আমি একজন ভ্রমণ পিপাসু মানুষ , গত গরমের ছুটিতে শারীরিক অসুস্থতার কারণে কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠেনি । তাই শীতের ছুটি পরতেই বেরিয়ে পড়লাম মুর্শিদাবাদে হাজারদুয়ারির উদ্দেশ্যে।
আমাদের ট্রেনের সময় ছিলো সকাল ছটা বেজে ৪০ মিনিটের হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেস। আমরা ভোর পাঁচটা তিরিশ নাগাদ স্টেশনে পৌঁছে যাই এবং চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে তিন নম্বর প্লাটফর্মে যাই যেখানে ট্রেনটি দাঁড়িয়ে ছিলো। আমরা সামান্য কিছু খাবার খেয়ে ছটা নাগাদ ট্রেনে উঠি কিন্তু বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা এতটাই খারাপ যে অন্ধকারে কিছুই ভালোভাবে দেখা যাচ্ছিল না। আস্তে আস্তে ট্রেনটিতে জনমানুষের সমাগম হতে থাকে এবং ঠিক ছয়টা বেজে ৪৫ মিনিটে ট্রেনটি চলতে শুরু করে প্রথমে মন্থর গতি থাকলেও আস্তে আস্তে গতিবেগ বাড়াতে থাকে ট্রেনটির। পথে ছোট-বড়ো মিলিয়ে অনেক স্টেশনে ছুটতে থাকে তার সাথে। আস্তে আস্তে পার হয়ে যায় উল্টোডাঙ্গা, দমদম, হালিশহর, নোয়াপাড়া, ইছাপুর, কাঁচরাপাড়া, পানিহাটি, নৈহাটি ,ব্যারাকপুর ,পায়রাগাছা ,টিটাগর, খড়দহ ,সোদপুর ,শ্যামনগর ,শিমুরালি, রানাঘাট ,পাগলা চণ্ডী ,তাহেরপুর, কৃষ্ণনগর ,ধুবুলিয়া ,খিদিরপুর ,বীরনগর, সাহেবনগর ,শ্যামনগর ,কল্যাণী, বেথুয়াডহরী ,শিবনগর ,দেবগ্রাম, তারকপুর, পলাশী ,বেলডাঙ্গা ,সিরাজনগর, রোজিনগর, বহরমপুর এবং সবশেষে মুর্শিদাবাদ স্টেশনে নামার পালা। আমি জালানার ধারে বসে বাইরে প্রকৃতির দৃশ্যটা সবসময় দেখতে বড়ো ভালোবাসি। তাই ১০১নম্বর সিটে বসে, হলুদ সরষে ফুলের রাশি ,সাদা সুগন্ধি রজনীগন্ধার মেলা ,আম গাছের সারি ,তার সাথে লিচু গাছের সারি, কত কুল গাছের সমাহার বিভিন্ন রংবেরঙের বাগান বিলাসের বাগান চোখের সামনে থেকে স্বপ্নের মতো ভেসে চলে গেল। সবকিছু মিলে মিশে ট্রেন দাঁড়াচ্ছে বিভিন্ন স্টেশনে আবার ছুটেই চলেছে তার গতিতে এবার এসে দাঁড়ালো পলাশী তে, কেন জানিনা সেখানে ইংরেজদের সাথে সিরাজ দৌলার১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের কথা কিছুক্ষণের জন্য অনুভূত হলো আমার মনে তার সাথে কখন যেন হারিয়ে গেলাম সেই অতীতের যুদ্ধক্ষেত্রে। মনের মধ্যে কেবলই হাজারদুয়ারি দেখবার আকাঙ্ক্ষাকে আরো যেন বাড়িয়ে দিলো দ্বিগুণ। আমার বড়ো মেয়ে অহনা উল্লাসিত হয়ে বলেই উঠলো - প্যালেস কখন আসবে ?
অবশেষে পৌঁছলাম গন্তব্যস্থলে ট্রেন থেকে নেমে মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে ঠিক দুপুর বারোটায় সেই স্বপ্নের হাজারদুয়ারি। আমি বরাবর ইতিহাসে খুব একটা ভালো ছিলাম না কিন্তু এত সুন্দর প্রাসাদ দেখবার পর ইতিহাস বই এর পাতা যেন আমার চোখের সামনে মেলে ধরলো। আস্তে আস্তে তার অন্তরে প্রবেশ করলাম দেখলাম তখনকার রাজ রাজা বা নবাব সিরাজদৌল্লা নানান ব্যবহৃত সামগ্রী, তাদের মধ্যে ছিলো - নবাবের ব্যবহার করা পালঙ্ক, তখনকার দিনের টাকা-পয়সা, বস্ত্র সামগ্রী, ঢাল তরোয়াল যুদ্ধ সামগ্রী, কামান , অবশেষে এলাম এক বিরাট কক্ষে সম্ভবত সেখানে সভার আয়োজন করা হতো বিরাট এক ঝাড়বাতি তার ওপরে বিশাল এক গোলক আকৃতির ছাদে সুন্দর কারুকার্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তখনকার দিনের আয়না সোনার চিরনি থেকে আরম্ভ করে চিনামাটির বাসন পত্র ফুলদানি বড় বড় আরাম কেদারা খাবার টেবিল ইত্যাদি আজও সংগ্রহ করে রাখা আছে। এক কথায় অনবদ্য নীল আকাশের ছাতার তলায় হলদে রংয়ের রাজপ্রাসাদ দেখার মজাটাই আলাদা। এরপর সেই রাজপ্রাসাদের প্রাঙ্গনে এক বিরাট কামান তার চারিপাশে গোলাপ ফুলের বাগান সত্যিই খুব সুন্দর। এবার একটু হেঁটেই ছোট্ট এক মদিনা মসজিদ দূর থেকে দেখলে মনে হয় শ্বেত পাথরের এক টুকরো তাজমহল; তার পাদদেশে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করা হলো। এবার কিছুটা এগিয়ে বিশ্ব বিখ্যাত বিশাল আকৃতির ইমামবাড়া, তার সামনে একটি সাদা ঘোড়া ঘাস খাচ্ছিলো। শোনা যায় এই ইমামবাড়াতে নাকি শুধুমাত্র মহরমের দিনেই প্রবেশ করা হয়।
এবার এখানকার পর্ব শেষ করে একটি টোটো নিয়ে ভাগীরথী নদী বরাবর পৌঁছে গেলাম মতিঝিলে। এটা ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত একটি পুরানো দিনের গম্বুজ আকৃতির মসজিদ তার সামনে কিছু ভাঙা কবর আছে, ওখানকার স্থানীয়রা বলেন ওই কবরে নাকি ভূত থাকে। আবার শোনা যায় এখানে নাকি সিরাজ দৌলার মাসি ঘাসেটি বেগম থাকতেন। এরপর তার পাশেই একটি আমাদের কলকাতায় অবস্থিত ইকো পার্কের মতো মতিঝিল পার্ক রয়েছে । সেখানে একটি অপূর্ব মূর্তি দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম মূর্তিতে পলাশীর যুদ্ধকে দেখানো হয়েছে সুন্দরভাবে, এর পাশাপাশি আলীবর্দী খান এবং সিরাজউদ্দৌলার একখানি মূর্তি রাখা আছে। এখানে বাচ্চাদের বিভিন্ন খেলার সামগ্রী ,নৌকা চড়া, ফুল বাগান, লাইট অ্যান্ড সাউন্ড এর ব্যবস্থা, এক বিশাল আকৃতির গ্যালারি ,একটি পদ্ম ফুলের পুকুর ,সবচেয়ে বড়ো কথাটি হলো এর ঠিক পাশেই অস্বক্ষুর আকৃতির হ্রদ কে স্পষ্ট ভাবেন লক্ষ্য করা যায়। এই মতিঝিল এবং হাজারদুয়ারি দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো যে আর অন্য
কিছু দেখবার সুযোগ হলো না প্রথম দিন।
সেদিন নৈশ্য ভোজনে ছিলো বিরিয়ানি।
পরদিন ঠিক সকালে উঠে সামান্য কিছু জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম ভাগীরথীর ওপারের গন্তব্যে ; একটি টোটো সংযোগে ভাগীরথীর ঘাট পর্যন্ত যাওয়া হলো। তারপর বৃহৎ আকৃতির নৌকার সাহায্যে ভাগীরথীর বক্ষ মাঝ পেরিয়ে আমরা চলেছি ওপারে, আশ্চর্যের বিষয় এখানকার নৌকাতে শুধু যে মানুষ পরিবহন করে তা নয় তার পাশাপাশি যানবাহন অর্থাৎ মোটরসাইকেল, সাইকেল , টোটো ,ছোট ছোট মারোতি, মটোর ভ্যান, গরু ,ছাগল, হাঁস, মুরগি ইত্যাদি পারাপার করা হয় এই ধদীর মাঝে।
ওপারে পৌঁছে শহুরে পরিকাঠামো ছেড়ে যেন একটু গ্রাম বাংলার ছবি দেখতে পেলাম সেখানে ভাগীরথীর পাড়ে বসে গরম চা খাওয়ার মজাটাই আলাদা। আবারো টোটো সংযোগে খোশবাগ অর্থাৎ এখানে নবাব সিরাজ দৌলা নবাব আলীবর্দী খাঁ সিরাজের স্ত্রী এবং এনাদের পরিবারের অনেকের কবরস্থান দেখলাম এখানকার পরিবেশ খুবই শান্ত চোখ বন্ধ করলে যেন মনে হয় এক প্রশান্তি। এখানে জুতো খুলে অন্তরে প্রবেশ করতে হয় কারণ এখানে মৃত মানুষের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। কবরের পাশে এক অসাধারণ হাসনুহানা গাছ আমাকে মুগ্ধ করেছে সাথে লাগোয়া মসজিদ ঠিক তার পাশেই এক বিরাট বড়ো স্নানাগার দেখলাম, দেখে মনে হলো যেন তখনকার সময়ে পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করে এই স্নানাগারের স্নান করতেন। আমার বাচ্চারা আনন্দের সাথে তো বলেই উঠলো - This is a nice swimming pool. তারা সেখানে পুকুরের জলে পা ডোবার মতো করে খানিকক্ষণ বসে রইল।
এবারের গন্তব্য রোশনি বাগ, "রোশনি" এই কথাটির মধ্যে যেন একটা কোমলতার সুর কানে বাজে। এখানে এক শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ মনে হয় না কেউ খুব একটা আসে। এখানে আমি, আমার মা ও ভাই প্রবেশ করেছিলাম
- এটি নবাব সুজাউদ্দিনের কবর স্থান। এত সুন্দর শান্ত পরিবেশ এক স্নিগ্ধ নির্মল বিরাজমান বায়ু আর তার সাথে হাসুনহানার সুমিষ্ট গন্ধ সুনীল নীলাভ আকাশের সাথে মিলেমিশে এক হয়ে গেল। এখানে এক পুরোনো মসজিদ সমৃদ্ধ ফুলের বাগান ও আম গাছের সারি রয়েছে।
তারপরের গন্তব্য ১০০০ কবরস্থান, এখানে কথিত আছে নবাব মীরজাফর এবং তার পরিবারকে এখানেই সমাধিস্থ করা আছে, এখানে মুক্ত কবর গুলি পুরুষের এবং ছোট কক্ষের মধ্যে থাকা কবরগুলি মহিলাদের। কারণ সেই সময় মহিলারা পর্দা প্রথা বিশ্বাস করতেন সেই জন্য তাদের শব দেহের এই ব্যবস্থা। এর ঠিক বিপরীতে, কিছু ভাঙাচোরা পুরানো ঘরবাড়ি আছে যেটা কিনা মীরজাফরের বাড়ি হিসেবেই পরিচিত শোনা যায় সেখানে ওনার বংশধররা আজও বসবাস করেন।
এবারের গন্তব্য কিরিটেশ্বরী মন্দির , পুরানে কথিত আছে মা কালীর এক রূপ হলো কিরিটেশ্বরী। এখানকার দেবী খুবই জাগ্রত এবং মা তার ত্রিনয়নী রূপ দিয়ে যেন জগতকে রক্ষা করেন। আরেকটি মন্দিরে মা কালী অধিষ্ঠাত্রী রূপে বসে আছেন পরনে নীল বেনারসি স্বর্ণ অলংকার দ্বারা সুসজ্জিত। এই মন্দিরের তিনদিক ঘিরে রয়েছে বাবা মহাদেবের মন্দির। যেহেতু এটা পৌষ মাস তাই এখানে পৌষী মেলার সমাবেশ ছিল বেশ জমজমাট। এর ঠিক দু তিন মিনিট পরেই রয়েছে গুপ্ত কিরিটেশ্বরী মন্দির।
এখানেও মা কালী অধিষ্ঠাত্রী রূপে বসে আছেন। এখানে দুপুরে সেবার ব্যবস্থা আছে।
এবারের গন্তব্য জগতবন্ধু ধাম এটি এক বিশাল আকৃতির মঠ। আমাদের বেলুড়ের রামকৃষ্ণ মঠের মতোই প্রায় এখানে বিগ্রহের কোন মূর্তি আমরা দেখতে পাইনি কারণ তিনি পর্দার আড়ালে ছিলেন। সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি মঠ বেশ কিছু মানুষ বসে ছিলেন মনের শান্তির জন্য, এখানকার পরিবেশ মনটা যেন পবিত্র করে দিলো। এখানে আর বেশিক্ষণ দাঁড়ায়নি।
এরপরে পথে পরলো, দিলখাগরির অর্থাৎ আজিমুন্নেসার কবর। ওটাতে আমরা যাইনি কেননা শোনা যায় উনি নাকি ছোটবেলায় এক দুরারোগ্য ব্যাধি তে আক্রান্ত ছিলেন, বাচ্চাদের খেয়ে নেওয়ার এক গল্প রয়েছে তাই সাহস করে যেতে পারলাম না।
ভাগীরথীর ওপারের গ্রাম বাংলার দৃশ্যের ইতিহাস প্রায় শেষের পথে এবার গ্রামের পথ ধরে টোটোতে করে ফিরছি সেই সময় হলুদ সর্ষে ফুলের বর্ণমালায় দুপুরের রোদের আভাকে যেন সোনার রঙে ভড়িয়ে দিলো।
এবার দ্রুত মধ্যাহ্নভোজন সেরে বেরিয়ে পড়লাম ভাগীরথীর এপারের ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করতে।
এদের মধ্যে প্রথমেই যাওয়া হয়েছিল কাঠগোলা বাগান এবং পরেশনাথ জৈন মন্দিরে । ঢুকতেই বিরাট এক ফটোক এর ভিতরে মনে হলো ছোট ছোট জালনা আছে যেটা দিয়ে বহিঃ শত্রুদের খুব সহজেই দেখতে পাওয়া যায়। এবার আস্তে আস্তে এগোচ্ছি দুই ধারে আম বাগান ও দেবদারু গাছ আমাদের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে ক্রমশ এগিয়ে চলেছে। এসে এক বিরাট হলুদ অট্টালিকা নাম কাঠগোলা প্রাসাদ, এটি সাধারণত জৈন রাজাদের নির্মিত। অন্তরে প্রবেশ করতেই তাদের নিদর্শন যেমন বড় বড় পালঙ্ক,টাকা করি ,ঝাড়বাতি ,তখনকার আয়না ,পোশাক-পরিচ্ছদ, আসবাবপত্র যুদ্ধ সামগ্রী ইত্যাদি রয়েছে। প্রায় অসম্ভব দেখা করছিলো তাই অট্টালিকার উপরের অংশটা আর দেখা সম্ভব হয়নি, যারা গিয়েছিলেন তাদের মুখে শুনলাম সেখানে নাচ ঘর ও আমদ প্রমোদের ব্যবস্থা রয়েছে। এই অট্টালিকা সামনে এক সুন্দর মূর্তি নির্মিত আছে। অট্টালিকার পিছনপ্রান্তে এক বিশাল পুকুর তার পাশে দুটি বড় বড় ফোয়ারা বিশাল জলাধরের পিছনে পাখি ও মাছের চিড়িয়াখানা রয়েছে। এই প্রাসাদের এক প্রান্তে রয়েছে বিশাল এক নদী বাহিত সুরঙ্গ পথ যেখান থেকে রাজারা বাণিজ্য করতে যেতেন।
দ্বিতীয়ত নসিপুরের রাজবাড়ী
এই বহুতল রাজপ্রাসাদ আমাদের টেলিভিশনের পর্দায় প্রায়শই দেখা যায়। এটিও হলুদ আকৃতির অট্টালিকা কাঠগোলা প্রাসাদের মতই কিছুটা, এর ভিতর প্রবেশ করতেই সেই একই সামগ্রী দেখলাম এর সাথে এই প্রাসাদে কিছু বিগ্রহের মূর্তি চোখে পড়লো। এটিও জৈনদের প্রাসাদ, এখানে একটি বিরাট ফাঁসি দেওয়ার ঘর চোখে পড়লো, যারা অন্যায় কাজ করতো তাদের জন্য এই ব্যবস্থা ছিল। এখানে এক বিরাট দালানে এখনো পর্যন্ত রাস উৎসব পালন করা হয়। এখানে একজন টেলিভিশন জগতের সঞ্চালক সতীনাথ মুখোপাধ্যায় উনার সাথে চাক্ষুষ দেখার সৌভাগ্য লাভ করলাম।
তৃতীয়তঃ জগত শেঠের বাড়ি, ওখানকার জমিদার ছিলেন তিনি।
তেনার বাড়িতে যুদ্ধ সামগ্রী পালঙ্ক আসবাবপত্র অলংকার পোশাক পরিচ্ছদ ছাড়াও তখনকার দিনে কিছু যানবাহন যেমন মোটরগাড়ি বাইক এগুলো চোখে পড়লো। দুটি পাশাপাশি কালো ও লাল রঙের এখনকার দিনের বুলেট বাইক এর মতন মোটরসাইকেল ছিলো ; যেটাকে দেখে আমার জ্যেষ্ঠা কন্যা অহনা বলেই উঠলো - আমার ক্যারাটে স্যারের বাইক।
এবার দেবী সিংয়ের রাজবাড়ী, এটি বিরাট এক সাদা অট্টালিকা ঢুকতেই ওপরে দেবী দুর্গার মূর্তি খোদিত আছে। এর ভিতর অনেক ছোট ছোট মূর্তি, রাধা কৃষ্ণ, জগন্নাথ দেব , কালী মূর্তি , দুর্গা মূর্তি, এক দালানের চারিপাশে বিভিন্ন ধরনের মন্দির নির্মাণ করা আছে। দেবী সিং মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করতেন। এখানে এক বিরাট রুপার এবং পিতলের রথ ছিলো। এই প্রাসাদের পিছনে রয়েছে এক বড়ো রান্নাঘর যেখানে এখনো বড়ো বড়ো হাড়ি কড়াই থালা-বাসন সংগ্রহ করে রাখা আছে।
তারপর ছিলো তোপখানা যেখানে কিনা এক বড়ো কামান রাখা ছিলো ওটার ভিতরে আর প্রবেশ করা হলো না ।
চতুর্থ এবং সর্বশেষ ইতিহাস প্রসিদ্ধ বিখ্যাত কাটরা মসজিদ অবস্থিত এই মুর্শিদাবাদেই। দূর থেকে দেখলে মনে হয় এটি পোড়ামাটি দ্বারা নির্মিত। এর এত সুন্দর নকশা সত্যিই আমাকে মুগ্ধ করেছিলো সবকিছু দেখার একেবারে অন্তিম পর্যায়ে এসে মুশিদাবাদ যেন আমার মনকে আরো আপন করে নিলো এর সম্পর্কে আমি যে কি লিখবো সেটাই ভেবে পাচ্ছি না। এই মসজিদের সিঁড়ির তলায় নবাব মুর্শিদতুলি খানের সমাধি রয়েছে। সবকিছু দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে কখন যে সন্ধ্যে হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না, এবার বাচ্চাদের আবদারে ঘোড়ার গাড়িতে করে ইমামবাড়ার চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করা হলো। হঠাৎই চলতে চলতে ঘোড়াটি ক্লান্ত হয়ে পরে এবং তাকে চাবুক দিয়ে আঘাত করা হয় সেই নাকি আমার বড় মেয়ে প্রচন্ড বিষন্ন হয়ে পরে। এবার একটু সন্ধ্যের আঁধারে বাজারে বেরিয়েছিলাম সেখানে চাঁদনী চক মসজিদের পাশে ফুচকা খাওয়া হলো, এবার এক বিরাট সাদা সিংহ দুয়ার পেরিয়ে একটু হেঁটে যেতে দেখলাম এক পুরানো রাজবাড়ি এখানেও কিছু নবাবের বংশধর আছেন স্থানীয় বাসিন্দারা বলে থাকেন। তাছাড়াও মুর্শিদাবাদের সংশোধনাগারটি বেশ দেখার মতন।
এই দিন তাড়াতাড়ি নৈশ ভোজন শেষ করে সারাদিনের ক্লান্তির পর শুয়ে পরলাম ; পরের দিন সকালে আবার ও কলকাতায় রওনা দিতে হবে।
পরদিন সকাল সাড়ে ছটা নাগাদ স্টেশনে উপস্থিত হই সেই সময় লাল রবির রেখা কেবলই খুব আকাশ থেকে উঁকি দিচ্ছে। সাতটা পঞ্চাশের ধনধান্য এক্সপ্রেসে উঠে বসলাম ৬৫ নম্বর সিটে বসে আবারো প্রাকৃতিক দৃশ্যটা শেষবারের মতো উপভোগ করলাম এবার বহরমপুর পার হয়ে যেন কোনো এক ছোট নদী বয়ে চলে গেছে, কৃষ্ণনগর পার হয়ে আরেকটি নাম না জানা ছোট নদী ছুটে চলে গেলো এভাবেই দেখতে দেখতে চলেছি...............
কোথাও একটা জায়গায় যেন ট্রেনটি কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে পরেছিলো সেখানে অপূর্ব সর্ষে ফুলের ক্ষেত দূর থেকে কি : অপূর্ব দেখতে লাগছিলো। এভাবেই ছুটে চলেছে পার হয়ে যাচ্ছে মাঠ ঘাট গাছের সারি পুকুর কতো ঘরবাড়ি হলুদ গাছের রাশি, ফুলকপি বাঁধাকপির সারি পেয়ারা বাগান আরো কতকিছু । যখন ট্রেনটি কল্যাণীর ওপর থেকে চলে যাচ্ছে সেই সময় চোখে পরলো, একটি ছোট স্টেডিয়াম যেটা কিনা যাওয়ার সময় লক্ষ্য করিনি। ট্রেনের দোলা চলে চোখে ঘুম এসে গেলো, অবশেষে ট্রেন এসে থামলো দুপুর ১:০০ টায় কলকাতা স্টেশনে । তারপর মারুতি সংযোগে যখন বাড়িতে ফিরবো তখনো মনটা যেন সেই মুর্শিদাবাদের পরে আছে , উত্তর কলকাতার বিভিন্ন অট্টালিকা থেকে শুরু করে বড় বড় শপিং মল থেকে অলিগলি তখনো বড়দিনের উৎসবের সজ্জায় সজ্জিত রয়েছে। আবার কোথাও সান্তাক্লজ দাঁড়িয়ে তদারকি করে চলেছেন। তারপর সল্টলেকের যুবভারতীর পাশ দিয়ে গাড়ি ক্রমশ এগিয়ে চলেছে................. এভাবেই প্রাকৃতিক সঙ্গীর হাতে হাত ধরে বাড়ি ফেরা হলো।।
======================
ভাঙ্গড় , দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।