
মাধব ও মালতি
সমীরণ সরকার
চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ,ফা হিয়েন বাংলায় এসেছিলেন। তাঁদের ভ্রমণ বিবরণী থেকে জানা যায় যে, সেই সময় বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অরণ্য প্রদেশে অনেকগুলি ছোট ছোট রাজ্য ছিল। রাজধানী পাটলিপুত্র থেকে তাম্রলিপ্ত-আসতে অরণ্য অঞ্চলের ভিতর দিয়ে যে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হতো তার দুদিকে অনেকগুলি ছোট বড় রাজ্য ও জনপদ গড়ে উঠেছিল। সবচেয়ে সোজা পথটি ছিল বর্তমান বাঁকুড়া জেলার মধ্য দিয়ে। এই পথের পাশেই মল্ল রাজবংশের রাজধানী বিষ্ণুপুর পড়তো।
মল্লরাজ্যই বাঁকুড়া জেলার বৃহৎ ধর্মীয় জীবনের কাঠামোটি গড়ে তুলেছিল। মল্ল রাজ্যের সীমানা ছিল সেই সময় সমগ্র বাঁকুড়া, বর্ধমানের একাংশ গড়বেতা ,চন্দ্রকোনা ও পঞ্চকোট পর্যন্ত।
টাকা কড়ির অপ্রতুলতার জন্য মল্ল রাজারা কর্মচারীদের বেতনের পরিবর্তে ভূমি দান করতেন। এই জমি ছিল দুই ধরনের, পঞ্চকী বা স্বল্প খাজনার আর বেপঞ্চকী বা বিনা খাজনার।
রাজা ও সর্দারদের সঙ্গে বিভিন্ন খানে গমনা গমন পালকি বহন গৃহের নানাবিধ কাজে অনেক লোক নিয়োজিত ছিল। এদের নিষ্কর জমি দেওয়া হতো। এইসব জমিকে 'চাকরান' জমি বলা হত।
হস্তশিল্পী কারিগর বৈদ্য পন্ডি ত পুরোহিতরাও নিষ্কর জমি পুরুষানুক্রমে ভোগ করতো।
১৭৫৭ সালে পলাশর যুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে সুকৌশলে লর্ড ক্লাইভ বাংলা -বিহারের ক্ষমতা দখল করে।১৭৬০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জঙ্গলমহল এলাকায় বাণিজ্য করার অধিকার মীর কাশিমের কাছ থেকে লাভ করে।
১৭৬৫ সালে দিল্লির বাদশা শাহ আলমের কাছ থেকে দেওয়ানী আদায়ের সনদ পায়। এইভাবে জঙ্গলমহলে রাজস্ব ও বাণিজ্যের স্বর্ণ খনি পেয়ে যায় বিদেশি বণিকেরা।
দেওয়ানি আদায়ের অধিকার পেয়ে কোম্পানি মেদিনীপুরে রেসিডেন্ট নিয়োগ করে। রেসিডেন্টগন উচ্চহারে বার্ষিক খাজনা, রাজাদের জবরদস্তি উচ্ছেদ আটক নিলাম ইত্যাদি শুরু করে। রাজাদের উপরে এদেশীয় দেওয়ান নিযুক্ত করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খাজনা দেয়ার জন্য তিনটি ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
প্রথম পর্যায়ে ১৭৬৫ থেকে ১৭৭২ পর্যন্ত স্থানীয় আদায় ব্যবস্থার মাধ্যমে,১৭৭৩ থেকে ১৭৯১ সরকারি বল প্রয়োগে বর্ধিত খাজনা আদায় করে। এটাই ছিল 1791 সালে কর্নওয়ালিসের 'দশশালা বন্দোবস্ত'। তৃতীয় পর্যায়ে ১৭৯৩ সালে 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত' প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জমির উপরে জমিদার ও পাইকদের সামান্যতম অধিকার লোপ পায় ,পুরো ভূমি ব্যবস্থা আমূল বদলে দিয়ে মারাত্মক পরিণাম ডেকে আনে।
বহু যুগ যুগ ধরে এলাকার কৃষক হস্তশিল্পী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাদের নায়ক সরদার ,রাজারা এসব স্বাধীনতা ভোগ করতেন। এইসব স্বাধীনতা একসঙ্গে কেড়ে নেওয়া হয়। নতুন ধরনের জমিদার তৈরি হওয়ায় জন্ম নিল একদল তালুকদার ,পত্তনিদার নায়েব, গোমস্তা প্রভৃতি। এদের লুণ্ঠনের ফলে কৃষকরা সর্বস্বান্ত হয়ে ধ্বংসের মুখে দাঁড়ালো।
এইসব হস্তক্ষেপ ও অধিকার হরণের প্রতিবাদে দক্ষিণবঙ্গের মানুষ সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ব্রিটিশ সৈন্য দলের রসদ আটকে দেওয়া, কর আদায় বন্ধ করে দেওয়া এবং নানা প্রকার আক্রমণ চালানো ইত্যাদি হিন্দু মুসলমান উপজাতি সকলেই একজোট হয়ে করেছিল।
সমগ্র জঙ্গলমহল যখন উত্তপ্ত হয়ে উঠল ইংরেজ শাসকগণ কৌশলী বুদ্ধি খাটাল।
মেদিনীপুরের ম্যাজিস্ট্রেট উইলিয়াম স্ট্রাচি ১৩ই এপ্রিল ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কে সুপারিশ করেন যে, পূর্বতন রাজাদের জমিদারিতে শান্তি আনতে গেলে তাদের প্রতি নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করতে হবে।'পাইকান','চাকরান' ফিরিয়ে দিতে হবে। নব তম জমিদারদের অত্যাচারের প্রতি নজর দিতে হবে।
কৌশল গুলি সদর দপ্তর কাজে লাগায়। তারা রণক্লান্ত সর্দারদের মধ্যে বিভেদ আনতে সমর্থ হয়।শেষে বিদ্রোহ অনেকটা প্রশমিত হলে মেদিনীপুর,ওো মল্লভূম বর্ধমান জেলার অংশ নিয়ে ১৮০৫ সালে জঙ্গলমহল জেলা হয়, বাঁকুড়া হয় সদর কার্যালয়।
এই সময় সর্দারেরা উৎকল প্রদেশ উত্তর ও দক্ষিণ ভারত থেকে কিছু মানুষকে নিজেদের প্রয়োজনে অনুপ্রবেশের ও বসবাসের সুযোগ করে দেয়।তাঁদের মধ্যে ছিল ব্রাহ্মণত্ব ও ক্ষত্রিয় বোধ উচ্চবর্ণের মানসিকতা।
ঠিক সেই সময় বালেশ্বর থেকে গঙ্গা নারায়ণ মিশ্র নামে এক যুবক ভাগ্য অন্বেষণে বাঁকুড়ায় আসে।
নিজের কর্মদক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার জোরে সে ইংরেজ শাসকদের নজরে পড়ে যায়। মূল্যবান কাঠের কারবার করে সে ধীরে ধীরে ধনী হয়ে ওঠে। ইংরেজি আনুকূল্যে প্রচুর ভূ সম্পত্তির মালিক হয়। গঙ্গা নারায়ণের পুত্র প্রতাপ নারায়ণ ছিল বাবার চেয়েও কৌশলী এবং ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত। ফলে সাহেবদের কাছের লোক হয়ে আরো উপার্জন করায় তার কোন বাধা ছিল না। এই প্রতাপ নারায়ণ মিশ্র পদবী বদলে হন প্রতাপ নারায়ন চৌধুরী। তিনি বাঁকুড়া থেকে সাত ক্রোশ দূরে পনের বিঘা জায়গার উপরে 'চৌধুরী ভিলা' প্রতিষ্ঠা করেন।
চৌধুরী ভিলার তিনটি অংশ। কাছারিবাড়ী, অন্দরমহল ও উদ্যান।
এই কাছারিবাড়ি এক সময় লোকজন এ গমগম করত। প্রজারা খাজনা জমা দিতে আসতোৃন্তন্ত সরকার মশাই খাতা মিলিয়ে খাজনা জমা করতেন।
এখন কাচারি বাড়ি একেবারেই ফাঁকা। বর্তমানে এ বাড়ির দারোয়ান হরিলাল সিং তার বউ, মেয়ে নিয়ে কাছারি বাড়ির একটা অংশ থাকে। কাছারিবাড়ির অন্য অংশে থাকে চৌধুরী ভিলার চার চাকা গাড়ির ড্রাইভার যাদব পাত্র ও তার বউ।
চৌধুরী ভিলার বর্তমান মালিক মানবেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী।
(চলবে)