আলোর দিশারী বিদ্যাসাগর
পাভেল আমান
বঙ্গ নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সমাজ সংস্কারের কঠোর ব্রত নিয়ে মর্ত্য জীবনে বিবিধ বাধা বিপত্তি পেরিয়ে লড়াই সংগ্রাম অদম্য মনোবলকে সাঙ্গ করেই বাঙালি জাতিসত্তার উত্তরণ ঘটিয়েছিলেন। বিবেক চেতনা জাগ্রত করে অন্তঃস্থ মনুষ্যত্বের বরাভয়ে আমৃত্যু যুক্তিবাদ মানবতাবাদ লিঙ্গ বৈষম্য ভেদাভেদহীন সমাজবাদ প্রতিষ্ঠায় জীবন উৎসর্গীকৃত। কোনো প্রতিকূলতাই বিদ্যাসাগরকে তার সংকল্প থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। যুক্তিকে অবলম্বন করে তিনি কুসংস্কার ও দেশাচারের দুর্গে আঘাত করেছেন। নিজে ব্রাহ্মণ ছিলেন, কিন্তু গোঁড়া ব্রাহ্মণদের নির্বাক করে দিয়ে ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ সবার জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করেছিলেন। সংস্কৃতে অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল তার, কিন্তু ইংরেজিকে শিক্ষা গ্রহণের বাহনে পরিণত করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের চরিত্র সম্পর্কে মাইকেলের মূল্যায়ন অবিস্মরণীয়- 'প্রাচীন ঋষিদের মতো প্রতিভা ও জ্ঞান, ইংরেজদের মতো প্রাণশক্তি আর বাঙালি মায়ের হৃদয়।'বিদ্যাসাগর তার জীবনের সিংহভাগ ব্যয় করেছেন শিক্ষাবিস্তারে। নিজগ্রাম বীরসিংহে ১৮৫৩ সালে অবৈতনিক ও আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপন থেকে শুরু করে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত ৩৭ বছর ধরে তিনি একটি নরমাল স্কুলসহ ২০টি মডেল বিদ্যালয়, ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় ও একটি কলেজ স্থাপন করেছিলেন।ছিলেন পরাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। প্রখর আত্মমর্যাদা ও অসামান্য তেজস্বিতায়, বিপন্ন মানুষের দুর্দশা মোচনে, শিক্ষা বিস্তারে, নারী অধিকার রক্ষায় খাঁটি হিউম্যানিস্ট বিদ্যাসাগর ছিলেন অতুলনীয়। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছিলেন, 'ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব।' সমাজসংস্কারে আধুনিকতার জাজ্ব্বল্যমান প্রতীক বিদ্যাসাগর ধর্মীয় অনাচার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। উপমহাদেশে ও বিশ্বের নানা স্থানে যখন সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তখন বিদ্যাসাগরের জীবনী আলেখ্য স্মরণ একান্ত জরুরি।বাঙালি সমাজকে, বাঙালি জীবনকে মুক্তির পথ দেখাতে বিদ্যাসাগরের প্রতিটি কর্মযজ্ঞ যে কতটা সুদূরপ্রসারী তা আমরা আজও অনুধাবন করতে পারি না।বিদ্যাসাগর তার কালের চেয়ে প্রাগ্রসর মানুষ ছিলেন।মানুষের জন্য পুরো জীবন ব্যয় করলেন বিদ্যাসাগর। চাকরির উপার্জন, পুস্তক রচনা করে বিক্রিত অর্থ সমস্ত কিছু ব্যয় করলেন মানুষের জন্য।সর্বস্তরের জন্য শিক্ষা বিষয়ক বই, শিশুদের বর্ণপরিচয় থেকে শুরু করে সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদ করেছিলেন তিনি। তাঁর কিছু কিছু পাঠ্যপুস্তক কয়েক প্রজন্ম ধরে বাঙালি শিশুদের মৌলিক শিক্ষার প্রধান বাহন হয়েছে।বাঙালি শিশুদের কাছে বেদগ্রন্থ ছিল তাঁর লেখা বর্ণপরিচয়। রবীন্দ্রনাথের মতে, বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন। বাংলা গদ্যের জনক বিদ্যাসাগর সম্পর্কে সুকুমার সেনের মন্তব্য যথার্থ- 'তিনি প্রচলিত ফোর্ট-উইলিয়মি পাঠ্যপুস্তকের বিভাষা, রামমোহন রায়ের পণ্ডিতি ভাষা এবং সমসাময়িক সংবাদপত্রের অপভাষা কোনটিকেই একান্তভাবে অবলম্বন না করিয়া তাহা হইতে যথাযোগ্য গ্রহণবর্জন করিয়া সাহিত্যযোগ্য লালিত্যময় সুডৌল যে গদ্যরীতি চালাইয়া দিলেন তাহা সাহিত্যের ও সংসারকার্যের সব রকম প্রয়োজন মিটাইতে সমর্থ হইল।' পরবর্তীকালে বাংলা গদ্যের যে সুরম্য অট্টালিকা তৈরি হয়েছে এর ভিত্তি স্থাপন করেছেন বিদ্যাসাগরই।সমাজ সংস্কারের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নিরলস আন্দোলন সমগ্র বাঙালি জাতিকে নতুন পথে চলার রাস্তা দেখিয়েছিল। একটা আদর্শ স্থাপন করেছিল, একটা সংগ্রামের ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছিল। তিনি তাঁর প্রগতিশীল চিন্তাধারা দিয়ে সমাজকে নতুন পথের দিশা দিয়েছিলেন। জন্মের দ্বিশতবর্ষ পেরিয়ে আমরা হতভাগা বাঙালিরা তার দেখানো পথে হাঁটতে পারিনি। শুধুমাত্র তার জন্মদিনে প্রতিকৃতিতে মাল্যদান নয় তার জন্মদিনে বড় বড় গাল ভাড়া কথা নয় তার আদর্শ চিন্তা ভাবনাকে আমাদের প্রত্যেকদিন চলার পথে একনিষ্ঠ ভাবে অনুসরণ করতে হবে সেখানেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যথার্থ স্মরণ। আজকে চারিদিকে যখন বিদ্বেষ বিভাজন সামাজিক অবক্ষয় সংকট ঠিক সেই মুহূর্তেই বাঙালি জাতির উত্তরণে আলোর দিশারী বিদ্যাসাগর। বাঙালি জাতিসত্তার উত্তরণে সর্বোপরি বাংলা সংস্কৃতি ভাষা বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনে বিদ্যাসাগর এখনো আমাদের চির প্রাতস্মরণীয বরেণ্য ও শ্রদ্ধার আসনে উপবিষ্ট।
=========================================
চিত্র ঋণ - ইন্টারনেট
রচনা -পাভেল আমান- হরিহরপাড়া -মুর্শিদাবাদ