ধারাবাহিক গল্প।। প্রেম ও সংকল্প।। দীপক পাল
প্রেম ও সংকল্প ( ৪র্থ পর্ব )
দীপক পাল
পরদিন জুলাই মাসের প্রথম তারিখ। সুমন্তর সাথে চান্দ্রেয়ীর দেখা হলো বাসস্ট্যান্ডে। চান্দ্রেয়ীর বাবা নাকি আজ অনেকটাই ভালো। তিনিই জোর করে চান্দ্রেয়ীকে কলেজে পাঠিয়েছেন। কাকু নাকি শুক্রবার অফিসে যাবেন।
শনিবার ও রবিবার দুদিন ছুটি থাকায় তিনি শুক্রবার অফিস জয়েন করবেন। সেপ্টেম্বরে তার এক্সটেনশনমে য়াদ শেষ হয়ে যাবে। ডাক্তার চন্দ্রকে রাজি করিয়ে ফিট সার্টিফিকেটটা বানিয়ে নিতে হবে। এই সব কথা চান্দ্রেয়ী তাকে বললো। অবশেষে সে টাটা করে বাসে উঠে পড়ল। সুমন্ত এবার ঘুরতেই মনোজদার চোখাচোখি হলো।
- ' কিরে সুমন্ত মেঘ কেটে সূর্য উঠলো অবশেষে। যা ভালো থাক, সুখে থাক।' হেসে বললো মনোজদা।
- ' তোমার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক।' বলে সুমন্ত।
- ' না না না, ফুল চন্দনে আমার কোনো লাভ নেই, আমার লোভ রসগোল্লা, সন্দেশ, রাবড়ি বুঝলি।'
- ' আচ্ছা বুঝলাম। দেখা যাবে ভবিষ্যতে। অবশ্য এগুলো তুমি পাবে কান্তির দোকানে। আমি ওকে বলে দিচ্ছি তোমাকে পাঠাতে। তুমি খেয়ে পয়সা টা দিয়ে দিও কেমন।'
- ' তবে রে হতচ্ছাড়া, দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা
তোকে।'
মনোজদা দোকান থেকে বেরিয়ে
আসতেই সুমন্ত বাড়ীর রাস্তায় প্রায় দৌড়তে থাকলো। ঠিক সেই সময় সুচন্দ্রা ইস্কুলে
যাচ্ছিল। ওকে দৌড়তে দেখে যেন একটু অবাক হলো। সুমন্ত কিন্তু গতিবেগ না কমিয়ে সোজা
গিয়ে বাড়ীতে ঢুকলো।
সুমন্ত ঘর থেকে বেরলো বিকেল সাড়ে ৪টায়। ক্লাস ৫টা থেকে ৭টায়। প্রথম দিন ও বাসেই যাবে। পরদিন থেকে সে হেঁটেই যাবে। কারণ প্রতিদিনই সে বিকালে এমনিতেই পার্ক সার্কাসে ঘুরতে যায়। পুরো ২/৩ টে পাক ঘুরে, অবশ্য খুব আস্তে আস্তে, পার্ক থেকে বেরিয়ে এসে ফেরার পথে বাম দিকে আরও একটা ছোট পার্ক পড়ে।
সুমন্ত সেই পার্কের পেছনের গেট দিয়ে ঢুকে সরু পিচের রাস্তার গায়ে যে শেড দেওয়া বেঞ্চটা আছে তাতে বসে।
এরপর একে একে সব বন্ধুরা আসতে থাকে। তারপর রাত ৯টা পর্য্যন্ত আড্ডা চলে, তারপর ধীরে ধীরে গল্প করতে করতে বাড়ি ফেরে সাড়ে নটায়। সুমন্ত ৫টার মধ্যেই স্কুলে পৌঁছে গেলো। প্রথম ক্লাস শর্টহ্যান্ড শেখা।
তার আবার দুটো ভাগ, প্রথম ভাগটা যারা নতুন শিখছে তাদের জন্য আর দ্বিতীয় ভাগটা যারা শিখে গেছে তাদের ডিকটিশন নেওয়া স্পিড তোলার জন্য। এর পরের পিরিয়ড এক ঘন্টা টাইপ শেখা। নতুন, পুরনো সব একসাথে।
এদিকে বি
কম পরীক্ষার রেজাল্ট বেরলো সেপ্টেম্বরের শেষে। রেজাল্ট তার খুব ভালো হয়েছে তার। কিন্তু সে কি করবে
ভেবে পেলনা। কারণ বাবা তার এক চেনা শোনা মাড়োয়ারি কোম্পানীতে একাউন্টিং কাজে তাকে নিযুক্ত
করতে চায় কিছু অভিজ্ঞতার জন্য। সে অনেক ভেবে সেখানে ১৬ই আগস্টে জয়েন করলো।
কোম্পানির মালিক দুই ভাই। দুজনেই ইয়াং, স্মার্ট ও শিক্ষিত। এক্সপোর্ট ইমপোর্টের ব্যবসা করে। চলেও ভালো।
একাউন্টস এ দুজন লোক আছে। একজন পারচেজের দিকটা দেখে ও আর একজন দেখে সেলস এর দিকটা।
সুমন্ত ওদের হেল্প করে। এছাড়া এটেনডেন্ট শিট্ ও পে-শিট্ও বানাতে হয়। একটু আধটু টাইপের কাজ ও করতে হয়। কিন্তু মন দিয়ে একাউন্টস এর কাজ ও শিখে নিচ্ছে সেই দুজন লোকের কাছ থেকে। তাদের নাম জীবনদা
ও তারকদা। আগস্ট মাসের মাইনে পেয়ে সদর স্ট্রীটে গিয়ে কস্টিং এর ফার্স্ট ফেজের পরীক্ষা দেবার জন্য যা যা করার করে এসেছে। এ ছাড়া কলেজ স্ট্রীটে গিয়ে খান তিনেক বই কিনে এনেছে। মন দিয়ে এবার থেকে পড়াশোনায় লেগে পড়তে হবে যাতে কস্টিং ইন্টারটা অন্তত পাশ করা যায়। আড্ডাটা কমাতে হবে। টাইপ সে ছেড়ে দিয়ে খালি শর্টহ্যান্ড ক্লাসটা করবে। শর্টহ্যান্ড ক্লাসে এখন থেকে সে অফিসের পরে সাড়ে ছটায় যাবে।
ওখান থেকে বাসে করে সোজা বাড়ী ফিরবে। সে এবার থেকে সেই কাজই শুরু করলো। সেপ্টেম্বরের প্রথম রবিবার চান্দ্রেয়ীর বাড়ি গিয়ে সব বলে এসেছে সে। সবাই খুশী হয়ে খুব উৎসাহ দিয়েছে সুমন্তকে।
অতি দ্রুত
সেপ্টেম্বরটা কেটে গেল। মাসের মাইনে পেয়ে
মায়ের জন্য একটা ভালো কাপড় আর বাবার জন্য পাঞ্জাবী
পায়জামা কিনলো। তারা এই অল্পতেই খুব খুশি হলো। চান্দ্রেয়ীর কিছু কেনা ঠিক হবে কিনা
সেটা বুঝতে পারলো
না। যদি রাগ করে। কিন্তু মনোজ দাকে রসগোল্লা আর রাবড়ি খাইয়ে দিয়েছে। খুব খুশী হয়ে বলেছে,
- ' তোর সাথে আমি ইয়ার্কি করেছিলাম, তাই বলে..'
- ' আমিতো তোমাকে বলেছিলাম পরে দেখা যাবে, সেই কথাটার একটা মর্যাদা আছে না? তাই না?'
- ' বেঁচে থাক আর খুব সুখে থাক।'
অফিস থেকে বেরিয়ে পরি মরি করে ছুটতে হয় শর্টহ্যান্ড ক্লাসে। ভাবছে অক্টোবর মাস টা করে শর্টহ্যান্ড ক্লাসটা ছেড়ে দেবে। যদি সম্ভব হয় টিভিতে ইংরেজি খবর শুনে প্রাকটিস করবে। কিন্তু কস্টিং পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতিটা করার দরকার বেশী। সামনে আসছে দুর্গাপূজা, কালী পূজা। কিন্তু তাতে এবারে মেতে যাওয়া চলবে না। কিন্তু ওদের বাড়ীতে আবার কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা হয়। এবারে ভাবছে চান্দ্রেয়ীকে লক্ষ্মী পূজার দিন বাড়ীতে নিমন্ত্রণ করে আনবে। এইসব চিন্তা করতে করতে ক্লাসরুম থেকে বেরোতেই দেখে অফিসে রুমের একটা চেয়ারে বসে আছে চান্দ্রেয়ী। হাতে বড়ো একটা প্যাকেট। সুমন্ত ওকে দেখে যেমন অবাক ও তেমনি খুশী হল। বলে,
- ' আরে, তোমার কথা ভাবতে ভাবতে বেরচ্ছিলাম '|
- ' থাক আর বলতে হবে না। কতদিন কোন একটা খবর নেই, ভুলে গেলে কিনা সেটা পরখ করতেই স্বয়ং এসে হাজির হলাম। তাও ভাবলাম মনে মনে কি জানি দেখা হবে কিনা কে জানে।'
- ' সমু, তুমি এভাবে বলো না। সত্যি আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম। বিশ্বাস কর।'
- ' আচ্ছা বেশ বিশ্বাস করলাম। এখন বেরোবে তো?'
- ' হ্যাঁ হ্যাঁ চলো।' ওরা সিঁড়ি বেয়ে ফুটপাথে নামলো।
- ' এখন বাড়ী ফিরবে তো?' জিজ্ঞেস কর সুমন্ত।
- ' হ্যাঁ এখন বাড়ী ফিরবো কিন্তু হেঁটে। কতদিন পরে দেখা। কত গল্প জমে আছে আমাদের মনে। সেগুলো সব শেয়ার করতে করতে যাব। কত মজা হবে।'
- ' হ্যাঁ তাই চলো। আমিও এখন হেঁটেই ফিরি বাড়ী।'
- ' আগে তো শুনেছি এখান থেকে সোজা আর এক পার্কে গিয়ে আড্ডা মেরে বাড়ী ফেরো।'
- ' এখন অফিস করে শর্টহ্যান্ড ক্লাস করে সোজা বাড়ী চলে যাই। কারণ খিদে পেয়ে যায়, তাছাড়া মন দিয়ে পড়াশোনাটা তো করতে হবে। একটা চেষ্টা তো করি কস্টিংয়ের ইন্টারটা যদি অন্তত দুবছরের মধ্যে পাশটা করতে পারি।'
- ' অবশ্যই। আমি জানি তোমার দু বছর লাগবেনা।'
- ' এমন একসেপ্ট করো না প্লীজ।'
- ' আজকে চলো আমাদের বাড়ী। মা তোমার কথা খুব জিজ্ঞেস করে আমাকে।'
- ' ইচ্ছে তো করে খুব, কিন্তু প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করে সময় বার করা কঠিন। তাছাড়া আছে পড়াশোনা। কি করি বলো। কিন্তু তোমাকে এমন কি কাকু কাকিমাকে ভুলে যাবো এমনটা কখনো হয়।'
- ' ঠিক আছে, তাহলে আজ এখনই প্রমাণ দাও।'
- ' কি ভাবে দেবো বলো?'
- ' আমাদের বাড়ির কাছাকাছি তো এসে গেছি যদি প্রমাণ দিতে চাও তবে আমি তোমাকে এখন চায়ের নিমন্ত্রণ করছি। চলো। বেশিক্ষণ সময় নেব না।'
- ' ওদিকে মা' বাবা চিন্তা করবে। আচ্ছা চল। কিন্তু বেশিক্ষণ বসবো না কেমন।'
- ' না বেশীক্ষণ নেব না। কিন্তু একটা খুব জরুরী কথা আছে তোমার সঙ্গে যদি কিছু মনে না কর তবেই বলব, না হলে না।'
- ' আচ্ছা বেশ কথা দিলাম। কি বলবে বলো।'
চান্দ্রেয়ী তার হাতের প্যাকেটের ভেতর থেকে আর একটা প্যাকেট বার করে সুমন্তকে দিয়ে বললো,
- ' তোমার জন্য এই গেঞ্জীটা কিনেছি, আশা করি এটা পরে বেশ মানাবে তোমায়। তবে আমি দিয়েছি এ কথা কাউকে বলার প্রয়োজন নেই।'
- ' ঠিক আছে এটা নিলাম আমি। পূজোর সময় অতি অবশ্যই পড়বো এটা। কিন্তু সমু তুমি আমার একটা সঙ্কোচ কাটিয়ে দিলে।'
- ' কি সেই সংকোচ তোমার তাড়াতাড়ি বলে ফেলো, গেটের কাছে এসে গেছি যে।'
- ' সেপ্টেম্বরের মাইনে পেয়ে একটু পূজার বাজার করেছি বাড়ীর জন্য। তোমার জন্যও একটা শাড়ি কিনবো ভেবেছিলাম ভাল দেখে। কিন্তু চিন্তা হলো তুমি যদি রাগ করো, তবে আমি কোথায় যাব। এই ভয়ে পিছিয়ে গেলাম। সেই ভয়টা এখন কেটে গেল। তোমার পছন্দটা জানতে পারলে ভাল হয় আমার।'
- ' তুমি যেটা কিনবে সেটাই আমার পছন্দ হবে। তবে একটা কথা আমি খুব সাধারণ মেয়ে, তাই যেটা কিনবে সেটা যেন বেশী দামী না হয়।'
চান্দ্রেয়ী বাড়ির গ্রীল গেটটা খুলে সুমন্তকে ঢুকতে দিল তারপরে গেট বন্ধ করে এগিয়ে গেল। সুমন্ত ওর পেছন পেছন গিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। ঢুকে দেখল কাকু খাটের ওপর বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। কাকিমা ঘরে নেই। চান্দ্রেয়ী মাকে ডাকলো- ' মা মা দেখো কাকে এনেছি, তোমায় বলেছিলাম না আজকে সুমন্তকে ধরে আনব ঠিক দেখো।'
কাকু খবরের কাগজটা নামিয়ে সুমন্তকে বসতে বললো চেয়ারে। এপাশ থেকে কাকিমা ঘরে ঢুকে এক গাল হেসে একটা চেয়ার টেনে বসে বললো - ' অনেক দিন পরে এলে বাবা। সমু ধরে না আনলে তো আজকেও আসতে না। যাই হোক তুমি কেমন আছো? বাড়ির লোকই বা কেমন আছে?'
- ' সবাই ভালো আছে। আপনি ভালো? আর কাকু, আপনি ভালো আছেন তো।? আপনার এক্সটেনশন পিরিয়ড কি শেষ হয়ে গেছে?
- ' হ্যাঁ এখন আমি একদম ফ্রী। ৫৮ বছরে অবসর নেবার কথা ছিল, ২ বছর এক্সটেনশনের পর ৬০ বছরে অবসর নিলাম। যথেষ্ট হলো, আর কেন।'
- ' তুমি একটু বস আমি একটু চেঞ্জ করে আসি।'
এ কথা বলে চান্দ্রেয়ী পাশের ঘরে গেলো। ওর মা সুমন্তকে বললেন - ' জান, আজ সকালেই আমি সমুকে বললাম বহু দিন হলো সুমন্ত আমাদের বাড়ীতে আসে না, তুই কিছু বলিসনি তো ওকে।
- ' আচ্ছা দাঁড়াও আজই ওকে নিয়ে আসতে পারি কিনা দেখি। আমাকে তখন তোমায় বিশ্বাস করতে হবে। আমার আসতে তবে একটু দেরি হবে। কারণ সন্ধ্যে সাতটার আগে ওকে পাওয়া যাবে না, সেই ফাঁকে আমি গড়িয়াহাটে গিয়ে বাবার দেওয়া টাকা নিয়ে পূজোর বাজারটা করে নেবো। মাঝের সময়টা আমি এই কাজটাই করবো বুঝলে কিছু?'
- ' ও তাই নাকি?'
ভেতর থেকে সমু মাকে ডাকতে উনি বলেন,
- ' যাই সমু ডাকছে। তুমি একটু বস আমরা এখুনি আসছি। তোমার বেশী দেরী হবে ন। জানি তোমার মা খুব চিন্তা করবে।'
( চলবে )
চিত্র ঋণ - ইন্টারনেট
======================================
Dipak Kumar Paul,
DTC Southern Heights,
Block-8, Flat-1B,
Diamond Harbour Road,
Kolkata - 700104.