অণুগল্প।। পয়সার মালিক ।। অরবিন্দ পুরকাইত
ছবিঋণ - ইন্টারনেট।
পয়সার মালিক
অরবিন্দ পুরকাইত
নানান আকারের চাবির বড় রিংটা ঝাঁকিয়ে বাজিয়ে দোলাতে দোলাতে সেলিমপুরের ফুটপাত ধরে হেঁটে আসছে মাঝবয়সি মাধব। লম্বাটে দোহারা গড়ন, পরনে রঙচটা লুঙ্গি ও ফতুয়া, উসকোখুসকো কাঁচাপাকা চুল মাথায়। কাঁধে কাপড়ের ছোটখাটো একটা ঝোলা। অভ্যাসবশত চনমনে চোখ নিরীক্ষণ করে চলে ফুটপাতকে, মাঝে মাঝে এদিক-সেদিক। হঠাৎ নজরে পড়ল ছ'-আটটি পয়সা একত্র পড়ে আছে। বুঝতে বাকি থাকে না মাধবের, এক্ষুনি এখান থেকে উঠে তাকে পাশ কাটাল যে ভিকিরিটা এ তারই। আধশোয়া-হয়ে বসে ছিল রেলিংয়ে হেলান দিয়ে, পকেট থেকে কখন পড়ে গেছে নিশ্চই, খেয়াল করেনি। পয়সা ক'টি তুলে নিয়ে ভিখারিটির দিকে তাকিয়ে ডাক দিল, এই পয়সা নে যাও, তোমার পয়সা পড়ে গেচে— নে যাও।
যার উদ্দেশে এ ডাক, সবে ছাড়িয়ে গেছে আট-দশ কদম। আপন মনে হেঁটে চলেছে শীর্ণকায় বৃদ্ধ ভিক্ষুক। পরনে তস্য ময়লা হাফহাতা একটি জামা আর একই গোত্রের ঢোলা ফুল প্যান্ট। কাঁধে লম্বা ঝোলা একটি। ঝোলাটির বয়স কম মনে হচ্ছে, কেন-না তুলনায় সেটিকে কম ময়লা লাগছে।
দু-তিনবার ডাকের পর, চলতে চলতে ঘুরে তাকাল বৃদ্ধ। একটু তাকিয়ে দেখে, পাশে থুক করে থুথু ফেলে আবার আগের মতো এগিয়ে যেতে শুরু করল। মাধব পড়ল মুশকিলে! থুতু ফেলা পেয়েছিল, না ইচ্ছা করে— সে না হয় ছেড়ে দেওয়া গেল, কিন্তু না ফিরে চলে যায় যে! ডাকতেই এসে নিয়ে যাবে, বা অন্তত দাঁড়াবে তার কাছে পৌঁছনো পর্যন্ত, এটাই ভেবেছিল। ভেবেছিল পড়ে-যাওয়া পয়সা পেয়ে খুশি হবে, হয়তো সারাদিনের ভিক্ষের পয়সা। উলটে ভ্রুক্ষেপও করে না! অগত্যা ভিখারিটির দিকে এগিয়ে যেতে হল মাধবকেই।
— আরে তোমার পয়সা পড়ে গেল, ডাকতিচি— তুমি না নে চলে যাচ্চ! একদম পিছনে ডাক শুনে থমকে ঘুরে দাঁড়াল বৃদ্ধ। পয়সা বাড়িয়ে ধরল মাধব। লম্বা লম্বা ময়লা চুল আর দাড়ি-গোঁফের ফাঁক থেকে পিচুটিওলা চোখে তাকিয়ে শীর্ণ মুখটি বলে উঠল, পয়সা কি কারও একার হয় নাকি?
হতভম্ব হয়ে পড়ল মাধব! কী করবে প্রথমটা বুঝতে পারল না। দু-একজন তাকাচ্ছে চলার পথে। এক তরুণ ব্যাপারটা অনুধাবন করে দাঁড়িয়ে পড়ল পাশে। মাধব বলল, আরে বাবা, তোমার পকেট থেকেই পড়ে গেচে— তুমি ওকেনে বসেছেলে— আমি দেকিচি।
— দেকোচো তো তুমি বোঝো, আমার বলতোচো কেন!
— তোমার পয়সা— আমি কী করব!
— পয়সা পেলি লোকে কী করে! নিজে না রাক, ভিকিরি-মাউন্তুরের দান করে দাও।
আচ্ছা ঝকমারি হল তো! লোকের উপকার করতি গে এ তো ভাল ফ্যাঁসাদ! এ শুদু ভিকিরি নয়, খ্যাঁপা পাগলও বোধহয়! মনে মনে ভাবল মাধব। কিংকর্তব্য বিবেচনা করে উঠতে না পারার মধ্যে হঠাৎ মাধবের মাথায় চকিতে একটা উপায় দেখা দিল। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের বড়সড় হাঁ-র মধ্যে ঝট করে পয়সা ক'টি ফেলে, লোকটাকে কোনো সুযোগ না দিয়ে সটান নিজের পথে! ভাবল, নে বেটা, তোর পয়সা ভিকিরি-মাউন্তুরে-খ্যাঁপা-পাগলা-তোরেই দান করে দিলুম! ঢাউস ব্যাগের ভেতর খোঁজ একন!
প্রায় দৌড় লাগিয়েছে মাধব! এখনই কেউ যেন ধরে ফেলবে তাকে!
গল্পটা এখানে শেষ হতে পারত। শেষটা কেমন বা কীভাবে হবে গল্পকারের কাছে তা খুব গুরুত্বের। পাঠক-সমালোচকদের কথাও মাথায় রাখতে হয়। তা এখানে বাধ সাধল মাধব তথা বাস্তব। দেখা গেল পরপর দুটো গলির মুখ পেরিয়ে কাঁপন-ধরা-বুকে ঝটিতি পিছন ফিরে তাকাল মাধব। নাহ্, ওই তো ফুটপাত থেকে পাশের গলিটাতে ঢুকে গেল বলতে গেলে লোকটা! হাঁপ ছেড়ে যেন বাঁচল মাধব!
==================================