বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

অণুগল্প ।। ভাগ্যবান ভাদু ।। চন্দন দাশগুপ্ত


 ভাগ্যবান ভাদু

চন্দন দাশগুপ্ত 


          বিকেল থেকেই বৃষ্টি নেমেছে। আমরা আজ জড়ো হয়েছি বিশুদার বাড়ির আড্ডাতে। যথারীতি মুড়ি-চানাচুর মাখার সাথে গরম আলুর চপ এসে আড্ডা জমিয়ে দিয়েছে।
          আমাদের আড্ডার একটা নিয়ম আছে। সবাইকে কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলতে হবে। সেটা মজার হতে পারে, দুঃখের বা ভূতেরও হতে পারে। সবগুলো শুনে বিশুদা নিজেও কিছু বলেন আর সকলের বলা ঘটনাগুলোর ভালোমন্দ নিয়ে আলোচনা করেন। 
           প্রথমেই রাজীব শুরু করল,
------"এটা আমি বছরখানেক আগে এক নাপিতের কাছে শুনেছিলাম। সে একটা সেলুনে চুলদাড়ি কাটতো। একদিন দুপুরবেলা এক ভদ্রলোক একটা ছোট ছেলেকে নিয়ে হাজির। নিজে আগে চুল দাড়ি কাটলেন। তারপর ছেলেকে বসালেন চুল কাটার জন্য। নাপিতকে বললেন "তুমি ভাই ওর চুলটা কাটো, আমি একটু ঘুরে আসছি।" তারপর ছেলেটির চুল কাটা হয়ে গেল, কিন্তু ভদ্রলোক আর ফিরে এলেন না। নাপিত এবার ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল, "কি ব্যাপার, তোমার বাবা এত দেরি করছেন কেন ?" ছেলেটি বলল, "উনি আমার বাবা হতে যাবেন কেন ? একটু আগে উনি আমাকে বললেন ,
"আমার সাথে চল্। এখানে বিনাপয়সায় চুল কাটতে পারবি। তাই তো আমি এসেছি। আমার সাথে কোনও টাকা পয়সা নেই।"
        রাজীবের গল্প শুনে আমরা হেসে ফেলেছি। বিশুদা চোখ বুঁজেই বললেন "নেক্সট  !"
        আমি এবার শুরু করলাম, 
------"নতুন অফিসে জয়েন করে সকলের সাথে পরিচয় হলো। সবার পেছনে দাঁড়িয়েছিল এক শীর্ণকায় বয়স্ক মানুষ। শুনলাম তার নাম ভাদু মন্ডল। সে অফিসের একজন পিয়ন। দিন কাটছে। ভাদু কথা কম বলে, তার কাছ থেকে একটা অদ্ভুত সার্ভিস পাওয়া যায়। অফিসের কাছাকাছি যে রেল স্টেশন, সেখান থেকে কলকাতার ট্রেনে মারাত্মক ভিড়ের জন্য ওঠা অসম্ভব। কারো কলকাতা যাবার দরকার হলেই ভাদুর ডাক পড়ে। শুনলাম, তার নাকি তিনটে বৌ ! আর আটটা ছেলে ! ভাদুর বাড়ি জেলার একদম শেষ প্রান্তে, ট্রেনটা ওখান থেকেই ছাড়ে। ভাদু ফোনে বলে দিলেই তার যেকোনও ছেলে বা বউ ঐ ট্রেনে উঠে বসে পড়ে। ইঞ্জিন থেকে দুটো কোচ পরেই ওরা ওঠে। তারপর আমাদের অফিসের কাছাকাছি স্টেশনে ওরা নেমে যায়, আর ওদের ছেড়ে যাওয়া যায়গায় আমরা উঠে বসে পড়ি। 
        দিন কেটে যাচ্ছে। ভাদুর বয়স হয়েছে, চোখেও আজকাল একটু কম দেখে। একদিন ভাবলাম, ওর সার্ভিস বুকটা আপডেট করে রাখি। কিন্তু সেটা অনেক খুঁজেও পাওয়া গেল না। শুনলাম,  ওটা নাকি বছরখানেক আগেই হেড অফিসে পাঠানো হয়েছে। আরো শুনলাম, চাকরিতে যোগ দেবার কয়েক মাস পরেই গাঁজা পাচারে জড়িয়ে পড়ায় ভাদু বছরতিনেক জেল খাটে, সাসপেন্ড হয়। সেইসব ঝামেলা মেটার পর ভাদু আবার অফিসে এসে জয়েন করে। কিন্তু ঠিক দেড় বছরের মাথায় সে আবার সাসপেন্ড হয় ! এবার সে বাংলাদেশে গরু পাচার করতে গিয়ে বি এস এফের হাতে ধরা পড়ে। পাক্কা পাঁচবছর পর সে মুক্তি পায়, সাসপেনশন ওঠে, তারপর আবার অফিসে জয়েন করে। 
         বছর দুয়েক সব ঠিকঠাকই ছিল। তারপরেই ভাদু আবার ধরা পড়ে পুলিশের হাতে ! এবার নারী পাচার ! আবার সাসপেনশন.........পুরো ষোল বছরের জন্য। 
         আমি এই অফিসে বদলী হয়ে আসার কয়েক বছর আগে ভাদু মুক্তি পেয়েছে। তারপরেই তার সাসপেনশন উঠে যাওয়ায় সে আমাদের অফিসে এসে জয়েন করেছে। হিসেব করে দেখলাম, গোটা কর্মজীবনের মোট চব্বিশ বছরই ভাদু সাসপেন্ড ছিল !
          কিন্তু হেড অফিস থেকে ভাদুর সার্ভিস বুকটা আসতেই চমকে গেলাম। রিটায়ারমেন্টের ডেট পার হয়ে যাবার পরেও ভাদু পুরো আটমাস বেশি চাকরী করেছে ! ওর সার্ভিস বুকটা হেড অফিসে পড়ে থাকায় বিষয়টা কারো নজরেই আসেনি !
          যাইহোক, গ্র্যাচুইটির প্রাপ্য টাকা থেকে ওভারড্রয়াল হওয়া বেতনের টাকা কেটে নিয়ে ভাদুর পেনসন সহ অন্যান্য রিটারমেন্ট বেনিফিট দিতে পেরেছিলাম। তবে আমি অন্য অফিসে বদলী হবার পর আমার জায়গায় আসা সহকর্মীর একটা ফোন পেয়েছিলাম মাস ছয়েক পরে।
          জানতে পেরেছিলাম, মোট যে চব্বিশ বছর ভাদু সাসপেন্ড ছিল, গভর্নমেন্ট তা রেগুলারাইজড্ করে দিয়েছে। অর্থাৎ ঐ চব্বিশ বছর ভাদু শুধু সাসপেনশন অ্যালাউন্স পেলেও এই নতুন অর্ডার অনুসারে সে পুরো বেতনই পাবে। 
          আমার সেই সহকর্মী আক্ষেপ করেছিল যে, এই লোকটি কর্মজীবনের বেশিটাই জেলে থেকেও পুরো বেতন পেল। গভর্নমেন্ট ওর থেকে প্রায় কোনও সার্ভিসই পেল না। আর এখন ওর ত্রিশ বছরের এরিয়ার বিল বানাতে গোটা অফিসের তিনজন কর্মী ব্যস্ত থাকায়, এখন তাদের কাছ থেকেও অফিস কোনও সার্ভিস পাচ্ছে না।
           আমার বলা শেষ হতেই বিশুদা মন্তব্য করলেন, 
---------ওয়াও ! ফাটাফাটি !!!
===========================

 
 
চন্দন দাশগুপ্ত 
সি/৩০/১, রামকৃষ্ণ উপনিবেশ, রিজেন্ট এস্টেট, 
কলকাতা---৭০০ ০৯২

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.