
রহস্যের সন্ধানে
মিঠুন মুখার্জী
সেদিন ছিল রবিবার। কলকাতার বাটানগর থেকে তিন দিনের জন্য দীঘাতে সমুদ্রসৈকতের অসাধারণ সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য মেয়ে নন্দিতা ও বউ মনামীকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন সৈকত মুখোপাধ্যায় নামে এক ব্যক্তি। পেশায় তিনি কলকাতার এক নামি কলেজের ইতিহাসের শিক্ষক। ঘুরতে তার খুবই ভালো লাগে। প্রত্যেক বছর দু-একবার তিনি পরিবার নিয়ে দেশের মধ্যেই ঘুরতে যান। এই নিয়ে তিনি দশবার দীঘায় ঘুরতে গেছেন। তাই দীঘা ও তার আশেপাশের জায়গাগুলো তার একেবারে নখদর্পণে। চোখ বেঁধে নিয়ে গিয়ে চোখের বাঁধন খুলে দিলে একমুহুর্তে তিনি বলেদিতে পারবেন কোথায় তিনি আছেন। মেয়ে নন্দিতা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে সবে অঙ্কে অনার্স নিয়ে বাবার কলেজে ভর্তি হয়েছে। তার দুচোখে স্বপ্ন বাবার মতো কলেজের অঙ্কের প্রফেসর হবে। বউ মনামী বিয়ের পর একটা প্রাইমারি স্কুলে চাকরি পেয়েছেন। এতদিন চাকরি করার অভিজ্ঞতায় তিনি এখন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হয়েছেন। পরপর তিনদিন স্কুল ছুটি থাকায় দীঘাতে আসার প্রস্তাব স্বামী সৈকতকে তিনিই দেন। সৈকতের ইচ্ছা ছিল সিমলা-কুলু-মানালি যাওয়ার, কিন্তু হাতে সময় কম থাকায় শেষমেশ মনামীর প্রস্তাবে তিনি রাজি হয়ে যান।
হাওয়া থেকে ট্রেনে চড়ে মাত্র চার ঘন্টার মধ্যে তারা নিউদীঘায় পৌঁছে যান। নন্দীতা বাবা-মার সিদ্ধান্তের উপর কখনো কোনো কথা বলে না। তাদের সমস্ত সিদ্ধান্তকে কোনো প্রশ্ন না করে মেনে নেয় সে। এককথায় নন্দিতা বাবা-মার খুবই বাধ্য সন্তান। দীঘায় পৌঁছে তারা নিউদীঘায় একটি সুন্দর হোটেলে ওঠেন। সেখান থেকে নিউদীঘার সমুদ্রসৈকত একদম কাছে। এমন কি হোটেলের দুইতলার ঘরগুলো থেকে সমুদ্রের মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক শোভা চোখে পরে। হোটেলে বসে সৈকত ও মনামী ঠিক করে নেন কীভাবে নিউদীঘা,ওল্ড দীঘা ও সাইড সিনগুলো তারা এই অল্পসময়ের মধ্যেই কভার করবেন। স্নান সেরে হোটেল থেকেই দুপুরের খাবার খেয়ে তারা সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে যান। নন্দিতার হাতে একটা ডিএসএলআর ক্যামেরা ছিল। বাবা-মার সুন্দর মুহূর্তগুলি সে ক্যামেরাবন্দী করতে ব্যস্ত ছিল। এরপর মার হাতে ক্যামেরা দিয়ে বাপ ও মেয়ে সমুদ্রে স্নানে নাবেন। নন্দিতার মা মনামীও একের পর এক তাদের সুন্দর সুন্দর ছবি তোলেন । এই আনন্দের মাঝেও যে একরাশ বিপদ অপেক্ষা করছিল তা তারা তিনজন কেউ একমুহুর্তের জন্যও বুঝতে পারেন নি। মিনিট ত্রিশ পর নন্দিতা জল থেকে উঠে এসে হাত-মুখ ও মাথা মুছে মার হাত থেকে ক্যামেরাটি নিয়ে মাকে বাবা সৈকতের সাথে সমুদ্রস্নানে যেতে বলে। বাবা - মা যখন সমুদ্রস্নানে রত তখন মেয়ে নন্দিতা ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়। সৈকত মুখোপাধ্যায় ও মনামী মুখোপাধ্যায় মিনিট পনেরো স্নানে এমন ব্যস্ত ছিলেন যে মেয়ের দিকে কোনো খোঁজ ছিল না। হঠাৎ মনামী সৈকতকে বলেন--- "নন্দিতাকে দেখতে পাচ্ছি না, ও কোথায় গেল? জামা পাল্টাতে হোটেলে চলে গেল না কি? তাড়াতাড়ি চলো তো দেখি।" এরপর তারা দুজন জল থেকে উঠে তাড়াতাড়ি দৌড়াতে দৌড়াতে হোটেলে যান। সেখানে নন্দিতাকে খুঁজে পান না। মনামী কান্না করতে থাকেন। তিনি তার স্বামীকে বলেন--- " আমার মেয়ে কোথায় গেল? যেখান থেকে হোক আমার মেয়েকে তুমি খুঁজে এনে দাও। ওকে না পেলে আমি মরে যাব। ওর দিকে আমরা নজর রাখলাম না কেন?" মনামীকে কাঁদতে দেখে সৈকত মুখোপাধ্যায়ের মুখটা অন্ধকার হয়ে যায়। মনামীকে সাহস দিয়ে বলেন--- " এখনি এমন করো না। হয়তো ও আমাদের সমুদ্র সৈকতে খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছে না। তাড়াতাড়ি চলো আমরা ওকে সমুদ্রসৈকতে খুঁজি । যদি না পাওয়া যায় তখন পুলিশের কাছে যেতেই হবে। নিশ্চয় ওকে খুঁজে পাব আমরা।" এরপর দুজনে মিলে নিউদীঘার সমুদ্রসৈকতে অনেক খোঁজাখুঁজি করেন। সৈকতের মানিব্যাগে মেয়ের ছবিও ছিল। অনেককে ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেসা করেন তারা নন্দিতাকে দেখেছেন কিনা। সবাই জানান তারা দেখেন নি। এরপর কাল বিলম্ব না করে সৈকত বাবু মনামীকে নিয়ে দীঘার পুলিশ স্টেশনে যান এবং তাদের দীঘায় আসার পর থেকে সমস্ত ঘটনা পুলিশের সামনে খুলে বলেন। একজন পুলিশ অফিসার সবকিছু শুনে তাদের বলেন--- "আপনারা মিসিং ডাইরিটা লিখিয়ে আপনাদের মেয়ের একটা ছবি দিয়ে হোটেলে যান, আমরা ঘন্টা দুয়ের মধ্যে আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব। যদি আপনাদের মেয়ের কোনো খবর পাওয়া যায় তবে অবশ্যই আপনারা তা জানতে পারবেন। এখন আসুন।" তারা দুজন মিসিং ডাইরিটা করে মানিব্যাগে থাকা ছোট ফটোটি পুলিশ অফিসারের কাছে দিয়ে হোটেলে চলে যান। নন্দিতার মায়ের মনে কু-ডাকছিল বারংবার।
এদিকে তারা দুজন চলে গেলে পুলিশেরা মেয়েটির ফটোটি নিয়ে নিউদীঘার সমুদ্রসৈকতের আশপাশের দোকানগুলোতে ও মানুষদের কাছে যান, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারেন না। পুলিশেরা অনেককে ছবিটি দেখিয়েও কোনো তথ্য পান না। এরপর তারা কিছুটা দূরে একটা জেলেকে মাছ ধরতে দেখেন। নন্দিতার ছবি নিয়ে তারা তাকে দেখান। তিনি নন্দিতার ছবি দেখে বলেন ---- "ঘন্টা দুয়েক আগে চারজন ছেলে এই মেয়েটিকে একটি হুডখোলা গাড়িতে করে জঙ্গলের দিকে নিয়ে গেছে। মেয়েটিকে আমি চোখের জল ফেলতে দেখেছি, কিন্তু কোনো চিৎকার করতে শুনি নি। আমার মনে প্রথমে সন্দেহ হলেও মাছ ধরার ব্যস্ততায় বিষয়টি তেমন গুরুত্ব দিই নি। এখন বুঝতে পারছি মেয়েটাকে শয়তান ছেলেরা তুলে নিয়ে গেছে।" আসলে মেয়েটির পেটে একটি যুবক বন্দুক ধরেছিল, যেকারনে প্রাণভয়ে সে চিৎকার করতে পারে নি। এরপর পুলিশ কোনদিকে গেছে জিজ্ঞাসা করলে জেলে আঙ্গুল দিয়ে দিক নির্দেশ করে দেন। পুলিশ তার দেখানো পথে জিপ গাড়ি নিয়ে যান। কিডন্যাপারদের কাছে বন্দুক থাকতে পারে অনুমান করে পুলিশেরা সচেতনভাবে বন্দুক সঙ্গে নিয়ে যান। তিন চার কিলোমিটার যাওয়ার পর একটি বিরাট শালবন পরে। যেটি প্রায় ছয়-সাত কিলোমিটার বিস্তৃত। দিনের বেলায় ঐ জঙ্গলে সেভাবে আলোপ্রবেশ করতে পারে না। তাছাড়া ওই জঙ্গলটি রহস্যময়। গত পাঁচ বছরে দশজন মানুষের প্রাণ গিয়েছে। যারা যারা ওই জঙ্গলের ভিতরে গেছে তাদের বেশিরভাগ মানুষই মারা গেছে। ভয়তে এই রহস্য উন্মোচন করার সাহস পুলিশেরাও দেখান না। একবার তিনজন গোয়েন্দা পুলিশ এই জঙ্গলের রহস্য উন্মোচনে একটা জিপ নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারা আর ফিরে আসেন নি। এখনো পর্যন্ত তাদের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তারা নন্দিতা ও তাকে কিডন্যাপ করা যুবকদের দেখতে না পেয়ে সেখান থেকে চলে আসেন। সেই রহস্যময় ভয়ানক জঙ্গলে প্রবেশ করেন না।
এদিকে পুলিশের অপেক্ষায় নন্দিতার বাবা-মা বসে বসে আর ধৈর্য্য রাখতে পারেন না। তাদের পুলিশ স্টেশন থেকে ফেরার পর দুঘন্টা অতিক্রান্ত হয়ে যায়। পুলিশ অফিসার তার কথা মতো তখনও আসেন নি। সৈকত ও মনামীর টেনশন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায়। মনামী সৈকতকে বলেন --- " তাহলে কি পুলিশ আমাদের মেয়েকে এখনো খুঁজে পায়নি? কোথায় গেল মেয়েটা? দীঘায় ঘুরতে আসা কি আমাদের নিয়তি ছিল? হে ভগবান আমার মেয়েকে আপনি রক্ষা করুণ। ওর সাথে যেন কোনো খারাপ কিছু না হয়।" এই বক্তব্য রাখার পর হঠাৎ তারা যে ঘরে ছিলেন সেই ঘরের দরজায় দুটোকার শব্দ থেমে থেমে তিনবার শোনেন। মনামী তাড়াতাড়ি দৌড়ে এসে দরজা খোলেন। দেখেন পুলিশ অফিসার দুজন কনস্টেবল নিয়ে হাজির হয়েছেন। তাকে দেখে নন্দিতার মা কান্নায় ভেঙে পড়েন। নন্দিতার বাবা পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞাসা করেন ---- " অফিসার আপনারা আমাদের মেয়ের খোঁজ পেয়েছেন? ওর মাকে আর সামলাতে পারছি না । আমাদের মনের অবস্থা খুবই খারাপ। আপনাদের কাছে হাত জোড় করে অনুরোধ করছি বিষয়টি একটু গুরুত্ব দিয়ে দেখুন। " এরপর পুলিশ অফিসার নন্দিতার বাবা-মাকে নন্দিতার কিডন্যাপের বিষয়টি খোলাসা করে বলেন। তাদের বলেন--- " আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি, সিসি ক্যামেরার ফ্রুটেজ চেক করে দেখতে বলে দিয়েছি। এই বিষয়ের সঙ্গে যারা যারা জড়িত খুব তাড়াতাড়িই তাদের ধরতে পারব বলে আশা করছি। আপনারা একটু ধৈর্য ধরুন, আপনাদের মেয়েকে অবশ্যই পাওয়া যাবে।" পুলিশ চলে গেলে নন্দিতার মা মনামী পাগলের মতো আচরণ করতে থাকেন। নন্দিতার বাবা কি করবেন তা বুঝে উঠতে পারেন না।
পরদিন সকালে নিউদীঘার দুই কিলোমিটার দূরে সমুদ্রসৈকতে একটি মেয়ের মৃতদেহ পাওয়া যায়। পুলিশ খবর পেয়ে সৈকত মুখোপাধ্যায়কে ফোন করেন। পুলিশের সঙ্গে তিনি ও মনামী দেবী যান। ভয়ে তাদের দুজনের শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। সারাশরীরে শিহরণ জাগে। সমুদ্রসৈকতে গিয়ে তাদের পা আর চলতে চায় না। তবুও কোনোরকমে মনে একরাশ যন্ত্রনা আর ভয় নিয়ে তারা মৃত মেয়েটির কাছে পৌঁছায়। তখন সেই মৃত মেয়েটি সৈকতের বালিতে উবু হয়ে পড়ে ছিল। পুলিশ যত মেয়েটির কাছে এগতে থাকে ততই তাদের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। এমন অবস্থা হয় যে যখন-তখন তাদের একটা কিছু হয়ে যেতে পারে। পুলিশ মৃতদেহটি চিৎ করলে ভয়ে মনামী চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন এবং চোখদুটো বুজিয়ে নেন। কিন্তু সৈকত মুখোপাধ্যায় মৃত মেয়েটিকে সাহস করে দেখে বুঝতে পারেন এটি তাদের মেয়ে নন্দিতা নয়। তিনি তখন মনামীকে বলেন--- "এটা আমাদের মেয়ে নন্দিতা নয়। চোখ খুলে দেখো একবার।" মনামী চোখ মেলে তাকিয়ে দেখেন এ তার মেয়ে নন্দিতা নয়। টেনশনে তার গলা শুকিয়ে এসেছিল। নন্দিতা নয় বোঝার পরে তার প্রানে জল আসে। এরপর পুলিশ অফিসারকে নন্দিতার বাবা বলেন ----- " অফিসার এ আমাদের মেয়ে নয়। আপনারা গতকাল যে জঙ্গলের কথা বলছিলেন ওখানে একটু খুঁজে দেখার ব্যবস্থা করুণ। যতটাকা প্রয়োজন আমি আপনাদের দেব, কিন্তু আমার মেয়েকে আপনারা খুঁজে এনে দেন।" এরপর অফিসার বলেন ---- আমরা দু-এক দিনের মধ্যে ওই জঙ্গল অভিযানে যাব। কলকাতা থেকে আজই স্পেশাল ফোর্স আসছে। যারা জীবনের ঝুকি নিয়ে ওই জঙ্গলে আপনার মেয়েকে খুঁজবেন। তাছাড়া সিসি ক্যামেরার ফ্রুটেজ চেক করে আপনার মেয়েকে কিডন্যাপ করা চারজন ছেলেকে কাল রাতেই গ্ৰেপ্তার করা হয়েছে। তাদেরকে থার্ডডিগ্ৰি প্রয়োগ করে জানতে পেরেছি আপনার মেয়ে ওদের গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে ওই গভীর জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করেছিল। কিছুটা সময় আপনার মেয়ের পিছু পিছু ওরা গিয়েছিল। কিন্তু ভয়ানক জঙ্গল হওয়ায় তারা সেখান থেকে ফিরে আসে। আপনারা আরেকটু ধৈর্য্য ধরুন। আমি আপনাদের মনের অবস্থা বুঝতে পারছি।"
সেই দিন বিকেল বেলা কলকাতা থেকে পাঁচজন স্পেশাল ফোর্সের পুলিশ দীঘায় এসে পৌঁছায়। তারা পুলিশ অফিসার সুব্রত রায়ের কাছ থেকে পুরো বিষয়টি শোনেন। তারপর কিডন্যাপার চারজনের কাছে যান। পাঁচজন স্পেশাল ফোর্সের মধ্যে একজন অফিসার ছিলেন। তার নাম দেবরাজ বর্মন। তিনি তাদেরকে বলেন--- " তোদের কথা যদি মিথ্যা হয় তবে কুকুর দিয়ে তোদের খাওয়াব। মনে রাখিস আমার নাম দেবরাজ, আমার কথায় যা কাজেও তাই। তোরা যদি ভোগ করে মেয়েটাকে হত্যা করে থাকিস তবে এখনি সব বলে দে, নতুবা তোদের কপালে দুঃখ আছে।" এরপর কোমরের বেল্ট খুলে চারজনকে মারাত্মক মার মারেন তিনি।
পরদিন সকালে স্পেশাল ফোর্সের পাঁচজন ও দীঘার পুলিশ স্টেশনের দুজন কনস্টেবল নিয়ে অফিসার সুব্রত রায় জঙ্গল অভিযানে যান। প্রত্যেকের হাতে বন্দুক ও মাথায় হেলমেট। হেলমেটের সঙ্গে লাইট ফিট করা। তারা এক কিলোমিটার গভীরে প্রবেশ করার পর একটা বিকট শব্দ শুনতে পান। শব্দশুনে তারা সকলে শিহরিত হন। গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। শব্দ লক্ষ্য করে মনে সাহস নিয়ে সকলে এগিয়ে যান। কিন্তু কিছুই দেখতে পান না। দিনের বেলায় জঙ্গলের মধ্যে অন্ধকার বিরাজ করে। জায়গায় জায়গায় কিছুটা সূর্যের আলো প্রবেশ করেছে। ফলে ওই আলো দেখে মনের ভয় কিছুটা দূর হয় তাদের। যখন তারা গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করেন, তখন দিনের বেলাতেই চারিদিকে অন্ধকার। তবে পথ বোঝা যায়। পাখির ডাক শুনেও তাদের কেমন যেন ভয় ভয় করে। দেবরাজ বর্মন পুলিশ অফিসার সুব্রত রায়কে বলেন---- " এই জঙ্গলে কেউ একবার ভুল করে ঢুকে গেলে তার বাঁচা কঠিন আছে। আমার মন বলছে এর মধ্যে হিংস্র প্রানী এবং ভূত-প্রেতের ব্যাপার আছে। একবার তাদের খপ্পরে পড়ে গেলে ফিরে যাওয়া খুবই কঠিন।" তারা নন্দিতাকে খুঁজতে খুঁজতে একটি বড় গাছের কাছে আসেন, সেখানে একটা ক্যামেরা পান তারা। সেটি অন করে নন্দিতার বাবা-মার ও নন্দিতার ছবি দেখে তারা বুঝতে পারেন এটি নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মেয়েটিরই ক্যামেরা। তারা যে ঠিক পথে চলেছেন তা বুঝতে পারেন দেবরাজ বর্মন। তিনি এটিও অনুভব করেন, খুব ভুল না হলে মেয়েটি আশেপাশেই কোথাও আছে। তিনি এটা চিন্তা করেও অবাক হন, এই অন্ধকারময় বনের ভিতর এতোদূর মেয়েটি এলো কি করে! কয়েক মুহূর্ত পর দেবরাজ বর্মন দেখেন কিছুটা দূরে দুটো চোখ অন্ধকারের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু কোন প্রানী তিনি তা বুঝতে পারেন না। তিনি বন্দুক তুলে গুলি করলে সেই প্রানীটি ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় মারে। তারা সকলে সেই অচেনা প্রানীটির পিছু নেন। দৌড়াতে দৌড়াতে পুলিশ অফিসার সুব্রত রায় হঠাৎ কিছু একটায় বেঁধে পড়ে যান। সকলে লাইট মেরে দেখেন একটি মেয়েদের জুতো। স্পেশাল ফোর্সের দেবরাজ বর্মন সেটি হাতে নিয়ে পুনরায় নন্দিতাদের ক্যামেরাটি অন করেন। নন্দিতার ছবি দেখে তার পায়ে পড়া জুতোর সঙ্গে এই জুতোটি মেলান। তিনি বুঝতে পারেন, এটি নন্দিতার জুতো। তিনি সকলের উদ্দেশ্যে বলেন--- " আমরা আমাদের উদ্দেশ্য পূরণের খুবই কাছে আছি। সকলে খুবই সাবধান থাকবেন। এখানে চারিদিকে শুধু বিপদ। এই জঙ্গলের রহস্য এখনো আমাদের কাছে অজানা। হিংস্র বন্যপ্রানীরা যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণ করতে পারে। তাছাড়া এখানে অলৌকিক কোনো কিছু থাকতে পারে। বন্দুক খুব শক্ত করে ধরবেন।" দেবরাজ বর্মণের কথা শেষ না হতেই একটা বন্যপ্রানী তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পুলিশ অফিসার সুব্রত রায় সেটা সময় মতো লক্ষ করে গুলি ছোড়েন। তাকে গুলি ছুড়তে দেখে স্পেশাল ফোর্সের তিনজন পুলিশও গুলি ছোড়েন। তাদের পায়ের কাছে এসে পড়ে হিংস্রপ্রানীটি । তারা হেলমেটের লাইট মেরে দেখেন একটি হায়না বাঘ। সকলে অবাক হয়ে যান। এখানে যে হায়নার মতো বাঘ থাকতে পারে তা তাদের কাছে ও দীঘার স্থানীয় মানুষদের কাছে অজানা ছিল। চারজনের ছোড়া গুলির দুটি হায়নার গায়ে লেগেছিল। একটি মাথায় আর অন্যটি পেটে। এরপর সকলে নন্দিতার নাম ধরে ডাকে ও হেলমেটের লাইট দিয়ে তাকে খোঁজ করেন। খুঁজতে খুঁজতে দেবরাজ বর্মণ একটি গাছের নীচে এসে দাঁড়ান। হঠাৎ তিনি লক্ষ করেন উপর থেকে কি যেন তার গায়ে পড়ছে। সে আঙুলে লাগিয়ে লাইট দিয়ে দেখেন রক্ত। তিনি তখনি অনুমান করেন গাছের উপরে কেউ আছে। সঙ্গে সঙ্গে সকলকে বিষয়টি জানান। তারপর গাছের উপরের দিকে লাইট মেরে দেখেন একটু উপরের একটা মোটা ডালকে জড়িয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় রয়েছে নন্দিতা। সত্বর দুজন পুলিশ উপরে উঠে নন্দিতাকে উদ্ধার করে নীচে নামিয়ে আনেন। বাঁ পা ও ডান হাত থেকে রক্ত ঝরছে। দেখে সকলে অনুমান করেন নিশ্চয় হায়না বাঘের সম্মুখীন হয়েছিল সে। কথা বলার মতো কোনো অবস্থাই তার ছিল না। গায়ে প্রচন্ড জ্বর এবং ভয়ে তখনও সারা শরীর কাঁপছে ।
নন্দিতার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাওয়ায় দেবরাজ বর্মণ ও সুব্রত রায়েরা এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে তক্ষুনি জিপে তুলে দীঘার একটি ভালো নার্সিংহোমে নিয়ে আসেন। খুব তাড়াতাড়ি নন্দিতার চিকিৎসা শুরু হয়। পুলিশ অফিসার নন্দিতার বাবা সৈকত মুখোপাধ্যায়কে ফোন করে বলেন--- " আপনার মেয়েকে পাওয়া গেছে। আপনারা তাড়াতাড়ি নিউদীঘার 'সেবা' নার্সিংহোমে চলে আসুন।" নন্দিতার বাবা-মা খোঁজ নিয়ে অটোতে করে 'সেবা' নাসিংহোমে পৌঁছান। যখন তারা সেখানে পৌঁছান, তখন নন্দিতাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছিল। আইসিইউয়ের দরজার কাঁচ দিয়ে তারা দুজন মেয়েকে দেখেন এবং চোখের জল ফেলেন। এই প্রথম নন্দিতার বাবার চোখেও জল দেখা যায়। তিনি নিজেকে আর সামলাতে পারেন নি। অফিসার সুব্রত রায়ের কাছে নন্দিতা উদ্ধারের কাহিনী শুনে তাদের দুজনের শরীর রোমাঞ্চিত হয়েছিল এবং দুচোখে পুনরায় জল এসেছিল। স্পেশাল ফোর্সের পাঁচজনকে ও দীঘার পুলিশ অফিসার সুব্রত রায়কে তারা দুজন অসংখ্য ধন্যবাদ জানান। সৈকত বাবু বলেন---" আপনাদের সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনারা জীবনের ঝুকি নিয়ে আমার মেয়েকে না উদ্ধার করলে আমাদের দুঃখের অন্ত ছিল না। ওর মাকেও আমি বাঁচতে পারতাম না। আপনাদের মতো মানুষ আছে বলেই এখনো মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস আছে। ভগবান আপনাদের পরিবারের সমস্ত সদস্যদের ভালো রাখুন।" দেবরাজ বর্মন সৈকত মুখোপাধ্যায়ের কথার শেষে বলেন ---- " এটা আমাদের দায়িত্ব। মানুষকে বিপদ থেকে পরিত্রাণ দেওয়ার জন্যই সরকার আমাদের নিয়োগ করেছেন। আমরাও চাই আপনার মেয়ে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুক। " এরপর দুজন কনস্টেবল নার্সিংহোমে রেখে পুলিশ অফিসার সুব্রত রায় ও স্পেশাল ফোর্সের পুলিশেরা চলে যান।
দুইদিন পর নন্দিতার জ্ঞান আসে। বাবা - মাকে দেখতে দেওয়া হয়, কিন্তু কথা বলা বারণ থাকে। তিন দিনের দিন বিকেলে আইসিইউ থেকে তাকে সাধারণ বেডে দেওয়া হয়। মা-বাবাকে দেখে জড়িয়ে ধরে নন্দিতা ও কান্না করে। তার বাবা তাকে অভয় দিয়ে বলেন ---- " সব ঠিক হয়ে যাবে, একদম টেনশন করিস না। আমাদের কপালে ছিল, মেনে নিতে হবে। তবে যারা তোর এই ঘটনার জন্য দায়ী তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করবো আমি। খুব তাড়াতাড়ি তুই সুস্থ হয়ে যাবি।" একসপ্তাহ পর নন্দিতাকে নার্সিংহোম থেকে ছাড়া হয়। তখনও তারা নিউদীঘার হোটেলটি ছাড়েন নি। হোটেলে নন্দিতাকে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ অফিসার সুব্রত রায় সৈকত মুখোপাধ্যায়কে ফোন করে বলেন --- " আসামি চারজনকে এক সপ্তাহের মধ্যে কোর্টে তোলা হবে। আপনারা একসপ্তাহ বিচারের স্বার্থে দীঘায় থাকবেন। আমরা চাই অন্যায়কারীরা শস্তি পাক।"
একটু একটু করে নন্দিতা সুস্থ হয়ে ওঠে। পাঁচ দিন পর চারজন কিডন্যাপারকে কোর্টে তোলা হয়। নন্দিতা ও তার বাবা-মাও কোর্টে উপস্থিত ছিলেন। বিচারপতি নন্দিতার কাছে জানতে পারেন --- "এই চার অচেনা অজানা শয়তান খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে সমুদ্রসৈকত থেকে মুখে রুমাল চাপা দিয়ে তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের কাছে বন্দুকও ছিল। ভয়ংকর জঙ্গলের সামনে গিয়ে এদের হাত থেকে বাঁচতে ও নিজের সম্মান বাঁচাতে জ্ঞানশূন্য হয়ে সে জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করে। তার সে সময় একবারও মনে হয় নি সে লোকালয় থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার ভিতরে চলে এসেছে। যখন সে স্বাভাবিক অবস্থায় আসে তখন জঙ্গলের অন্ধকারে তার ভয় করতে থাকে এবং সে পথ হারিয়ে ফেলে। একটা সময় বাঘের গর্জন শুনে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। একবার বাঘের হাতেও পড়েছিল সে। হাতে ও পায়ে থাবা মারার পর একটা বিকট আওয়াজ শুনে বাঘ পালিয়ে যায়। রক্তে জামা-প্যান্ট ভিজে যায়। বাঘের হাত থেকে বাঁচতে একটি গাছের কিছুটা উপরে অনেক চেষ্টা করে উঠে গাছ জড়িয়ে বসে থাকে সে এবং দুর্গানাম জপ করতে থাকে। দুই দিন ভয়ে ও আতঙ্ক্ষে তার মনে হয়েছিল প্রানটা বেরিয়ে যাবে। বাবা-মার কথা চিন্তা করে খুবই কেঁদেছিল সে। বাঘ তারপরও এসেছিল কিন্তু তাকে খুঁজে পায় নি। নন্দিতা ওর উজ্জ্বল চোখদুটো ও গর্জন শুনে বুঝেছিল এটা হায়না বাঘ। " তারপর তার শরীরের দুর্বলতায় আর কিছু মনে পড়ে নি। বিচারপতি নন্দিতার কাছে সব শুনে কিডন্যাপ ও ধর্ষণের চেষ্টা আইনে দোষী সাব্যস্ত করে চারজনকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদন্ডের আদেশ শোনান। আদালতের রায়ের দুইদিন পর নন্দিতাকে নিয়ে সৈকত মুখোপাধ্যায় ও মনামী মুখোপাধ্যায় কলকাতায় ফিরে আসেন। আস্তে আস্তে নন্দিতা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।
=====================
মিঠুন মুখার্জী
C/O-- গোবিন্দ মুখার্জী
গ্ৰাম : নবজীবন পল্লী
পোস্ট+থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগণা