
ভালোলাগার ইতিকথা
ইয়াসমিন বানু
এখন ভ্যালেনটাইন আবহ। চারিদিক দিলময়। অতীত থেকে ঋদ্ধ হয়ে পার করেছি জীবনের পঁচিশ পঁচিশ বসন্ত। পারিপার্শ্বিক দেখে আজ বড়ো পিছুতে ইচ্ছা করছে আমার।
বেশ মনে পড়ে তখন আমি নিচু ক্লাসে। একদিন টিফিনে আনিস আমসত্ত্ব নিয়ে এসেছিল। শান্তশিষ্ট আমি বেঞ্চের এক কোণে বসে নিজের টিফিন খাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমসত্ত্বের একটা পাতলা স্তর তুলে নিয়ে আমার সামনে এসে এদিক থেকে ওদিক দেখা যাওয়ার মতো করে আমায় দেখে বলেছিল খাবি?, আমি বলেছিলাম 'সন্দেশ নিবি?' সেদিনের এক অদ্ভুত ভালো লাগা,,,
দিন গড়িয়ে কৈশোরে পা রাখলাম। দোলের দিনে অন্য পাড়া থেকে ছেলেরা আসত রঙ খেলতে আমাদের পাড়ায়। পাড়া আলাদা হলে কী হবে? প্রায় সকলেই আমার চেনা।তাদের মধ্যে একজন আবির মেখে দুষ্টু- মিষ্টি তাকাতো, কিন্তু আমাকে একটু আবির দিতে পারত না, আমিও পাবার ইচ্ছাটা মনেই রাখতাম। কারণ ওরকমটাই ছিলাম আমি।
কলেজে পা রাখলাম। সবুজে ঘেরা সরকারি কলেজ ক্যাম্পাস। উল্টোদিকে বাবার অফিস ক্যাম্পাস ,আমাদের কোয়ার্টার। তখন আমি বেশ কিছুটা সাবলীল। কলেজের প্রোফেসর স্যারেরা, সিনিয়ার, জুনিয়র বন্ধুরা, সকলেরই আমাদের বাড়ি আনাগোনা।আমার বিষয় ছিল উদ্ভিদবিদ্যা, সাথে জীববিদ্যা ও রসায়ন। তাই গাছগাছালি ,পাখপাখালি চিনতে প্রায়শই ট্যুরে যেতাম। সঙ্গে থাকতো বড়ো বায়োলজি বক্সের একটা ছোট্ট রূপ। যাতে খুব দরকারী কয়েকটা ছুরি- কাঁচি থাকতো। সেই সময় ছেলেদের ব্যাগি শার্ট পরার একটা চলন উঠেছিল। ঢোলা জামা , বড়ো বুক পকেটওয়ালা। আমার এক বন্ধু প্রায়ই আমার ছোট্ট বায়োলজি বক্সটা ওর বুক পকেটে রেখে নিতো। তার ওপর ত্রিমাত্রিক আকার দিয়ে লিখেছিল আমার নাম । আমি ওটা নেবার জন্য যতবারই বলতাম ও ততবারই আমায় দিতে দেরি করতো। ওই অতিবাহিত সময়কালটা দারুন লাগত আমার।
আমার আর এক বন্ধু থাকতো খড়গপুর আই আই টি ক্যাম্পাসে।একবার আমরা সবাই মিলে গিয়েছিলাম ওখানে ঘুরতে। ও খুব ভালো ছবি তুলত। আমি ওর কাছ থেকে আই আই টি ক্যাম্পাসের একটা ফটো চেয়েছিলাম। রাতের আলোয় তোলা ভারী সুন্দর একটা ছবি ও আমায় দিয়েছিল। ছবির উল্টোদিকে লিখেছিল 'In sweet memory of Little lady of botany.' ছবিটা বহুদিন খুব যত্ন করে রাখা ছিল আমার কাছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পৌঁছালাম। তখন স্যারদের নোট জেরক্স করা হতো। ক্লাসের একজন দায়িত্ব নিয়ে অনেকগুলো কপি জেরক্স করতো। ওরকমটাই তখন চলতো। আমার সেই খড়গপুর ক্যাম্পাসের বন্ধুটি একবার দায়িত্ব নিল। প্রত্যেকের সেট জেরক্স করে একটা করে স্টিকার লাগিয়ে দিয়েছিল। বিভিন্নজনেরটায় মজার মজার কমেন্টস। আমারটাই লেখা ছিল ' I love you too much for words'. সেও এক মোহাবেশ।
বাংলা ব্যাকরণে অক্ষরগুলো অর্থপূর্ণভাবে বসে তৈরি হয় শব্দ। শব্দে বিভক্তিযুক্ত হয়ে তৈরি হয় পদ। আর এই পদ অর্থপূর্ণভাবে বাক্যে বসে তৈরি হয় কবিতা।
আমার ভালো লাগার ব্যাকরণের নিয়ম হয়তো বা ত্রুটিযুক্ত ছিল , তাই 'ভালোবাসার' কবিতা লেখা হলো না।
এরপর প্রথা মেনে এক অপরিচিত সঙ্গীর সাথে জীবনদোলায় উঠে পড়লাম। ভাবলাম এবার কবিতা লিখবই , একদম অন্যরকমভাবে। কবিতাতো চলছিল, প্রায় মাঝপথেরও বেশি। আকস্মিকভাবে আমার সাথীটি ছেড়ে গেল আমায়,,,,, কোথায় গেল, বলে গেল না। কবিতা থামিয়ে এখন আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখি ওকে।
আমি একজন স্কুল শিক্ষিকা। ছেড়ে দিলাম স্কুল। জীবনে ছোটো, বড়ো অনেক রকম স্টুডেন্টই পড়ালাম। এখন একদম ছোটোদের নিয়ে শুরু করেছি নিজের মতো।
আঁচড় কাটা দিয়ে শুরু করিয়েছি ওদের। প্রথমে শোওয়া বা স্লিপিং লাইন । তারপর কিছুটা কাত করে স্ল্যান্টিং লাইন, তারপর পুরো সোজা স্ট্যান্ডিং লাইন। লক্ষ্য একটাই, ওই কচিকাঁচাদের সাথে সাথে নিজেকেও তো আবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে।
ভীষণ ভালোলাগা ওদের মাঝে। এ আর এক অন্যরকম ভালোলাগা।
ভারী মিষ্টি, এক ছোট্ট মেয়ে আমার জন্য রোজ সন্ধ্যায় ওর ছাদ বাগানের ফুল আনে। ওর ফুলেই আমার সন্ধ্যার প্রেম। আজ এনেছে সুগন্ধি গোলাপ, পাপড়ির মোটা বুনোটে ঠাসা। ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, তুমিই আমার 'ভ্যালেন্টাইন', আমার 'ভালোবাসা'।।
======================
বেকবাগান
কলকাতা-১৭