
ক্লাচ
সোমনাথ মুখার্জী
দাদা একটু সাহায্য করবেন। ভদ্রলোকের বয়েস ষাট বছর অতিক্রান্ত। একজন যুবক বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল তাকে। দ্বিধা সরিয়ে কথাটা বললেন। তিলোত্তমা শহর অসম্ভব ব্যস্ত। বাইক চালক প্রত্যুত্তর দিল না। চোখের পলকে উধাও। বুঝলেন, সবাই ব্যস্ত। উনি একমাত্র বেকার। অজান্তে একবার হাসলেন। এবার যে কী করবেন বোধগোম্য হল না। সাহায্য চাইলে এমন ব্যবহার প্রত্যাশা করেন নি। জীবনে কত মানুষকে, থাক্ সেসব কথা! আত্মপ্রচার না করাই তো ভালো।
রাস্তার ডানদিক থেকে হলুদ রঙের ট্যাক্সি এগিয়ে এল। আচমকা। সামনে। হতভম্ব ভাবে তাকালেন। নিজেকে সামলে নিলেন তথাগত। হাতঘড়ির দিকে তাকালেন। সকাল দশটা দশ। ট্যাক্সি চালকের মতলব বোধগম্য হল না। আশ্চর্য, মেঘ না চাইতেই জল!! চালক হেসে বলল, কোন দিকে যাবেন দাদু?
হাসলেন তথাগত সেন। বললেন, সাহায্য আমার দরকার ঠিক। তবে ট্যাক্সি নয়।
চালক আড়চোখে তাকাল। এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন কেন!!
কঠিন মুখে তাকালেন তথাগত। ট্যাক্সি নিমেষে উবে গেল। বাস্তবে ফিরলেন তথাগত। ডান পা ব্যথা করছিল। মাস আষ্টেক হল অ্যাক্সিডেন্ট
হয়েছে। বিরাট ক্ষতি হল। কত লড়াইটাই না লড়লেন। অথচ, অঙ্গ হারাতে হল চিরজীবনের মত। ক্লাচ ব্যবহার করেন। প্রবল অসুবিধা হয়। তবুও-
কি হল দাদু এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন। কথাটা পিছন থেকে যেন ভেসে উঠল। ক্লাচে ভর দিয়ে ঘোরার চেষ্টা করলেন। পরাস্ত হলেন সময়ের ভারসাম্যে। শব্দ সামনে এসে প্রকাশ হল। দেখলেন, জিন্স এর ওপর টি-শার্ট পরিহিত চৌকস তরুণ সামনে এসে দাঁড়াল। অজগরের মত রাসবিহারীর রাস্তায় অসংখ্য যানবাহন প্রবল গতিতে পরিষেবা দিতে ব্যস্ত।
তথাগত সেন যেন হাতের মুঠোয় চাঁদ ধরতে পারলেন। অদৃশ্য কোনো শক্তিকে ধন্যবাদ জানালেন সকলের অগোচরে। বললেন, কী বলব বাবা, রাস্তাটা পেরোতে চাই। রাস্তাটা অনেকটাই চওড়া। সাহসের অভাব বলতে পারো। সাহয্যের দরকার। হাসার অকারণ চেষ্টা করলেন। হাসি ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে দেখলেন, পরীর মত সুন্দরী চমৎকার ভাবে রাস্তা পেরিয়ে ওপারে পৌঁছে গেল।
তথাগত হতাশা গিলে নিলেন, হাসি ঠোঁটে রেখে। চৌকস ছেলেটা এগোতে যাবে এমন সময়ে দামী গাড়ি এসে দাঁড়াল। কাঁচ নামিয়ে সুন্দরী মায়াবী গলায় বলল, হাই অরিত্র। গাড়িতে উঠে এস তাড়াতাড়ি। কুইক।
তথাগত সেন হতভম্ব। এমনভাবে ঘটনার সন্নিবেশ যেন সিনেমা। চৌকস ছেলেটি অবলীলায় গাড়িতে উঠে গেল। বলল, স্যরি দাদু। বাই। আজ যে ভ্যালেন্টাইন ডে।
আশ্চর্য!! সত্যিই আশ্চর্য!! দুঃখ অনুভব করবেন কী, হঠাৎ মনের মধ্যে অসম্ভব জোর খুঁজে পেলেন। মানুষের মন ঢেউ ভাঙা গড়ার খেলা। ক্লাচের সাহায্যে বারণ সত্ত্বেও স্ত্রীর জন্য উপহারই তো কিনতে বেরিয়েছেন।আজকাল মাঝে মধ্যে স্মৃতিভ্রংশ হয়। ক্লাচটা শক্ত করে ধরলেন।
রাস্তায় প্রবল ভীড়। ওপারে পৌঁছে তৃপ্তির হাসি হাসলেন। সূর্যের ঝকঝকে আলোয় ব্যস্ত শহরকে ক্ষমা করলেন তথাগত সেন।
===================
শ্রী সোমনাথ মুখার্জী
৫৬১/সি,লেক ভিউ পার্ক রোড,বনহুগলী, সোলারিস ফেজ-১, টাওয়ার-১, ফ্ল্যাট নম্বর -১০০৫, কলকাতা-৭০০১০৮