একটা কান্নার শব্দ অনবরত বহুদূর থেকে ভেসে আসছে কানে, কে কাঁদে? অনিমেষের চোখ খুলে দেখতে ইচ্ছে করছে না। আজ শরীরে মনে বড় শান্তি, কত যুগ পরে এমন শান্তির ঘুম, মনে করতে পারে না অনিমেষ। স্বার্থপরের মত শোনালেও কিছু করার নেই।এই শান্তিকে বিঘ্নিত করার সাধ্য তার নেই। এই শান্তির মধ্যে কাঁটার মত ঐ কান্নার শব্দ যতই বিড়ম্বনা দিক, উপেক্ষা করা ছাড়া তার গতি নেই। একটু অবাক লাগে অনিমেষের। এমন তো নয়, যে অনেকদিন ঘুমোয়নি, যতদূর মনে পড়ছে নিয়ম করে যেমন ঘুমোনোর কথা তেমনি ঘুমিয়েছে।তবে আজ কেন এত ভালো লাগছে, চোখ খুলতে ইচ্ছেই করছে না। যাই হোক তেমন কিছু হলে রিমি তো তাকে ডাকতে আসতো।যখন ও ডাকবে তখন দেখা যাবে। ততক্ষন এই প্রশান্তি উপভোগ করা যাক। যদিও অনিমেষ এসির ব্যাবস্থা করে নি তবুও বেশ একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। সম্ভবত জৈষ্ঠ মাসের গরমে ঠান্ডা আমেজ সত্যিই ভীষণ আরামপ্রদ। এটা জৈষ্ঠ মাস। সম্ভবত এই কারণে,মনে আছে,গত মাসেই হালখাতার নিমন্ত্রণ ছিল,বাপ বেটিতে সে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিল ।অনেক অনুরোধ স্বত্বেও তার মা বেড়তে চায় নি।তাই মনে আছে।এমনি তে অনিমেষের বাংলা সন তারিখ মনে থাকে না কোন কালেই, কিন্তু ঋতুর হিসেব করতে গেলে কেন জানি না বাংলা মাসের কথাই মনে আসে।
অনিমেষের অফিসে এসি ছিলো সেই ঠান্ডায় ওর একটা সময় কষ্টই হতো। সেকারণে ও বাড়ীতে এসির বন্দোবস্ত করেনি কখন। কিন্তু আজকের এই ঠান্ডার অনুভুতি টা সম্পূর্ণ পৃথক। এই ঠান্ডার তীব্রতা কম,অনেকটা গ্রীষ্মকালে বাঁশঝাড়ের জঙ্গলে এমন ঠান্ডা উপভোগ করা যায়, তার ওপর, ওর সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ শরীরটা যেন নরম তুলতুলে একটা বিছানায় পড়ে আছে। কি অনির্বচনীয় সুখ ওকে ঘিরে রয়েছে। বয়সোচিত যে সব রোগ ব্যারাম শরীরের উপস্থিতি জানান দেয়,সে সব ও যেন শরীর থেকে বিদায় নিয়েছে। ফলত এই সুখ ছেড়ে অন্যত্র যাবার কোন ইচ্ছে আপাতত তার নেই।
ইচ্ছে করেই বা কি করবে, কোন অবস্থার পরিবর্তন করা এই বয়েসে তার পক্ষে সম্ভব নয়।
প্রায় বছর পাঁচেক হলো এই টু বি এইচ কে ফ্ল্যাট টা কিনেছিল অনিমেষ। সেই ছাত্রাবস্থা থেকে এই শহরের বিভিন্ন জায়গায় বাড়ী পাল্টে পাল্টে লাট খেয়েছে। শেষে অবসরের পর শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে একটু দূরে নিরালায় এই আস্তানা অনিমেষের বেশ পছন্দ ছিল। পছন্দ ছিলো মা-মেয়ে দুজনেরই। এখানে আসার আরও আরেকটা কারণ হল। রিমির স্কুল বাড়ী থেকে হাঁটা পথেই। সারা জীবন ভাড়া বাড়ীতে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিল পরিবার টা। যতই ভাড়া দাও না কেন! ভাড়া বাড়ী তো আর নিজের বাড়ী নয়। ভাড়া বাড়ীতে বিভিন্ন বিধি নিষেধ। একটা নজরদারির মধ্যে দিন গুজরান। সেই নজরদারির থেকে মুক্তি! দুই কামরার ফ্ল্যাট হলেও জায়গা নেহাত কম নয়, প্রায় সাড়ে ন'শো, ড্রয়িং কাম ডাইনিং রুম টা বেশ বড়। তবে অনিমেষের বরাদ্দ ঘরের সাথে পশ্চিমের ব্যালকনি টা ওর সব থেকে পছন্দ। ব্যালকনি তে বসে সূর্যাস্ত দেখা এই পাঁচ বছরে ও প্রায় অভ্যাস করে ফেলেছে। সূর্যাস্তের আলোতে, কেমন যেন একটা মায়াবী ব্যাপার আছে। সাড়া দিনমান যাঁর দোর্দন্ড প্রতাপ, অস্তায়মান সেই কত নম্র,কত ধীরে রঙ্গমঞ্চ থেকে প্রস্থান। টুপ করে জগৎ সংসার অন্ধকারে আচ্ছন্ন। সাড়া দিন তার কত কর্মকান্ড,কত তেজ, কিন্তু সূর্যাস্তের পর, তার কথা কেউ স্মরণ করে।ভারি আশ্চর্য বোধ হয় অনিমেষের। যতক্ষন তার উপযোগিতা,ততক্ষন তাকে নিয়ে আলাপ,তারপরেই বিস্মরণ। সেই অভিমানেই বুঝি, অস্তগামী দিবাকর,সাড়া আকাশে অভিমানের লাল বর্ণ ছড়িয়ে দিয়ে প্রতিদিন বিদায় নেয়।
সঞ্চিত অর্থের কিছু আর প্রফিডেন্ট ফান্ড আর গ্রাচুইটির টাকায় হয়ে গেল ফ্ল্যাট টা,একটু দ্বিধা ছিল কিন্তু রিমি আর তার মায়ের উৎসাহে অনিমেষ দ্বিতীয় বার আর ভাবেনি। বহু দিনের কৃচ্ছ্র সাধন! কত বুঝে শুনে চলা। সেই মিতব্যয়ীতা নিয়ে কত কথা শুনিয়েছে শাশ্বতী । সারাটা জীবন অনিমেষ ভেবেছে নিজের একটা বাড়ী, ছেলেবেলায় বাবার মুখে শুনেছে, ওপার বাংলায় নিজেদের বাড়ীর কথা,বাবা এই দেশে এসে ছেলে পিলে মানুষ করতে আর গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যাবস্থা করতেই জীবন পার করে ফেলেছেন। তার আর নিজের বাড়ী করা হয়ে ওঠেনি। সেই সম্ভবনা ও ছিলো না। তাই নিজের বাড়ীর স্বপ্ন, ছেলেবেলা থেকেই অনিমেষের বাসা বাঁধার বাসনা মনে গেঁড়ে বসেছিল। শাশ্বতী হাড় কিপটে বলে কত কথা শুনিয়েছে,কখন রাগ করেনি অনিমেষ,মনের পরিকল্পনা মনে চেপে রেখে, সঞ্চয় করে গেছে।দীর্ঘ কৃচ্ছ্র সাধনের ফলশ্রুতি অনিমেষের আস্তানা। বিষয় টা শুধু আনন্দের না তৃপ্তির,নিশ্চিন্ততার!
বাবা চলে গেলেন তখন অনিমেষ কলেজে পড়ে। সেই থেকে প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। টিউশানি তখন নিজের খরচা খরচ চালানোর হাতিয়ার। নিজের খরচ চলে গেলেও বাড়ী ভাড়া আর আহারাদির জন্যে এর তার কাছে হাত পাত তে হত প্রায়শই। সেই দিনটা কখন ভুলতে পারে অনিমেষ? আজ মনে হয় ঐ অবস্থায় দিন গুজরানের জন্যেই জীবনে চলার পথ টা ঠিক চিনে নিতে পেড়েছিল , জীবনে প্রথম চাকরি কলেজ স্ট্রিটে এক বই প্রকাশকের অফিসে হিসাব-রক্ষকের। তখন বেশ নিশ্চিন্ত মনে হয়ে ছিল, মনে হয়ে ছিল এই বার একটু সুখের দিনের নাগাল পাওয়া গেল।কিন্তু কিছুদিন পরেই বুঝতে পারে, তাকে আরও বহু দূর এগোতে হবে,। বছর দুই এর মধ্যে মা ও চলে গেল, ব্যাস, জগৎ সংসারে অনিমেষ একদম একা,কেউ নেই যার জন্যে অনিমেষ কে ভাবতে হবে বা কেউ অনিমেষের জন্যে কেউ ভাববে। ভাড়া বাড়ী ছেড়ে অনিমেষ উঠল বাগবাজারের এক মেসে। তখনকার মনের অবস্থা বর্ণনাতীত। কাজ করতে হয় তাই কাজে যায়। লক্ষহীন উদ্দেশ্যহীন এক আদর্শ শহুরে বোহেমিয়ান।
প্রতি সকালের আবহাওয়া এক রকম থাকেনা।কখন আকাশের মুখভার তো কখন নির্মল আকাশ আবার কখন পেঁজা তুলোর মত সাদা মেঘ আকাশময় ছড়িয়ে থাকে, অনিমেষের ভাগ্যাকাশের এমন এক সকালে মেসের এক বন্ধু জীবনের অনুরোধ, "চল একটা ভালো বিজ্ঞাপন বেড়িয়েছে,পরীক্ষা দি !" অনিমেষ জীবনের দিকে তাকিয়ে বলে,কিসের পরীক্ষা? জীবন প্রবল উৎসাহে বলে,"সরকারি চাকরির" অনিমেষ,নিঃস্পৃহ হয়ে উত্তর দেয়,কি হবে আমার সরকারি চাকরি পেয়ে? ঝাজিয়ে ওঠে জীবন, "কি হবে সরকারি চাকরি পেয়ে? বোকার মত কথা বলিস না। তোর কি জীবন শেষ হয়ে গেছে? কত বছর বয়েষ তোর?" আরও কত কথা যে বলল,কত গালাগাল দিল তার ইয়ত্তা নেই। জীবনের গালের থেকে বাঁচতে অনিমেষ পরীক্ষা দিতে রাজী হয়ে যায়। সেদিনের সেই রাজী হয়ে যাওয়ার ফলশ্রুতি তেই আজকের অনিমেষ।
অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা হলেই কি মানুষ ঘর বাঁধতে চায়? না অনিমেষের অন্তত সে নিয়ম জীবনে খাটেনি। ঘর বাঁধতে গেলে ঘরনীর প্রয়োজন। যাঁরা তিন কূলে কেউ নেই,থাকলেও কারুর সাথে কোন যোগাযোগ নেই। মা চলে যাওয়ার পর কোন নারীকুলের সান্নিধ্যে আসার সূযোগ তার ছিলো না। কখন তেমন কিছু ওর মনেও আসে নি, সাড়াক্ষন মন বিষাদের ভাব। মুখেও সে ছাপ স্পষ্ট হয়ে থাকত,সে কোন মেয়ে কে না দেখলেও সমাজের দু-চার জন যে তাকে চেয়ে দেখেনি এমন তো নয়। তবে ওমন বিষাদগ্রস্ত মুখ কে পছন্দ করবে? তাই অনিমেষের জীবন চলতে থাকে সমান্তরাল পথে।
মেসের আর খাবারের খরচ চালিয়ে অনেক টা টাকা বেঁচে যেত প্রতি মাসে,অনিমেষ একা কত রাতে ভেবেছে, একটা সময় একটা টাকার জন্যে কত হাপিত্যেশ করতে হয়েছে, কিন্তু আজ তার নিজের রোজগারের টাকাই শেষ হচ্ছে না। এই সময় টাতে ও বহে যাওয়ার কত সূযোগ ছিল। কিন্তু তা হয়নি,আসলে টাকা ওড়াতে গেলে মনে যে প্রফুল্লতা লাগে সেটা শরীরে মনে কখন অনুভব করেনি অনিমেষ। সে সব পথে যে ডাক পায়নি এমন তো নয়,কোলকাতার শহর, বন্ধু-বান্ধব তার যথেচ্ছ ছিল,কিন্তু কৈশোর আর প্রথম যৌবনের দিন গুলি ওকে দৃঢ় করে দিয়েছিল। এই ভাবে বছর তিনেক কেটে যায়,অনিমেষের জীবনের অর্থনৈতিক ভিত তখনই তৈরী হয়ে যায়।
অনিমেষের সমান্তরাল জীবনে রং লাগে প্রায় তিন বছর পর, ওর কম কথা বলার কারণেই অফিসে সহকর্মীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা তেমন একটা বাড়েনি।বন্ধুত্ব ও তেমন করে গড়ে ওঠেনি। কাজের প্রয়োজনে যেটুকু কথাবার্তা হত সেটুকুই। আর অফিসের সমস্যা সংক্রান্ত কথাবার্তা চলত কিন্তু সে আলোচনা ব্যাক্তিগত পরিসরে কখনই কোন আলোচনা কারুর সাথে হয়ে ওঠেনি। হঠাৎই বড়বাবু এক শুক্রবারের টিফিন আওয়ার্সে বলে, "আচ্ছা অনিমেষ,ছুটির দিনে তুমি সময় কাটাও কি করে? আমি যতদূর জানি বিয়ে থা তো অদ্যবধি করো নি,তাহলে?" হঠাৎই এমন একটা বেমওকা প্রশ্নের জন্যে তৈরী ছিলো না অনিমেষ। তাই প্রথমটাতে একটু থতমত খেয়ে গেলেও, একটু ধাতস্থ হয়ে বলে,"কি আর করবো স্যার,এই শুয়ে বসে কেটে যায় আরকি!" সুপ্রকাশ ঘোষ তার থলথলে মুখ শুধ্ধু মাথাটা নেড়ে বলে,না না এতো ভালো কথা নয় অনিমেষ, তুমি একটা ইয়ং চ্যাপ,নব যৌবনের দূত,দস্তুর মত একটা সরকারি চাকুরে, তুমি কি না ছুটির দিনে, শুয়ে বসে কাটিয়ে দাও। না না এমন করে চললে তুমি তো ডিপ্রেশনে চলে যাবে। তোমাকে আমি লক্ষ্য করেছি অনিমেষ, তুমি স্বাভাবিক জীবনযাপন করছো না।তুমি রবিবার সকালে আমার বাড়ী আসছো। তারপর তোমার বিষয় টা আমি দেখছি। মাথার ওপর ইমিডিয়েট বস,সব্বাই তাকে তেলিয়েই চলে,বিব্রত অনিমেষ ঘাড় গোঁজ করে বসে ছিল। স্যার তাকে নিয়ে হঠাৎ এত কনসার্ন হয়ে ওঠাতে, অবাকই হয়েছে সে। সোজাসুজি বাড়ীতে যাওয়ার নেমতন্ন দেওয়ায় একটু লজ্জিত ও বটে। বস বলে কথা,অনিমেষ কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না।একি রকম ঘাড় গোঁজ করে বসে থাকে,তাকে কোন উত্তর দিতে না দেখে, সুপ্রকাশ একটা কাগজে নিজের বাড়ীর ঠিকানা টা লিখে অনিমেষের হাত ধরিয়ে দিয়ে বলে,রবিবার সকাল সকাল চলে আসছো, দুপুরে আমরা এক সাথে লাঞ্চ করবো। এমন চাপের কাছে অনিমেষের মুখে মনে হয় কেউ লাগাম পড়িয়ে রেখেছে। আরও খানিক সময় চুপ করে বসে থেকে,ঠিকানা লেখা কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে ধীর ধীরে উঠে দাঁড়ায়। অনিমেষের কেমন মনে হয়,সুপ্রকাশ চোখ দুটো যথা সম্ভব ছোট করে অনিমেষ কে মেপে চলেছে। শ্লথ পায় নিজের টেবিলে এসে বসে পড়ে অনিমেষ।অস্বস্তিকর পরিবেশ টা থেকে বেড়িয়ে এসে একটু হালকা লাগে অনিমেষের। এখন মনে হচ্ছে, চিৎকার করে বলে, না স্যার আমি কোথাও যাই না।আমি ছুটির দিনে আমার নিজের বিছানায় চুপ করে শুয়ে থাকতেই ভালোবাসি। কিন্তু অগত্যা, সময়ের কাজ সময়ে না করতে পারলে আর কি লাভ! আপাতত তো হাতে সময় আছে, মাঝে শনিবার সাড়াদিন ছুটি আছে, পরে ভাবা যাবে। বলে নিজেকে আশ্বস্ত করে অর্ধ সমাপ্ত একটা ফাইল টেনে নিয়ে কাজে মন দেয়।
আজ এই সব পুরনো দিনের কথা মনে হচ্ছে কেন ? যেন পুরোন হিসাবের খাতা নিয়ে মেলাতে বসেছে।কান্নার আওয়াজ টা এখন কেমন যেন থেমে থেমে শোনা যাচ্ছে। যাক ভালোই হয়েছে, একটানা যে কান্নার শব্দ ওকে বিরক্ত করছিল, এখন সে বিড়ম্বনা অপেক্ষাকৃত কম। অনিমেষের মনে হয়, সাড়া আকাশ জুড়ে ঘন কালো মেঘ করে আছে। যদিও এখন রাতের অন্ধকার। আকাশ দেখতে পাওয়ার কথা নয়। তবুও অনিমেষের মনে হয়,সাড়া আকাশের রঙটা কাকের ডিমের মত বর্ণ ধারন করেছে। পায়ের সামনে থাকা চাদর টা টেনে নিতে পারলে ভালো হত, কিন্তু চাদর টা টেনে নিতে যে টুকু শ্রম লাগে সেই শ্রম টুকু ব্যায় করবার ইচ্ছে হচ্ছে না। এমনি তে বিয়ের পর সংসারের ব্যাপারে অনিমেষ বেশ করিতকর্মা, কোন কাজ ও ফেলে রাখেনা কখন। যখন যেটা দরকার তখনই সেই কাজ সম্পন্ন করার জন্যে যেটুকু উদ্যোগ নেওয়া দরকার ততক্ষনাৎ, সে ব্যাবস্থা করে ফেলত,অথচ আজ ওকে এক সীমাহীন অলসতা ঘিরে ধরেছে, এই আস্তানায় তার জীবনের সব থেকে আপন জনেরা তার সাথে বাস করে,তাদের কে ঘিরেই গড়ে উঠেছে অনিমেষের সংসার, তাদের কষ্ট দুঃখ তো অনিমেষের কষ্ট দুঃখ। তাদের আনন্দে অনিমেষের আনন্দ,অথচ আজ কেউ তার আপনার জন কেঁদে চলেছে, এই বাসগৃহে কেউ কষ্ট পাচ্ছে,সেই কারণ টুকু জানবার স্পৃহা পর্যন্ত অনুভব করছে না। এই তো বছর দুয়েক আগে সুপ্রকাশ দা যে দিন চলে গেলো, প্রায় রাত সাড়ে নটা, শাশ্বতী ফোন ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। তখন সবে রাতের খাওয়া নিয়ে বসেছে ওরা। মায়ের হাত থেকে রিমি ফোন কেঁড়ে নেয়। সেও মুহুর্তে কেঁদে ওঠে, বড় মামার মৃত্যু সংবাদে। খানিক ধাতস্ত হয়ে অনিমেষ,রিমি কে রাতের খাবার খাইয়ে সেই রাত্রেই, এই বেহালার প্রত্যন্ত থেকে উত্তরের বারাসতে পৌচে যায় শোক সন্তপ্ত ভগিনী ও ভাগিনেয়ী কে নিয়ে । সেই অনিমেষ আজ পাশের ঘরে কে কাঁদে, সেটুকু উঠে দেখার প্রয়োজন মনে করছে না। নিজের শান্তির জন্যে, নিজের সুখের জন্যে। অনিমেষে নিজেকে স্বার্থপর ভাববে? অদ্ভুত লাগে অনিমেষের।
বড় সাহেব, সুপ্রকাশ ঘোষের একমাত্র বোন কে বিয়ে করার পর,অনিমেষের বোহেমিয়ান জীবনে লাগাম পড়িয়ে,সংসার জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে নিয়ে এসেছিল শাশ্বতী। কৃতজ্ঞ অনিমেষ! কি অপরিসীম দক্ষতায় সেদিন শাশ্বতী সংসারের হাল ধরে ছিলো। জামাকাপড় নিয়ম করে কাচাকাচির বালাই ছিলো না অনিমেষের, একটা জামা কাপড়ে এক সপ্তাহ অফিস চালিয়ে দিত অনিমেষ। কোন রকম একটা পদেই ক্ষুধা নিবৃত্তি করে নিত অনিমেষ। অনিমেষ তো নিয়ম করে দাঁড়ি-গোঁফ ও কাটতো না। একটা বনমানুষের মত জীবন কাটতো সে। বাড়ী ঘরের ও তো বালাই ছিলো না। মায়ের মৃত্যুর পর মেসেই কাটিয়ে দিচ্ছিল জীবন টা। শাশ্বতী একা হাতে হা-ঘরে হাড় হাভাতে লোক টাকে মাত্র তিন মাসে আমুল পাল্টে দিয়েছিল। অফিসের সহকর্মীরা বলে ছিলো,অনিমেষ,তোমার বিয়েটার খুব প্রয়োজন ছিলো ভাই।সত্যিই প্রয়োজন ছিল, সেইদিন সুপ্রকাশ দা নেমতন্ন করে বাড়ীতে না ডাকলে জীবনের পথে হয়ত কোন মোর আসতো না অনিমেষের। শ্বাশতী এসে ছিলো জীবনে,মায়ের পর যে নারীর সান্নিধ্য পেয়েছিলো অনিমেষ,সে শ্বাশতী! তাই শরীরে মনে তাকে আঁকড়ে ধরতে সময় নেয় নি অনিমেষ। সারাদিন শ্বাশতী যাই করে,তাই ওর নতুন লাগে,আদোরে আশ্লেষে দুজনের একটা সংসার।যা ওদের নিজেদের, নিজেরাই তিলতিল করে গড়ে তুলছে নিজেদের সংসারের নিয়ম,আইন কানুন, সেই সময় অনিমেষের মনে হত সংসার টা একটা দেশের মিনিয়েচার! লিঙ্গভেদের স্বাভাবিকতায়, অনিমেষ সে দেশের রাজা, রাজা হলেও, এ রাজা রানীর বশ্যতা মেনে নিয়েছে ভালোবেসে, তাই রাজ্যপাট দক্ষ হাতে পরিচালনার দায় রানীর। অনিমেষে শুধু রসদ বন্দোবস্তের দায়িত্বে,বাকিটা সুখের মান্দাসে ভেসে বেড়ানো অনিমেষের দিন যাপন। বেশ চল ছিলো সময় টা। আজ মনে হচ্ছে তেমন করে গোটা জীবনটা কেটে গেলেই বুঝি ভালো হত। তেমন আর থাকলো কোথায়, কবে যে নিজের অজান্তে শাশ্বতী তার থেকে দূরে যেতে শুরু করেছে সেটা সময়ে উপলব্ধি না হলেও আজ কেমন সেই সন্ধিক্ষণ টা এক নিমেষে ধরতে পারছে অনিমেষ। বিয়ের দু বছরের মাথায় ওরা দুই ছেড়ে তিন হল।ছোট্ট রিমি,ক্ষুদ্রতম সদস্য সংসারে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসাবে নিজেকে জাহির করে তুলল এক লহমায়,সেটাই সংসারে স্বাভাবিক, না না তা নিয়ে অনিমেষের কোন বিরোধিতা ছিলোনা, কোন অভিযোগ ছিলো না।বরংচ অনিমেষ তাতে ইন্ধন যুগিয়েছে, আর সেই ইন্ধন যে কবে নিজের অভ্যাসে পরিনত হয়েছে, নিজেও তার হিসেব রাখেনি,আর হিসেব রাখে নি বলেই সেই পথ ধরে একদিন একই আস্তানায় দুটো ভিন্ন গোষ্ঠী তে সংসার পৃথক হয়ে গেছে, গোষ্ঠী শব্দ টা কি এক্ষেত্রে সঠিক হলো?না বোধহয় না, ওর উল্টো দিকটা গোষ্ঠী বলা গেলেও,অনিমেষ তো একা! এক নির্জন দ্বীপের অধিবাসী। শাশ্বতী,মায়ের পর তোমাকে আকড়ে ধরেই তো ভেসে ছিলাম,বেঁচে ছিলাম, এই সংসার সাগরে,মাঝপথে কেন তুমি তোমাকে আমার থেকে মুক্ত করে নিলে শাশ্বতী। নোঙর হীন এক জলযানের মত! এই অনুযোগ টা মনে হতেই,অনিমেষের মনে হলো,বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে,পাশের ঘরের পর্দা সরিয়ে, শাশ্বতী কে সরাসরি প্রশ্ন টা করে। ও চেষ্টা করলো উঠে বসার কিন্তু পারলো না,নিজে হাত পা শিরদাঁড়া কোনটাই নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই,হঠাৎ মনে হলো,খোলসের মত নিজের আপন শরীরটা বিছানায় পড়ে থাকলেও ও তো উঠে বসেছে, আগের থেকে নিজেকে হালকা, হ্যাঁ বেশ হালকা, ফুড়ফড়ে লাগছে,অনিমেষ এই প্রথম খেয়াল করলো ঘরে সে একা নেই,তার বিছানার দুই পাশে সাড়া ফ্ল্যাটের লোকজন ভিড় করে ,কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে,ঐ তো নিচের তলার চক্রবর্তী, অনিমেষের থেকে বছর দুয়েক ছোটই হবে, ওর ও একটা মেয়ে,নন্দিনী!সেও দরজায় দাঁড়িয়ে, পায়ে পায়ে অনিমেষ পাশের ঘরের পর্দা সরিয়ে শাশ্বতীর ঘরে এসে দেখে,শাশ্বতীর বৃদ্ধ শরীর টা বিছানায় লুটিয়ে পড়ে আছে,বুকের কাপড়ের দিকে কোন খেয়াল নেই,রিমি তার মাকে একটু জল খায়ানোর চেষ্টা করছে,ওর চোখ দুটোও কেঁদে কেঁদে ফুলিয়ে ফেলেছে। হঠাতই অনিমেষের খুবই হাসি পেলো।অনিমেষ হাসছে,আকাশ বাতাস কাপিয়ে হা হা করে হাসতে লাগলো অনিমেষ,এত হাসি, যে ভুলেই গেল, হাসির ফাঁকে বলবে,শাশ্বতী তুমি আমাকে কি ছেড়ে যাব? আমিই চললাম, আমিই চললাম শাশ্বতী!
===========================
চিত্র ঋণ - ইন্টারনেট
মনোজিৎ চক্রবর্ত্তী
দিশা নান্দীমুখ এ্যাপার্টমেন্ট
৫মতল,ফ্ল্যাট নম্বর ৫ই
বড়নীল পুর রোড,বর্ধমান
জিলা সৈনিক ভবনের সন্নিকটে