গল্প ।। বৃহন্নলা ।। সুমিতা চৌধুরী
0
ডিসেম্বর ০১, ২০২৪
বৃহন্নলা
সুমিতা চৌধুরী
বধূ নির্যাতনের কেসটা হাতে নেওয়া ইস্তক ভয় দেখানো, হুমকি রোজকার সঙ্গী হয়ে উঠেছে জয়ার জীবনে। পণের জন্য নির্মম অত্যাচার করে মেরে ফেলেছে মাত্র ২২বছরের সদ্য ফুল হয়ে ফোটা জুঁইকে। অর্থবলে প্রভাবশালী শ্বশুরবাড়ি যেনতেন প্রকারে ভয় দেখিয়ে কেসটা তুলে নিতে সমানে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু জুঁইয়ের বাপের বাড়ির সবাইকেই নয়, ওদের তরফে কেস লড়া জয়াকেও। কিন্তু আজ যেন সবসীমা পার করে মরিয়া হয়ে উঠেছে ওরা।
অন্ধকার গলিটায় পা দিয়েই জয়া বুঝেছিল তার পিছু নিয়েছে ওরা। পালাতে না পারলে শেষ করে দিতে হাত কাঁপবে না ওদের। তাই প্রাণপণে দৌড়াচ্ছিল সে। রাস্তার মোড়ে এসে একটা বৃহন্নলা দলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে যায়। ততোক্ষণে প্রায় কাছে এসে গেছে ভাড়াটে মাফিয়া দলের তিনটে ছেলে। রোজি, মালতী, বাসন্তী, লায়লি তাদের নিজেদের জীবনযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় বুঝে যায় কি ঘটতে চলেছে। তারা জয়াকে টেনে নিয়ে যায় পাশের এক দোকানে। দোকানি বলে ওঠে," এই এখানে কি? এসব ঝুটঝামেলা এখানে একদম বরদাস্ত করবো না। যা তোরা এখান থেকে। যা বলছি। যত্তোসব..." রোজি মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে," কি ? থামলে কেন? পুরো কথাটা শেষ করো বীরপুরুষ। "হিজড়ে"। তাইতো বলছিলে? তা তোমরা কেমন পুরুষ হে, মেয়েটাকে তিনজন মস্তান মিলে মারতে আসতে দেখেও যারা রক্ষা করার দম রাখেনা? এমনকি একটু আশ্রয় দিতেও অস্বীকার করে । তোমরা তো রাস্তায় মাদারির খেল দেখা পাবলিক। খেলা দেখে হাততালি মারো। হিজড়ে বলছো আমাদের? ও এখন এখানেই থাকবে। বেশী ঝামেলা করলে চেনো আমাদের। এই দিদিমণি, তুমি এখানেই দাঁড়াও। আমরা সালটে আসছি ওদের সাথে। এই ভদ্রলোকের ছেলেরা তো শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখতেই আছে, মাদারির খেল দেখছে রাতদিন।" ততোক্ষণে লায়লিরা তাড়া করে মুখোমুখি হয়ে গেছে ঐ তিনটে ভাড়াটে গুণ্ডার। চারদিকে লোক জড়ো হয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু সত্যিই যেন সবাই মাদারির খেল দেখছে, কেউ এগোনোর বা প্রতিবাদের সাহস দেখাচ্ছে না। লায়লি তিনটে ছেলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হুঙ্কার ছাড়লো,"কি রে,রাস্তার মাঝে নাচাবো নাকি? এইসবে এক বাড়ি থেকে ছেলে নাচিয়েই ফিরছি। বলিস তো তোদেরও নাচিয়ে দিই আয়। আর যদি না নাচতে চাস তো ভেগে পড়। ভদ্রলোকেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাসা দেখতে পারে, আমরা না। খুব ভালো করে জেনে নে। আমরা থাকতে কারোকে তোরা নাচাতে পারবি না। হয় ভাগবি, নয় আমাদের হাতে নাচবি। কোনটা পছন্দ বল। তোরা তো জানিসই আমাদের খুব ভালো করে, আমাদের কিছু করতে শরম ভি লাগে না, আটকায়ও না। ভদ্রলোকের কাপড় গায়ে নেই কিনা, তোদের মতো পুরুষও না, যাদের একটা মেয়েকে মারতে তিনটে পুরুষের দরকার হয়। আমরা হিজড়ে আছি, তাই হিম্মতটাও একটু বেশী।" হঠাৎ এমন অপ্রত্যাশিত প্রতি আক্রমণের মুখে ঐ তিনটে ছেলে পিছু হটতে বাধ্য হলো। সঙ্গে সঙ্গে ভিড় ফাঁকা হয়ে গেল, মাদারির খেল না দেখতে পাওয়ার মনের দুঃখে। জয়া অবাক হয়ে রোজি, লায়লিদের দেখছিল আর ওদের বলা কথাগুলো ভাবছিল। যেন ঘোরের মধ্যে ছিল সে। বাসন্তীরা ঐ দোকানে ফিরে এসে জয়ার পিঠে স্নেহের হাত রেখে বললো, "যাও দিদিমণি, আজকের মতো আর ভয় নেই তোমার। বাড়ি কি সামনে? যদি এইসব ভদ্রলোকেদের মতো আমাদের সাথে যেতে আপত্তি না থাকে, তবে পৌঁছে দিতে পারি।" জয়া কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে বলল," এসব বলে লজ্জা দিও না। তোমরা আজ আমার জন্য যা করলে আমি আজীবন চিরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকবো তোমাদের কাছে। পাশের গলিতেই আমার বাড়ি, চাইলে আমার সাথে আসতে পারো তোমরা সবাই। আমি খুশীই হবো। তোমাদের ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করবো না। তবে একটু কিছু খেয়ে গেলে আমার ভালো লাগবে। যদিও প্রাণের বিনিময়ে খাওয়াতে চাওয়া নয়, কারণ তোমারা আজ যা করেছো আমার জন্য তা কোনো মূল্যেই শোধ করা যায় না। তাই ওটা শুধুই আমার ইচ্ছের কথা বললাম।" রোজি এগিয়ে এসে হাত ধরে বলে," আচ্ছা চলো তোমার বাড়ি দেখিয়ে দাও। আজ যাবো না। পরে একদিন আসবো। চিনবে তো সেদিন?" রোজিরা সেদিন জয়াকে বাড়ির মোড় অবধি ছেড়ে চলে যায়।
বছর তিনেক পর সত্যিই একদিন রোজিরা আসে জয়ার বাড়ি। না, সেইদিনের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে নয়। উকিল হিসেবে জয়ার কাছে নিজেদের একটা কেস নিয়ে। সেইদিন জয়া চিনতে অস্বীকার করেনি তার প্রাণরক্ষাকারীদের। সাদরে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছিল ঘরে আর কেসটাও লড়েছিল।
কেসটা ছিল একটা ছেলে হওয়ার দরুণ হিজড়েরা বেশী পয়সা চেয়ে হুজ্জুতি করার বিরুদ্ধে। কেসটা চলাকালীন রোজিরা অদ্ভুত প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিল বিচারক তথা সমাজের কাছে। বলেছিল," আমরা তো ছেলে হওয়ার আনন্দে পয়সা নিই গো, তাদের মঙ্গল কামনা করি। আর সেইসব ছেলেরাই যখন বড়ো হয়ে বিয়ে করে তখন তাদের বাপ মা কিসের জন্য টাকা চায় বলতে পারেন ? ছেলে বেচার টাকা? মানুষ বেচে টাকা নিলে দোষ নেই, আর মঙ্গল কামনায় টাকা নিলে দোষ? জানেন আমরা আপনাদের গড়া নিয়মকে মেনেই মেয়ে হলে কম টাকা নিই, কারণ মেয়েকে তো বিয়ে দিতে হবে, আর তখন ঐ ছেলের জন্য পণও দিতে হবে। তাই দয়া লাগে। তোমাদের তো বাপু সে দয়াও নেই, পণ না পেলে জিন্দা জ্বালিয়ে দাও মেয়েটাকে। নিজের ছেলেকে বড়ো করে বিক্রি করতে তোমাদের শরম আসে না, আর ছেলের পূজোর জন্য টাকা চাইলেই আমরা অপরাধী? তোমাদের সমাজ তো আমাদের জন্য এই একটা কাজই রেখেছে। তাই আমরা সেই কাজ করেই খাই। তবে ইমানদারির সাথে, মন থেকেই মঙ্গল কামনাটা করি, আশীর্বাদটা করি। তোমাদের মতো নিজের ছেলেকে বাজারে বিক্রি করবো বলে মানুষ করে তারপর তার কিমতটা মাগি না। যদি মন থেকে না ভি করতাম তবুও ঠিকই করতাম। কারণ তোমরা তোমাদের ছেলের পিছনে ছোটোবেলা থেকে যা পয়সাটো খরচ করবে সবই তো পরে সুদে আসলে আদায় করে নেবে ছেলেকে বিক্রি করে। তাও তো তোমাদের অন্য কাজ কারবার আছে, আমাদের মতো নয়, যে ছেলে মানুষ করে বিক্রি করাটাই একমাত্র পেশা তোমাদের। তাহলে বলুন জজসাহেব কে অপরাধী?" যদিও কেসটা রোজিদের পক্ষে যায়নি। জজসাহেব বেলাগাম টাকা চাইতে বারণ করে টাকার অঙ্ক বেঁধে দিতে বলেছিলেন আর সামান্য কিছু টাকা জরিমানা বাবদ চেয়ে কেসটা ক্লোজ করেছিলেন। তবু শুধু জাজ বা জয়ার মনেই নয়, আদালতে উপস্থিত সবার সামনে তথা গোটা সমাজের সামনে রোজিদের প্রশ্নগুলো বারবার ফিরে ফিরে আসছিল আর ধিক্কার জানাচ্ছিল।
জয়ার মনে বারবার সেই তিনবছর আগের তাকে বাঁচানোর সময় রোজির বলা কথাটাই ফিরছিল, " বৃহন্নলা কারা? যারা নিত্য নানা আঙ্গিকের মাদারির খেল দেখে পৃষ্ঠপোষকতার, সমর্থনের হাততালি দেয় তারা অর্থাৎ এই সমাজ, নাকি, সমাজ যাদের তৃতীয় লিঙ্গের আখ্যা দিয়ে একঘরে করে রেখেছে তারা??"
#শব্দসংখ্যা_৯১২
====================
Sumita Choudhury
Liluah, Howrah