বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো
মিঠুন মুখার্জী
গৌরচন্দ্রিকা : বাঙালির বারোমাসে তেরো পার্বণ। যে কোন একটা অনুষ্ঠান হলেই বাঙালিরা আনন্দ না করে পারে না। এক কথায় আনন্দ প্রিয় বাঙালি। সামাজিক-পারিবারিক-আন্তর্জাতিক-ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে তারা আপন করে পালন করে। সারা বছর তারা আনন্দে- হৈ হুল্লোড়ে-নাচানাচি করে কাটাতে চায়। বিভিন্ন পুজো থেকে শুরু করে স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস, নেতাজি জন্ম জয়ন্তী, বিবাহ, জন্মদিন, অন্নপ্রাশন, দোল, ক্রিসমাস, ভ্যালেন্টাইন্স ডে, আরো অনেক উৎসব আছে যা বাঙালিরা হৃদয় দিয়ে পালন করে থাকে। তবে সকল উৎসবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ উৎসব হলো দুর্গাপুজো। আপামর সমস্ত বাঙালিরা এই উৎসবটি মহাজাকজমকের সঙ্গে আয়োজন করে থাকে। শুধু বাংলায় নয়, বাংলার বাইরে দেশে-বিদেশের প্রবাসী বাঙালিরাও সমস্ত ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও এই উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠেন। বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির আর কোনো মহোৎসব এতদিন ধরে অনুষ্ঠিত হয় না। পঞ্চমী থেকেই পুজোর সূত্রপাত হয়ে যায়। ষষ্ঠী-সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী ও দশমীর এই ছয় দিন বাঙালিদের কাছে সবথেকে বেশি আনন্দের দিন। আবালবৃদ্ধবনিতারা এই উৎসবে শামিল হয়। মূলত মহালয়া থেকেই দেবীপক্ষের সূচনা হয়ে যায়।
দুর্গাপুজোর কেনাকাটা : এই মহোৎসবে শ্রেণীগত কোন ভেদাভেদ থাকে না। ধনী-দরিদ্র-মধ্যবিত্ত যার যেরকম ক্ষমতা প্রত্যেকেই বাড়ির সকলের জন্য এই সময় জামাকাপড় কিনে থাকেন। ছেলেদের জন্য জিন্সের প্যান্ট, গেঞ্জি, জামা, দামি সু, বেল্ট ; আর মেয়েদের জন্য সালোয়ার, শাড়ি, জুতো, সাজার মেকাপ, আরো অনেক দামি দামি দ্রব্য। এছাড়াও আত্মীয়দের মধ্যেও জামা-কাপড় দেওয়ার চল আছে। এই সময় বাজারের সবকিছুর দাম অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। একশ্রেণীর ব্যবসায়ীদের সারা বছরের রোজগার পুজোর আগের তিন মাসে উঠে আসে। সব জেনে শুনে কেনাকাটা করা ছাড়া মানুষের উপায় থাকে না।
দুর্গাপুজোর আনন্দ : আনন্দ প্রিয় বাঙালিরা সবসময় আনন্দ করতে ভালবাসে। পুজোর দিনগুলি তাদের কাছে এত তাড়াতাড়ি চলে যায় যে, অনেকেই মনে মনে ভাবেন-- 'সাধ মিটিলো না। আরো কিছুদিন যদি দুর্গা পুজোর আনন্দ উপভোগ করতে পারতাম, তবে খুবই ভালো হতো।' মহালয়া থেকেই সকলের মনের মধ্যে একটা পুজো পুজো ব্যাপার চলে আসে। মনটা আনন্দে ভরে ওঠে সকলের। সারা বছর আপামর বাঙালিরা এই দিন গুলির জন্য অপেক্ষা করে থাকে। ছোট থেকে বয়স্ক পর্যন্ত সকলেই এই উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে। মাঠে মাঠে কাঁশফুল শরৎকালে মা দুর্গার আগমন বার্তা নিয়ে আসে। এই কাঁশফুলও বাঙালির মনে আনন্দ এনে দেয়।
কলকাতা সহ বড় বড় মফস্বল এলাকায় যেখানে বড় বড় পূজো হয়, সেখানে চতুর্থি - পঞ্চমীর দিন থেকেই মানুষের ঢল নামে। শুধু রাত্রিবেলা নয়, দিনের বেলাতেও পুজোর প্যান্ডেল ও প্রতিমা দর্শন করে আনন্দ উপভোগ করে তারা। তবে আনন্দ উপভোগের বিষয়টা এক একজনের কাছে এক এক রকম। কেউ ঠাকুর ও প্যান্ডেল দেখে আনন্দ পায়, কেউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোক দেখে আনন্দ পায়, কেউবা কোন একটা মন্ডপে গিয়ে ওই কদিন বসে থেকে আনন্দ উপভোগ করে, আবার কেউ বাড়িতে থেকেই আনন্দ পায়।
দুর্গাপুজোর খাওয়া- দাওয়া : বাঙালিরা ভোজন প্রিয় । অনুষ্ঠান হবে আর খাওয়া-দাওয়া হবে না, এটা হতেই পারে না। বাঙালির কাছে সমস্ত উৎসবের আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার বিষয়টাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পুজোর কদিন বেশিরভাগ বাঙালি রাতের খাওয়াটা বাইরে থেকেই সেরে আসে। খাওয়ার তালিকায় থাকে--- ফুচকা, চাউমিন, মোগলাই, বিরিয়ানি, চিকেন, মাটন, মিক্স রাইস, রুমালি রুটি, তরকা আরো অনেক ধরনের ফাস্টফুড। সঙ্গে থাকে আইসক্রিম ও নরম পানীও ইত্যাদি। প্রতিদিনই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্ন খাবারের স্বাদ অনুভব করে তারা। তাছাড়া অষ্টমীর দিন বাঙালিদের বাড়িতে লুচি - ছোলার ডাল - আলুর দম - ফুলকপির তরকারি - চাটনির ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। নবমীর দিন ঘরে ঘরে মটন ও চিকেন রান্না হয়। কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া দাওয়া হয় সেইদিন।
দুর্গাপুজোর ঘোরাঘুরি : বাঙালিদের পুজোর কটা দিন কোন বাঁধনই আটকে রাখতে পারে না। কেউ দুপুরের পর পরিবার নিয়ে ফাঁকায় ফাঁকায় ঠাকুর দেখে, আবার কেউ সন্ধ্যা ও রাত্রির ভিড়ের মধ্যে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখে। কেউ নিজের এলাকায় ঠাকুর দেখে কলকাতায় বড় বড় প্যান্ডেল ও প্রতিমা দেখতে যায়। সারারাত ধরে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখে ভোরবেলা ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে। কষ্ট হলেও এই কদিন ঠাকুর দেখার আনন্দ কেউই মিস করতে চায় না।
দুর্গা পুজোর দিনগুলি : পঞ্চমীর দিন বেলতলার পুজো হয়। বিকেল বেলা প্রতিমা মন্ডপে প্রবেশ করানো হয়। তারপর ষষ্ঠীর দিন থেকে দেবী দুর্গা ও তার সঙ্গে আসা লক্ষী - সরস্বতী - গনেশ - কার্তিক প্রভৃতি দেব-দেবীদের পুজো করা হয়। তাছাড়াও কলাবউ ও মহাদেবের পুজোও হয়। অষ্টমীর দিন সকালবেলা পুজো হওয়ার পর আবালবৃদ্ধবনিতারা মায়ের কাছে অঞ্জলী দেন। পুজোর দিনগুলির মধ্যে এই দিনটিই বাঙালিদের কাছে সবচেয়ে আনন্দের দিন। নবমীর দিন আসলেই বাঙালির মনটি ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। কারণ নবমী নিশি পেরিয়ে গেলেই পিতৃগৃহ থেকে মা দুর্গার স্বামীগৃহে চলে যাওয়ার সময় চলে আসে। আবার একটা বছর বাঙালিদের অপেক্ষা করতে হয় মার ঘরে ফেরার। সকলের মনটা দুঃখে ভরে ওঠে। বাঙালির মনটা বলে ওঠে-- "ওহে নবমী নিশি না হইওরে অবসান।'' মন্ডপে মন্ডপে এই পাঁচ- ছয় দিন ঢাক - কাঁসর - ঘন্টা ও শঙ্খের ধ্বনিতে অপূর্ব একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মণ্ডপের ও লাইটিং-এর রেষারেষি হয় পুজো কমিটিগুলির মধ্যে।
দুর্গা পুজোর দিনগুলিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান : বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবে সবকিছুই হবে আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে না--- এটা অসম্ভব। বড় বড় পুজোগুলিতে চতুর্থি থেকে ষষ্ঠী পর্যন্ত উদ্বোধন করতে নামিদামি শিল্পীদের আগমন ঘটে। তাদের দিয়ে ফিতে কেটে যেমন সেই বছরের পুজোর উদ্বোধন করা হয়, তেমনি নাচ-গান ও বিভিন্ন যন্ত্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দুর্গাপুজো আরো মহিমাময় হয়ে ওঠে। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমীর দিনগুলিতে অনেক পুজো কমিটি বিভিন্ন সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। কলকাতার বড় বড় পুজোয় যেমন বোম্বে থেকে নামিদামি তারকারা আসেন, তেমনি দিল্লি-ব্যাঙ্গালোর- মুম্বাইয়ের প্রবাসী বাঙালিদের পুজোতেও বাংলা থেকে বড় বড় শিল্পীরা গান-বাজনা করার জন্য যান। এক কথায় গান ও নাচ পাগল বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের একটা গুরুত্ব আছে। তাছাড়া মাইক ও বক্সে বিভিন্ন শিল্পীর বিভিন্ন ধরনের গান বাজে পুজোর মন্ডপে মন্ডপে। যা শুনলে মনের মধ্যে একটা পুজো পুজো ভাব আসে।
দুর্গা প্রতিমা নিরঞ্জন : নবমী নিশি পার হয়ে দশমী পড়তেই বাঙালিদের চোখে জল দেখা যায়। এই দিনটি মা দুর্গার বিদায়ের দিন। মন চায় না মাকে বাপের বাড়ি থেকে স্বামী গৃহে যেতে দিতে ,কিন্তু যেতে যে দিতেই হবে। যতই আমরা বলি যেতে নাহি দিব। দশমীর দিনেই বেশিরভাগ প্রতিমা নিরঞ্জন দেওয়া হয়। বারোয়ারী পুজো গুলোর প্রতিমাকে বরণ করে দশমীর দিন নদীতে নিয়ে যাওয়া হয়। বড় বড় ক্লাবের দুর্গা প্রতিমাগুলি দশমীর পরও আরো দুই-তিন দিন রেখে দেওয়া হয়। তারপর নদীতে কিংবা পুকুরে বিসর্জন দেয়। পচেশন করে বাঙালিরা নাচতে নাচতে খুব আনন্দের সহিত প্রতিমা নিরঞ্জন করে। এই দৃশ্য দেখার জন্য রাস্তার দুই পাশ দিয়ে অসংখ্য বাঙালিরা দাঁড়িয়ে যায়। তারা মা দুর্গার বিগ্ৰহকে প্রণাম করেন এবং মায়ের আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন।
শেষকথা: পরিশেষে বলা যায় বাঙালির দুর্গা পুজো শুধু বাঙালিদের কাছেই নয়, বাঙলার বুকে থাকা সমস্ত জাতির মানুষের কাছে শ্রেষ্ঠ উৎসব। তারা নিজেদের মধ্যে উচ্চ-নীচ,ধনী-দরিদ্র ও জাতিগত ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এই মহোৎসবে জনস্রোতে মিশে যায়। সকলের মন থেকে একটা কথাই ধ্বনিত হয়---" আসছে বছর আবার হবে। মা তুমি আবার এসো।"
==========================
মিঠুন মুখার্জী
C/O-- গোবিন্দ মুখার্জী
গ্ৰাম : নবজীবন পল্লী
পোস্ট+থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগণা