প্রসাদোপম বাড়িটার বয়স ঠিক কত, কেউ জানে না। কেউ বলে তিনশো বছর, কেউ বলে চারশো আবার কারও মতে পাঁচশো বছরের এক দিনও কম হবে না। অবশ্য নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের ফলে বাড়িটা দেখে খুব বেশি পুরাতন বলে মনে হয় না। তবে কাঠের উঁচু দরজা জানালা, কড়ি বরগার ছাদ জানান দেয় বাড়িটার প্রাচীনত্ব। বিভিন্ন জন বাড়িটাকে বিভিন্ন নামে ডাকে। কেউ বলে রায় বাড়ি, কেউ বলে রাজ বাড়ি আবার কেউ বলে জমিদার বাড়ি। তবে বাড়িটার বিভিন্ন মহলে টাঙিয়ে রাখা বাঘ ছাল, শিংওয়ালা হরিণের মাথা এবং প্রাচীন অস্ত্রশস্ত্র প্রমাণ করে কোনও সাধারণ মানুষ বসবাস করার জন্য এই বাড়ি তৈরি করেনি।
বর্তমানে রাজতন্ত্র নেই, জমিদার প্রথাও বিলুপ্ত হয়ে গেলেও, এই বাড়ির সদস্যদের ঠাটবাট অতি উচ্চমাত্রায় বিরাজমান। রায় বাড়ির সদস্যরা এলাকায় যথেষ্ট প্রভাবশালী। এমন কি স্থানীয় থানা, পঞ্চায়েতেও তাদের প্রভাব চোখে পড়ার মত। শোনা যায় জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পর তাদের বিঘার পর বিঘা জমি বিক্রি করে, সেই টাকায় বেলজিয়াম কাচ এবং বার্মা থেকে আমদানি করা সেগুন কাঠের ব্যবসা করে তারা প্রভুত সম্পত্তির অধিকারী হয়েছে। তারপর আরও বিভিন্ন রকমের ব্যবসা শুরু করে রায় পরিবার তথা জমিদার পরিবার তথা রাজ পরিবার এক ব্যবসায়ী পরিবারে পরিনত হয়েছে। সেইসঙ্গে ক্রমশ বেড়েছে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি। স্থানীয় পঞ্চায়েতের ভোট, এমনকি এই অঞ্চলের বিধান সভা ভোটেও রায় বাড়ির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। স্থানীয় থানাতে রায় পরিবারের সদস্যদের অবাধ যাতায়াত। তাদের কথাতেই ওঠে বসে থানার বড় বাবু, মেজ বাবুরা। বলতে গেলে তাদের অঙ্গুলী হেলনে অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হয় থানার কার্যকলাপ।
স্কুলের গন্ডি ছাড়িয়ে এবার কলেজের চৌকাঠে পা রেখেছে কেতকী। তবে এত বিত্তশালী পরিবারের মেয়ে হয়েও অতি সাধারণ তার আচরণ। দামী অলঙ্কারে তার রুচি নেই। তার পোষাকও অতি সাধারণ। বাড়িতে অনেকগুলো গাড়ি থাকলেও, বন্ধুদের সঙ্গে বাসে করে সে কলেজে যেতে পছন্দ করে। সে ভালোবাসে মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে যেতে। সে ভালোবাসে পদ্মদিঘির পাড়ে বসে থাকতে। পদ্মদিঘিতো দিঘি নয় যেন এক সমুদ্র। তার এপার ওপার দেখা যায় না। পাড়ে বসে কেতকী তাকিয়ে থাকে পদ্মদিঘির কালো জলের দিকে। ভাবে কি আছে পদ্মদিঘির ওপারে? কেবল জল আর জল। স্পষ্টভাবে কিছুই দেখা যায় না। কেবল এক অস্পষ্ট সবুজ রেখা। ওপার থেকে ভেসে আসে এক সুমধুর বাঁশির সুর। কেতকী ভাবে কে রোজ তার বাঁশিতে এই সুর তোলে? কে সেই বাঁশরিয়া? সেকি কোনও শ্যামল বরণ রাখাল বালক? তার অধরে কি আছে মোহিণীমোহন হাসি? তার মাথায় কি আছে শিখি পাখা? হয়ত আছে! না হলে কি করে সে তার বাঁশিতে এমন পাগল করা সুর তোলে? কি যাদু আছে সেই বাঁশির সুরে? যে সুরের, যে ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেজে ওঠে কেতকীর পায়ের নূপুর! কেতকীতো নাচতে জানেনা, তাহলে তার পায়ের নূপুরের রিনিঝিনি কি করে মিশে যায় দুর থেকে ভেসে আসা সেই বাঁশির সুরের সাথে? ভাবে, কেতকী ভাবে। ভাবতে ভাবতে চলতে থাকে দিঘির পাড় ধরে।
কৌতুহল দমন করতে পারে না কেতকী। বাঁশির সুরের অমোঘ টানে একদিন সে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়। দুর থেকে ভেসে আসা মৃদু সুর যেন কেতকীকে টানছে, টেনে নিয়ে যাচ্ছে তার কাছে। সে পৌছে যায় দিঘির অপর পারে। তার চোখে পড়ে দিঘির পাড়ে গাছতলায় বসে একজন বাঁশি বাজাচ্ছে। শুনতে থাকে কেতকী। যাদুকরী সেই সুর ক্রমশ যেন অবশ করে দিচ্ছে কেতকীর সমস্ত স্বত্বাকে! তার মন, প্রাণ, হৃদয়কে! যেন নিজের মধ্যে নেই সে! কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে!
এক সময়ে বাঁশি থামে। সম্বিত ফিরে আসে কেতকীর। সে প্রশ্ন করে, "কে গো তুমি রাখাল ছেলে? তুমি কেন বাঁশি বাজাও?"
- "না গো, আমি রাখাল ছেলে নই। আমার নাম রতন। আমি মৌয়ালের পো। আমি চাক ভেঙে মধু আনি জঙ্গল থেকে। তুমি কে গো মেয়ে? কোথা থেকে এসেছ? এই দিঘির পাড়ে কি করছ?"
- "আমি কি আর নিজে এসেছি! তোমার বাঁশির সুর আমাকে টেনে নিয়ে এসেছে। আমি থাকি ঐ ওদিক পানে, ঐ গঞ্জে। থামলে কেন গো মৌয়ালের পো? বাজাও না তোমার বাঁশি।"
- "ও তুমি গঞ্জে থাকো। কত ধনী মানুষ তোমরা! কত আধুনিক গান বাজনা তোমরা শোনো! তোমার কি ভালো লাগবে এই মেঠো সুর?"
- "না গো না। কোনও আধুনিক সুর আমার ভালো লাগে না। এই মেঠো সুর যে আমার মন প্রাণ জুড়ে আছে। আমি ধনী নই। আমি যে ভিখারিণী গো, ভিখারিণী। তোমার বাঁশির এই মেঠো সুর যে আমাকে ভিখারিণী করে দিয়েছে মৌয়ালের পো! হ্যাঁ, আমাদের বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, টাকাও আছে। কিন্তু আমার যে ওসব চাইনে মৌয়ালের পো। ওসব আমার ভালো লাগে না। আমি যে সুর শুনতে চাই। তোমার বাঁশির সুর। সারাদিন, সারারাত শুনতে চাই। সুরের সঙ্গে মিশে যেতে চাই। তোমার বাঁশির সুর এত মিঠে কেন গো? কেন এত মাদকতা আছে তোমার এই বাঁশিতে? বলো না মৌয়ালের পো, ঐ সুর কেন এত নেশা ধরায় আমার মনে, আমার প্রাণে?"
কেতকীর অনুরোধে একাগ্র চিত্তে বাঁশি বাজাতে থাকে রতন। বিভোর হয়ে শুনতে থাকে কেতকী।
রায় বাড়ির সেরেস্তার পুরানো তাকিয়াগুলোকে সরিয়ে সেখানে চেয়ার টেবিল পেতে আধুনিক অফিস করে নিয়েছেন ব্রজেন্দ্র বাবু। বসিয়েছেন এয়ার কন্ডিশনার। পুরানো কাঠের আলমারিগুলোকে সরিয়ে, বসিয়েছেন রুচি সম্মত স্টিলের আলমারি। বলতে গেলে মান্ধাতার আমলের সেরেস্তার খোল নলচে পুরোপুরি বদলে দিয়েছেন। ব্রজেন্দ্র বাবু প্রতিদিনই দোতলা থেকে নেমে এসে একতলাতে তার অফিসে বসেন। কাজকর্মের তদারকি করেন। অবশ্য ব্যবসায়ের যাবতীয় দায় দায়িত্ব তার দুই ছেলে কমল এবং শ্যামলের উপর। বেলজিয়াম কাচ বা বার্মা সেগুন কাঠের ব্যবসা অনেক দিন আগেই বন্ধ হয়ে গেলেও, ইমারতি দ্রব্য, ট্রান্সপোর্ট, কৃষিজাত দ্রব্যের যে ব্যবসা ব্রজেন্দ্র বাবু শুরু করেছিলেন, সেই ব্যবসা এখন ফুলে ফেঁপে উঠেছে কমল শ্যামলের কর্মদক্ষতায়। কমল বিক্রির জন্য চাষিদের থেকে কৃষিজাত পন্য ন্যুনতম দামে কিনে নেয়। পুকুর, দিঘি থেকে জেলেদের ধরা মাছও স্বল্প মূল্যে কিনে নেয়। সেই কৃষিজাত দ্রব্য চলে যায় শ্যামলের গোলায়। সেই মাছ চলে যায় শ্যামলের আড়তে। সেখান থেকে সেই সব পন্য যায় পাইকারদের কাছে। তারপর ছড়িয়ে পড়ে জেলায় জেলায়। এমনকি ভিন রাজ্যেও। জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে আনা খাঁটি মধু, কেন্দু পাতাও বিভিন্ন হাত ঘুরে চলে যায় দুর দুরান্তরে। এই সব জিনিস বলতে গেলে জলের দরে কিনে নেয় কমল। উৎপাদনকারী চাষি, জেলে, মৌয়ালদের হাতে বলতে গেলে কিছুই থাকে না। কোনও রকমে তারা দিন কাটায়। দারিদ্রতা, অনাহার যেন তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দিন বদলায়, কাল বদলায়, যুগ বদলায়, মানুষ বদলায়। চাষি মজুরদের সন্তানরা এখন স্কুলে যাচ্ছে, দুনিয়াটাকে চিনতে পারছে, নিজেদের ভালো খারাপটা বুঝতে শিখছে। মৌয়ালদের ছেলেরা বুঝেছে, তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গল থেকে যে মধু সংগ্রহ করে, সেই মধু অন্যায্য দামে কিনে নেয় কমল রায়। এই মধু তারা সহরের কোনও পাইকারকে বিক্রি করলে, তিন চারগুন বেশি লাভ করতে পারবে।
বদলাচ্ছে দিন, বদলাচ্ছে ব্যবসার সমীকরণ। জঙ্গল ছেঁচে আনা মধু শ্যামলের গোডাউনের বদলে চলে যাচ্ছে সহরের পাইকারদের হাতে। দুটো পয়সার মুখ দেখছে মৌয়ালরা, দেখছে একটু ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন। ব্যবসায়ে টান পড়ছে রায় বাড়ির। কোনও এক চক্রান্তের গন্ধ পাচ্ছে তারা। ক্রমশ ভ্রূ কোঁচকাচ্ছে কমলের। চিন্তিত শ্যামলও।
রঘু মৌয়ালকে তার অফিসে ডেকে পাঠিয়েছেন ব্রজেন্দ্র বাবু। কমলও অফিসে আছে। রঘু বরাবরের অভ্যাস মত ব্রজেন্দ্র বাবুর অফিসে ঢুকে মাটিতে এক কোনে বসে আছে। সেদিকে চোখ পড়ে ব্রজেন্দ্র বাবুর। রঘুর দিকে তাকিয়ে বলেন, "রঘু তুই মাটিতে বসে আছিস কেন? এই চেয়ারে বস।" তারপর অন্যদিকে ঘুরে বলেন, "এই কে আছিস, তাড়াতাড়ি এই চেয়ারটা মুছে চকচকে করে দে। দেখতে পাচ্ছিস না বড় নেতার বাপ রঘু বাবু এসেছেন।"
রঘু আমতা আমতা করে বলে, "কি যে বলেন কত্তা। আমি বরাবরই আপনার পায়ের কাছে বসেছি। আজ চেয়ারে বসতে বলে কেন লজ্জা দিচ্ছেন?"
- "আগে কি করেছিস সে কথা ভুলে যা। এখন তুই কত বড় নেতার বাপ! তোর ছেলে রতনের অর্ডারে আর কোনও মৌয়াল আমাদের মধু বিক্রি করছে না। সব মধু সহরের পাইকারদের কাছে চলে যাচ্ছে। আমরা যে এবারে না খেয়ে মরব! আমাদের দয়া করুন রঘু বাবু। আপনার ছেলেকে বলুন আমাদের প্রতি এতটা নির্দয় না হতে।"
ব্রজেন্দ্র বাবু থামতে কমল বলে, "শোনো রঘু, আমি বাবার মত অত কথার জাল বুঝতে পারিনা। তাই সোজাসুজি বলছি, রতন খুব বাড়াবাড়ি করছে।ওকে সাবধান করো। আর বেশি বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু এ তল্লাটে থাকতে পারবে না। থানার মেজ বাবুকে বলে এমন কেস খাওয়াব যে সারা জীবন জেলের ঘানি টানতে হবে।"
হাতের ইশারায় কমলকে থামিয়ে ব্রজেন্দ্র বাবু বলেন, "ভয় পাস না রঘু। কমল ছেলে খারাপ নয়। কেবল রেগে গেলে একেবারে বাপের কুপুত্তুর। একেবারে চন্ডাল হয়ে যায়। তখন ওকে সামলানো শিবেরও অসাধ্য। কমলের কথা শুনে, সমঝে চল, দেখবি এই কমল বিপদে আপদে তোদের কত সাহায্য করবে। যা, এখন বাড়ি যা, তোর ব্যাটাকে ভালো করে বোঝা। রতন বাচ্চা ছেলে, একটু ভুল করে ফেলেছে। তবে তোর ব্যাটা শুনেছি লেখাপড়া শিখেছে, বুদ্ধিসুদ্ধি আছে। তাই বলছি, ভালো করে বোঝালে ঠিক বুঝবে। যা এখন বাড়ি যা।"
ব্রজেন্দ্র বাবুর অফিস থেকে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে বেরিয়ে আসে রঘু। ভাবতে থাকে এখন সে কি করবে? একদিকে কমল বাবুর হুমকি, অন্য দিকে তার সরল কিন্তু জেদি ছেলে রতনের একগুঁয়েমি। রতনের এক কথা, বছর বছর ধরে রায় বাবুরা যেভাবে গরীবদের রক্ত চুষে খাচ্ছে, সেটা আর হতে দেবে না। সে একজোট করেছে অন্যান্য মৌয়ালদের। তাদের বুঝিয়েছে যে শিক্ষা তার চোখ খুলে দিয়েছে। জগতটাকে চিনতে শিখিয়েছে। এবার সে অন্যদের চোখ খুলে দেবে। খেটে খাওয়া গরীব মানুষদের রক্ত জল করা টাকা পয়সা আর কাউকে সে ছিনিয়ে নিতে দেবে না।
রঘু বাড়ি ফিরে এসে তার ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করে, "রতন আমার কথা শোন। জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করে লাভ নেই। এসব লড়াই ঝগড়া তুই ছেড়ে দে। নিজের কাজে মন দে। রায়েদের মধু বিক্রি করে আমাদেরতো মোটামুটি ভালোই চলে যাচ্ছে। মৌয়ালরাতো খেয়ে পরে বেঁচে আছে। তাহলে বড়লোকদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে, অহেতুক বিপদ ডেকে কি লাভ?"
- "আমরা কি সত্যিই বেঁচে আছি বাবা? মৌয়ালরা কি সত্যিই বেঁচে আছে? আধপেটা খাওয়া, ছেঁড়া কাপড়, শিক্ষাদীক্ষার বালাই নেই, এটাকে কি বেঁচে থাকা বলে? কবি বলে গেছেন - 'কেউ খাবে, কেউ খাবে না, তা হবে না।' তাহলে আমরা কেন অর্দ্ধাহারে দিন কাটাব? কেন আমরা আমাদের রক্ত জল করা পরিশ্রমের দাম পাব না? কেন আমরা দারিদ্রের সঙ্গে বছরের পর বছর লড়াই করে একদিন শেষ হয়ে যাব?"
- "তাই বলে রাজার সঙ্গে লড়াই করা!"
- "আজকের দিনে রাজা উজির বলে কেউ নেই। সবাই দেশের নাগরিক। তুমিও যা, ব্রজেন্দ্র রায়ও তাই। ওরা কোনও রাজা নয়, ওরা ব্যবসায়ী। তাছাড়া আমাদের লড়াই কোনও ব্যক্তির সঙ্গে নয়। রায় বাড়ির লোকজনরা আমাদের শত্রু নয়। আমাদের লড়াই সিস্টেমের বিরুদ্ধে। আর্থিক মেরু করনের বিরুদ্ধে। এক শ্রেনির তহবিলে কোটি কোটি টাকা ঢুকতে থাকবে, আর একটা শ্রেনি না খেতে পেয়ে মরে যাবে, এটা চলতে পারে না। কমল রায় যদি মধু কিনতে চায় কিনুক, তবে ন্যায্য দামে কিনুক।"
রতনের বেশির ভাগ কথার মানে রঘু বুঝতে না পেরে, হতাশ হয়ে, কথা থামিয়ে দিয়ে, তার ছেলের নিরাপত্তার কথা ভেবে ঈশ্বরকে ডাকতে থাকে।
অনেক দুরের পথ। পায়ে হাঁটা পথ। এতটা পথ হেঁটে যেতে কষ্ট হয়। তবুও পথ চলে। হাজার কষ্টকে উপেক্ষা করে সুরের টানে নিত্যদিন কেতকী পাড়ি দেয় পদ্মদিঘির ওপারে।
- "আমি এসেছি বাঁশরিয়া। তোমার বাঁশির সুর শুনতে আমি আজও এসেছি। শোনাবে না তোমার বাঁশির সুর?"
- "তোমাকে সুর শোনাব বলেইতো আমি বসে আছি। কাজকর্ম ছেড়ে বসে আছি। সময় গুনছি, কখন তুমি আসবে! তুমি বলো আমার বাঁশির সুর তোমাকে যাদু করেছে, না গো গঞ্জের মেয়ে, বরং তুমি বশ করেছো আমার বাঁশিকে, আমার বাঁশির সুরকে। তুমি না এলে আমার বাঁশি যে বাজে না! সুর তোলে না! ঠিক করে বলতো কি সম্পর্ক আছে তোমার সঙ্গে আমার বাঁশির?"
- "জানি না গো মৌয়ালের পো! আমি কিছুই জানি না! শুধু জানি তোমার বাঁশির এই মাতাল করা সুর শুনতে না পেলে আমি বাঁচব না। তোমার বাঁশির সুর যে আমার হৃদয়কে ছুঁয়ে ফেলেছে। এক অদৃশ্য বন্ধনে বেঁধে ফেলেছে। সেই জন্যইতো এত দুরে, এত কষ্ট করে ছুটে আসি। তুমি আমাকে তোমার বাঁশির সুর শোনাবেতো বাঁশরিয়া? সারা জীবন শোনাবেতো? বলো, কথা দাও।"
- "আমি হৃদয় দিয়ে বাঁশি বাজাই। সেই সুর তোমার হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। দেখবে একদিন আমাদের দুজনের হৃদয় ঠিক মিলে মিশে একাকার হয়ে যাবে। আমি যখন বাঁশি বাজাই, তখন আমি আমার মধ্যে থাকি না। আমি যেন তখন এক লোক থেকে অন্য লোকে চলে যাই। চলে যাই এক জগৎ থেকে অন্য জগতে। যেখানে সুরের দেবী শ্বেত পারিজাত হাতে অপেক্ষা করে থাকেন আমার জন্যে। তুমি যাবে গঞ্জের মেয়ে, সুরের ভেলায় চড়ে পাড়ি দেবে এক লোক থেকে অন্য লোকে, এক জগৎ থেকে অন্য জগতে? বলো যাবে?"
ক্রমশ ব্যবসা পড়তির দিকে। ইমারতি ব্যবসা, ট্রান্সপোর্ট ব্যবসা ঠিকঠাক চললেও, কৃষিজাত দ্রব্যের ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। পুকুর, দিঘি থেকে ধরা মাছ এসে পৌছাচ্ছে না শ্যামলের আড়তে। মাঠ থেকে ওঠা ফসল এসে জমা হচ্ছে না শ্যামলের গোলায়। জঙ্গল থেকে চাক ভাঙা মধু আসছে না শ্যামলের গোডাউনে। সব চলে যাচ্ছে সহরে। কোন মাল কোথায় যাচ্ছে, কি দামে বিক্রি হচ্ছে সব খবর আসছে ব্রজেন্দ্র বাবুর কানে। চিন্তা বাড়ছে ব্রজেন্দ্র বাবুর। রাগে ফুসছে কমল শ্যামল। তাদের এলাকার সব কৃষিজাত পন্য বাইরে চলে যাচ্ছে! থানা, পুলিশ, প্রশাসন হাতে থাকা সত্ত্বেও কমল শ্যামল কিছুই করতে পারছে না। কোটি কোটি টাকা মুনাফার ব্যবসা প্রায় বন্ধের মুখে। একটা ছেলে, কেবল একটা ছেলের জন্য তাদের এই লাভজনক ব্যবসা লাটে উঠতে বসেছে। কিছুতেই রতনকে আটকানো যাচ্ছে না। যত দিন যাচ্ছে, তত সে খেপিয়ে তুলছে চাষি, জেলে, মৌয়ালদের। এই চাষি, জেলে, মৌয়ালদের খেপানোটা সে ছড়িয়ে দিচ্ছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। দুর দুরান্তর থেকেও কৃষিজাত পন্য স্বল্প দামে সংগ্রহ করতে পারছে না কমলরা। সময় মত মাল দিতে না পারার জন্য তাদের কাস্টোমাররাও হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। কোনও রকম প্রলোভন দিয়ে, ভয় দেখিয়ে রতনকে বিরত করা যাচ্ছে না! ক্রমশ রতন যেন তাদের ব্যবসার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু কিছুতো করতে হবে হবে। কোনও না কোনও ভাবে রতনকে প্রতিহত করতে হবে। কিন্তু কিভাবে সেটা সম্ভব, ভেবে পায় না কমলরা! অবশেষে তারা নেয় সেই চরম সিদ্ধান্ত। কমলের লোকজনরা রতনকে তুলে এনে এক গোপন আস্তানায় গুম করে রাখে।
বাঁশির সুরকে ভালোবাসতে থাকা কেতকী কখন যেন নিজের অজান্তে ভালোবেসে ফেলে বাঁশরিয়াকে। কলেজ যাওয়া ভুলে প্রতিদিন সে ছুটে যায় পদ্মদিঘির অপর পারে। কিসের অমোঘ টানে, বাঁশি নাকি বাঁশরিয়ার? সে জানে না! সে শুধু জানে, তাকে যেতে হবে।
প্রতিদিন কেতকী যায়। কিন্তু শুনতে পায় না বাঁশির সুর। দেখতে পায় না বাঁশরিয়াকে। সে পদ্মদিঘির কালো জলের দিকে তাকিয়ে কাতর ভাবে বলে, "বাঁশরিয়া কোথায় তুমি? তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? কেন শুনতে পাচ্ছি না তোমার বাঁশির সুর? তুমিতো বলেছিলে আমাকে বাঁশির সুর শোনাবে। কথা দিয়েছিলে সারা জীবন আমাকে সুর শোনাবে। তাহলে দেখা দিচ্ছ না কেন? কেন সুর শোনাচ্ছে না? ফিরে এসো বাঁশরিয়া, ফিরে এসো মৌয়ালের পো। দেখা দাও। ভগবানের দোহাই একবারের জন্য দেখা দাও।" কিন্তু বাঁশরিয়া ফিরে আসে না। ব্যর্থ মনোরথ নিয়ে ঘরে ফেরে কেতকী। কিছুদিন পরে পদ্মদিঘির ওপারে যাওয়া বন্ধ করে দেয় সে। অত দুরে যাওয়ার ক্ষমতা যে নেই তার। ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে সে। ক্ষুধা, তৃষ্ণা তাকে ত্যাগ করেছে। সজ্জাশায়ী হয়ে পড়েছে কেতকী। একদিন তার বাক শক্তিও রোহিত হয়ে যায়।
খুবই চিন্তায় পড়েছেন ব্রজেন্দ্র বাবু তার আদরের মেয়ে কেতকীকে নিয়ে। কেতকীর দুই দাদা শ্যামল কমলও উৎকন্ঠার মধ্যে আছে। কি এক অদ্ভুৎ অসুখ করেছে কেতকীর। খিদে নেই, ঘুম নেই, বাক শক্তিও রোধ হয়ে গেছে। সারাদিন কেবল শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কি যেন বলার চেষ্টা করে! কিন্তু বলতে পারে না। স্থানীয় ডাক্তাররা বুঝতে পারছেন না কি অসুখ হয়েছে কেতকীর। তবে বোঝা যাচ্ছে হার্টের কোনও জটিল সমস্যা হয়েছে। যার চিকিৎসা এই গ্রামাঞ্চলে সম্ভব নয়। এই কদিনেই কেতকীর জীবনী শক্তি প্রায় শূণ্যতে নেমে এসেছে।
এখানে আর নয়। ব্রজেন্দ্র বাবু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, তার মেয়ের চিকিৎসার জন্য কলকাতায় নিয়ে যাবেন। সেখানে বড় ডাক্তারকে দেখাবেন।
হাজারো পরীক্ষার পর জানা যায় কেতকীর হার্টের অবস্থা খুবই খারাপ। বলতে গেলে কাজ করা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে তার হৃদযন্ত্র। অবিলম্বে হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের প্রয়োজন।
ভেঙে পড়েছেন ব্রজেন্দ্র বাবু। তার মেয়ের সুস্থতার জন্য তিনি কোটি টাকা খরচ করতেও রাজি। কিন্তু কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না ক্রয়যোগ্য হৃদযন্ত্র। দিশেহারা কমল শ্যামল। বিভিন্ন জায়গায় তারা যোগাযোগ করছে। কিন্তু কোনও সুরাহা হচ্ছে না।
হঠাৎ বেজে ওঠে শ্যামলের ফোন। থানার মেজ বাবু ফোন করেছে। যখনই টাকার প্রয়োজন হয় তখনই মেজ বাবু ফোন করে শ্যামলকে। টাকা টাকা টাকা। টাকা ছাড়া আর কিছুই জানে না মেজ বাবু। তাই বলে এই ক্রাইসিসের সময়ও তার টাকা চাই! লোকটার কি মানবিকতা বলে কিছু নেই? বিরক্ত হয়ে ফোনটা ধরে শ্যামল।
- "হ্যালো শ্যামল, আপনাদের গোডাউনেতো একটা ছাগল বাঁধা আছে। ওটাকে জবাই করুন। আইন আদালতের দিকটা আমি সামলে নেব। অনেক নেমক খেয়েছি আপনাদের, এবার তার প্রতিদান দেব। এটুকু ভরসা রাখতে পারেন আমার উপর।"
ঝড়ের গতিতে চলে যায় ট্রাকটা। থেঁতলানো মাথা নিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে রতনের নিথর দেহ। কার দেহ, কোনও মতেই সনাক্ত করা সম্ভব নয়।
ঢং ঢং শব্দে দুরের কোনও গির্জায় বেজে ওঠে রাত বারোটার ঘন্টা। পুলিশ আসে, বডি তোলা হয়। পোস্ট মর্টেমের জন্য পাঠানো হয় মর্গে।
পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে। অবশেষে পাওয়া গেছে এক হৃদযন্ত্র। এক আকস্মিক দুর্ঘটনায় মারা যায় এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। তার সক্রিয় হৃদযন্ত্রকে পাঠানো হচ্ছে কেতকীর জন্য।
মর্গ থেকে গ্রীন করিডোর করে, এক টুকরো মাংস পিন্ড নিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে যায় গাড়ি। নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছায় রতনের হৃদয়।
ভারাক্রান্ত মনে, গভীর দুঃখের সঙ্গে ডাক্তার বাবু জানালেন যে আর প্রয়োজন নেই হৃদযন্ত্রের। রাত ঠিক বারোটার সময়ে কেতকী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।
কাছাকাছি এসেও, এ জীবনে মিলতে পারল না দুটো হৃদয়। হয়ত পরের কোনও জন্মে, অন্য কোনও জগতে, অন্য কোনও লোকে তারা মিলিত হবে। একাকার হবে দুটো হৃদয়। হয়ত সুরের দেবী সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকবেন শ্বেত পারিজাত হাতে!
==========================
ঠিকানা - 34/10/A, M.G.ROAD,
BUDGE BUDGE,
KOLKATA - 700137.