গল্প ।। নির্জন শ্মশানে ।। দুর্জয় মণ্ডল
চিত্র ঋণ - ইন্টারনেট
নির্জন শ্মশানে
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
দুর্জয় মণ্ডল
ঘটনাটা শুরু হয় শ্মশান থেকেই, কালের অমোঘ নিয়মে ঘটনাটা শেষও হবে একদিন শ্মশানে গিয়েই।
বিকেলের পড়ন্ত রোদ্দুর! সময়টা হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়। অবাক লাগছে? ভাবছেন হয়তো পরিবারের সাথে, প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার জন্য নতুবা মাঠে খেলা, গায়ে হাওয়া লাগানোর জন্য, আবার অনেকে ভাববেন হয়তো জীবিকার তাগিদে। কিন্তু আসলে সত্যিই একজনের প্রেমের টানেই অপেক্ষায় থাকে আমাদের প্রিয় রাইদাস, পেশাগতভাবে সেরকম কিছুই করেনা, তবে এই মন্দাবাজারে দু-চারজনের বাড়িতে বাড়িতে বাচ্চাদের পড়ায়, আর কি জানি কিসব লেখালেখি করে আপনমনে, লোকে হয়তো এইজন্যই পাগল বলে। বয়স এক কুড়ি দশ হবে, যুবক কিন্তু এই বয়সে অন্যদের মতো পেশাগত ব্যস্ততা বা সাজসজ্জা, আড্ডা এসব কোনোটাই নেই, হয়তোবা কোনো এক কালে ছিল তবে হঠাৎ এক ঝড় তার জীবনের ধারা বদলে দেয়।
রাইদাস প্রত্যহ ঘুম থেকে উঠেই অপেক্ষায় থাকতো কখন বিকেলে সে যাবে নদের ধারে পরম প্রেমের টানে। কথাটা শুনতে একটু আশ্চর্যজনক মনে হলেও ঘটনাটা একদম সত্যিই। সে রোজ আসে নদের ধারে, একাকী নির্জনে এক মন্দিরে। শুনেছি সে নাকি ওই মন্দিরে এলেই শান্তি পায়।
গ্রীষ্মের দিন, বিকেলে রোজ
কালবৈশাখীর তাণ্ডব; সে রীতিমতো পড়াচ্ছে, বাইরে হঠাৎ ধেয়ে এল ভয়ানক কালো মেঘ। তড়িঘড়ি ছুটি দিয়ে সে
যাবে মন্দিরে, হঠাৎ ছাত্রের মা বলে উঠল,"ইসকা তো নেক্স্ট্ উইক মে সাইন্স এক্সাম হ্যে, যারা ঠিক সে ধ্যান্ দিজিয়েগা।" সে বলল, "আচ্ছা,
ঠিক হ্যায়।"
তার আর মন্দিরে যাওয়া হল না। ছুটি হল যখন, ঘড়িতে রাত্রি ৮টা, কিন্তু সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে মন্দিরে যাবেই। এত রাত্রিতে যাওয়া ঠিক হবে কিনা, এসব না ভেবে পথে এগিয়ে যায়। ইতিমধ্যে মন্দিরেও পৌঁছে যায় একাকী। নদের পাড়, একদিকে শ্মশানঘাট অন্যদিকে ঘনকালো মেঘে ঢাকা আকাশ, আবার রাত্রি ঘনিয়ে এসেছে।
মন্দিরে প্রবেশ করে আগেরমতো প্রনামরীতি মেনে, তারপর বসে জপ করে। জপে বসেছে সে। চোখ তার বন্ধ, মন্দিরের দরজা বন্ধ, ভিতরে মঙ্গলদীপ জ্বলছে মাত্র, বাইরের বৈদ্যুতিক বাতিটিও জ্বলছে। জপ শুরু হল, এদিকে বাল্বটি নিভে যায়, বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টি বলে বৃষ্টি! আকাশ যেন ফেটে আছড়ে পড়ছে শুধু ওই মন্দির চত্বরে, আশেপাশে কেউ নেই, শুধু শোনা যাচ্ছে শেয়ালের ডাক। এতকিছুর মধ্যেও জপ থেমে নেই। হঠাৎ শোনা গেল পায়ের নুপুরের শব্দ, তবে কি কোনো মহিলা এসেছেন পূজো দিতে? তবে এত দুর্যোগে কেই বা আসবে? তাছাড়া সন্ধ্যারতির সময় যে পার হয়ে গেছে। এই সময় নাকি আসতে নেই শশ্মান চত্বরে। তারপর আবার মহিলা! তাদের তো এমনি শ্মশান চত্বরে আসতেই নেই। শব্দটা ক্রমশই কাছে আসতে লাগলো। বৃষ্টির বেগ যেন দ্বিগুণ, ঝড়ও শুরু হল। এদিকে জপ চলছে। সে কোনোভাবেই চোখ খুলল না, ভয় হচ্ছিল হয়তো, কিন্তু চোখ না খুলেই আবাহন কার্যাদি করতে লাগলো। হঠাৎ তার ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাসের আভাস হল! সেকি? তবে কি সত্যিই কেউ আছে তার পাশে? সে যেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, যাইহোক চোখ সে খুলবে না। মায়ের নাম অনবরত করেই যাচ্ছে সে। এদিকে বৃষ্টির বেগ যেন দশগুণ হয়ে গেল। আভাস পাচ্ছে সে, তবু কি আশ্চর্য জলের ছিটেফোঁটাও তার গায়ে নেই। হঠাৎ আবার তার গায়ে নিঃশ্বাসের উষ্ণ বাতাস তার ধ্যান ভাঙানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেই চলেছে। এবার হয়তো ভয় পেয়েছে সে। কিন্তু না, এবার সজোরে মায়ের নাম করতে লাগলো। হঠাৎ মন্দিরের ছাদ থেকে কিছু পড়ার আওয়াজ! পরিস্থিতি যেন ভয়ানকভাবে তাকে বলছে খুব শীঘ্রই সে যেন মন্দির চত্বর ছেড়ে চলে যায়। হঠাৎ আবার! এবার শুধু নিঃশ্বাস নয়, বরং কারোর হাসির শব্দ, যেন সেটা বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। কি সাংঘাতিক ভয়াবহ পরিস্থিতি সেখানে! তবুও একাকী সেখানে মায়ের নাম জপেই যাচ্ছে সে। কেউ যেন তার ঘাড়ে স্পর্শ করল, শরীরের সব লোম যেন খাড়া হয়ে উঠলো। এবার হয়তো তার আর নিস্তার নেই, কিন্তু মায়ের মন্দির চত্বরে কে তার অনিষ্ট করবে? কার এমন সাধ্যি যে মায়ের সামনে সন্তানের ক্ষতি করে! হয়তো সেদিন এই সাহসটাই তার একমাত্র সম্বল ছিল। তবে এতক্ষণ পর্যন্ত সে স্থির ছিল, জপে মগ্ন ছিল তাই। এবার জপ শেষ, চোখ তবুও খোলেনি। হঠাৎ কি যেন তার সামনেই ওপরের ছাদ থেকে পড়লো। চমকে উঠলো সে। চোখ বন্ধ তবু। বাইরে বৃষ্টি একটু কমেছে তবুও ভিজে যাবার মতোই পড়ছিল। হঠাৎ বজ্রপাত শুরু হল, বিদ্যুতের শব্দে ও আলোয় তার চোখ খুলে যায়। চোখ খুলেই সে মায়ের মৃন্ময়ী রূপ দেখে, আগের থেকেও যেন আলোটা বেশি লাগছে। ভিতরে প্রদীপটা জ্বলছে। কিন্তু কোথায় সে রমনী? আশেপাশে তো কেউ নেই। চারদিকটা দেখলো ভালো করে, সত্যিই কাউকেই দেখতে পেল না সে। তবে কি সেখানে ভুত বা প্রেত সেসব কিছু এসেছিল? তা কেমনে সম্ভব? মন্দিরে কিভাবে আসবে সেসব! নিছক কল্পনা নয়তো? হয়তো ভয় পেয়ে সে কল্পনা করেছিল।
হঠাৎ তার চোখ যায় যেখানে বসেছিল সেই জায়গায়, দেখে বৃষ্টির ছিটেফোঁটাও নেই, অথচ চারিপাশে জলের দাগ, এমনকি রাস্তায় জল জমে। তার বসার জায়গায় কেউ যেন তাকে আগলে ছিল, চারিদিক অদ্ভুত সুবাসে মুখরিত হয়ে ওঠে, এমন সুবাস আগে কখনোই সে পায়নি। এদিকে বাতিটি হঠাৎ জ্বলে উঠলো। মায়ের দিকে তাকাতেই আরেক চমক! মায়ের দিকে কেউ যেন হেঁটে চলে গেছে, তারই পদচিহ্ন আঁকা। রাইদাসের বুঝতে আর কিছু বাকি রইল না, স্বয়ং মা এসেছিলেন তার কাছে! দু'চোখ দিয়ে জলধারা বইছে, কিন্তু একি ! মায়ের মৃন্ময়ী রূপের চোখ যেন ছলছল করছে, সন্তানকে ব্যাকুল হতে দেখে মা নিজেকে আর সংযত করে রাখতে পারে না, এ যেন তারই বহিঃপ্রকাশ! এই মুহূর্তে তার সব ভয়ভীতি যেন মা স্বয়ং নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন।
তারপর মা'কে হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে সে রওনা দেয় তার বসতবাড়ির দিকে। বৃষ্টি তখনও পুরোপুরি থামেনি, এ যেন মা তার সন্তানকে ছাড়তেই চান না! তবু সে ফিরবেই। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সে কোনোক্রমে বাড়িতে পৌঁছালো মায়ের নাম করতে করতে। বাড়ি ফিরে নৈশভোজ করে যখন বিছানায় গা এলিয়ে দেবে, অমনি খেয়াল করে তার দেহের তাপমাত্রা যেন হঠাৎ বেড়ে গেছে। তবুও মায়ের নাম নিয়ে শুয়ে পড়ে সে। রাত্রে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, তবুও বাড়িতে কাউকেই জানায় নি সে, যাতে তারা চিন্তায় পড়ে যায়, এমনিতেই গরীবের সংসার - চিন্তার শেষ নেই, তারপর যদি সন্তানের অসুস্থতার খবর শোনে, তবে হয়তো আরোও মুশকিল হবে। যাইহোক, ঘুমের মধ্যেও যেন অনবরত মায়ের নাম জপেই যাচ্ছে সে। ভোরবেলা মায়ের নাম জপের সময়ে ঘুম থেকে ওঠে, একদিকে প্রচণ্ড জ্বর, অন্যদিকে জপ বন্ধ করা যাবে না। স্নান সেড়ে জপে বসে, জপ চলছে, হঠাৎ সেই নূপুরের শব্দ! সে খুশিতে আত্মহারা। জপ শেষ করে বলে উঠলো, "মা, তুই এসেছিস?" তারপর আর বসে থাকতে না পেরে হঠাৎ শুয়ে পড়ে। হঠাৎ ঘুমের মধ্যেই সে শোনে তার জন্মদাত্রী মা তাকে ডাকছে। তবুও সাড়া না দিয়ে শুয়ে থাকে। হঠাৎ তাকে কেউ যেন নড়িয়ে দিয়ে ডাকে, "ওঠ"। সে এবার চমকে যায়। আশ্চর্যের বিষয় যে আবদ্ধ ঘরে কে আসবে? তারপর প্রচণ্ড বিষ্ফোরণের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়, তাকিয়ে দেখে চারিদিকে আগুন ঝরছে, আগুনের তেজ অনেক বেশি ছিল, দরজা ভেঙে গেছে। আশ্চর্য তো! পুরো ঘরে আগুন, তবু তার কিছু হয়নি, এমনকি সব জ্বলছে, তবুও সাধনার বস্ত্র, পূজার সামগ্রী কিছুই জ্বলছে না, আবার যে বিছানায় শুয়ে ছিল সে সেখানে কিছুই হয়নি, মশারি টেনেছিল, তবু সেখানে আগুন ধরেনি। সেদিন রাত্রে ভয়ে সে মা-বাবার কাছে শুয়েছিল। তবে কি জপ বন্ধ থাকবে? না, যাইহোক জপ বন্ধ হবে না। এদিকে গায়ে জ্বর, তবু বাড়ির কেউ টেরও পায়নি। রাত্রে স্বপ্ন দেখে সে মায়ের কোলে শুয়ে আছে। মা যেন বলছেন," তোর চিন্তা কি রে, আমি তো আছি, আয় আমার কাছে।"
হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়, একাই চলে যায় সেই কক্ষে, ভয় করছিল ঠিক, তবে স্বয়ং মা তাকে আশ্বস্ত করেছেন, তাই কিছু না ভেবে চলে যায়। সেদিন ছিল জপের শেষ দিবস। জপে বসে, চোখ বন্ধ করে জপ শুরু করে, হঠাৎ সেই নূপুরের শব্দ! সেই সুবাস! জপ শেষ করে চোখ খুলতেই কিছুই নেই, রয়ে গেছে শুধু সুবাস। পরদিন মন্দিরে গিয়ে পূজো দিয়ে আসে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সেদিনের পর থেকে তার মধ্যে ভয় লোপ পেয়ে যায়। তারপর অনেক বিপদও আসে, কিন্তু সব বিপদ অলৌকিকভাবে কেটে যায়, যেন মা স্বয়ং বিপদমুক্ত করেন তার প্রিয় সন্তানকে। পরবর্তীকালে মা তার জীবনসঙ্গী খুঁজে দেন, নির্দেশও দেন, আগামী দিনে মা সব বাধা কাটিয়ে তাদের চারহাত এক করে দেবেন এই আশ্বাসও দেন।
নাম : দুর্জয় মণ্ডল
ঠিকানা : মেজিয়া, হসপিটাল রোড, বাঁকুড়া।