অনন্য রাধাকৃষ্ণণ
মিঠুন মুখার্জী
শিশুর শৈশব গড়ার সময়। সে থাকে সাদা খাতার মতো স্বচ্ছ। তাকে যে পরিবেশে যেভাবে গড়ে তোলা হবে, সে সেভাবেই মানুষ হবে। কথায় বলে, গোড়া মজবুত হলে যতই ঝড়-জল আসুক না কেন গাছ যেমন ভেঙে যায় না, তেমনি মানুষের জীবনে শৈশবে ঠিকমতো দেখাশোনা করলে ভবিষ্যৎ তত উজ্জ্বল হয়। তবে সবকিছুই যেটুকু প্রয়োজন সেটুকুই দেওয়া ভালো। নতুবা অপচয় হবে। না চাইতে শিশু সব পেয়ে গেলে জিনিসের মূল্যটাই বোঝেনা। কিছুটা অভাবও শিশুকে মানুষ হতে সাহায্য করে। যদিও সবার শৈশব একরকম কাটে না। প্রয়োজন অনুযায়ী অনেক শিশু কিছুই পায় না। ভারতবর্ষে এমন অনেক শিশু আছে যারা একবেলা ঠিক মতো খেতেও পায় না। আজ এমনই একজন শিশুর কথা বলব, যার জীবনটা ছিল অন্যান্য শিশুদের থেকে অনেকটা আলাদা।
জন্মসূত্রে অসাধারণ মেধাবী ছিল সে। তার বয়সী ছেলেমেয়েদের থেকে পাঁচ বছর চিন্তায় ও মেধায় সে এগিয়ে। তাই প্রথম ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে যাওয়ার পর শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বোর্ডে কোন কিছু পাতিয়ে সবাইকে করতে দিলে কয়েক সেকেন্ডে সে উত্তর লিখে জমা দিত। শিক্ষকরা তার আই কিউ ও মেধাকে অনুভব করে অবাক হয়ে যেতেন। একদিন ছেলেটির পিতা ও মাতাকে ডেকে শিক্ষক-শিক্ষিকারা বলেন--- "আপনার ছেলে অনন্য। এই বয়সই ছেলেদের থেকে চিন্তা-ভাবনায় ও মেধায় অনেক এগিয়ে। আমরা চাই সামনের বছর ওকে আপনারা ক্লাস থ্রিতে ভর্তি করেন। ও এ দেশের আশ্চর্য শিশু।" ছেলেটির পিতা-মাতা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এই উৎসাহ দেখে অবাক হয়ে যান। প্রধান শিক্ষক মহাশয়ও তাদেরকে ডেকে বলেন--- "আমি একদিন তৃতীয় শ্রেণীর ক্লাসের সামনে দিয়ে গ্ৰন্থাগারে যাচ্ছিলাম। তখন টিফিন চলছিল। যে যার মতো বাইরে খেলা করছিল। যাওয়ার সময় দেখি বোর্ডে একটা অংক করতে দেওয়া হয়েছে। ফেরার সময় দূর থেকে দেখি একটি ছোট্ট ছেলে বোর্ডের অংকটা ছবির মতো সাজিয়ে দিচ্ছে। আমি এগিয়ে গিয়ে দেখি আপনাদের ছেলে রাধাকৃষ্ণণ। অংকটা ওর পক্ষে অসম্ভব ছিল। কিন্তু ওর মেধা দেখে বুঝতে পারি ও আর পাঁচটা ছেলের মতো নয়। আপনাদের ঈশ্বর রত্ন দিয়েছেন। সঠিকভাবে নজরে রাখবেন। অবহেলায় নষ্ট করে ফেলবেন না।" রাধাকৃষ্ণণের বাবা-মা ছেলের প্রশংসা ও সম্ভাবনার কথা শুনে খুব আনন্দ পান। রাধাকৃষ্ণণের পিতা শিশির মুখোপাধ্যায় ও মাতা স্বপ্না মুখোপাধ্যায়। পিতা হাইকোর্টের কেরানির চাকরি করেন ও মা গৃহবধূ। তাদের ঘরে যে এমন সন্তান জন্মাবে তা ভাবা যায় না।
রাধাকৃষ্ণণের জীবন ইতিহাস সকলের অজানা ছিল। কয়েক বছর আগে দক্ষিণভারত ঘুরতে গিয়েছিলেন শিশির মুখোপাধ্যায় ও তার পত্নী স্বপ্না দেবী। তাদের কোন সন্তান ছিল না। সন্তানসুখ থেকে তারা বঞ্চিত ছিল। দত্তক নেবেন চিন্তা করেও নেওয়া হয়নি। দিনটি ছিল ৫ই সেপ্টেম্বর অর্থাৎ শিক্ষক দিবস। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিন। ওই দিন তিরুপতি মন্দিরে তিরুপতি নারায়ণ দর্শনে তারা গিয়েছিলেন। হঠাৎ একটা বাচ্চার কান্না তাদের কানে আসে। কান্নাকে লক্ষ্য করে অনেক খোঁজার পর একটা ডাস্টবিনের মধ্যে একটি শিশুকে শুয়ে কাঁদতে দেখেন তারা। সেদিকে কারো লক্ষই ছিল না। যে যার মতো ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। সন্তান সুখ থেকে বঞ্চিতা স্বপ্না দেবীর মাতৃহৃদয় ক্রন্দন করে ওঠে। তিনি ডাস্টবিন থেকে বাচ্চাটিকে তুলে কোলে নেন। শাড়ির আঁচল দিয়ে গায়ের সমস্ত নোংরা মুছে দেন। স্বামীকে বলেন--- "দেখো, আমাদের অপূর্ণ জীবনকে পূর্ণতা দিতেই নারায়ণ এই সন্তানকে হয়তো আমাদের দিয়েছেন। ফেলে চলে যাওয়া কী ঠিক হবে!! আমার নিতে খুব ইচ্ছা করছে। তুমি কি বলো?" স্বপ্না দেবীর দুই চোখে বারিধারা লক্ষ করা যায়। শিশির মুখোপাধ্যায় একটু ভেবে বলেন--- "ঠিক আছে, নারায়ণের যদি তাই ইচ্ছা হয় তবে অবশ্যই নিয়ে চলো। আজ থেকে এর পিতা-মাতা আমরাই। কিন্তু এই শিশুর জীবনের রহস্য রহস্যই রাখা ভালো। নতুবা বড় হলে লোকের কাছে আসল পরিচয় জানলে আমাদের ছেড়ে চলেও যেতে পারে।" স্বপ্না দেবী স্বামীর সমস্ত শর্ত মেনে নেন। মাতৃসুখ অনুভব করে স্বপ্না দেবী আনন্দ পান ও চোখে জল দেখা যায়।
এক সপ্তাহ পর বাড়ি ফিরে ব্যারাকপুর ছেড়ে তারা শ্যামবাজারে বাড়ি কিনে চলে যান। আইনত শিশুটিকে সমস্ত নিয়ম মেনে গ্রহণ করেন তারা। যাতে পরবর্তীতে কোনরকম সমস্যার মধ্যে তাদের পড়তে না হয়। অনেক ভেবেচিন্তে ছেলের দুটি নাম রাখেন। সকলের জন্য রাধাকৃষ্ণণ। যেহেতু সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিনে তারা তাকে আবিষ্কার করেছিলেন তাই। আর নিজেদের ডাকার জন্য নাম রাখেন তিরু অর্থাৎ তিরুপতি। যেহেতু তিরুপতি নারায়ণের স্থান থেকে তাকে পাওয়া গিয়েছিল সেহেতু এরূপ নামকরণ। আজ রাধাকৃষ্ণণের বয়স ছয় বছর। কিন্তু মেধায় সে দশ বছরের ছেলে-মেয়েদেরও হারিয়ে দিতে পারে।
রাধাকৃষ্ণণ কোনো কুমারী মেয়ের সন্তান নয়। তার ইতিহাসও জানার প্রয়োজন। তিরুপতি মন্দির চত্বরে একজন গরিব নারী ফুল বিক্রি করত। যার স্বামী মদের নেশায় সবসময় চূড় থাকতো। সংসারের দিকে তার কোন নজর ছিল না। মদ খেয়ে পত্নীকে মারধর করত সবসময়। রাধাকৃষ্ণণের আগে তিন-তিনটি সন্তান আছে তাদের। যাদের বয়স যথাক্রমে সাত, পাঁচ ও তিন। তাদের সামলানোর জন্য মনের অনেক কষ্টে রাধা কৃষ্ণণকে ডাস্টবিনের মধ্যে রেখে আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল সে। লক্ষ রাখছিল ডাস্টবিনের দিকে। সে চেয়েছিল ছেলেটির যেন ভালো করে লালন-পালন হয়। মানুষের মতো মানুষ হয় সে। তাদের মতো অবহেলায় অভাবী জীবন যেন সে না পায়। নাড়ি ছেঁড়া ধনকে এভাবে অন্যের হাতে তুলে দিতে তার খুব কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতির কাছে সে অসহায় হয়ে পড়ে। সামান্য ফুল বেঁচে সংসার ঠিক মতো চলতো না। তার উপর মদ খেয়ে তার স্বামী তার উপার্জনের টাকা নিয়ে নিতো। না দিলে খুব মারধর করতো। রাধাকৃষ্ণণের মায়ের নামখানিও খুব সুন্দর--- মহালক্ষ্মী। শিশির মুখোপাধ্যায় ও স্বপ্না দেবীকে ডাস্টবিন থেকে তুলে নিতে দেখে মানসিক শান্তি পেয়েছিল সে। ভেবেছিল, আমার ছোট এবার নিশ্চয়ই মানুষের মতো মানুষ হবে। বুক ফেটে দুচোখে জলের ধারা নেমে এসেছিল। গুমড়ে গুমড়ে কেঁদেছিল মহালক্ষ্মী। তিরুপতি নারায়ণের উদ্দেশ্যে বলেছিল--- "হে ভেঙ্কটেশ্বর, আপনি আমার সন্তানকে দেখবেন প্রভু। ও অনেক বড় হোক। যেখানেই রাখবেন ভালো রাখবেন আপনি।"
ওইটুকু শিশু মাকে না দেখতে পেয়ে কান্না করে । অনেক কষ্ট করে স্বপ্না দেবী বাচ্চাটিকে চুপ করান। কেনা দুধ ও বার্লি খাইয়ে শিশুটির ক্ষুধা মেটান । কয়েক দিন পর কলকাতায় ফিরে আসেন। শ্যামবাজারে গিয়েও বাচ্চাটিকে সামলাতে তাদের অনেক কষ্ট হয়। ধীরে ধীরে স্বপ্না দেবীদের মুখ রাধাকৃষ্ণণের কাছে পরিচিত হয়ে গেলে তাদের আর কোনো সমস্যা হয় না।
দেখতে দেখতে পাঁচ বছর কেটে যায়। অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়ে যায়। রাধাকৃষ্ণণের সঙ্গে কয়েক জন বাচ্চার বন্ধুত্ব হয়। তাদের প্রত্যেকেই খুবই মেধাবী এবং ধনী। রূপম, সঞ্জীব, অভয় ও বিদীপ্তা। ইংরাজী মিডিয়াম স্কুলে সকলে পড়ে। প্রথমে কিছুটা ভয় পেয়ে স্বপ্নাদেবী ও শিশির মুখোপাধ্যায় ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছ থেকে তার প্রশংসা শুনে তারা বুঝতে পারেন--এ শিশুর উপর দেবতার আশীর্বাদ আছে। তাঁরা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কথা মতো রাধাকৃষ্ণণের প্রতি বিশেষ নজর দেন। পরের বছর তাকে থ্রিতে ভর্তি করা হয়। এবারও অবাক করে দেয় রাধাকৃষ্ণণ। সবাইকে পিছনে ফেলে প্রথম স্থান অধিকার করে। তার মেধা দেখে অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীরা ও তাদের বাবা-মারা হিংসা করতেন। আবার কেউ কেউ রাধাকৃষ্ণণের মতো হওয়ার জন্য ছেলেমেয়েদের প্রেরণা দান করতেন।
থ্রীতে পড়াকালীন শিক্ষক-শিক্ষিকারাও সমস্যায় পড়ে যেতেন। তাদেরও বিভিন্ন ভুল-ভ্রান্তি সকলের সামনে ধরিয়ে দিত সে। শুধু ধরিয়ে দিত না বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখিয়েও দিত। লজ্জায় পড়ে যেতেন তারা। তারা বুঝতে পেরেছিলেন এই ছেলেটি আশ্চর্য বালক। মাত্র বারো বছর বয়সে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন শিক্ষকরা। স্কুলে নতুন রেকর্ড করল রাধাকৃষ্ণণ। সমগ্র ভারতবর্ষে প্রথম হল সে। সবেতেই একশোয় একশো। অবাক করে দিল সবাইকে। তার রেজাল্টের ধারে কাছে তার স্কুলের কেউই ছিল না। ফলে ধন্য ধন্য পড়ে গেল চারিদিকে।
সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন পত্রিকায় রাধাকৃষ্ণণের পিতা-মাতার ছবিসহ অসম্ভবকে সম্ভব করার কাহিনী ছাপা হয়েছিল। তারই একটি রাধাকৃষ্ণণের মা মহালক্ষ্মীর হাতে পড়ে। শিশির মুখোপাধ্যায় ও স্বপ্না দেবীর ছবি দেখে সে বুঝতে পারে ওই ছেলেটি তারই ছেলে। নিজে পড়াশুনা না জানায় একজন শিক্ষিত ব্যক্তিকে দিয়ে খবরের কাগজটি পড়ায়। রাধাকৃষ্ণণের সাফল্যের কথা শুনে তার দুচোখ দিয়ে টপটপ করে আনন্দাশ্রু নির্গত হয়। সে বুঝতে পারে তার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। ছেলের সাফল্যে গর্ব অনুভব করে সে। কয়েকজন পরিচিতকে কাগজটি দেখিয়ে বলে--- 'দেখো আমার ছোট কত বড় হয়ে গেছে। আজ ও মাধ্যমিকে দেশের মধ্যে প্রথম হয়েছে।' খবরের কাগজটি পড়ার পর কেউই তার কথাকে গুরুত্ব দেয়নি। সেখানে ছিল ছেলেটির পিতা শিশির মুখোপাধ্যায় ও মাতা স্বপ্না মুখোপাধ্যায়। দূর থেকে আশীর্বাদ করে মহালক্ষ্মী। তিরুপতির উদ্দেশ্যে বলে--- 'হে ভেঙ্কটেশ্বর, আমার সন্তানের সঙ্গে একবার দেখা করিয়ে দাও। আমার প্রতি তোমার অসীম কৃপা হবে।' ছেলেটির মুখ মহালক্ষ্মীর মনে গেঁথে যায়। এতদিন তাকে না দেখতে পেয়ে মাতৃ স্নেহের জাগরণ ঘটে।
এদিকে রাধাকৃষ্ণণ প্রথম হওয়ার আনন্দে শিশির মুখোপাধ্যায় তিরুপতিতে যাবেন বলে মনস্থির করেন। মাস খানিক পর একদিন তিরুপতির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন তারা। যশোবন্তপুর এক্সপ্রেসে তারা তিরুপতির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তিরুপতিতে এসে পুজো দেওয়ার উদ্দেশ্যে ফুল কিনতে যান তারা। মহালক্ষ্মীর মুখোমুখি হন তারা। শিশির মুখোপাধ্যায় ও স্বপ্না দেবীরা তাকে না চিনলেও মহালক্ষ্মী তাদের চিনে ফেলে। তাদের সঙ্গে রাধাকৃষ্ণণকে দেখে দুচোখে জল এসে যায় তার। রাধাকৃষ্ণণের সাথে সে কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্ত সুযোগ পায় না। সে দোকান ছেলে-মেয়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে তাদের পিছু নেয় । আজ সে শিশির বাবুদের সঙ্গে কথা বলে রাধাকৃষ্ণণের সম্পর্কে সব জানাতে চায়। সে যে তাদের অনুসরণ করছে সেটি স্বপ্না দেবী বুঝতে পারেন এবং স্বামীকে বলেন। অনেকক্ষণ পর শিশির মুখোপাধ্যায় মহালক্ষ্মীকে ডেকে বলেন---" এই ফুলয়ালি তুমি আমাদের পিছু পিছু আসছো কেন? তোমার মতলব কী?" প্রথমে তাদের সঙ্গে কথা বলতে কিছুটা ভয় পেলেও মনে সাহস জুগিয়ে অতীতের সমস্ত ঘটনা খুলে বলে মহালক্ষ্মী। সে বলে --- "বাবু আপনি আমাকে চিনবেন না, কিন্তু আমি আপনাদের চিনি । এই ছেলেটিকে অনেক বছর আগে যখন আপনারা ডাস্টবিনের ভিতর থেকে তুলে নিয়েছিলেন তখন আমি পাশেই ছিলাম। আসলে আমিই ওর হতভাগ্য মা। সেদিন ওকে ডাস্টবিনে রেখে দিতে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বাস করুন বাবু আমি নিরুপায় ছিলাম। ওছাড়া আমার আরও তিনটি ছেলে-মেয়ে আছে। ওর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমি আপনাদের কাছে ছেড়ে দিয়েছিলাম। ওকে আপনারা নিয়ে যাওয়ার পর আমি খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম।" এই কথাগুলো বলতে বলতে মহালক্ষ্মীর দুচোখ সিক্ত হয়ে গিয়েছিল। মহালক্ষ্মী যখন শিশির মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথাগুলো বলছিল তখন স্বপ্নাদেবী রাধাকৃষ্ণণকে নিয়ে পাশের একটি দোকানে গিয়েছিলেন। শিশির মুখোপাধ্যায় প্রথমে তার কথা বিশ্বাস করেন নি। মহালক্ষ্মীকে বলেন--- "তোমার কাছে কোনো প্রমান আছে? আমি কীভাবে বুঝব তুমি মিথ্যা বলছো না। তোমাকে তো আমরা চিনি না।" এই কথা শুনে মহালক্ষ্মী দোকান থেকে তার ও রাধাকৃষ্ণণের ছোটবেলার একটা পুরনো ছবি এনে দেখায়। ছবিটি দেখে শিশির বাবু বুঝতে পারেন ফুলয়ালি এতক্ষণ যা যা বলেছে সবই সত্য। হঠাৎ তার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়।
মহালক্ষ্মী দূরে থাকা রাধাকৃষ্ণণের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ শিশির মুখোপাধ্যায় তাকে বলেন --- " দেখো বোন আমাদের কাছ থেকে তুমি ওকে কেড়ে নিও না। তাহলে স্বপ্নাকে আমি বাঁচাতে পারব না। সময় এলে আমি ওদের দুজনকে সব জানাব । তুমি ফোনে আমার সাথে যোগাযোগ রেখো। রাধাকৃষ্ণণের খোঁজখবর তুমি আমার কাছ থেকে পাবে।" এই বলে একটি কাগজে তার দুটো ফোন নম্বর লিখে মহালক্ষ্মীকে দেন তিনি। পরিস্থিতি বুঝে মহালক্ষ্মীও বিষয়টি মেনে নেয়। মহালক্ষ্মী তার দোকানে ফিরে গেলে স্বপ্নাদেবী রাধাকৃষ্ণণকে নিয়ে ফিরে এসে বলেন--- 'কী বলছিল মেয়েটি? ও আমাদের অনুসরণ করছিল কেন?' শিশির বাবু বলেন --- "আসলে আমাদের রাধাকৃষ্ণণের সঙ্গে ওর পরিচিত একজনের মুখের মিল পেয়েছিল।তাই তাকে ভেবে আমাদের পিছু নিয়েছিল। আমি ওর ভুল ভেঙে দিয়েছি।"
এরপর আরও দশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায়। অনেক কিছু ঘটে যায় এই দশ বছরে। রাধাকৃষ্ণণ পদার্থ বিজ্ঞানী হয়েছে। চারিদিকে খুব নামডাক হয়েছে তার । শিশির বাবু চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। স্বপ্না দেবীর চুলে পাক ধরেছে। মহালক্ষ্মীর স্বামি মারা গিয়েছে চারবছর হয়েছে। শিশির বাবুর কাছে ফোন করে মহালক্ষ্মী রাধাকৃষ্ণণের খোঁজখবর নেয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সম্মেলনে রাধাকৃষ্ণণকে যেতে হয়। সে এখন দেশবাসীর খুব পরিচিত মুখ। তার জন্য শিশির মুখোপাধ্যায় ও স্বপ্না দেবী যেমন গর্ব অনুভব করেন তেমনি মহালক্ষ্মী। একদিন মহালক্ষ্মীর শরীর খুব অসুস্থ হয়। ডাক্তার তার শেষ ইচ্ছা পূরণ করে নিতে বলেন। ছোটকে দেখার জন্য মনটা তার চঞ্চল হয়ে ওঠে। সে শিশির বাবুকে ফোন করে সব জানায়। নিরুপায় হয়ে তিনি স্বপ্না দেবী ও রাধাকৃষ্ণণকে সব জানান । তিনি রাধাকৃষ্ণণকে বলেন --- " শোন বাবা, আমরা তোকে একটা কথা এতোদিন ধরে লুকিয়ে রেখেছি। আমরা তোর জন্মদেওয়া বাবা-মা নই। তোকে তিরুপতিতে আমরা পেয়েছিলাম। তোর জন্মদাত্রী মা সেখানেই থাকে। একপ্রকার নিরুপায় হয়ে সে তোকে ত্যাগ করেছিল। আজ সে মৃত্যুর সম্মুখে দাঁড়িয়ে তোর আশায় দিন গুনছে। তুই যাবি সেখানে? আমরা তোকে লালন-পালন করেছি, জন্ম দিয়েছে সে।" স্বপ্না দেবীকে বলেন --- " তুমি কষ্ট পাবে তাই তোমাকে এতদিন বলিনি। শেষবার তিরুপতিতে আমাদের যে ফুলয়ালি অনুসরণ করছিল, সেই রাধাকৃষ্ণণের প্রকৃত মা।" শিশির মুখোপাধ্যায়ের কথা শুনে রাধাকৃষ্ণণ ও স্বপ্না দেবীর চোখে জল এসেছিল। রাধাকৃষ্ণণ বলেছিল --- " তোমরাই আমার পিতা-মাতা। আমি জ্ঞানত তোমাদেরই দেখেছি। আমি কোথাও যাবো না। আর এতো বছর পর আমায় মনে পড়লো। " তার কথায় অভিমানের সুর বেজে উঠেছিল। শিশির বাবু সবকিছু বুঝে বলেছিলেন ---- "একটি বার চল বাবা। তোর মা খুব নিরুপায় ছিল। শেষ দেখা তোকে না দেখলে সে মরেও শান্তি পাবে না। তাছাড়া আমরা চিরকাল মনকে বুঝ দিতে পারব না। তুই তোর গর্ভধারিনীকে চিরকাল দেখা থেকে বঞ্চিত হবি।"
বাবার কথা শুনে তারা সকলে তিরুপতি যান। মাকে দেখে রাধাকৃষ্ণণের চোখে জল আসে। তার দাদা ও দিদিরাও সেখানে ছিল। মহালক্ষ্মীর দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। তার ছোটকে দেখে বাঁচতে ইচ্ছা করে। রাধাকৃষ্ণণ বলে ---" মা তোমার কিছু হবে না। আমি ভালো ডাক্তার দেখাব তোমায়।" অনেক চেষ্টা করেছিল সে। কিন্তু তার মা মহালক্ষ্মীকে বাঁচাতে পারে নি। একরাশ হতাশা আর দুঃখ নিয়ে শ্যামবাজার ফিরেছিল সে। স্বপ্না দেবীর ও শিশির বাবুর ভালোবাসায় ধীরে ধীরে সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। নীলাকাশ থেকে মহালক্ষ্মী দুহাত তুলে তাকে আশীর্বাদ করে।
ছবিঋণ - ইন্টারনেট।
=========================
মিঠুন মুখার্জী
C/o -- গোবিন্দ মুখার্জী
গ্ৰাম -- নবজীবন পল্লী
পোস্ট + থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগনা