ছবিঋণ - ইন্টারনেট।
ভূতের অবস্থান ও ভবিষ্যৎ
- প্রবোধ কুমার মৃধা
এমন একটা সময় ছিল যখন ভূতের ভিড়ে পথে - ঘাটে, অলিতে গলিতে,গ্ৰামে-গঞ্জে,রাত-বিরেতে পথ চলা দায় ছিল।লোকশ্রুতি চলে আসছে -- গয়াধামে গিয়ে মৃত পূর্বপুরুষগণের প্রেতাত্মার শান্তি তথা মুক্তি কামনায়, উপযুক্ত উত্তরাধিকারী দ্বারা পিন্ড উৎসর্গিকৃত হলে সেই সমস্ত বিদেহী আত্মাকুল মুক্তিলাভ করে স্বর্গলোকের অধিবাসী হন। স্থূল আত্মা হয়ে তখন আর মর্ত্যলোকে বিরাজ করেন না। আধুনিক প্রজন্মের মুখে এই জাতীয় কথা শুনতে পাওয়া যায় না।
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার প্রসার, বিজ্ঞানের আশীর্বাদ, মানুষের গতিবিধি ও মানসিক জগতের পরিধির বিস্তার বৃদ্ধির কারণে ভূতের দলের অধিকাংশই চিরদিনের মতো অবলুপ্ত প্রায়, তার মধ্যে অবশিষ্ট যেগুলি রয়ে গেছে, এগুলি আর যাওয়ার নয়। আমাদের পুরুষানুক্রমে লব্ধ কুসংস্কারপূর্ণ মনের মণিকোঠায় অক্ষয় হয়ে থেকে গেছে।
আমরা বড়রা কথায় কথায় শিশু -কিশোরদেরকে ' ভূত বলে কিছু নেই,' বলে জ্ঞান দিয়ে তাদেরকে নির্ভীক করে তোলার চেষ্টা করে থাকি। এটি নিছক নিয়মরক্ষার, নিছক কথার কথা; কারণ আমরা বড়রা সময়ে অসময়ে ভয় যে পাইনা, এমন কথা বুক ঠুকে বলার মতো সততা ক'জনের আছে? বললে তা হবে মিথ্যার নামান্তর।
আসলে ভূত বলি, আর ঠাকুর-দেবতা বলি, এ সবই মানুষের সৃষ্টি, মানুষের কল্পনা। মানুষের প্রয়োজনে, মানুষের অক্ষমতার কারণে, অসীম শক্তির আধাররূপে মানব মনের কল্পনায় মূর্ত রূপ নিয়ে তারা আমাদের চিন্তা-চেতনার অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে।
অবান্তর বা অপ্রয়োজনীয় বলে উচ্ছেদ করতে চাইলে ও তা সহজ নয়। যা আমাদের অস্তি-মজ্জায় সংপৃক্ত হয়ে গেছে, আমাদের বিবেক-বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে, তাকে সমূলে নির্মূল করা হয়তো বা কয়েক শতাব্দীর ব্যাপার।
আমাদের মনের ভূমির পুরনো অনুর্বর মাটি তুলে ফেলে আধুনিক শিক্ষা -সভ্যতার উর্বর পলি ভরিয়ে নতুন করে আবাদ করতে হবে।
বেদ-পুরাণ প্রভৃতি ভারতীয় সনাতন শাস্ত্র সমূহ বলে, ' আত্মা অবিনশ্বর।' বিজ্ঞান সে কথা অস্বীকার করার পথে হাঁটেনি। আত্মা কি? সে বিতর্ক সরিয়ে রেখে বলতে হয়,এই অদৃশ্য নিরাকার আত্মার ধারণা থেকেই নিরাবয়ব ভূতের জন্ম বলেই অনুমান।যার অদি বাসস্থান আমাদের অন্তরে বা মনোলোকে।
পঞ্চেন্দ্রিয় প্রহরী পরিবেষ্টিত হয়ে ছায়াময় ভৌতিক সত্ত্বা সমূহ আমাদের বক্ষ পিঞ্জরে নির্ভয়ে অবস্থান করে। অনুকুল পরিবেশ পরিস্থিতিতে তাদের অস্তিত্বের আভাস মেলে। তখন পঞ্চ প্রহরী একে একে ভীতির সংকেত দিতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। সেই সুযোগে ভূত-পেত্নি, দত্তি-দানাদের অবাধ আগমন ঘটতে থাকে।
মানুষের মৃত্যু পরবর্তী পারলৌকিক কর্ম বিধানের মূল উদ্দেশ্য হল, বিদেহী আত্মার শান্তি স্থাপন। সেই উপলক্ষে আয়োজিত কার্য প্রণালীর আদ্যোপান্ত জুড়ে আছে ভূত-প্রেতাদির গতিবিধি এবং আচার-আচরণ সংক্রান্ত ভৌতিক ইতিহাস।যা ভূতের অস্তিত্ব সম্বন্ধে ভয়ংকর কৌতুহল সৃষ্টিতে সাহায্য করে। এভাবে পুরোহিত শাস্ত্রের পরতে পরতে গাঁথা হয়ে আছে ভৌতিক আত্মার বিবিধ কল্পিত ধারণা ও আচার-অনুষ্ঠানের বিবরণ।
অজ্ঞ, অশিক্ষিত, পিছিয়ে পড়া নিম্ন সম্প্রদায়ের অন্ধ ভক্তি-বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে উচ্চবর্ণের, বিশেষ করে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদগ্ধ পন্ডিত যাঁরা, বহুকাল যাবত নিজেদের আধিপত্য ও উপায়ের পথ প্রশস্ত রাখতে, তাঁদের শাস্ত্রীয় সুকৌশলী প্রচেষ্টার বিরাম ছিল না।
বিজ্ঞান মনস্ক ব্যক্তিবর্গের ভূতে বিশ্বাস নেই। অর্থাৎ ভূতের অস্তিত্বহীনতায় তাঁরা বিশ্বাসী। তাঁদের যুক্তি,ভূত যে আছে, তার প্রমাণ কি? পক্ষান্তরে ভূতবাদীদের জিজ্ঞাস্য,ভূত যে নেই তার কি প্রমাণ আছে? পক্ষে বিপক্ষে এই চাপান-উতোরের মধ্যে কিছু ভূত-পেত্নি তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। তবে নতুন করে বংশ বিস্তার করার মতো অনুকুল বাতাবরণ আর খুঁজে পাচ্ছে না।
ভূত নিয়ে মানুষের কৌতূহলের সীমা নেই।ভয় পেয়েও মানুষ কিন্তু ভূতের ভক্ত। তাই সমগ্ৰ বিশ্বের সাহিত্যের জগতে ভৌতিক বিষয় বা ভূতকে নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টির অন্ত নেই।আট থেকে আশি,সব বয়সের,সব ধর্মের মানুষ জন ভূত নিয়ে বিবিধ কল্পিত কাহিনি উপভোগ করতে ভীষণভাবে আগ্ৰহী। ভূত থাক বা না থাক, বেঁচে থাক ভৌতিক সাহিত্য, নতুন নতুন ভূতের গল্পগাথা।
ভূতকে মানুষ ভয় পায়, ভয় পেয়ে তার থেকে অনিষ্ট আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়, তবু ভয় পেতে ভালোবাসে। তাতেই সম্ভব হয় ভূতের বেঁচে থাকা। যতদিন মানুষের মধ্যে ভয় থাকবে, ততদিন ভূতের বিদায় নেওয়ার সম্ভাবনা কম।
আমাদের ছায়া যেমন আমাদের কায়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে থাকে, ভূতের ধারণা ও তেমনি আমাদের সত্ত্বার সাথে মিলে -মিশে একাকার হয়ে গেছে।যার শুরু হয়েছিল শৈশবে ঠাকুরমা,দিদিমা'র মুখ থেকে ভূতের গল্প শোনার মাধ্যমে।সেটিই ছিল ভৌতিক সূচনা পর্বের ভিত্তিভূমি।
মনের ভ্রমে আমরা ভূত দেখি, তবে সেই ভূতের আকার-আকৃতি জাগতিক জীবকুলের অবয়বের বাইরে আমরা কল্পনা করতে পারি না। মানুষের মতো তাদের দু' হাত, দু' পা। একাধিক মস্তিষ্কের অধিকারী ভূতের পরিচয় আমাদের কল্পনার বাইরে থেকে গিয়েছে। তবে ভূতেদের অনেকে অসীম শক্তির অধিকারী,দক্ষ কর্মকূশলী, প্রচন্ড মায়াবী। অনেকে আবার রূপ পরিবর্তনে ওস্তাদ। বিশেষ করে মেয়ে ভূত অর্থাৎ পেত্নিগুলো। কোনো কোনো ভূত কখনো কখনো মানুষের অবয়ব ত্যাগ করে মনুষ্যেতর প্রাণীর প্রতিবিম্ব হয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।
কল্পিত এই ভূত প্রজাতির পৃথক কোনো ভাষা নেই। তারা মানুষের ভাষায় কথা বলে, কিন্তু যথেষ্ট খোনা গলায়। মানুষের কল্পনা তাদেরকে সেই অধিকারের স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছে। ভয় পাওয়া ব্যাপারটির স্থান-কাল-পাত্র ভেদে তারতম্য ঘটে থাকে। কিন্তু মানুষ কেবল ভূতকে ভয় পায় তা নয়, ভূত ও মানুষকে ভয় পায়।যতক্ষণ দিনের আলো থাকে,ততক্ষণ ভুতেরা ভয় দেখাতে সাহস পায় না। অন্ধকার নামতেই যত ধরণের অশরীরী আছে, সবাই ভয় দেখাতে ভয়ংকর হয়ে ওঠে।প্রশ্ন উঠতে পারে এই মর্মে যে, ভূত ভয় দেখায় না মানুষ ভয় পায়? কথাটা বোধহয় এভাবে উপস্থাপন করলে সহজসাধ্য হবে যে, ভূত তখনই ভয় দেখাতে সক্ষম, যখনই মানুষ অনন্যোপায় হয়ে ভরসা হারায়।
উভয় তরফের প্রতিক্রিয়ার উদ্দীপক হল অন্ধকার। এই অন্ধকার যেমন বহির্জগতের তেমন মনোজগতেরও। রবির আলোয় জীবলোক আলোকিত হয় আর জ্ঞানের আলোকে আলোকিত হয় মনোলোক। এই আলোকের ব্যাপ্তি ও স্থায়িত্বের উপর নির্ভর করছে ভবিষ্যতে ভূতের ভাগ্য।
============================