
সাহসী বুবুদিদি
অঞ্জনা মজুমদার
সাম্যদের পাড়াটাই শান্ত। গোটা পাড়ায় মোটে দশটা নাবালক। তিন বছর বয়স থেকে বারো বছর বয়স তাদের। সাম্য আর বিনু দশ বছরের। সতুদা আর রচনাদি যথাক্রমে বারো আর এগার বছরের। আর পানু, চিনু, রিতু,মিতু, চিনু সব সাত আট কি পাঁচ ছয় বছর। কেবল বুবু তিন বছরের। আর কোনও সঙ্গী নেই বলে বুবুকে মাঝে মধ্যেই খেলতে নিতে হয়। তবে সে ভারি লক্ষ্মী মেয়ে। দাদা দিদিদের কোনও ডিসটার্ব করে না। ক্রিকেটে বল ওর কাছে পড়লে ছুঁড়ে সদেয় ব্যাটের দিকে। ভয় পায় না। বুবু কিন্তু খুব বুদ্ধিমতী। সে ছোট ছোট ইংরাজি বাংলা শব্দ পড়তে পারে। কান্নাকাটি নেই একেবারেই। তাই দাদা-দিদিদের ভারি পছন্দ তাকে। তবে তাকে সবাই বুবুদিদি বলে ডাকলে সে খুশি হয়।
ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। সবাই দুপুরের খাবার পরে পাড়ার ক্লাবের মাঠে জড়ো হয়েছে। বুবুও সঙ্গী। দুপুরে তার ঘুম নেই।
আজ সবাই ঠিক করেছে লুকোচুরি খেলবে। সেইমতো খেলা শুরু। তবে একরাউন্ড খেলার পরই বুবু জেদ ধরেছে আমিও খেলব।
কি আর করা! এবারে চিনু চোর হয়েছে। সবাই লুকিয়ে পড়বে। পানু বলল, বুবুদিদি আমি তোমাকে লুকাতে হেল্প করবো?
বুবু গম্ভীর স্বরে বলল, না আমি একা।
বুবু জেদি খুব। আর কেউ তাকে ডিসটার্ব করল না। কেবল পানু খেয়াল করল, বুবু ক্লাব ঘরের পেছনের দিকে গেল।
সেই রাউন্ড শেষ। কিন্তু বুবুকে আর কেউ খুঁজে পায় না।
সবাই চারিদিকে খোঁজাখুঁজি করল। বুবুদিদি বুবুদিদি বলে কত ডাকল। সাড়া নেই। সাম্যদের দলের সবাই হতাশ হয়ে মাঠেই বসে পড়ল।
সতুদার কাকাই বিতান আর রচনাদির দাদা শুভ দুজনে মাঠের পাশ দিয়ে কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছিল। দুজনেই রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে পড়ে। সাম্যদের দলটাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে হাঁক দিল, কি হয়েছে রে চিনু? কোনও সমস্যা ?
পানু, চিনুরা আর থাকতে পারল না। জোরে কেঁদে ফেলল।
বিতান আর শুভ বুঝল ব্যাপারটা খুব ভালো নয়। নিশ্চয়ই গুরুতর সমস্যা। ওদের পাশে বসে পড়ল। কান্না নয়। প্রব্লেম কি?
সবটা শুনে সবাই মিলে আবার খুজতে লাগল। এবার ধীরে ধীরে। ক্লাবের পেছনে বটগাছের নীচে হঠাৎই একটা লাল চুলের ক্লিপ। এটা কার? এই লাল ক্লিপটা তো বুবুর। একটু দূরে লাল মাটির রাস্তার ধারে বুবুর হাতের চুড়ি একটা।
বিতান সবাইকে থামালো। দাঁড়া, একটা মোটর সাইকেলের চাকার দাগ না? শুভ বলল, পুলিশ চাই।
সাম্যর বাবা হেরম্বপুর থানার ও সি। সাম্য দ্রুত বাবাকে বিতানের ফোন থেকে ফোন করল। পুলিশ এলো। পুলিশের কুকুর মোটর সাইকেলের দাগ ধরে দৌড়ল। সবাই পিছু পিছু।
এক কিলোমিটার দূরে একটা ভাঙা ঘর। চারপাশে আবছায়া অন্ধকার নেমে আসছে। ওই ভাঙা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কুকুরদুটো ঘেউঘেউ করছে। আর দুটো লোক পড়িমরি করে মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে পালিয়ে গেল।
পুলিশের একটা মোটরসাইকেল ওদের তাড়া করল। কুকুরদুটো চেঁচিয়ে চলেছে। আর ঘরটাকে ঘিরে দৌড়চ্ছে।
পুলিশের লোকজন দরজা ভেঙে ফেলল। ভেতরে ভাঙাচোরা জিনিসপত্র। বুবু বুবু বলে সবাই ডাকছে। কোনও সাড়া নেই। ঘরের ভেতরে তো বুবুকে দেখা যাচ্ছে না। কোথায় বুবু?
সবাই মিলে খুঁজে চলেছে। ঘরে একটা চৌকি,দুটো চেয়ার, আর একটা ড্রাম। চৌকির ওপরে, তলায় কিছু নেই। ড্রামের ওপর কাঠকুটো, ছেড়া কাপড়চোপড় জড়ো করা। কুকুরদুটো ড্রামের বাইরে চেঁচামেচি করছে। সাম্য বলল, একবার ড্রামের ভেতরটা দেখি তো। কাঠকুটো সরিয়ে, ভেতরের কাপড়চোপড় সরিয়ে দেখা গেল বুবুকে মুখ বেঁধে রাখা আছে।
বিতান বুবুকে তুলে ড্রামের বাইরে নিয়ে এলো। চিনু মুখের বাঁধন খুলে দিল। বুবু বলল, জল খাব।
দু ঢোক জল খেয়ে বুবু কথা বলল, ওরা দুষ্টু লোক।
ইতিমধ্যে বাইরে পুলিশের গাড়ি থামল। দুটো লোককে ধাক্কা দিয়ে ওদের সামনে পুলিশের গাড়ি থেকে নামালেন পুলিশরা। দুজনের হাত বাঁধা।
বুবু ওদের দিকে হাত দেখিয়ে বলল, ওই আঙ্কেলটা না ও আঙ্কেল নয় ও দুষ্টু লোক। আমার মুখ বেঁধে রেখেছে। তারপর মোটর সাইকেলে করে নিয়ে এসেছে। আমি চেঁচামেচি করতে পারিনি।
পুলিশের লোকজন বলল, এখানে একটা ছেলেপাচারের চক্র কাজ করছিল। আজ দুজন ধরা পড়ল। এবার মাথাদের ধরতে হবে।
সাম্যর বাবা বললেন, বুবু আমাদের ব্রেভ গার্ল।
বুবুর গর্বিত মিষ্টি হাসি। বুবুর মা বাবাও চলে এসেছেন। বুবু কিন্তু কোল থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। গম্ভীর হয়ে বলল, আমি বড় হয়ে গেছি। দুষ্টু লোকেদের ভয় পেয়ে কাঁদিনি।
সবাই মিলে চিৎকার করে উঠলো, থ্রি চিয়ার্স ফর ব্রেভ বুবুদিদি। হিপ হিপ হুররে।
===================
অঞ্জনা মজুমদার
এলোমেলো বাড়ি
চাঁদপুর পল্লী বাগান
পোঃ রাজবাড়ি কলোনী
কলকাতা ৭০০০৮১