সংগ্রামী নায়ক নেতাজি সুভাষ
পাভেল আমান
প্রায় দুশো বছর ব্রিটিশ শাসনের অধীন ছিল আমাদের ভারতবর্ষ। বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রাণ দিয়েছেন, কারাবন্দি হয়েছেন, আরও অনেকরকম নির্যাতন-অত্যাচারের শিকার হয়েছেন বহু মানুষ। তবুও নিজেদের সর্বস্ব ত্যাগ করে অত্যাচারী ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাঁরা রুখে দাঁড়িয়েছেন, অবলীলায় জীবন উৎসর্গ করেছেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক নেতৃস্থানীয় লড়াকু বীর। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করেছিলেন, কিন্তু সরকারের উচু পদের মোহ তাঁকে কখনই আকর্ষণ করেনি। দেশের মুক্তিই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। ভারতকে স্বাধীন করার লক্ষ্য নিয়ে তিনি পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটেছেন, তাবড় রাষ্ট্রনেতাদের কাছে সাহায্য চেয়েছেন, সশস্ত্র সেনাবাহিনী নিয়ে আক্রমণ করেছেন ব্রিটিশ শক্তিকে। এই নির্ভীক স্বাধীনতা সংগ্রামী ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাম্প্রদায়িক সম্মিলনের ব্যাপারেও ছিলেন দুর্দমনীয়।পৃথিবীর ইতিহাসে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু একজন বিপ্লবী শ্রেষ্ঠ হয়ে বরণীয় হয়ে রয়েছেন। ভারতের ইতিহাসে নেতাজির অবদান কোনদিন ভুলবার নয় ।নেতাজির স্বপ্ন ছিল একটি স্বাধীন সমৃদ্ধশালী অবিভক্ত ভারত গঠন। যেই ভারতে বিভেদ থাকবে না, বৈষম্য থাকবেনা । নিজের জীবন তুচ্ছ করেও তিনি এই আদর্শের জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। আপোষহীন সংগ্রামী সুভাষ চন্দ্র বসু কখনও নিজের আদর্শের সঙ্গে আপোষ করেননি। স্বাধীনতা ছিল তার জীবনের মূল মন্ত্র। যে করেই হোক স্বাধীনতা পেতে হবে। এ জন্য তিনি ভয়ংকর সব বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে টলানো যায়নি। আদর্শবান এই স্বাধীনতা সংগ্রামী কোনদিন অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেননি। এজন্য তাঁকে কম মূল্য দিতে হয়নি। এমনকি শেষ পর্যন্ত তাঁকে দেশও ত্যাগ করতে হয়েছিল।চোখের সামনে নারী নির্যাতন হচ্ছে, ঘুষ নিতে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু আমরা পরিবারের দোহাই দিয়ে জীবনের ঝুঁকির দোহাই দিয়ে চকরির দোহাই দিয়ে সবকিছুর সাথে সমঝোতা করি। নেতাজি বলতেন সমঝোতার চিন্তা বড্ড অপবিত্র বস্তু। তিনি বলতেন আমাকে তৈরি করেছে সংঘর্ষ, এই সংঘর্ষই আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস উৎপন্ন করেছে যা আগে ছিলনা। কষ্টের আন্তরিক নৈতিক মূল্য আছে। আমার জন্মগত প্রতিভা ছিল না, কিন্তু কঠোর পরিশ্রম থেকে বাঁচার প্রবৃত্তি আমার ছিলনা। আমরা সংঘাত ও তা সমাধানের মাধ্যমেই এগিয়ে চলি। আমাদের অবস্থা যতই ভয়ানক হোক বা কন্টকময় হোকনা কেনো তবুও আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। সাফল্যের দিন দূর হতে পারে, তবে তা অনিবার্য। যদি সংঘর্ষই না থাকে, ভয়ের সম্মুখীনই হতে না হয়, তখন জীবনের অর্ধেক স্বাদই শেষ হয়ে যায়।রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন 'দেশনায়ক'। ভরতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর স্বার্থত্যাগ আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। সাম্প্রদায়িক ও আঞ্চলিক সীমাকে অতিক্রম করে তাঁর অবদান আজ দেশবাসী শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। এক অর্থে সুভাষচন্দ্র ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধের প্রতীক। ইংরেজ শাসকদের ভারতবর্ষ ছাড়তে বাধ্য করার জন্য তিনি যে কোন উপায় অবলম্বনের পক্ষপাতী ছিলেন। পথ ও লক্ষ্য নিয়ে চুলচেরা বিতর্কে তিনি কালক্ষয় করতে রাজি ছিলেন না। 'শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু' এই নীতি মেনে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অক্ষ শক্তিবর্গের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দ্ধিধাবোধ করেননি। এই পন্থা অবলম্বনের জন্যে তাঁকে অনেক বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়।তাঁর আপসহীন দেশপ্রেম, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম ও জাতীয়তাবাদ পরবর্তী প্রজন্মকে উদবুদ্ধ করে চলেছে।নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এমন এক ভারত গড়তে চেয়েছিলেন, যেখানে সব রকম ধর্মীয় পরিচয়কে শ্রদ্ধা করেই সবাই নিজেদের ভারতীয় হিসেবে ভাবতে ও বলতে গর্ব অনুভব করবেন। তিনি দৃঢ় চিত্তে বলেছিলেন "আমাদের সবচেয়ে বড় জাতীয় সমস্যা হল, দারিদ্র, অশিক্ষা,রোগ, বৈজ্ঞানিক উৎপাদন।যে সমস্যাগুলির সমাধান হবে, কেবলমাত্র সামাজিকভাবনা চিন্তার দ্বারা"। এখন ভারতের দিকে দিকে এবং সারা পৃথিবীর নানা প্রান্তে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিষবাষ্প ধিকিধিকি জ্বলছে। এই সময়ে বড়োই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আদর্শ। ভারতের জাতীয় রাজনীতি তথা সমাজবোধে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা কোনও দিনই ম্লান হবে না। তিনি একটা গোটা জাতিকে ঝুঁকি নিয়ে লড়বার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। আর তাই তিনি সকলের 'নেতাজি'। 'নেতাজি' বলতে বাঙালি একজনকেই বোঝে তিনি সুভাষ চন্দ্র বসু।আজও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের একজন জনপ্রিয় এবং অনুপ্রেরণাদায়ী ব্যক্তিত্ব। নেতাজির জীবন এবং কর্ম আমাদের সকলের জন্য একটি অনুপ্রেরণা। তিনি আমাদের শেখান যে কঠোর পরিশ্রম, দৃঢ় চেতা, এবং ত্যাগের মাধ্যমে সবকিছু সম্ভব। নেতাজির জীবন আমাদের দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব উপলব্ধি করিয়ে দেয়। আসুন আমরা সবাই জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালিত্ব জাগরণে ভারতীয় পরিচয়ে আজ নেতাজির ১২৮তম জন্মদিনে আমরা শপথ নিই, এক সুন্দর ধর্মনিরপেক্ষ পৃথিবী গড়ে তুলতে আমরা সর্বতোভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব সর্বোপরি তার আদর্শ চিন্তাভাবনা ও কর্মধারাকে জীবনের এগিয়ে চলার রসদ ও অব্যর্থ আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করি।
=========================
রচনা -পাভেল আমান- হরিহরপাড়া- মুর্শিদাবাদ