কবির মৃত্যু
প্রনীল মাধব
দক্ষিণ আনুখা হোগলাবাড়ি হল ময়নার প্রশাসনিক কেন্দ্র। ব্লকের সমস্ত দপ্তরই এখানেই অবস্থিত ।ব্লক প্রশাসন হঠাৎ নড়ে চড়ে বসলো।ব্লক পর্যায়ের রাস্তা সুরক্ষিতকরণ কমিটি অনুমোদন করা হয়। ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক, ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক, যুব দপ্তরের আধিকারিক,জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার ( আর ডব্লিউ পি),নিকটবর্তী কলেজের প্রিন্সিপাল,থানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক ,পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ,অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক -- এই হল ব্লক পর্যায়ের পথ নিরাপত্তা পর্ষদের সদস্য।
মালবাহী গাড়ির দৌরাত্ম্য রোধের জন্য সকাল নয়টা থেকে ১১টা পর্যন্ত No Entry ডিভাইডার স্থাপন করা হয়েছে।রাস্তার দুপাশে অবৈধ নির্মাণ থাকলে তো ভেঙে ফেলার নিদান সর্বজনস্বীকৃত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অবাঞ্ছিত গুল্ম পরিষ্কারের ব্যবস্থা করতে হবে।ময়না কলেজের NSS ইউনিট তা করতে সম্মত হয়েছে।থানা থেকে "সেভ ড্রাইভ সেফ লাইফ" কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।জনবসতিপূর্ণ এলাকায় রাস্তায় রিফেক্টর লাগানোর পরামর্শ দেন থানার ওসি সাহেব।
কিসের জন্য এত উদ্যোগ?
কি এমন ঘটনা যা প্রশাসনকে নাড়িয়ে দিল।রোমহর্ষক সেই ঘটনা কে ঘটালো? কিভাবে , কোথায় ঘটলো?সবার মনেই উঁকি মারতে থাকে।
সবে টিফিন হয়েছে ।স্কুলের ছেলেমেয়েরা কেউ মাঠে খেলা করছে,কেউ বসে গল্প করছে।অনেকে স্কুল গেটের বাইরে নাস্তা, মুড়ির ঠোঙা,কেক ,আইসক্রিম, স্যান্ডউইচ খাচ্ছে।
রমেশ ঘাটা সবেমাত্র ক্লাস ফাইভে পড়ে।বাবা নিত্যানন্দ স্কুলের সামনে স্টেশনারি দোকান করে।স্কুলের ছেলেমেয়েদের বই ,খাতা,লেখাপড়ার সরঞ্জাম নিয়ে ছোট্ট গুমটি তার।কোনমতে টেনেটুনে সংসার চলে যাচ্ছে।
একটিমাত্র ছেলে পরিবারের।মা আশাকর্মীর কাজ করে।তিনজনের সুখী পরিবার।
প্রত্যহ টিফিনের ফাঁকে ঢু মেরে বাবার দোকানে আসে রমেশ। সারাদিনে বিদ্যালয়ে কি কি ঘটলো।কতটা পড়া আয়ত্তে আনলো ,বন্ধুদের সাথে খুনসুটি ইত্যাদি নিয়ে কথাবার্তা হয়।
"বাবা এবার স্কুল ট্যুরে সায়েন্স সিটি যাবে ।আমিও যাবো বাবা।গার্জেনরাও যেতে পারবে,তুমি আর মামনি তো অনেকদিন হল কোথাও যাওনি।এবার যেতেই হবে"
বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে রমেশ।
"হ্যাঁ বাবা হবে।তুই কিছু খেয়েছিস?মা যে টিফিন দিয়েছিল আলুভাজা আর পরোটা" নিত্যানন্দ জিজ্ঞেস করে রমেশকে ।
"হ্যাঁ বাবা খেয়েছি।" বলেই পরীক্ষার খাতার নম্বরগুলো দেখায় বাবাকে।
" বাহ! শাবাশ! এবার তোকে ক্লাসের মধ্যে ফার্স্ট হতে হবে।মাদপুরের মনসা মায়ের মন্দিরে মানত রেখেছে তোর মা।" বলেই ছেলেকে বুকে টেনে নেয় বাবা ।
" চেষ্টা করবো বাবা। অঙ্কে,বিজ্ঞানে,ভূগোলে সেন্টপারসেন্ট নম্বর সিওর আসবে।বাকি গুলোতে একটু খাটতে হবে।" বলে মার্কশিটটা বাবার হাতে দেয়।
বাবার মুখে হাসির গোলাপ ফুটে উঠল।
ছেলের পিঠ চাপড়ে বলতে লাগলো," তোকে কবি হতে হবে...অনেক অনেক অনেক বড়ো।আমার অধরা স্বপ্ন তোকেই সার্থক করতে হবে পুত্র ।"
"আমি এই ছোট্ট দোকানে বসে আজও লিখে যাই।কিন্তু আমার লেখা আর বইতে ছাপা হয়না।বড় বড় পত্রিকাগুলো আমার লেখা ছাপায় না।আমি নাকি বড্ড সেকেলের কবিতা লিখি।আধুনিক কবিতার কিছু বুঝি না ।......."বলতে বলতে নিত্যানন্দের চোখে জল এসে গেল।
ছেলে বাবার চোখের জল মুছে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে," বাবা আমি দেহের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে শেষ চেষ্টা করবো ।"
" তোর মুখে ফুল চন্দন পড়ুক বেটা ।তুই যেনো আমার কল্পনার সেই কবিই হতে পারিস।" বাবা ছেলের কপালে স্নেহের কপালে স্নেহের চুমু এঁকে দিল ।
"বাবা আসি।পরের সেশনে ক্লাস শুরু হতে চলল।ইংলিশ গ্রামারটা একটু দেখতে হবে ,স্যার পড়া ধরবেন আজকে।"
"সাবধানে রাস্তা দেখে যা ।"
দোকানের ভেতর থেকে বলতে না বলতেই রমেশ দৌড়ে রাস্তা পার হতে যায়।এমন সময় দক্ষিণ দিক থেকে আগত একটি মাছের গাড়ি দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসে।
" দাঁড়া বাবু ! দাঁড়া! আমি যাচ্ছি!!" উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে নিত্যানন্দ।
দোকানের ভেতর থেকে বেরিয়েই যা দৃশ্য দেখে তাতে মাথা ঘুরে পিচ রাস্তায় পড়ে যায় বছর পঁয়ত্রিশের যুবক নিত্যানন্দ।নিস্তেজ হয়ে রাস্তায় ছটফট করতে থাকে।
মাছগড়ির সামনের চাকায় পিষ্ট হয়ে এক উদীয়মান কবির জীবনাবসান হল ।
===================
Vill & PO - Gangasagar PS - Sagar
Dist - South 24 Pgs
Pin- 743606