ধারাবাহিক গল্প ।। প্রেম ও সংকল্প ।। দীপক পাল
প্রেম ও সংকল্প
( পঞ্চম পর্ব)
দীপক পাল
বসে বসে সুমন্তর মনে একটা খটকা লাগলো চান্দ্রেয়ী ওর নিজের কাপড় কিনতে গিয়ে ওখান থেকে টাকা বাঁচিয়ে ওর জন্য গেঞ্জিটা কেনেনি তো? নাহলে কাউকে বলতে বারণ করলো কেন? ভাবতেই মনে কেমন যেন ওর প্রতি অদ্ভুত একটা টান অনুভব করলো। একবার সমুর দেওয়া উপহারটা খুলে দেখার ইচ্ছে থাকলেও দেখলো না। সমু ঘরে ঢুকে একটা ছোট টেবিল টেনে এনে সুমন্তর সামনে রেখে অপর প্রান্তে নিজে একটা চেয়ার টেনে বসলো। কাকিমা ট্রেতে করে দু প্লেট লুচি ও হালুয়া টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। সুমন্ত একটু লজ্জা পেল, বললো,
-' এতো তাড়াতাড়ি এত সব হলো কি করে সমু?'
- ' তুমি আসতে পার ভেবে মা একটু আগেই রেডি করে রেখেছিল, তাই দুজনে চটপট হাত লাগাতেই হয়ে গেল।'
- ' কিন্তু কাকু কাকিমা?'
- ' বাবা খেয়ে নিয়েছে, মা নিজেরটা আনতে গেছে। ততক্ষণ আমরা শুরু করি। হাত লাগাও।'
সুমন্ত আর কথা না বলে লুচি ছিঁড়ে হালুয়া দিয়ে খেতে থাকলো ও চান্দ্রেয়ীর সাথে টুকরো-টাকরা কথা চালাতে থাকলো। কিছুক্ষণ পরে কাকিমা চার কাপ চা এনে এক কাপ ডিসে করে কাকুর হাতে দিলেন, দু কাপ টেবিলে ওদের সামনে রাখলেন ও নিজের হাতের কাপে চুমুক দিলেন। ওদের লুচি খাওয়া হয়ে গিয়েছিল এবার চায়ে চুমুক দিল। কাকিমা নাকি রান্নাঘরে তার খাবার খেয়ে নিয়েছেন। খাওয়ার পরে সুমন্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে কাকু কাকিমাকে বললো,
- ' এবার আমি আসি, বাড়ীতে নিশ্চয় খুব চিন্তা করছে। আপনারা সব ভাল থাকবেন কেমন?'
- ' তুমি ও তোমার বাড়ির সবাইও যেন খুব ভাল থাকে। সময় পেলে আবার এসো।' এই কথা বলে কাকিমা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এলেন। চান্দ্রেয়ী সুমন্তর সাথে একেবারে গেট পর্যন্ত এগিয়ে গেল। সুমন্ত রাস্তায় নেমে ওকে বললো,
- ' সমু, তোমার জন্য শাড়ি কিনে তোমাকে কি ভাবে দেব?'
- ' একটা কাজ করি, ষষ্ঠীর দিন সন্ধে ছটায় আমরা বাস স্ট্যান্ডে দেখা করি। তারপর আমরা একটু ঘুরবো, ঠাকুর দেখবো, তারপর বাড়ী ফিরবো। সেদিন ওটা দিলেই হবে।'
- ' ঠিক আছে তাহলে ঐ কথাই থাক। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায়।'
বাড়ী ফিরতেই দেখে মা-বাবা কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে। মা বললো,
- ' কিরে এত দেরি হলো যে? আমি এদিকে তোর জন্য বসে আছি। হাতে এটা কি?'
- ' আমি এক বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলাম, তার বাড়িতেই কিছু খেয়ে নিয়েছি চা সমেত। ঐ বন্ধুই এই গেঞ্জিটা আমাকে দিয়েছে।'
- ' তোর কোন বন্ধু দিয়েছে রে? কৈ এর আগে তো কোনোদিন দেখিনি। তুই তো তোর কোন বন্ধুকে দিয়েছিস বলে তো শুনিনি।'
- ' না এই বন্ধুর সাথে আমার নতুন আলাপ হয়েছে, এই মাস চারেক হলো।'
- ' সে কি ছেলে বন্ধু না মেয়ে বন্ধু?' বোধহয় মেয়ে বন্ধু, তাই নারে?'
- ' ঠিক।'
- ' তবে তো তোকে আবার পাল্টা দিতে হবে। না হলে কোন মান থাকবে না তার কাছে তোর। তোকে তো ভালবেসে দিয়েছে গেঞ্জিটা, আর তোকে মানাবেও ভাল এটা পরে।'
- ' আমি এখন চেঞ্জ করে হাত পা ধুয়ে একটু পড়তে বসি। তোমরা খেয়ে নাও, অনেকক্ষণ না খেয়ে আছ। পারলে আমাকে শুধু এক কাপ চা দিও।'
মিনিট পনেরো মধ্যে সুমন্ত পড়ার টেবিলে এসে বসলো। কিন্তু পড়ায় মন বসলো না। একটা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে । মাকে কি সব কথা বলা যায়। মা যদি আবার বাবাকে বলে দেয় তবে কি হতে পারে। ট্রেতে তিন কাপ চা নিয়ে মা ঢুকলো ঘরে। এক কাপ চা সুমন্তর টেবিলে নামিয়ে রেখে পেছনে ঘুরতেই সুমন্ত বলে ওঠে,
- ' মা, বাবার চা টা দিয়ে এসে একটু বসবে আমার কাছে, একটু কথা আছে তোমার সাথে।'
- ' তবে আমার চা টা রাখলাম এখানে, তোর বাবার চা টা দিয়ে আসি।' ফিরে এসে বললো,
- ' কি বলবি বল?'
সুমন্ত চান্দ্রেয়ীর সাথে কি ভাবে আলাপ হলো, প্রতিদিন ওর সাথে বাসস্ট্যান্ডে কথা হতো যতক্ষণ না ও বাসে উঠে কলেজে চলে যেত। তারপর ওর বাবার হার্ট এটাক হওয়া, বিপদ কেটে যাবার পরে সুমন্তকে একদিন বাড়ী নিয়ে যাওয়া, ওর বাবা সুস্থ হয়ে আবার অফিসে জয়েন করা, তারপর চাকরি থেকে অবসর নেওয়া অব্দি সব কথা মাকে যতটা সম্ভব বললো। শুনে মা বললো,
- ' চান্দ্রেয়ীই ঐ গেঞ্জিটা তোকে উপহার দিয়েছে তাই না?'
- ' ঠিক বলেছ। জানো, চাকরী পাওয়ার পর ওর সাথে আমার অনেক দিন দেখা হয় নি। আজকে শর্ট হ্যান্ড ক্লাস করে বেরতেই দেখি চান্দ্রেয়ী অফিস রুমে বসে আছে। হাতে তার একটা প্যাকেট, বড়। আমি ইনস্টিটিউটে ওকে দেখে তো একদম অবাক। বলে, 'তুমি তো দেখা করবে না, তাই আমিই চলে এলাম দেখা করতে।' এদিকে বাসে না উঠে, বলে হেঁটে হেঁটে গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরবে। তারপর ওর বাড়ির কাছে এসে এই প্যাকেটটা আমার হাতে দিয়ে বললো কাউকে যেন আমি না বলি। তারপর আমাকে নিয়ে ও ঘরে ঢুকলো। আমার কিন্তু মনে হলো ওর বাবা কাপড় কিনতে ওকে যে টাকা দিয়েছেন, ও নিজের জন্য কেনা শাড়ীর টাকা থেকে আমার জন্য এই গেঞ্জিটা কিনে এনেছে। এরপর আমি যখন ওর কাছে আমার তরফ থেকে একটা ভালো শাড়ি কেনার কথা বললাম তখন শর্ত দিল কি জানো?'
- ' কি শর্ত?'
- ' বলে আমি অতি সাধারণ মেয়ে, তাই আমার কাপড় যেন বেশী দামী না হয়।'
- ' এ এক সোনার চাঁদ মেয়ে দেখছি।'
- ' এখানেই শেষ নয়। আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম কি রঙের বা অন্য কিছু বিশেষ ধরণের যা আমি জানিনা, এরকম যদি বলার থাকে যদি আমায় বলো। তখন বললো তুমি পছন্দ করে যেটা আনবে সেটাই আমি পরবো, শুধু বেশি দামি যেন না হয়।'
- ' সত্যিই মেয়েটার কথা শুনে আমার ওকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কি ভাবে দিবি শাড়ীটা?'
- ' আমরা ঠিক করেছি ষষ্ঠীর দিন সন্ধেবেলা একসাথে মিলে একটু কাছাকাছি ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখব আর বাড়ি ফেরার সময় ওর হাতে কাপড়টা দেব।'
- ' সেই দিস। তবে এমন কাপড় দিবি যেটা পরে একজনের বাড়ীতে যেন যেতে পারে।'
- ' ঠিক ঠিক। আচ্ছা মা এবারের লক্ষী পুজোর দিন চান্দ্রেয়ীকে সন্ধ্যার সময় আমাদের বাড়িতে আসতে বলবো?'
-' বলবি বৈকি। তবে শুধু ওকে কেন, ওর মা বাবাকেও আসতে বলবি।'
- ' আচ্ছা বলব আসতে। কিন্তু বাবা যদি রাগ করে কিম্বা অসন্তুষ্ট হয় তখন।'
- ' আচ্ছা সেটা আমি তোর বাবাকে বুঝিয়ে বলবো। সেটা তোকে চিন্তা করতে হবে না। এখন যাই। কাজ পরে আছে অনেক। রাতে খাবি না?'
পঞ্চমীর দিন শর্টহ্যান্ড ক্লাসের পর পার্কের আড্ডা খানায় গিয়ে বসলো একটু। বন্ধুরা সব ওকে দেখে হৈ হৈ করে উঠলো। ঠাট্টা-ইয়ার্কি শুরু হয়ে গেল এরপর। সবারই জিজ্ঞাসা, তুই তো আমাদের একদম ভুলেই গেলি। সুমন্ত ওদের বুঝিয়ে বলে "দেখ তোরাও তো সব চাকরি করিস। কেউ আমারই মতো প্রাইভেট কোম্পানিতে, আবার কেউ ব্যাংকে। আমি আবার এরপরে অফিস থেকে বেরিয়ে প্রায় দৌড়ে শর্ট হ্যান্ড ক্লাসে যাই। ওখান থেকে বেরিয়ে এত খিদে পেয়ে যায় যে সোজা বাড়ি চলে যাই। তাছাড়া আছে খুব পড়াশোনার চাপ। তোরা তো জানিস আমি কসটিং পরীক্ষায় বসবো তার জন্য আমার যতটা পড়াশোনার দরকার ততটা সময় আমি পাই না"। বুটো বলে, " এটা ঠিক কসটিং পাস করা অত সোজা নয়। অনেকে আছে বছর বছর দিয়েই চলেছে তবুও ইন্টারটাই পাশ করতে পারছে না। আর তোর বাড়ীতে ফিরতেই কত দেরী হয়ে যায়।"
- ' ঠিক বলেছিস। শর্টহ্যান্ড ক্লাসে পুজোর ছুটির পর আর যাওয়া ছেড়ে দেব ভাবছি।'
- ' আমরা কিন্তু হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে আসা একটা খবর পাচ্ছি।' বলে সুজয়।
- ' ভেসে আসা খবরটা কি মণিশের দেওয়া?'
- ' মণিশের কাছে অপু শুনেছে। অপুর কাছে সুজয় শুনেছে। এই হলো ঘটনা। আমি কিন্তু তোকে দেখেছি একটা মেয়ের সাথে খুব ঘনিষ্ট হয়ে কথা বলতে বলতে বাড়ির দিকে যেতে। আমি এদিকে ফুটপাথ ধরে আড্ডাখানার দিকে আসছিলাম। দেখ এটা কোন বিশেষ ঘটনা নয়। এটা নিয়ে আমরা বিশেষ কোন আলোচনা করি নি। আমরা আমাদের আগামী আসন্ন ভ্রমণ নিয়েই মেতে আছি। তুই তো যাচছিস না এবারে আমাদের সাথে। গেলে আমাদের খুব ভালো লাগত।'
সোমেনের এই আন্তরিক কথাগুলো সুমন্তের মন স্পর্শ করলো ভীষণ ভাবে। বললো,
- ' আসলে জানিস সোমেন, চাকরিতে জয়েন করার পর চান্দ্রেয়ীর সাথে বহুদিন আমার দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। যেদিন তুই আমাদের দেখেছিলি, সেদিনই ও কলেজ থেকে গড়িয়াহাট যায় পুজোর বাজার করতে। তারপর সোজা আমার শর্টহ্যান্ড স্কুলে গিয়ে অফিস রুমে ঢুকে জিজ্ঞেস করে আমি এসেছি কিনা। এসেছি শুনে আমার জন্য অপেক্ষা করে। তারপর আমি বেরোলে বলে হেঁটে গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরবে। ঐ জন্য তুই আমাদের দেখতে পেয়েছিস। তবে আমি আজ এসেছি অন্য কারণে। তোরা তো কাল রাতের ট্রেনে নৈনিতাল যাচ্ছিস, তাই একটু দেখা করার ইচ্ছে হলো। আমি চাই তোদের এই ভ্রমণ অত্যন্ত নির্বিঘ্নে ও খুব সুন্দর হোক। তোরা ফিরবিও লক্ষী পুজোর পরে। অনেক দিনের সফর। কলকাতার পূজো তোরা দেখবি না বাইরে যাচ্ছিস বলে, কিন্তু কলকাতায় থেকেও এবার আমিও ঠাকুর দেখবো না পড়ার চাপে।'
- ' কিন্তু ঘর থেকে তো বেরোবি।' অনেকে একসাথে বলে উঠলো। একটা চা-ওয়ালাকে দেখে
- ' এই চা ' সুমন্ত চীৎকার করে ডাকলো। চা-ওয়ালা ওদিক দিয়ে ঘুরে কাছে আসতেই বললো,
- ' বড় ভাঁড়ে করে আটটা চা দাও।' টাকাটা চা-ওয়ালাকে দিয়ে সুমন্ত চায়ে চুমুক দিল। বললো,
- ' একটু হয়তো সন্ধেবেলা বেরবো পাড়ার পেনডেলে একটু যাব। একটু থেকে আবার বাড়ি ফিরে আসবো। অনেক পড়া। পুজোর ছুটিটা কাজে লাগাতে হবে। যাক এইবার তাহলে আমি উঠি। তোরা ভালো করে ঘুরে আয়, পরে গল্প শুনবো।' ওরা সবাই সুমন্তকে ওয়েল উইশ করলো। সুমন্ত হাত নেড়ে পার্ক থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথ ধরলো।
( চলবে )
--------------- 0 --------------
Address :-
----------------
Dipak Kumar Paul,
DTC Southern Heights,
Block-8, Flat-1B,
Diamond Harbour Road,
Joka, Kolkata