং খবরটা নাৎসি অফিসারদের কানে গেলেই তার আর বাঁচোয়া ছিল না। গেস্টাপো বাহিনী সেই অভিযুক্তকে ধরে নিয়ে গিয়ে বন্দী করে রাখত বন্দী শিবিরে অকথ্য নিপীড়নে কেউ মারা যেত কেউবা খুন হতো সৈন্যদের হাতে। আবার কেউ দীর্ঘদিন ধরে বন্দী জীবন যাপন করত।
'I was Hitler's mind' গ্রন্থে লেখিকা শ্রীমতি পলিন কোলার বন্দী হয়ে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আসলে অসহনীয় অত্যাচার নিজে যেমন সহ্য করেছিলেন তেমনি অপর বন্দিনীদের ওপর অমানুষিক অত্যাচারের দৃশ্য দেখেছিলেন।
তিনি তখন সদ্য বিবাহিতা।আর সেই সময় জার্মানি জুড়ে রাজনীতির উত্তাল অশান্ত ঝোড়ো হাওয়া বইছে । হিটলার বিরোধী এই মিথ্যা অভিযোগে লেখিকা পলিন-কোলারের স্বামীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং তাঁকে বন্দী করা হয়। এর পর তিনি স্বামীর আর খোঁজ পাননি । তখন মাত্র তিন সপ্তাহের দাম্পত্য জীবন তাঁদের । এর কিছুদিন পর লেখিকা কেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাকে বন্দী করা হয় সদ্য পিতা মাতা ও স্বামীহারা পলিনকোলার ছিলেন মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে তাকে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করা হতো। মিউনিখের মহিলা জেলখানায় নারী বন্দীদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করতো নাৎসি রক্ষীরা। এখানকার পুরুষরা যৌন ব্যাভিচারী ছিলেন এবং অত্যন্ত বিকৃত রুচি পোষণ করত।
বিশ্ব ত্রাস হিটলার । আবার বহু নারীর ক্রাশও ছিলেন । তাঁর বাঁদী ছিলেন লেখিকা । কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল হিটলারের প্রাসাদে। সেখানে তাঁকে পরিচারিকার কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল ।
বেরস্টেসগ্যাডেনের প্রাসাদে হিটলারের বাসস্থান হলেও হিটলারের আরো একটা গোপন বাসস্থল ছিল। বেরস্টেসগ্যাডেন প্রাসাদের দৃষ্টি সীমানার মধ্যে ৬ হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের মাথায় বসানো রয়েছে একখানা ছোট ফ্ল্যাট ।লোহা আর কাঁচ দিয়ে তৈরি। একখানা রান্নাঘর একখানা চওড়া শোয়া-বসার ঘর চারধারে দেওয়ালে কাঁচ লাগানো এই ঘরে বসে আল্পস পর্বতের মহান সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় ।পাহাড় কেটে একটা একটা লিফট ওঠা নামার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই লিফটে চড়ে হিটলার পৌঁছে যায় ফ্ল্যাটের নাম' ঈগল পাখির বাসা'। এ ফ্ল্যাটে হিটলার ছাড়া আর কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল এই নির্জনে বসে হিটলার বিশ্বজয়ের পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন। জানা যায় এখানে দুজন বিদেশি একবার প্রবেশ করার অনুমতি পেয়েছিল। ইউনিটি ইউফোর্ড নামের একটি মেয়ে যার সাথে হিটলারের গোপন প্রেমের সম্পর্ক ছিল, আর মুসোলিনির জামাই কাউন্ট সিয়ানো। আর এই সব জায়গায় সবসময় মজুত থাকতো হিটলারের ডামি। একসাথে বোধায় ৭ টা ছিল ।
হিটলার ছিলেন অজস্র ক্ষমতার অধিকারী, কিন্তু তার মন সবসময় এক অজানা মৃত্যু ভয়ে ভীত ছিল। অদৃশ্য বিশ্বাসঘাতক এবং হত্যাকারীদের আকস্মিক আক্রমণের ভয়ে তাঁকে নিজের চার ধারে এক অতন্দ্র প্রহরার প্রাচীর তুলতে হয়েছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন এবং নাজি জেনারেলরা ছাড়া সহজে কেউ তার সাথে দেখা করতে পারতেন না। গোটা প্রাসাদটা ছিল এক দুর্ভেদ্য দুর্গ। রক্ষী গেস্টাপোদের চোখে ধুলো দিয়ে দিনে রাতে কোন সময় এই প্রাসাদ কোন মানুষের পক্ষে ঢোকার সম্ভব নয়। এছাড়াও হিটলারের দরজায় একটা বৈদ্যুতিক চোখ লাগানো আছে। কোন লোক কোন লোহার তৈরি হাতিয়ার নিয়ে এই ঘরের দিকে পা বাড়ালেই দরজার চোখটা দেখে ফেলবে এবং সজোরে বৈদ্যুতিক ঘন্টাগুলো বেজে উঠবে। সচকিত রক্ষীরাও ছুটে আসবে মুহূর্তের মধ্যে। নিজেদের নিরাপত্তা সম্পর্কে হিটলার নিজেও খুব সচেতন ছিলেন। তার পড়ার টেবিলের একটি লাল রঙের বোতাম ছিল কোনো রকম সন্দেহের ব্যাপার ঘটলেই হিটলার বোতাম টিপে দেবেন এমন ছিল । আর অমনি ধুন্ধুমার কান্ড ঘটে যাবে গোটা প্রাসাদে। হিটলারের নিজের ঘরখানা ছাড়া সব ঘরে কাঁদানি গ্যাস হু হু করে ঢুকবে কয়েকশো গজ দূরের সৈন্য ব্যারাকে পাগলা ঘন্টা বাজতে থাকবে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারণাস্ত্র হাতে সৈনিকরা ছুটে আসবে।
হিটলার এর স্টাডি রুমে অজস্র দেশ-বিদেশের মানচিত্র ছিল সেখানে বসে তিনি বিশ্বজয়ের জন্য অভিযানের খসড়া তৈরি করতেন আর এই মানচিত্র ঘরে নাৎসি জেনারেলদের নিয়ে সভা বসত। এখানে ছিল একটা ছোট খাটো সিনেমা হল । জেনারেলদের নিয়ে সেখানে মাঝে মাঝেই দেখা হতো নিষিদ্ধ নীল ছবি । সেই প্রাসাদে পরিচারিকাদের সাথে যে অমানুষিক মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের চিত্র পাই তা লেখার মত ভাষা আমার জানা নেই।
জানা যায় গেলি রুবল (Angela Maria "Geli" Raubal) নামে এক মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন হিটলার । সম্পর্কে ছিলেন তিনি আত্মীয়া তাই বাড়ি থেকে সেই প্রেমকে কেউ স্বীকৃতি দেননি।
গেলি আত্মহত্যা করেছিলেন । গেলিকে হারিয়ে হিটলার ও একসময় আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকেছিলেন। রাজনীতি তখন তাঁর মাথায় উঠেছিল ।
অনেক বছর পর হিটলার আবারও প্রেমে বাঁধা পড়েন জার্মানির নামকরা সুন্দরী অভিনেত্রী রেনেট মুলারের সাথে । প্রবল শারীরিক প্রেমে এক সময় হিটলার জানতে পারেন অভিনেত্রী রেনেট তাঁর সাথেও অভিনয় করেছেন। হিটলারের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে ছিল শুধুই উচ্চাশা। অর্থ আর প্রতিপত্তি।ভালোবাসা কিছুই ছিল না । রেনেটের মনের মানুষ এক সুদর্শন ইহুদি যুবক। হিটলার ছিলেন শুধুই তাঁর শয্যাসঙ্গী ।খেলার সামগ্রী। সেই কাহিনী থেকে জানা যায় নিষ্ঠুর হিটলারের মনও ছিল একসময় এক দুর্বার প্রেমের পিপাসী। আর তা নারী হৃদয়ের । রেনেটের অভিলাষ জেনে যাওয়ার পর সম্পর্ক ভাঙনের দিকে এগোয় । রেনেট জানালা থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন ।
নারীদের প্রতি মন বিমুখ হলেও নারী শরীর বিমুখ ছিলেন না । নারী সাহচর্যে তিনি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন । আর হয়ে উঠছিলেন সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতা প্রিয় ইহুদি বিদ্বেষী নিষ্ঠুর এক শাসক।
হিটলারের প্রাসাদে এই সব সঙ্গিনীদের মধ্যেই এক জন দয়ালু ছিলেন লেখিকা পলিন কোলারের পতি। তারই সাহায্যে হিটলারের প্রাসাদ থেকেও তিনি বেরোতে পেরেছিলেন অবশেষে । এবং বহু ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এক ইহুদি ক্যাম্পে পৌঁছান । সেখান থেকেই নানা চেষ্টায় অবশেষে তাঁর স্বামীর খোঁজ পান এবং শেষ অব্দি তাঁদের দেখা হয় । দুজনেই তখন জরা জীর্ন। কিন্তু ভালোবাসা শেষ হয়ে যায়নি ।
১৯৩৯... সেপ্টেম্বর মাস তখন দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে হিটলারের বিশ্বজয়ের স্বপ্ন ।যুদ্ধের পরিধি ক্রমশঃ বাড়ছে । সোভিয়েত বাহিনীর সাথে তখন হাত মিলিয়েছে মার্কিন বাহিনী । সেকেন্ড ফ্রন্টের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল নাজী বাহিনী ।
হিটলার জীবনের শেষ অঙ্কে পৌঁছে বুঝেছিলেন তাঁকে ঘিরে এক ভয়ানক চক্রান্ত হচ্ছে । এর মধ্যমণি ছিল গোয়েরিং । একসময়ের ডান হাত । নাজি বাহিনীতে ছিল তাঁর ক্ষমতা হিটলারের পরেই ।সেই চিরকালীন ক্ষমতা লাভের আর লোভের লড়াই। সেই বিশ্বাস ঘাতকদের দলে ছিলেন আর এক কাছের মানুষ বোর ম্যান । তিনি ও চেয়েছিলেন হিটলারের জায়গা ছিনিয়ে নিতে।
বিশ্বাসঘাতকতা এবং দুর্নীতি ঠিক কোন অবস্থায় পৌঁছেছি তা বুঝতে পারলেন হিটলার। বাইশে এপ্রিল বাঙ্কারে খবর এলো যে জেনারেল স্টিনার হিটলারের আদেশ মত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি এগিয়ে আসা সোভিয়েত বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে ! হিটলারের আদেশ ছিল জার্মানদের কাছে অমোঘ ।
হিটলারের আদেশ অবাধ্যতার শাস্তি ফায়ারিং স্কোয়াডের সৈনিকদের গুলিতে মৃত্যু। কিন্তু বাঙ্কারে হিটলার তখন ক্ষমতাহীন এক শার্দুল। এদিকে তখন সোভিয়েত বাহিনী শহরতলীতে ঢুকে পড়েছে।
এরপর দ্রুত যুদ্ধের অবস্থা পরিবর্তিত হতে লাগলো বাঙ্কারে জার্মান সেনানায়কদের সংখ্যা আরো কমে গেল হিটলারের কাছে খবর এলো হেনরিক হিমলার সন্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছেন মিত্রশক্তির দপ্তরে।
২৮ এপ্রিল গভীর রাতে হিটলার সঙ্গিনী ইভা ব্রাউনকে স্ত্রীর মর্যাদা দান করলেন সংক্ষিপ্ত বিবাহ উৎসব শেষ হলো। এরপর ২৯ এপ্রিল শেষ আলোচনা সভা বসলো বাঙ্কারে তখন রাত দশটা সভাতে হাজির ছিলেন গোয়েবলস, বোরম্যান ক্রেবস ,আর ভন বিলো। সূর্যের আলোর মত স্পষ্ট তখন জার্মানির পরাজয় ,যে কোন সময় বার্লিনের এর পতন ঘটবে ।
৩০শে এপ্রিল চারদিকে থমথমে পরিবেশ । ইভা ব্রাউনকে সঙ্গে নিয়ে হিটলার দীপ্ত পদক্ষেপে ঘরে ঢুকলেন দরজা বন্ধ হল কয়েকটা মুহূর্তের জন্য সবাই নিস্তব্ধ। মূক!
প্রাসাদের মাথার উপরে তখন চক্রাকারে ঘুরছে সোভিয়েত বিমানগুলো মাঝে মাঝে বোমার বিস্ফোরণ ঘটছে বার্লিন শহরের বুকে সোভিয়েত ফাইটার বিমানগুলো আকাশ-পট দেখিয়ে বিজয়ীর ইঙ্গিতে উড়ছে ।
আর বাঙ্কারে তখন কেউ তার কর্মফল নিয়ে অজানা কোনো গ্রহে হয়তো ....! তাঁর কথায় " ভালবাসা না করে যুদ্ধে যাও হয় তুমি পরাজিত হবে, না হয় মরবে কিন্তু ভালোবাসায় পরাজিত হলে না পারবে তুমি বেঁচে থাকতে, না মরে যেতে "!
.......................................
তথ্য সংগ্রহ - ' I was Hitler's mind' এবং অন্যান্য নানা তথ্য ও ইতিহাসের গ্রন্থ থেকে ।
ছবিঋণ - ইন্টারনেট।
==============================
জয়শ্রী ব্যানার্জি ,পাল্লারোড, পূর্ব বর্ধমান।