জয়শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়
দেখতে দেখতে আবার পুজো চলে এলো । পুজো মানে বাঙালির আবেগ যে উৎসব কে ঘিরে থাকে সেই শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজা। অন্য দেব দেবীর পুজো এলে নাম জুড়ে দিয়ে বলা হলেও পুজো বললেই একমাত্র দুর্গাপুজো কেই বোঝায় সেখানে নাম জুড়তে হয়না আর । কত শরৎ এসেছে গেছে কত যুগ কেটে গেছে পুজোতেও এখন কত রকম ফের ।
বাংলার পুরনো রাজবাড়ি, জমিদার কোথাও অভিজাত ধনী বনেদী বাড়িগুলোয় যে দুর্গাপুজোর প্রচলন শুরু হয়েছিল আজও সেখানে দুর্গা পুজো হয়ে থাকে অনেক ঘটা করে। এক এক বাড়ির পুজোর এক এক নিয়ম আর প্রথা। দুর্গা পুজো এক সময়ে হয়ে উঠেছিল বিত্তবান পরিবারগুলোর আভিজাত্য ক্ষমতা আর বৈভব প্রদর্শনের বাৎসরিক উৎসব। এই নিয়ে দেখা যেত অনেক রেষারেষি। শহরে এবং গ্রামে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে নতুন জমিদার আর সেই সঙ্গে দুর্গা পুজোর সংখ্যা। কোনও কোনও বাড়ির পুজোয় অর্থের টান পড়লে আঠেরো শতকের শেষ দশকে শুরু হল কয়েক জন মিলে একসঙ্গে পুজো করার প্রথা। বারো জন 'ইয়ার' অর্থাৎ বন্ধু মিলে ১৭৯০ সালে হুগলির গুপ্তিপাড়ায় একসঙ্গে জগদ্ধাত্রী পুজো করেছিলেন বলে দল বেঁধে আয়োজন করা পুজোর নাম হয়ে যায় 'বারোয়ারি' পুজো।
জানা যায়, ১৯১০ সালে কলকাতার প্রথম বারোয়ারি পুজোর আয়োজন করে 'ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা'। বিপ্লবী অতীন্দ্রনাথ বসু কলকাতার 'সিমলা ব্যায়াম সমিতি'-র পক্ষে ১৯২৬ সালে প্রচলন করলেন প্রথম সর্বজনীন দুর্গোৎসবের। এই আয়োজনের মধ্যে দিয়েই যেন গণতন্ত্রীকরণ হয়ে গেল বিত্তবানদের দুর্গোৎসবের। শুধুই এক শ্রেণির মানুষের নাগালের মধ্যে না থেকে সকলের জন্য যে দুর্গোৎসব, তা-ই সর্বজনীন দুর্গোৎসব। সমীক্ষায় উঠে এসেছে প্রতিবছর পুজো সংখ্যা বাড়ছে ।
। বাংলায় গড়ে ওঠা অসংখ্য আবাসনের পুজো এখন পরিচিত 'ফ্ল্যাট বাড়ির পুজো' হিসেবে। এক এক বার এক এক বিষয়কে ভিত্তি করে প্রতিমা আর পুজো প্রাঙ্গণকে সুন্দর তোলার প্রবণতাও চোখে পড়ার মতো, চলতি ভাষায় যাকে বলা হয় 'থিম পুজো'। এই সব থিম পুজোয় থাকে নতুন নতুন চমক। কোথাও মূর্তি তাক লাগানো তো কোথাও প্যান্ডেল । থিমে বিভিন্ন বিষয় কে তুলে ধরা হয় ।
পুজোর উৎসব শুরু হয়ে যায় পুজোর বাজার দিয়ে
পুজো উপলক্ষ্যে আগে প্রতিটা বাড়ি তে ঘর ঝাড়ার রেওয়াজ ছিল , কত কিছুর সন্ধান পাওয়া যেতো তাতে ।হারিয়ে যাওয়া জিনিস কিম্বা অজানা জিনিস
পুরোনো কত বই পত্র টুকি টাকি কত কিছু । সেই ঘর ঝাড়ার পর কেমন পুজোর একটা গন্ধ মিশে থাকতো । মহালয়ার সময় থেকে শুরু হয়ে যেতো চালভাজা, মুড়কি, আর্সে,নারকেল নাডু, লবঙ্গ লতিকা ,নিমকি গজা ইত্যাদি নানাবিধ খাবার। এখনও জেলার অনেক গ্রামের বাড়িতেই এই প্রথা প্রচলন আছে ।
বাড়ির সাবেকি পুজোয় রোজ নানা রকমের পদ বানিয়ে ভোগ দেওয়া হতো মা কে ।সেই প্রথা এখনও বর্তমান তবে পদের অনেক পরির্বতন হয়েছে অনেক সাবেকি রান্না এখন বিলুপ্ত প্রায়। সাবেকি রাজ পরিবার জমিদারবাড়ি কি অভিজাত বনেদি বাড়িতে চারদিন বা অন্তত একটা দিনও পাত পেড়ে সবাই কে খাওয়ানোর প্রথা আগেও ছিল এখনও আছে । কোথাও লুচি ,পোলাও মোহনভোগ ছোলার ডাল ,বেগুন ভাজা , ছানার কালিয়া, সন্দেশ সহ ইত্যাদি পদ কোথাও বা আবার খিচুড়ি পায়েস ,সাথে নানাবিধ ভাজা ,নিরামিষ তরকারির পদ, মিষ্টি ,চাটনি এসব ।
এখন কোথাও কোথাও বারোয়ারী পুজোয় কখনও চারদিন বা একদিন ভোগ খাওয়ানোর ব্যবস্থা আছে।
পুজোর বাজার সেকালেও ছিল একালেও আছে । আশ্বিন মাস পড়তে না পড়তেই সকলে পাওনা টাকা আদায়ের চেষ্টা শুরু করে দিত । একালের মতো সেকালেও খবরের কাগজে দোকানদার গণ বিজ্ঞাপন দিতেন । নতুন জামা কাপড় না হলে কোনো কালেই পুজো মনে হতো না । তখন সব নির্দিষ্ট দর্জি দের কাছে অর্ডার চলে যেতো । তাদের তখন নাওয়া খাওয়ার সময় থাকতো না । গৃহস্থ বনেদি কি একান্ন বর্তী পরিবারে পুজোয় মস্ত বাজার হতো । বাড়ির কুল দেবতা কি দেবী , পরিবারের লোকজন আত্মীয় স্বজন দের সবাইকে দেওয়া হতো । কাজের লোক জন কিষান দের জন্য ও আসতো আরকিছু রাখা হতো গরীব দুঃখীদের জন্য ।
পুজোর বাজারে আজও ভাটা পড়েনি ।তবে একান্ন বর্তি পরিবার আর নেই । ছোটো ছোটো পরিবার কিন্তু ছোট ছোট অনেক পরিবারের এত বিশাল বিশাল চাহিদা হয়তো সেই টাকায় একটা একান্নবর্তি পরিবারে কম চাহিদায় খুশি থাকা মানুষ দের বাজার হয়ে যাবে । এখনকার পুজো তেও কেউ কেউ যেমন ব্যক্তিগত ভাবে গরীব দের দান করেন তেমনই বহু ক্লাব কি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে দুঃস্থদের জন্য বস্ত্র খাদ্য দেওয়া হয় ।
শুধু যে জামা কাপড় তা না কাঁসার বাসন,পিতলের জিনিস পত্র, সিঁদুর চুপড়ি, মোমবাতি, পিঁড়ে ,মধু পক্কের বাটি, গিলটি করা গয়না , বিলাতি মুক্ত, ,নতুন জুতো ,আরশি বেলোয়ারি চুড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি। বড়ো ঘরে সোনা কেনার রেওয়াজ ছিল পুজোয় । নতুন শাড়ি,নতুন সোনার গহনা পড়ে যখন রাজবাড়ী ,জমিদার বাড়ি কি বনেদি বাড়ির মেয়ে বউ রা ঠাকুর দালানে আসতো তখন তাদের দেখতেই বেশি ভিড় হতো যেন ঠাকুর দালানে ।
যুগের পরিবর্তনে এখন পোশাকেও পরির্বতন এসেছে ।এসেছে সাজ গোজেও। থিম পুজোর আকর্ষণে বেড়েছে প্যান্ডেলে রাস্তায় জন জোয়ার । একালের মতো সেকালেও কোলকাতায় পুজোর বাজার আরম্ভের সাথে সাথে চুরি ব্যবসা যাদের পেশা তারা তৈরি হয়ে যেতো।একটা সময় কলকাতার পুজোয় পকেট মার ছেয়ে থাকতো, তবে এখন সিসিটিভির যুগে কিছুটা হলেও পুজো মণ্ডপে কমেছে । হয় তবে কম ।
সেকালের দুর্গা পূজার বাজার দর কেমন ছিল তা সত্যেন্দ্র কুমার বসু মাসিক বসুমতী পত্রিকায়
১৩২৯ সনের আষাঢ় সংখ্যায় ওনার দাদা নরেন্দ্র কুমার বসুর কাছ থেকে একটি পুরোনো দুর্গা পুজোর এক খানি খরচের খাতা তুলে ধরেন ।
সেখানে দেখা যায় ১৮ ৪৯ খ্রিস্টাব্দে ১ টাকায় পাওয়া যেতো ৯৭ টা ঝুনো নারকেল ১৯৭৮ তে তার দাম ১৫০ টাকা । ১ মণ বালাম চাল উক্ত সাল অনুযায়ী ১.০৬ থেকে ৯২ .৫০ . ১৫০ জনের মাছ ৫টাকা সেটা উল্লিখিত সালে এসে পৌঁছায় ৯০০ টাকা । দশ সের সন্দেশের দাম ওই সালগুলোতে ছিল যথাক্রমে ৩:০০ টাকা থেকে ১৬০ টাকা ।
১০ হাতের দেশী তাঁতের এক খানি শাড়ি ১৮৪৯ এ ০.৬৯ থেকে ১৯৭৮ তে হয় ২০ টাকা ।
পুজোয় স্কুল ছুটি তখনও থাকতো ।ছুটি পড়ার দিন কোনো ক্লাস থাকতো না । মাষ্টার মশাই রা ছাত্র দের কে ছুটির পড়াও দিতেন । মেস এর লোকজন বাড়ি যেতেন । অফিস আদালত পত্রিকার অফিসও বন্ধ থাকতো ।কোলকাতায় থাকা অনেকেই গ্রামের বাড়িতে ফিরবে পুজো উপলক্ষে, অনেকেই পুরো পুজোর ছুটি সেখানে কাটাবেন তাই দৈনিক পত্রিকার সেই সব গ্রাহক দের পুজোর চারদিন বাদে বাকি দিনের পত্রিকা গুলি কোন স্থানে দেওয়া হবে এই বিষয়ে মনে করিয়ে দিয়ে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্ত বিজ্ঞপ্তি দিতেন ।
পুজোর ছুটিতে ভ্রমণ একালের মতো সেকালেও ছিল । একঘেয়েমি জীবনের বাইরে কদিন একটু বাইরে কাটানোর প্রবণতা বাঙালির আগাগোড়া ।
1875 সালের ৭ ই সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার রেল কোম্পানি 'সুলভ সমাচার পত্রিকায় ছুটির ভ্রমণের টিকিটের যে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছিল তা ছিল এমন
* বিজ্ঞাপন *
ইষ্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে
দুর্গা পূজার ছুটি
সর্ব্বসাধারণ কে জ্ঞাত করা যাইতেছে যে যে সকল ব্যক্তি পূজার ছুটিতে রেলে বেড়াইতে যাইতে ইচ্ছা করেন তাঁহাদের সুবিধার জন্য ১ম এবং ২য় শ্রেণীর মাসিক রিটার্ন টিকিট সিঙ্গল টিকিটের দেড় গুন মূল্যে ২০ সেপ্টেম্বর হইতে ২০ অক্টোবরের মধ্যে প্রতিদিনই বিক্রয় করা হইবে । যাঁহারা ৫০ মাইলের কম দূরত্বে যাইবেন তাঁহারা টিকিট এ মূল্যে পাইবেন না
কলিকাতা সিসিল স্টিফিন্সন
৩ রা সেপ্টেম্বর , ১৮৭৫ এজেন্ট
একটা সময় ছিল যখন দুর্গাপূজা হবে অথচ যাত্রাগান হবে না একথা যেন ভাবতেই পারা যেত না ,এমনকি কলকাতাতেও! পুজোর কদিন রাত জাগতে হবে সেই কারণে যাত্রার দলের খোঁজ চলতো। সারা রাত চলতো যাত্রা পালা । সকাল হয়ে যেতো ভাঙতে। এখন সারা রাত ঠাকুর দেখার ভিড়।মণ্ডপে উপচে পড়ে জনতা তাই হয়তো আর যাত্রা হয়না ।
সেকালে সারা দিন খাটুনির পর খেয়ে দেয়ে যাত্রা শুনতে আসতো । নিস্তব্ধ রাত ভেদ করে যাত্রা দলের গান বাজনা অভিনয়ের শব্দ দূর থেকে ভেসে আসত । ঢাক পিটিয়ে গ্রাম বাসীকে যাত্রা শুনতে ডাকা হতো । একটা সময় গালিচায় ব্রাহ্মণ শ্রেণী, শতরঞ্জি তে অন্য ভদ্রলোক রা , মাদুর শপে অন্যেরা, খেজুর শপে আর ও অন্যরা ,আর একদম নিম্নবিত্তদের থাকতো তারপাতার চাটাই। কলিকাতা তেও এমন ব্যবস্থা ছিল । " উঠোনে প্রথমে খড় তার ওপরে দরমা তার ওপরে মাদ্রাজি জাজিম হাসছে । "
১৮৪৮ এ কলকাতার একদল যাত্রা মোক্তাফুরন ছিল ১৯ টাকা এরপর এই শতকের মধ্যভাগে ১০০ টাকা ফুরন ছিল প্রতি রাতে ১৯৭৯ তে একরাতে ৫০০০ টাকা ।
যাত্রা সম্পর্কে একটা বিখ্যাত লাইন মনে এলো " "করো যাত্রা,দেখো যাত্রা, কিন্তু হয় শেষ যাত্রা গঙ্গা যাত্রা মনে যেন থাকে ।।"
দুর্গাপুজোয় কলকাতার নব বাবুরা তাঁদের দুর্গামন্ডপে বাঈ নাচের আসর বসাতেন ।এর শুরুটা হয়েছিল শোভা বাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের হাত দিয়ে । ইংরেজ রাজপুরুষরা এই পুজোয় নাচের আসরে উপস্থিত থেকে নাচ দেখে , গান শুনে খানা পিনা করে বাড়ি ফিরতেন। কিন্তু সাহেব দের জন্য শেরি শ্যাম্পেন কেক বিস্কুটের ব্যবস্থা তে ভাগ্যবান কজন বাঙালির তা জুটলেও সেখানে প্রথম দিকে বসে লুচি মিঠাই খাবার রেওয়াজ ছিল না । বিজয়া দশমীতে রাজারা নিমন্ত্রিত দের বাড়ি তে ভালো মিঠাই খানা পাঠাতেন । পরে কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর বাড়ির দুর্গোৎসব উপলক্ষ্যে হাজার হাজার লোককে নিমন্ত্রণ করে ভুরি ভোজনের আয়োজন করেছিলে।
সুতানটির বাবুদের মধ্যে আট বাবুর অন্যতম ছিলেন তনুবাবু । তিনি আবার এমন আয়োজন করেছিলেন পুজোর খাওয়াতে রান্না শেষে শাক চচ্চড়ির সাথে রুপোর সিকি মোহর মিশিয়ে দিতেন যাঁর ভাগ্যে পড়বে তাঁকে সম্মান করে ধুতি চাদর দিতেন ।একবার কৈলাস পন্ডিতের ঠাকুরদার পাতে চারটি সিকি মোহর পড়াতে তাঁকে ভাগ্যবান মনে করে নৈনানের দশ বিঘা জমি ও এক জোড়া শাল দেন ।
আর কোলকাতায় পুজোয় বাঈ নাচের ইতিকথা শুরু করেছিলাম তার বর্ণনা অনেক পাওয়া যায় যেমন -
" ওই দেখো রাজবাড়ি রম্য অট্টালিকা,
সম্মানের সরোজিনী সম্পদ নায়িকা
জ্বলিতেছে ঝাড় বৃন্দে বাতি - পরিকর ,
দুলিতেছে চন্দ্রাতপ শোভা মনোহর ,
চৌদিকে দেওয়াল গিরি সারি সারি থামে
বিরাজে দালানে দুর্গা যেন গিরিধামে .."
নাট্যকার কবি দীনবন্ধু মিত্রের তাঁর ' সুরধুনী ' কাব্য গ্রন্থে শোভা বাজারের রাজবাড়ীর পুজোয় নাচের আসরের বর্ণনায় লাইন গুলি তুলে ধরেছেন । সেকালে পুজো মনের সান্ধ্য আসরে যাত্রা কি নাচ গানের আসর । ঠিক রাত নয়টায় তখন তোপ পড়ত। এই তোপের শব্দ শুনেই পুজো বাড়ির মধ্যে কর্ম চাঞ্চল্য শুরু হয়ে যেতো ।কারণ এর পরেই শুরু হবে নাচ । তবে এই নাচ অনেকেই ভালো চোখে দেখেন নি। ব্রাহ্মণ শ্রেণীর অনেকেই এর আপত্তি জানিয়েছিলেন । সমাচার দর্পণ এ এর বিরুদ্ধে সমালোচনা করা হয়েছিল । এবং ৪ ঠা অক্টোবর ১৮৩৭( ২৯ আশ্বিন ১২৪৪) খ্রিস্টাব্দে সমাচার দর্পণ লিখেছিলেন ,
"আগামী বৎসরে নাচ একেবারেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে ।"
যখন বাবুরা নিজেদের আমোদ প্রমোদ আর আভিজাত্য অর্থের অহংকার এসব দেখাতে দু হাতে জলের মত পয়সা খরচ করতেন। সেখানে বাংলা ইংরাজী সংবাদ পত্র গুলিতে সেই অর্থ কে ভালো উন্নত মূলক কাজে ব্যয় করার জন্য অনুরোধ করা হতো ।
পলাশীর যুদ্ধের পর যখন ইংরেজ দের ভাগ্য তুঙ্গে উঠলো তখন কোলকাতায় নব বাবুরা তাঁদের নিমন্ত্রণ করতে শুরু করলেন কারণ এনাদের অনেকেই ইংরেজ দের নানা ব্যাপারে সাহায্য করে আর তোষামোদ করে বড়োলোক হয়েছিল । কিন্তু হিন্দু বাড়িতে পর পুরুষ দের অন্দর মহলে প্রবেশের অনুমতি ছিল না ।কিন্তু বাবুরা দেখলো দুর্গা পুজোয় নিমন্ত্রণ করলে অসুবিধা নেই ।এতে তাঁদের খাওয়ানো ও হবে আবার তৈল মর্দনের কাজ ও হবে । শুধুই খাওয়ার আয়োজন করলে খেয়েই চলে যাবে তাই দীর্ঘক্ষন বসিয়ে রাখার জন্য নাচের আসর মদ্য মাংস সহ আহারাদির ব্যবস্থা করা হয় । কিন্তু দুর্গাপুজোর মতো পবিত্র পুজোয় বাবুদের এই কালচার মানতে পারেননি অনেকেই ।
উনিশ শতকের কলকাতাকে 'বাবু কলকাতা 'বলা হয় । উনিশ শতক শেষ হবার সাথে সাথে কোলকাতায় বাবু গিরিও ঘুচে গেছে । বাবুরা পিতৃ পুরুষ অর্জিত সম্পত্তি থেকে লক্ষ টাকা খরচ করে নাচের আসর বসাতেন কিন্ত অ- বাবুরা এত টাকা ব্যয় করতে পারতেন না তাঁরা কবিগান , যাত্রা পালা এসব করিয়ে পুজোর আসার মাতাতেন ।
এই যুগে পুজোয় যাত্রা পালা কবিগান হয়না ,হয়না বাঈ নাচ কিন্তু তার জায়গায় এসেছে মাইক কালচার, ডিজে নাচ সারারাত অর্কেস্ট্রা । ভাসানে চলে মদ খেয়ে ডিজের সাথে নারী পুরুষের উত্তাল অশ্লীল নাচ । কোথাও কোথাও চটুল গানে অশালীন পোশাকে শরীর দুলিয়ে পুজোর আনন্দ নেওয়া হয় । তবে আবার কোথাও ক্লাব থেকে বা সংগঠক দের দ্বারা আয়োজিত অনুষ্ঠানে সুন্দর নাচ গান প্রদর্শিত হয়। সেগুলো ভালো ও লাগে । চলে খাওয়া দাওয়া।
কোথাও ছোটদের আঁকা , কুইজ প্রতিযোগিতা।
তবে কিছু বছর আগে আমাদের বাবা মা কি দাদু ঠাকুমা দের আমলে পুজোয় সেই পাড়ায় কি বাড়িতে সামিয়ানা খাটিয়ে ছোট ও বড় দের নিয়ে সুন্দর ভাবে পরিচালিত ছোট ছোট নাটক নাচ গান বা পুজোয় শিল্পী দের নিয়ে পাড়াতে গানের জলসা,সেই ধুনুচি নৃত্য সেই নস্টালজিক জিনিস গুলো আর নেই । সে সব এখন গল্প কথা । স্মৃতি মেদুর । সেই পুজোর একটা পবিত্র ভাব ,কুমারী পুজো ,সেই পাড়াতে বিজয়া দশমী করতে বেড়ানো , নাড়ু গজা ,খাজা নিমকি খাওয়া সেই সুন্দর ভাবে মা বরণ, সুন্দর সিঁদুর খেলা আসতে আসতে হারিয়ে যাচ্ছে ।এখন সারা বছর শাঁখা পলা সিঁদুর আলতা না পড়ে পুজোর সময় শুধু ফটো তুলে ভিডিও করে পোস্ট করার জন্য নকল অনুভূতি নিয়ে শুধু সাজগোজ । কে কত কাকে তার সাজ দেখাতে পারে ,দামী পোশাক দেখাতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলে । চাঁদার জুলুমবাজি, মাইকের মাত্রা ছাড়ানো অত্যাচার ,দেখনদারিভাব সবাই যেন সবাই কে টেক্কা দিতে চায় । পুজো প্যান্ডেল গুলো তে চলে প্রতিযোগিতা ।সেরা প্রতিমা নির্মাণ ,সেরা থিম ,সেরা প্যান্ডেল সেরা পুজো পরিবেশ ,বেশি ভিড় সবেরই প্রতিযোগিতা । সেই পুজোয় পবিত্রতা ,শান্ত সুন্দর ভাব ,মনের অকৃত্রিম আনন্দ সেই আড্ডা পুজোর দিন গুলোতে সেই নস্টালজিক স্মৃতি খুঁজতে থাকে চোখ ।
দুর্গা পুজোয় প্রচলিত পশুবলি প্রথা প্রায় উঠে গেলেও এখনও নবমীতে কোথাও কোথাও বর্তমান । বাঙালির দুর্গা পুজোর সঙ্গে আবেগের সাথে যেমন শিউলি, কাশ, পদ্ম ফুল, পুজোর বাজার ,পুজোর ছুটি, পুজোর ভ্রমণ, আড্ডা খাওয়া দাওয়া, মহালয়া, বোধন অঞ্জলি , ঢাক, কাঁসর ঘন্টার আওয়াজ, ধুনুচি নাচ ,সন্ধ্যারতির জাদু ভাসান, বিজয়া যেমন জড়িয়ে তেমনই এই সময় বাংলা জুড়ে পুজো উপলক্ষে মুক্তি পায় নতুন চলচ্চিত্র, গান আর সাহিত্যপত্র। লোকায়ত কাহিনীকার, পুরাণকারদের হাত ধরে যেমন বিবর্তন হয়েছে দুর্গা পুজোর আচার এবং প্রথার, তেমনই দশকের পর দশক ধরে প্রতিমাশিল্পীদের হাতে বিবর্তিত হয়েছে দুর্গা প্রতিমা। উত্তর কলকাতায় গঙ্গার ধারে গড়ে ওঠা কুমোরটুলি আজও বিশ্বের প্রতিমাশিল্পীদের সেরা ঠিকানা। দুর্গা পুজোর স্মৃতি নিয়ে আছে বহু লেখা, আঁকা, বাঁধা গান । সেখান থেকে আমরা জানতে পারি অনেক কিছু । সেই সব লেখক শিল্পী দের সৃষ্টিতে বেঁচে আছে তাঁদের নিজেদের যুগ আর সমকালীন দুর্গোৎসবের ইতিবৃত্ত।
একটা সময় ছিল, দেবী চলে যাবার লগ্নে কলকাতার বনেদী বাড়িগুলোর কামান উঠত গর্জে। একই সঙ্গে কৈলাসে উমার ফিরে যাওয়ার আগাম খবর নিয়ে যেতে খাঁচা থেকে খোলা আকাশে ছেড়ে দেওয়া হতো একটা নীলকণ্ঠ পাখি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উধাও সেই সব পাখিরা। তবু আগের মতোই মাটির প্রতিমা নিরঞ্জনের পরে ভেসে থাকে খড় কুটো, ফুল, পাতা আর স্মৃতি। শুভ বিজয়ার আচারের মধ্যে পড়ে বড়দের আশীর্বাদ নেওয়া, মিষ্টি বিতরণ, আলিঙ্গন আর শুভকামনা। আগে দূরের আত্মীয় বন্ধু দের বিজয়ার প্রণাম , শুভেচ্ছা জানিয়ে চিঠি দেওয়া হতো। তার পর ফোন এলে ফোন করা হতো ।এখন মেসেজ করা হয় । বিজয়ার এই আনন্দের ভেতর ভেসে থাকে বিষাদের করুণ সুর। দুর্গা ঠাকুর বিসর্জন হয়ে গেলেই কেমন এক মন খারাপ ঘিরে ধরে ! উৎসবের আলো, ঢাকের আওয়াজ, চণ্ডীপাঠ , পুজোর মন্ত্র ,শিউলির গন্ধ ফিকে হওয়ার আগেই শুরু হয়ে যায় আবার এক দুর্গা পুজোর অধীর প্রতীক্ষা!
তথ্যসংগ্রহে সাহায্য করেছেন - হরিপদ ভৌমিক মহাশয়
ও নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বাবু ।
=======================
জয়শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়, পাল্লারোড, পূর্ব বর্ধমান।