(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
সমীর কুমার দত্ত
বিলাস দাস গতরাতে দেহ রেখেছেন। হাঁপানির টান ছাড়া আর কোন রোগ ছিলো বলে মনে হয় না। দেশ ভাগের পর বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলা থেকে স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা নিয়ে এ দেশে এসে উঠেছেন। তবে কোন জায়গা দখল করেননি। মানুষটা নিঃস্ব হয়ে এদেশে এসে হাওড়া কোর্টে মূহুরীর কাজ জুটিয়ে নিয়েছিলেন। নামমাত্র রোজগারে হাওড়া ময়দান থেকে কিছুটা ভেতরে মাসিক তিন টাকা ভাড়ায় এক কামরা টিনের চালের পাকা ঘরে এসে উঠেছেন। ঐ নামমাত্র উপায়ে চার চারটে পেট, বাড়ি ভাড়া দিয়ে ঠিক কুলিয়ে উঠতে পারতেন না।
মানুষ ছিলেন খুব সৎ ও মর্যাদাসম্পন্ন। কাছাকাছি অনেক আত্মীয় থাকা সত্ত্বেও দুর্দিনে কারও কাছে হাত পাততেন না। প্রয়োজনে একমাত্র পথ কাবুলিওয়ালার কাছে টাকা ধার করা। যে সময়ের কথা বলছি সে সময়ে কাবুলিওয়ালা ছাড়া টাকা ধার করার আর কোন উৎস ছিলো না।ঠিক সময়ে হয়তো ধারের টাকা শোধ করে উঠতে পারতেন না।তাই কাবুলিওয়ালা ঘর থেকে দূরে সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে হাঁক পাড়তো, "রামবিলাস,এ রামবিলাস বাহার নিকলো। 'রামবিলাস' নামটি সংক্ষিপ্ত করে সকলে 'বিলাস' বলেই ডাকে। ব্যতিক্রম শুধু কাবুলিওয়ালা।যাই হোক বিলাস বাবু চুপ করে কিংবা আত্মগোপন করে থাকার লোক নন। ডাক শুনেই বেরিয়ে আসতেন , টাকা দিতে পারুন আর নাই পারুন । সুদ দেবার হলে দিয়ে দেন। না পারলে এসে বলেন, "দো রোজ কামাই অ্যাইসা কুছ নেই হুয়া। পরশু রোজ আ যাও দে দেঙ্গে, জরুর মিল জায়েগা।"
বেশ কয়েক বছর পর বিলাস দাসের আরও দুটি পুত্র সন্তান হয়। প্রথম সন্তান তিনুর বয়স তখন বছর কুড়ি।তিনুর পর কন্যা শেফালীর বয়স তখন সতেরো বছর। অর্থাৎ তিনুর চেয়ে তৃতীয় সন্তানের বয়সের ব্যবধান কুড়ি বছর আর চতুর্থ সন্তানের বয়সের ব্যবধান তেইশ বছর। কন্যা শেফালীর বিয়ে দেন আঠারো বছর বয়সে পোষ্ট অফিসে কর্মরত এক পাত্রের সঙ্গে। আর তিনু অকৃতদার। দর্জির কাজ করে। দুটো ভাই ওর তুলনায় খুবই ছোট।প্রায় সন্তান তূল্য। ওদের মানুষ করতে হবে। সুতরাং বিলাস বাবুর বাস্তব জ্ঞানশূণ্যতার জন্যই বোধ হয় তিনু আর সংসার করতে চায় নি। শেষে যে দুটি পুত্র সন্তান হয় তাদের একজনের নাম গোবিন্দ আর ছোটটির নাম শ্যামল।
তিনু সময় পেলে ছোট ভাই দুটিকে পড়াতে বসতো। পড়ানোর নামে তাদের ওপর এমন চাপ সৃষ্টি করতো যে অবস্থা এমন হতো, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি'র মতো। অন্য ছেলেপুলেরা যখন খেলছে, তিনু তখন দু ভাইকে নিয়ে পড়ার নামে যুদ্ধ করছে। বেচারিরা যখন সময় পেতো তখন খেলার সঙ্গী পেতো না। পড়া না পারলে শাসনের বহর দেখে এক এক সময় বিলাসবাবু বলতেন, "তোরে পড়াইতে হইবো না। বাস্সা পোলাদের মাইরা পড়ানোর কি দরকার। আমি দেইখ্যা লমু।"
একদিন শ্যামল অর্থাৎ কনিষ্ঠ সন্তানটা কোথায় যে চলে গেলো, তার আর পাত্তা পাওয়া গেলো না। পুলিশে ডাইরি করে ফটো দিয়ে কোন কিছু লাভ হয়নি। পুলিশ কিছু হদিশ করতে পারলো না। তখনকার সময় এতো ছেলে ধরার উপদ্রব ছিলো না। টেলিভিশন ছিলো না। কেবল অল ইন্ডিয়া রেডিও।তখন খবরের কাগজে নিরুদ্দেশ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন এতো ছিলো না। ছোট ছেলেকে হারিয়ে সাবিত্রী খাওয়া দাওয়া, ঘুম সব ত্যাগ করলো। খুব রুগ্ন হয়ে পড়লো। তার ওপর স্নায়ুর চাপে ঘটলো মস্তিষ্ক বিকৃতি। চুপচাপ শুয়ে থাকতো।রান্না করতো না ,স্নান করতো না,কাপড় কাচতো না।উদোম পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলে। বিলাস দাসের বয়স তখন অনেকটাই। তদুপরি অ্যাজমাটিক রোগী। সুস্থ থাকুন না থাকুন তাঁকেই বাজার, দোকান,উনুন ধরানো,রান্না করা সবই করতে হতো। বেচারি পেরে উঠতেন না। তিনু কোন কোন দিন দুপুরে খেতে এসে যদি দেখতো রান্না হয়নি, রান্না চাপিয়ে মাকে বলতো,"ওঠ ওঠ,ওইঠ্যা মুখ ধো। কী হইসে ?সব সময় শুইয়া থাকস।মুখ ধুইয়া মুখে কিসু দে।"
বলে নিজে রান্না করে দুটো ভাই,বাবা,মা কে খাইয়ে তবে নিজে খেতো। খেয়েই আবার ছুটতো দোকানে। অসুবিধে হতো পূজোর সময়, পয়লা বৈশাখ প্রভৃতি উৎসবের সময়। যদিও তখন মানুষের হাতে টাকা তেমন ছিলো না। অবস্থাপন্ন লোকেদের মধ্যেই ছিলো উৎসব। তিনুই দু ভায়ের ও বাবার শার্ট তৈরি করা, মা বাবার কাপড় কিনে দেওয়া ইত্যাদি দায় দায়িত্ব পালন করতো। ছেলেটা খুব ভালো ছিলো। খুব দুখচেটে ও কর্তব্য পরায়ণ।
বিলাস দাস যেদিন মারা গেলো তার আগের দিনও ভোর বেলা কাবুলিওয়ালা এসে ডেকেছিলো, "এ রামবিলাস, হামারা পয়সা দে যাও।"
তখন পয়সা বলতো এইজন্যে যে পয়সার তখন খুব দাম ছিলো। বিলাস দাস কথা দিলে কথা রাখতেন। সুতরাং কাবুলিওয়ালার হাতে তার প্রাপ্য মিটিয়ে দিলে কাবুলিওয়ালা বললো, " এ রামবিলাস, আর রুপায়া উধার লিবে না?
"আউর রুপিয়া কা জরুরত নেহি হ্যায়।"—বিলাস দাস জানালেন।
—রুপায়া লিবে না তো হামারা বেওসা চলবো কৈসান?
—হাম রহেগা নেহি তো পয়সা কা কেয়া জরুরত?
—তুম রহেগা নেহি তো যায়েগা কাঁহা? কহি দূর চলা যায়েগা কেয়া?
—তুম একদম সহি কহা।হম দূর চলা যায়েগা। এতনা দূর জাঁহা সে কভী বাপস আ নেহি সকতা
—তুমারা দিমাক খরাব হো গিয়া কেয়া?
কাবুলিওয়ালার সঙ্গে এই কথোপকথনের পরের দিনই বিলাস দাস দেহ রেখেছেন।সৎ মানুষ, হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন। অকৃতদার তিনুর ঘাড়ের ওপর বিধবা,বিকৃত মস্তিষ্ক সম্পন্ন মায়ের ও এক ভাই গোবিন্দর দায়িত্ব দিয়ে ইহলোকের মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন। তাঁর মৃত্যু তাঁর বিকৃত মস্তিষ্ক সম্পন্ন স্ত্রীর ওপর কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে নি। একদিকে স্বামীর মৃতদেহ পড়ে আর অন্যদিকে স্ত্রীর উদাসীন ভাবে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে থাকার অর্থ, সংসার সম্বন্ধে তার সংবেদনশীলতা হারিয়ে গিয়েছে ওই এক ছেলের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার কারনে।এমন কি নিজের জীবনের প্রতিও সমস্ত আকর্ষণ হারিয়ে গেছে। বিলাসবাবুও ছোট ছেলেকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি হয়তো সর্বসমক্ষে অশ্রুবিসর্জন করতেন। পুরুষের শোকের বহির্প্রকাশ স্ত্রীলোকের থেকে অপেক্ষাকৃত কম। রাতে হাঁপানির টানটা বেড়ে গেলে। মুখের ভেতর স্প্রে করে হাঁপানি কিছুটা কমলে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করতেন। কিন্তু মায়ের মন তো সন্তানের জন্য সর্বদাই ব্যাকুল। তাই শোক সহ্য করতে না পেরে উন্মাদ হয়ে গেছেন।
এখন তিনুর হয়েছে মহাবিপদ। উপার্জন করতে যাবে না ঘরের রান্না বাটনা, মাকে স্নান করানো,খাওয়ানো এসব করবে। স়সারের পুরো দায়িত্বটা এখন তিনুর ওপর।বোন শেফালী যেদিন আসে এটা ওঠা করে দিয়ে সাহায্য করে। রোজ তো আসতে পারে না।তারও তো সংসার আছে। এরমধ্যে আবার একটা ঘটনা ঘটলো। তিনুর মা সাবিত্রী দেবী একদিন ভোরবেলা ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন।তারপর থেকে তাঁর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নি। তিনুও ঘরে শুয়ে ছিল।বাবা যখন বেঁচে ছিলো তখন তিনু দোকানে শুতো। বাবা মারা যাওয়ার পর ঘরে শোয়। সারাদিন অনেক খাটুনি হয়। তাই রাতের দিকটা ঘুমটা ভালো হয়। সেইরাতে অথবা খুব ভোরে সাবিত্রী বেরিয়ে যায়।
তিনু কি আর করে। ঘরের সব মালপত্র বিক্রি করে দিয়ে ভাই গোবিন্দকে নিয়ে দোকানে থাকবে বলে স্থির করলো। কি হবে আর ঘর রেখে। মাথা নেই তার মাথা ব্যাথা। গোবিন্দকে দোকানে নিয়ে যেতে তিনুর সুবিধেই হয়েছে। ওকে হাত সেলাইয়ের কাজ শিখিয়ে দিতে পারলে ওই সমস্ত কাজের জন্য বাইরের লোক রাখতে হয় না। তাতে দুটো পয়সার সাশ্রয় হয়। গোবিন্দর কাঁচা হাতের কাজে ভুল হয়। আবার খুলে করতে হয়। তাতে সময় চলে যায়। তিনু গোবিন্দকে বকাঝকা করে কখনও কখনও গায়ে হাতও তোলে।গোবিন্দ কান্নাকাটি করে। বড় অসহায় ছেলে।এখনও ওর পড়ার ও খেলার বয়স। পড়া তো হলো না আর খেলাও হলো না। কাজ শিখবে, কাজে মন লাগে না। কোন অবসরও পায় না।ওর মতো বয়সী ছেলেরা যা করে, ও সেই সুযোগ পায় না।ছেলেটা মরমে মরে যায়।এই বয়সে এতো চাপের মধ্যে ওর নাভিঃশ্বাস উঠছে।এর থেকে ও মুক্তি চায়।
একদিন চুপিসারে দাদার আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো অকালে হারিয়ে যাওয়া তার ভাই শ্যামল, যে সম্ভবত পড়ার চাপ থেকে মুক্তি পেতে আর দাদার মারের হাত থেকে বাঁচতে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, আর ওর মা, যিনি উন্মাদ হয়ে ভায়ের খোঁজেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন।তিনু , যে শত আঘাতেও কোন দিন কাঁদতে শেখেনি, যখন টেবিলে রাখা একটা চিঠি মারফৎ জানতে পারলো যে গোবিন্দও তাকে ছেড়ে চলে গেছে। আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে নি।চিঠিতে সে লিখেছে, " দাদা, তোমার আশ্রয় ছেড়ে মা আর ভায়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম তোমাকে দায় মুক্ত করে। যদি পথ চলতি পথে ওদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ভালো। না হলে ওদের মতো আমিও হারিয়ে যাবো। এতোদিন তুমি আমাদের ভালো করার চেষ্টা করেছো, কিন্তু নিজের ভালো করোনি।তোমারও তো বয়স বেড়ে যাচ্ছে, তোমায় দেখবে কে। তুমি পারলে তোমার একটা সংসার পেতো। তোমার মতো দাদা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার ।ইতি —গোবিন্দ।"
তিনু মাথায় হাত দিয়ে সব স্বজন হারানোর দুঃখে কান্নায় ভেঙে পড়লো। এখন ওকে সান্ত্বনা দেবে কে? যাদের কথা ভেবে ও বিয়ে করেনি,তারা সবাই ওকে ছেড়ে একে একে চলে গেলো। রামবিলাসের সংসার একটু একটু করে ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবার উপক্রম হলো।
==========================
চিত্র ঋণ - ইন্টারনেট
Samir Kumar Dutta
Bally, Howrah