বাঙালি ও বাংলা ভাষা
শুভ্রেন্দু রায় চৌধুরী
না, শেষপর্যন্ত আমার আর পুরো বাঙালি হয়ে ওঠা হল না। ফেসবুকের লেখা 'অন্তরিন' নিয়ে ষোলটা বা 'চরৈবেতি' নিয়ে ন'টা পর্বের কোনও একটায় লিখেছিলাম, পুরো বাঙালি হওয়ার গোটা তিনেক শর্ত আছে। প্রথমত আপনাকে কবিতা লিখতে জানতে হবে, দ্বিতীয়ত, কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণে যখন বসন্তের হাওয়া হঠাৎ মনে ঢুকে পড়ে তখন একটা জবরদস্ত প্রেমে পড়তে হবে আর তৃতীয়ত 'দীপুদা'কে চিনতে হবে।
এই তিনটে শর্ত যে বাঙালির জীবনে পূর্ণ হয়েছে তারাই নাকি পাক্কা বাঙালি, বাকিরা ওই নামেই বাঙালি। আমার কবিবন্ধুদের যাঁকেই জিগ্যেস করেছি তাঁদের সবাই প্রায় বলেছেন, তিনটি শর্তই তাঁদের জীবনে ঘটে গিয়েছে। তাই তাঁরা সবাই পাক্কা বাঙালি। প্রথম শর্তটি তো তাঁদের কবি সত্তার মধ্যেই রয়েছে, মানে কবিতা লেখাই যাঁদের প্রাণ, তাঁদের কবিতা লিখেছেন কিনা সে প্রশ্ন করাটাই অবান্তর। এরপর তাঁদের অনেককেই, বুক ফুলিয়ে না হলেও, নীচু গলায় লাজুক লাজুক স্বরে স্বীকার করতে দেখেছি, যৌবনে তাঁরা কোনও না কোনও প্রেমের ফাঁদে, থুড়ি জালে জড়িয়েছেন, হয়তো কবিতা চালাচালি করেই! আর তাঁরা সবাই দীপুদাকে চেনেন, মানে দীঘা, পুরি আর দার্জিলিং ঘোরা তাঁদের হয়েই গিয়েছে। ব্যস, আর কী চায়! তাঁরা পাক্কা বাঙালি আর আমি এই শেষ শর্তটাতেই ল্যাং খেয়ে গিয়েছি। কারণ পুরী গিয়েছি, কিন্তু আজ পর্যন্ত দীঘা বা দার্জিলিং যাওয়া হয়নি, যদিও পেশার দৌলতে পৃথিবীর পুরোটা না হলেও অনেকটাই ঘুরে ফেলেছি।
আসলে, যবে থেকে জানতে পেরেছি পুরো বাঙালি হওয়ার কী কী শর্ত, তবে থেকেই কাছা খুলে লেগে পড়েছি পুরো বাঙালি হওয়ার সম্মান অর্জনে। মনে মনে শপথ করেছি প্রথম শর্ত পূরণ করতে যে করেই হোক একটা কবিতা লিখে ফেলব, কবিতা না হয় ছড়া লেখা এমন কোনও কঠিন কাজ নয়। কিন্তু দ্বিতীয় শর্ত পূরণের কথা ভেবেই সমস্যায় পড়লাম। যৌবনে ফিরে যাবো কী করে যে, একটা প্রেম করে সে শর্তটা মিটিয়ে ফেলবো! তবে হ্যাঁ, ছাত্রজীবনে আমার এক বন্ধুর বোনের প্রেমে পড়েছিলাম, কিন্তু কখনও জানতে পারিনি সেও আমার প্রেমে পড়েছে কিনা। তাই ওই ফিফটি পার্সেন্ট প্রেমকে একশো পার্সেন্ট প্রেম বলা যায় কিনা তা ভেবে দ্বিধায় পড়েছি। আর আমার বন্ধুর বোনটি এখন কোথায় আছে তাও জানি না, নয়তো তার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানার চেষ্টা করতে পারতাম সত্যিই তখন তার মনে আমায় নিয়ে কোনও প্রেম প্রেম ভাব এসেছিল কি না। একটু ভাব এসেছিল জানলেই মনে হয় দ্বিতীয় শর্তটা পূরণ হয়ে যাবে। কিন্তু সে গুড়ে এখন বালি।
তাই মনে করবার চেষ্টা করলাম, তখন এমন কী আর কোনও ঘটনা ঘটেছিল যা দেখে অনুমান করা যায় যে, সোচ্চার না হয়েও তার মনে নিশ্চয় প্রেম ভাব জেগেছিল! অনেক ভাবলাম। কিন্তু অনেক ভেবেও তেমন ঘটনা খুঁজে পেলাম না। আশা ছেড়ে দিলাম। তবে একদিন রাত্রে হঠাৎই একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল যা থেকে অনুমান করা যেতেই পারে একটা প্রচ্ছন্ন প্রেম ভাব তার মনে এসেছিল। ঘটনাটার কথা খুলেই বলি।
তখন আমরা মানে আমরা বন্ধুরা ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। যে বন্ধুর বোনের কথা বলছি সেই বন্ধুর বাড়িতে মঝে মাঝে আমাদের আড্ডা বসত আর ছুটির দিনে সারা দুপুর ধরে তাস পেটাতাম। বন্ধুর বোনটি আমাদের চা তেলেভাজা পরিবেশন করত। কখনও কখনও সে কিছু উল্টোপাল্টা কথা বলে ফেলত আর তা নিয়ে আমাদের দুই বন্ধু তার পেছনে লাগত। কথা কাটাকাটি হত। মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলত সে। আমার খুব খারাপ লাগত ওই দুই বন্ধুর ব্যবহারে। কিন্তু কিছু বলতে পারতাম না পাছে কেউ কিছু ভেবে বসে! আমি মনে মনে ফুঁসতামও। সেই তাকে নিয়েই একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছিল।
তখনকার দিনে কালীপুজোর পর পাড়ায় পাড়ায় জলসা হত। হেমন্ত, শ্যামল, সন্ধ্যা, মানবেন্দ্র, দ্বিজেন, তরুণ সব বিখ্যাত গায়ক গায়িকারা গাইতে আসতেন। সন্ধে সাতটার মধ্যেই জলসা শুরু হয়ে যেত। প্রথমে লোকাল গায়ক গায়িকারা গাওয়ার চান্স পেত, পরে একটু রাত হতেই বিশিষ্ট গায়ক গায়িকারা গাইতে উঠতেন। লোকাল উঠতি গায়ক গায়িকরা বহুদিন আগে থেকেই একটা মওকা পাওয়ার জন্য ওই সব জলসার আয়োজকদের পেছনে ঘুর ঘুর করত। আমার বন্ধুর বোনটি নিয়মিত গান গাইত এবং ভালোই গাইতো, অন্তত আমার মনে হত। আমাদের পাশের পাড়ায় একটা মোটামুটি ভালো জলসা হত। হেমন্ত সন্ধ্যাকে আনার তেমন ক্ষ্যামতা ছিল না, কিন্তু তরুণ দ্বিজেন প্রতিবারই আসতেন, একবার তো কাকে ধরে শ্যামল মিত্রকেও নিয়ে এসেছিল আর সেবার আশেপাশের পাড়ায় হইচই পড়ে গিয়েছিল।
একবার বন্ধুটির বোন আমাদের আরেকটি বন্ধুকে আবদার করে বসল যে, তার তো পাশের পাড়ার জলসার আয়োজকদের সঙ্গে বেশ দহরম মহরম আছে, তাদের বলে যদি পরের বারের জলসায় তার গান গাওয়ার একটা চান্স করে দিতে পারে। বন্ধুটি ব্যাপারটা কিছুই নয় এমন ভাব দেখিয়ে বলল, ঠিক আছে, দেখছি। তার একটু গা ছাড়া উত্তরে বন্ধুটির বোন খুব একটা খুশি হল না বলেই মনে হল আমার। আমি ভাবলাম, এই একটা মওকা। ওই পাড়ার এক দাদার সঙ্গে আমারও ভালো পরিচয় আছে ভালো ছেলে বলে, না, না, লেখাপড়ায় ভালো বলে নয়, গোবেচারা বলে। ভেবে দেখলাম, এই মওকাটা হাতছাড়া করা যাবে না। তাই পরেরদিনই সেই দাদার সঙ্গে দেখা করে বন্ধুর বোনের কথা একটু ফুলিয়ে ফাঁপিয়েই বললাম যে, সে গীতা দত্তের গানগুলো অসম্ভব ভালো গায়। আমার কথা শুনে দাদাটি বলল পরের দিন সন্ধেতে মেয়েটি যেন তাদের ক্লাবে চলে আসে, তারা তার গান শুনবে, ভালো লাগলে তাকে গাইবার চান্স দেবে।
দারুণ উৎসাহিত হয়ে বন্ধুর বোনকে বললাম সে কথা। বললাম, কাল বিকেলে যেন ওই ক্লাবে চলে আসে। আমিও থাকব বলে জানালাম। খুব খুশি হয়ে গদগদ হয়ে বন্ধুর বোনটি সম্মতি জানালো। পরের দিন আমি বিকেল থেকেই ওই ক্লাবের আশেপাশে দারুণ উত্তেজনা নিয়ে ঘুরঘুর করতে লাগলাম। এরপর ছ'টা বাজলো, সাতটা বাজলো, আটটাও বেজে গেল। বন্ধুর বোনটির কোনও পাত্তা নেই। ভাবলাম, বন্ধুর বাড়ি গিয়ে তাকে ধরে নিয়ে আসি। কিন্তু ব্যাপারটা একটু বেশি হয়ে যাবে ভেবে সেটা আর করলাম না। সে আর এলোও না। বিমর্ষ মনে রাত ন'টা নাগাদ বাড়ি ফিরে গেলাম।
পরেরদিন সকালেই সেই দাদাটির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বেশ ব্যঙ্গ করেই বললেন, কী হল, তোমার বন্ধুর বোনটি তো এলো না! ভয় পেয়ে গেল নাকি! আর আসার দরকার নেই। নমুনা দেখেই বুঝতে পারছি, ভরসা করার মতো নয়। দাদাটির শেষ কথাটা যেন তীরের মতো লাগল আমার বুকে। সত্যিই তো, এমন দায়িত্ব জ্ঞানহীন মেয়ের কিস্যু হবে না। আসলে, এমন একটা ইম্প্রেশ করার মওকা হাতছাড়া হতে দেখে আমি একেবারে ভেঙে পড়লাম। রাগে অভিমানে আমি পরের ক'দিন বন্ধুর বাড়িই গেলাম না। তারপর যেদিন তার বাড়িতে গেলাম, সেদিন ভেবেছিলাম, বন্ধুর বোনটি কী কারণে সে যেতে পারেনি জানিয়ে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে। কিন্তু সে তা করল না। আমিই শেষে উত্তেজিত হয়ে তাকে জিগ্যেস করলাম। বন্ধুর বোনটি বড় করে জিভ কেটে বলল, স্যরি, আমি এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ফেঁসে গেছিলাম। কোনও জবাব না দিয়ে আমি রাগে গরগর করতে করতে মুখটা ঘুরিয়ে নিলাম। তা দেখে বন্ধুর বোনটি চোখ নামিয়ে বলল, খুব রাগ হয়েছে আপনার, তাই না! আমি সত্যিই একটা অসভ্য মেয়ে।
সেদিন আমার আর কথা বলার ইচ্ছে হয়নি, একটু পর বন্ধুর সঙ্গে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। সত্যি বলতে কি, বসন্তের ঝোড়ো হাওয়ায় প্রেমের মোটা মোটা অনুভূতিগুলো তখন বুঝতে শিখলেও, সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো বোঝার মতো পরিণত মন তখনও হয়নি আমার। পরে তাবড় তাবড় সাহিত্যিকদের ভালো ভালো রোম্যান্টিক গল্প উপন্যাস পড়ে বুঝেছিলাম, কোনও মেয়েই সচারাচর নিজেকে 'অসভ্য' বলে না, যদি না তার বলার আবেগে অনুরাগের ছোঁয়া না থাকে। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি বন্ধুর বোনটির মনে কোনও না কোনও কোণে আমার প্রতি খুব বেশি না হলেও অনুরাগের কিছু ছিটেফোঁটা ছিল। বড় বড় লেখকদের এই অসামান্য উপলব্ধির যদি সত্যিই কোনও অর্থ থাকে, তবে আদ্যন্ত বাঙালি হওয়ার দ্বিতীয় শর্তটি কিন্তু তখনই আমার পূর্ণ হয়েছিল, তাই না!
রইল বাকি পাক্কা বাঙালি হওয়ার তৃতীয় শর্তটি, মানে 'দীপুদা'কে চেনা। সত্যি বলতে কি, দীপুদার 'পু' মানে পুরী আমি দু'বার গিয়েছি, একবার ছাত্রজীবনে বন্ধুদের সঙ্গে, পরে সংসার জীবনে পরিবার নিয়ে আরেকবার। দীপুদার 'দী' মানে দীঘা ঘরের কাছে একবার-ঘুরে-এলেই-হয় এই ভাবনায় আদ্যোপান্ত ভিজে থেকে এতগুলো বছরেও যাওয়া হয়ে ওঠেনি, তবে এখনও যেকোনও দিন সকালে ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে পড়লেই হয়, এ ভাবনাটা জ্যান্ত আছে। কিন্তু দীপুদার 'দা' মানে দার্জিলিং ঘোরার প্রবল সম্ভাবনাটার করোনা আক্রমণে সলিল সমাধি হল। সাধারণত প্ল্যান করে দার্জিলিং ভ্রমণ খুব একটা সহজ কথা নয়, কারণ শিব ঠাকুরটিও জানেন না পাহাড়ের অশান্তি কখন কবে কোথায় আছড়ে পড়বে আর সেই সম্ভাবনার খাঁড়াটি মাথায় ঝুলিয়ে দার্জিলিংয়ের পথে তাঁরাই বেরোতে পারেন যাঁদের অভিধানে 'চরৈবেতি' শব্দটা আছে। আমার অভিধানে কিন্তু নেই। সেদিক থেকে দেখতে গেলে আমি একটু ডরফুক মানুষ, অযথা ঝুঁকি নিতে আমার মন সায় দেয় না।
তবে সেই 'দা'কেই চেনার একটা সুযোগ এসে গেল যখন আমাদের মেয়ে জামাই বাগডোগরায় বদলি হয়ে এলো। মাত্র কয়েক ঘন্টায় দার্জিলিং শহরে পৌঁছানো যায় সেখান থেকে। না, তাদের ওখানে পৌঁছে গেলে ও সব অশান্তি ফশান্তির কথা মাথাতেও আসবে না। একদিন শান্ত থাকলেই ঘুরে আসা যাবে। বাগডোগরা গেলামও একবার, কিন্তু গণেশপুজোয় আমাদের দিল্লি যাওয়ার যে বাৎসরিক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়ে আছে, ওই ভ্রমণে সেটা জুড়ে যাওয়ায় সেবার আর দার্জিলিং যাওয়া হল না। ভাবলাম, ওরা তো আরও বছর দেড়েক থাকবে, দার্জিলিং দেখতেই যাবো ওদের কাছে আরেকবার।
কিন্তু কে জানতো, এক ভয়ঙ্কর করোনাবাবু ঘাপটি মেরে বসে আছেন আমাদের সেই পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিতে! শুধু কি তাই, সারা পৃথিবীকেই তিনি তুর্কি নাচন নাচাবেন, এটাও কি জগৎ সংসারের কেউ ভাবতে পেরেছিলেন! ভেবেছিলাম এপ্রিলের শেষের দিকে আবার বাগডোগরা যাবো আর সেখান থেকে টুক করে একবার দার্জিলিং। ব্যস, চব্বিশের মার্চ রাত আটটার মহামান্য প্রধানমন্ত্রীর একটি ঘোষণা সব গুবলেট করে দিল। আমাদের পরিকল্পনার মৃত্যু হল। লকডাউনের খাঁচায় বন্দি হয়ে গেলাম যে লকডাউনের গ্রহণ আটষট্টি দিনে ছাড়ল। আবার একটা ছোট্ট আশা জাগল। প্লেন চালু হলেই কোভিড বিধিনিষেধ মেনে নিজেদের পিপিই বর্মে সজ্জিত করে বাগডোগরার প্লেনে উঠে বসব। কিন্তু কে জানত, আমাদের আশার কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতবে জামাইয়ের মীরাট বদলি হওয়ার সংবাদ! শুধু সংবাদ নয়, বদলি হয়ে মেয়ে জামাই পৌঁছেও গেল মীরাট। ব্যস, আমার আদ্যপান্ত বাঙালি হওয়ার প্রয়াস আপাতত শিঁকেয় উঠল। আপাততই বা বলছি কেন, চিরতরে বলাটাই ঠিক হবে। যাঃ, পুরো দস্তুর বাঙালি হয়ে ওঠার আমার স্বপ্নের ফানুসটা শেষপর্যন্ত ফুটোই হয়ে গেল!
কিন্তু পুরো বাঙালি হওয়ার স্বপ্নটার গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটলেও, বাংলা ভাষা চর্চার ভূতটা কিন্তু আমার ঘাড় থেকে নামল না। এই ভূতটা ছাত্রজীবনে কাঁধে চেপেছিল বেতালের মতো। কবিতা লিখতাম না ঠিকই, বলা ভালো লিখতে পারতাম না। কিন্তু গল্পটল্প খুচখাচ লিখতে পারতাম আর কী দুঃসাহস আমার একটা গল্প দেশ পত্রিকায় পাঠিয়েও দিয়েছিলাম একবার যখন কলেজে পড়ি। কিছুদিন পর দেশ পত্রিকা সেটি গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে ফেরত পাঠিয়েছিল এক প্রখ্যাত সাহিত্যিকের মন্তব্য সহ 'আরও লেখালিখি করে ভাষা আর উপস্থাপনা উন্নত করতে হবে'।
যদ্দূর মনে পড়ে, সেটি লিখেছিলেন আমার অত্যন্ত প্রিয় সাহিত্যিক শ্রী বিমল কর মহাশয়। তবে এই ঘটনার কথাটি আমার বন্ধুসম আরেক প্রখ্যাত সাহিত্যিক সমরেশবাবুকে (মজুমদার) যখন বলি, তিনি বলেন মন্তব্যটি আমার আরেক প্রিয় সাহিত্যিক শ্রী রমাপদ চৌধুরী মহাশয়ের। সে তিনি যেই হোন না কেন, এমন অনুপ্রেরণা দায়ক মন্তব্য এখনকার কোনও লেখকের ভাগ্যেই জুটবে না, জুটবে জঞ্জালের বাক্স। শুনেছি দেশ পত্রিকায় দিনে এখন এত কবিতা গল্প প্রবন্ধ জমা পড়ে যে সেগুলো সব পড়েও দেখা হয় না, সম্ভবও নয়। তাই তাদের গন্তব্যস্থল ওই জঞ্জালের বাক্স। আরে ভাই, জমনা পলট গ্যয়া! এখন বাংলার ঘরে ঘরে কবি আর গল্পকার জন্ম নিচ্ছেন!
কিন্তু এমন অনুপ্রেরণা পেয়েও সেদিন আমি আর বেশি দূরে এগোতে পারিনি। সাহিত্যের ভূতটাকে ঘাড় ধরে নামিয়ে দিয়ে আরেকটা ভূত কাঁধে চেপে বসেছিল। কম্পিউটারের ভূত। শুধু চাপলই না, তার প্রেমেও পড়ে গেলাম। নতুন নতুন ভাষা শেখার অদম্য আনন্দ আর সেই ভাষা প্রয়োগে নতুন নতুন সফ্টওয়্যার তৈরির নেশা। সাড়ে তিনটে যুগ কেটে গেল সেই নেশায় বুঁদ হয়ে। কোথায় তখন বাংলা ভাষা আর তার সঙ্গে প্রেম পিরিত! কিছু বাংলা দৈনিক পড়া আর ফি বছর পুজোর সময় কিছু শারদীয়াতে চোখ বোলানো ছাড়া বাংলা ভাষার সঙ্গে আর কোনও সম্পর্কই ছিল না, তো চর্চা! তারপর নব্বুয়ের দশকের শেষ দিকে একটা অঘটন ঘটে গেল। আর সেই অঘটনটি ঘটল বলেই আজ এই লেখাটি লিখতে পারছি। ঘটনাটার কথা অনেকবার অনেকভাবে শুনিয়েছি। তবু আরেকবার বলতে মন চাইছে।
নব্বই দশকের শেষের দিকে বালাশোর মানে উড়িষ্যার বালেশ্বর গেছি পেশা সূত্রে। প্রায়ই যেতাম, থাকতাম দিনদশেক করে। সেবারও গেছি ওই দিনদশেকের জন্য। ইস্পাত অ্যালয়ের ফ্যাক্টরিতে। থাকতাম তাদেরই গেস্টহাউসে যেখানে কলকাতার দৈনিকগুলো দুপুরের দিকে পৌঁছাতো। তাই ওই দৈনিকগুলো পড়ার সুযোগ পেতাম সন্ধেতে গেস্ট হাউস ফিরে। এমনই একটা দিনে গেস্টহাউস ফিরে সেদিনকার টেলিগ্রাফে চোখ বোলাচ্ছিলাম। প্রথম পাতাতেই একটা ছোট্ট খবর পড়ে ভেসে গেলাম - ঝুম্পা লাহিড়ি পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছে। ঝুম্পা মানে টিয়াদির মেয়ে ঝুম্পা! যে টিয়াদি ও তাঁর ভাইদের সঙ্গে আমি বড় হয়েছি বিবেকানন্দ রোডের বাড়িতে, সেই টিয়াদির মেয়ে! কোনও ভারতীয় কোনও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেলেন এক ধরণের অনুভূতি হয়। কোনও বাঙালি পেলে অন্য অনুভূতি হয়। আবার চেনা কোনও মানুষ পেলে আনন্দের বিস্ফোরণ ঘটে।
সেদিন ঠিক তেমনটাই আনন্দের বিস্ফোরণ ঘটেছিল আমার মনের মধ্যে। মানুষের জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে যার স্ফূলিঙ্গ তার ভাবনাচিন্তার জগতটাকে এক নতুন মোড়ে পৌঁছে দেয়। যেমনটা সেদিন আমার হয়েছিল। সাড়ে তিন যুগ আগের ভাবনাচিন্তার গায়ে জমাট বাঁধা বরফ গলিয়ে আমায় ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ছাত্রজীবনের সাহিত্য চর্চার উন্মত্ত দিনগুলোয়।
বালাশোর থেকে ফিরেই খাতা পেন্সিল হাতে বসে গিয়েছিলাম গল্প লিখতে। প্রাথমিক আড়ষ্টতা কাটিয়ে সাড়ে তিন যুগের নানান অভিজ্ঞতা যেন ঝরে ঝরে পড়তে লাগল পেন্সিলের ডগা দিয়ে। এক একটা গল্প লিখি আর তা পড়ে শোনাই গিন্নিকে। তার ভালো লাগা আমায় আরও অনুপ্রাণিত করতে থাকে। এক বছরের মধ্যে আটটা গল্প লিখে মনে হল, এবার আমার লেখাগুলোর একমাত্র পাঠিকার গণ্ডি ছাড়িয়ে আরও পাঠক-পাঠিকার আঙ্গিনায় পৌঁছে দিতে হবে।
পরিচয় হল বিশিষ্ট কবি শ্রী কৃষ্ণ ধর মহাশয়ের সঙ্গে। তাঁর উদ্যোগেই প্রকাশিত হল আমার প্রথম গল্প সংকলন 'সম্পর্ক'। আমার জানাচেনা মহলে যেন একটা অ্যাটম বম্ব পড়ল। কী, এক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ তার নিজের জগৎ ছেড়ে গল্প লিখেছে! এও কি বিশ্বাস করা যায়! সেই অবিশ্বাসের স্রোতে ভাসতে ভাসতে সংকলনটি পৌঁছে গেল প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী সমরেশ মজুমদার মহাশয়ের হাতে। ভাবতেও পারিনি, তিনি মন দিয়ে সব ক'টা গল্প পড়বেন আর বলবেন, আপনার গল্প একবার পড়া শুরু করলে শেষপর্যন্ত না পড়ে ওঠা যায় না।। ব্যস, সেই শুরু বাংলা ভাষা চর্চার আমার নতুন অধ্যায়।
তবে আমার বাংলা ভাষা চর্চার এক নতুন মোড় নিল যখন সমরেশবাবু ভদ্রভাবে মৃদুস্বরে বললেন, এবার থেকে বানানের দিকে একটু নজর দিন। কথাটা শুনে চমকে উঠেছিলাম। কারণ আমার ধারণা ছিল, আমার বানান জ্ঞান ভালোই। কিন্তু সমরেশবাবুর মতো এতো বড় মাপের সাহিত্যিকের কথা তো আর অগ্রাহ্য করা যায় না। তাই একটা বাংলা অভিধান নিয়ে আমার প্রথম গল্প সংকলনটি পড়তে বসলাম।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এ কী করেছি আমি! বানানের তো গুষ্টির পিণ্ডি করে ছেড়েছি। বানান নিয়ে আমার গর্ব এক ধাক্কায় ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। তিনটে 'স'কে (স,শ,ষ) নিয়ে নিজের ইচ্ছে মতো যদি কেচ্ছা কেলেঙ্কারি করে থাকি তো দুটো 'ন' (ন,ণ) নিয়েও কম কিছু করিনি। তাঁর সঙ্গে আবার জুটেছে তিনটে 'র' (র,ড়,ঢ়) আর দুটো 'জ' (জ,য)। ভাগ্যিস, 'ঢ়' এর ব্যবহার কম। এ সব দেখে আমার সব জ্ঞানগম্যি যেন ঘেঁটে ঘ হয়ে গেল। হাড়ে হাড়ে বুঝলাম, বানানের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাটি অঙ্কের থেকেও জটিল। আর আমার প্রথম গল্প সংকলনে সেই জটিল অঙ্ক সমাধানে সত্যিই ঘেঁটে ঘ করেছি। অসম্ভব ভদ্রভাবে সমরেশবাবু আমায় সতর্ক করেছিলেন, অন্য কেউ হলে তুলোধোনা করে ছাড়তেন। তারপর থেকে শুধু সতর্কই হলাম না, আমার লেখালিখির সাথী হয়ে গেল তিন তিনটে বাংলা অভিধান। এতে লেখার গতি প্রায় তলানিতে এসে ঠেকলো। কী করি, লেখালিখির ভূত যখন মাথায় চেপেছে তখন বানানের দৌরাত্ম্য নিয়েই চলতে হবে। আজও চলেছি। এটা লিখতে যে কত বানান ভুল হচ্ছে কে জানে!
আমার এক জার্মান বন্ধু বাংলা শিখেছিল। শিখে এমন সব প্রশ্ন করতো যে আমি খাবি খেতাম আর আজেবাজে যুক্তি দিয়ে তাকে কাটাতাম। তবে সে আমাদের ভাষার কয়েকটি ভালো দিকও দেখিয়ে ছিল যার কিছু জানতাম কিছু জানতাম না, বলা ভালো তেমন করে ভাবিনি আগে। যেমন আমাদের 'খাওয়া'টা আমাদের ভাষায় সার্বজনীন। আমরা সব কিছুই খাই - জল খাই, ভাত খাই, সিগারেট খাই, মদ খাই, ওষুধ খাই, এমন কী মাথাও খাই। ভাবুন তো, কত শব্দ আমাদের মাথায় রাখতে হয় না, যেমন পান করা, সেবন করা ইত্যাদি আর কোথায় কোনটা প্রয়োগ করতে হয় সেটাও আমাদের ভাবতে হয় না। অবশ্য এই খাওয়া নিয়ে অবাঙালি বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে আমাকে কম ব্যঙ্গ শুনতে হয়েছে! এখনও শুনতে হয়। তাই আমার জার্মান বন্ধুর কাছ থেকে শোনা এই তত্ত্ব তেমন কিছু নতুন নয়। আবার তার মুখে শোনা অন্য একটি তত্ত্বও খুব একটা অচেনা নয়। সেটি হল, জার্মান বা হিন্দি ভাষার মতো লিঙ্গভেদের কোনও ঝুটঝামেলা নেই আমাদের ভাষায়, ট্রেনের ইঞ্জিন যদি পুংলিঙ্গ হয় তো তার কামরাগুলো স্ত্রীলিঙ্গ এমন বিদঘুটে ব্যাপারস্যাপার নেই বাংলা ভাষায়।
কিন্তু যে আরেকটি তত্ত্ব বন্ধু শুনিয়েছিল, সেটা নিয়ে আমি সত্যিই কোনওদিন ভাবিনি। আমরা আমাদের অভিব্যক্তিতে জোরালো করতে যে দুটো অক্ষর 'ই' আর 'ও' লাগাই শব্দের সঙ্গে, সেটা কিন্তু জার্মান বা ইংরেজি ভাষায় করতে গেলে একটা অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহার করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ জার্মান বন্ধুটি তিনটি বাক্য শুনিয়েছিল যা থেকে ব্যাপারটা বুঝেছিলাম এবং প্রচণ্ড অবাকও হয়েছিলাম। তিনটি বাক্য হল, 'ওখানে গেলে হয়', 'ওখানে গেলেও হয়' আর 'ওখানে গেলেই হয়'। এই তিনটি বাক্য ইংরেজিতে অনুবাদ করে দেখুন, বুঝতে পারবেন আমার জার্মান বন্ধুটি কী বোঝাতে চেয়েছিল।
কিন্তু তার একটা প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারিনি। জোড়াতাপ্পি দিয়ে কোনও রকমে এড়িয়ে গিয়েছি। পরে বাংলা ভাষার বহু পণ্ডিত মানুষজনকে জিগ্যেস করেও এটির সঠিক উত্তর পাইনি যার উত্তর ইদানীং আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া ভিডিও থেকে পেয়েছি। সত্যি বলতে কি, এই তত্ত্বটি কোনওদিন কারওর কাছেই শুনিনি। আমার বন্ধুর প্রশ্নটা ছিল, 'দেখাদেখি' শব্দটা উচ্চারণ করতে বলি 'দ্যাখাদেখি' অথচ দুটোই তো দ-এ একার, তাহলে উচ্চারণে এই অসঙ্গতি কেন? ভিডিওটি থেকে জানতে পারলাম, বাংলা ভাষায় দুটো এ-কার আছে, বলা ভালো ছিল। একটি মাত্রা ছাড়া এ-কার যার ব্যবহার 'দেখাদেখি'তে দ্বিতীয় এ-কারটি। যার অর্থ 'দে'য়ের উচ্চারণ দে-ই হবে। আর আরেকটি এ-কার হলো আঁকড়ি যুক্ত এ-কার যার মাত্রা আছে, যার ব্যবহার 'দেখাদেখি'তে প্রথম এ-কারটি। এই মাত্রাযুক্ত এ-কারটি উচ্চারণে 'এ' নয় '্যা', অর্থাৎ দ্যা। রবি ঠাকুরের 'সহজ পাঠ'য়ে এর উদাহরণ সহ ব্যাখ্যা আছে। কি জানি, ছোটবেলায় এ সব বুঝিনি কেন!
নীচের লিংকটিতে ক্লিক করলে দু'প্রকার এ-কার সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে পারবেন। আসলে, আগেকার দিনে এই মাত্রাযুক্ত এ-কারের ব্যবহার থাকত, কিন্তু আজকালকার বইপত্রে বা কম্পিউটারে মাত্রাযুক্ত এ-কার থাকে না। তাই লেখা আর উচ্চারণে বিভ্রান্তি দেখা দেয় যেমন আমার জার্মান বন্ধুটির হয়েছিল।
শেষে কিছু মনকষ্টের কথা বলি। দুর্ভাগ্যক্রমে বাঙালি হওয়ার কিছু শর্ত সারা জীবনেও পূর্ণ করতে না পারায় পুরোপুরি বাঙালি হতে পারলাম না। আবার বাংলা ভাষাটাকেও তেমনভাবে রপ্ত করতে পারলাম না। তা সত্ত্বেও লেখালিখি করি সীমিত শব্দ ভাণ্ডার মাথায় নিয়ে আর বানান যদ্দূর সম্ভব শুদ্ধ রাখতে তিন তিনটে বাংলা অভিধান পাশে রেখে।
==================
Subhrendu Ray Chaudhuri
C1/202 Mangalam Park
14 Ho Chi Minh Sarani
Kolkata - 700 034