
মহড়া
রীতা বিশ্বাস পান্ডে
হুর মুড়িয়ে ঢুকে পড়লো হলটাতে কমলী। এখানেই নাটকের রিহার্সেল হবে। আজ কাজের ছেলে দুটোই সারে ছটার পর এসেছে ওদের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে তারপর কমলীকে তার নিজস্ব কাজে ছুটতে হয়। নিজস্ব কাজ মানেই বিভিন্ন পত্রিকার লেখা তৈরি করা, নাটকের বা গানের রিহার্সাল, কুকুরকে স্নান করানো যাবতীয় কাজ। বিকেলে আবার রিহার্সালে ছোটো। উফ্ কমলীর মাথা ভন ভন করতে থাকে। হলে ঢুকে দেখে এখনো কেউ এসে পৌঁছোয়নি। হলটা মোটামুটি অন্ধকার। বাহির থেকে যতটুক আলো এসে পড়ছে তাতে বেশ সৌম্য দেখতে লাগছে কিন্তু হলটাকে।কি যা তা ভাবছে কমলী। সম্য দেখতে তো মানুষ হয়, হল কি করে হবে? কিন্তু আলো-আঁধারি পরিবেশে কমলীর তাই মনে হলো। ও ভাবলো একবার সব পাখাগুলো চালিয়ে দেয়, কিন্তু কি ভেবে সেটা আর করলো না। কারণ কটা পাখা লাগবে কটা বাতি জ্বালাতে হবে সেটা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। অবস্থা বুঝে করা যাবে। সে একটা ছবি তুলে নিলো হল ঘরটার। সুন্দর হয়েছে ছবিগুলো। আসলে সাদা সাদা চেয়ার সামনে ছোট একটা স্টেজ সাথে আলো ছায়ার খেলা বেশ লাগছে দেখতে। বাইরে বেরিয়ে আসল সে না তখনও কেউ আসেননি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, এমা পনেরো মিনিট বাকি দশটা বাজার। দশটার সময় সব কলা কুশলীরা এসে পৌছবে। হাতে সময় আছে তাই সে মন্দিরে গিয়ে এক চক্কর দিয়ে নিলো। করজোড়ে সূর্য প্রণাম করে নিলো। প্রণামেতে অবশ্যই আন্তরিকতা ছিল। সূর্যের দিকে তাকালো সে,যে ফ্লেটে থাকে সে, সেখান থেকে তো সূর্যর দেখা পাওয়া যায় না তবে ভোরের রোদটা তার ব্যালকনিতে তার বেডরুমে বেশ কিছুক্ষণ গড়াগড়ি খায়। তখন কমলীর অফিসে যাবার তাড়া থাকে তাই ভোরের রোদের সাথে কোলাকুলি করার সময় পায় না সে। চোখ পিটপিট করে সূর্যের সাথে চোখাচোখি দাড়ালো সে যতক্ষণ না সূর্য তাঁর নীল রুপ দেখালেন। মা খুব বকতেন, বলতেন, চোখ খারাপ হবে ওভাবে তাকাতে নেই সূর্যের দিকে। কিন্তু কমলী কি করে? তার যে সূর্যের ঐ নীলাদ্রি রুপটাই পছন্দ। নীলাদ্রি তো আবার....সে যাগ গে। আভাটা চোখে এসে পড়তেই কমলীর মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয় জবা কুসুম........। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন এসে গেছেন। ভেতরে ঢুকল কমলী। বিমলা এরা সবাই উপস্থিত নাটকের মহড়া হবে এই হলটাতে। না অত বড় হলের সমস্ত জায়গা জুড়ে মহড়া হয় না। যারা বসার বসেন আর সামনে ছোট্ট পরিসরে ওরা রিহার্সাল করে। যোগানন্দ আর তার ভাই বন্ধু ভবানন্দ এসে উপস্থিত হলেন। বিমলা উঠে গিয়ে যতগুলো পাখার দরকার ছিল চালিয়ে দিল। নাটকের মহড়া শুরু হল। নাটকের ডায়লগ কেউই মুখস্ত করেনি তেমন। যোগানন্দ নাটক পরিচালনা করছেন তিনি আশ্বাসের সুরে সবাইকে শান্ত করালেন, হবে হবে হাতে অনেক সময় আছে। অথচ হাতে তেমন সময় নেই তাই কমলীর চোখ বার বার স্ক্রিপ্ট পড়তে ব্যস্ত। এদিকে দর্শকের স্থানে একজন বসে ছিলেন তার ঠিক মাথার উপরে পাখাটা, তাই তার খুব ঠান্ডা লাগছিল। তিনি বলে উঠলেন, "এই পাখাটা বন্ধ করা যায় না। আরে পাখাটা কেউ একবার বন্ধ কর।" কমলী তার পাশে বসে ছিল তাই উঠে গিয়ে একটা সুইচ টিপতেই ভবানন্দের মাথার উপরের পাখাটা বন্ধ হয়ে গেল। ভবানন্দ তিতিবিরক্ত হয়ে বললেন, "আমার এখানে পাখা কেমন করে বন্ধ হলো। " কমলী আবার উঠে গিয়ে সেটাকে অন করে দিয়ে এলো। এবার বিমলা গিয়ে একটার পর একটা সুইচ টিপে টিপে কিছুতেই ঠান্ডা বহনকারী পাখার চাবিকাঠি না পেয়ে পরিশ্রান্ত হয়ে কাচুমাচু হয়ে নিজের স্ক্রিপ্ট হাতে নিয়ে বসে পরলো।এবার অভিজ্ঞ গোপা উঠে গিয়ে নির্দিষ্ট সুইচে টিপতেই পাখা বন্ধ। ভুক্তভোগী ও নিশ্চিন্ত হলেন মুখে হাসি ফুটে উঠলো। কমলী ও স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। যাক বাবা এবার ডাইলোগ মুখস্থ করতে সে মননিবেশ করলো।
এদিকে পরিচালক মহাশয় ডেকেই চলেছেন বিরেনবাবু এবার আপনার পালা।পাশ থেকে খোঁচা পড়তে তাড়াতাড়ি উঠলেন বিরেনবাবু। কে একজন আওয়াজ দিল, "দাদা দর্শকদের দিকে মুখ করে বলতে হবে তো"।
ঘাবড়ে গেলেন উনি দর্শকদের দিকে মুখ করে কিছু বলতে যাবেন আবার যোগানন্দ বলে উঠলেন,
"এদিকে একটু তাকাও, এদিকে না বললে দর্শকরা বুঝবে কি করে যে তুমি আমাদের সাথে কথা বলছ "
কাজেই এদিক ওদিক এদিক ওদিক করে ডায়লগ টা শেষ হলো বিবেকবাবুর।তিনি লম্বা নি:স্বাস ফেলে সেই যেমনটা পরীক্ষার পর নোটিস বোর্ডে নিজের নাম্বার আবিষ্কার করার পর ছাত্রের মুখের ভাবটা হয় তেমনটা করে নিজের আসনে গিয়ে বসলেন।
এবার কমলীর পালা। এদিকে হয়েছে কি আজ তাড়াহুড়োতে কমলী তার দাঁত পড়তে ভুলে গেছে। কাজেই নাটকের ডাইলোগ বলতে গিয়ে আদ্দেক তো দাঁতের ফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কিছু বলতে পারছে না সে, বলতে গেলে আবার লোকে দেখে ফেলবে সামনে দাঁত নেই। তাই সে খুব চেপে চেপে সংলাপ বলতে লাগলো। সোনা বৌদি বলে উঠলেন,
"আরে একটু জোরে বলো একটু জোরে বলো "
বিমলা বলে উঠলো,
"আরে জোরে বল, না হলে দর্শক শুনবে কি করে?"
এমন সময় চাচা চা নিয়ে ঢুকলেন। তাকে যে কে চা নিয়ে আসতে বললো এসময় বোঝা গেলো না। তিনি চা দিলেন সবাইকে কাগজের কাপে। সেটা চা না জল বোঝা যাচ্ছে না। জলে চাপাতি সেদ্ধ করে তার মধ্যে ঠান্ডা ঠান্ডা দুধ ঢেলে একটু চিনি গুলিয়ে নিয়ে এসেছে মনে হচ্ছে। একেবারে অখাদ্য। আর যায় কোথা। সুরেশবাবু পিছনে পড়ে গেলেন চাচার, "তুমি এরকম চা দিলে সামনে থেকে তোমাকে কিন্তু আর চায়ের অর্ডার দেওয়া হবে না বলে দিলাম। দশ টাকার চা নাকি এটা? দশ টাকা তে এর থেকে ভালো চা পাওয়া যায়। "
কমলী বলে উঠলো, "আরে চাচা, একটু আদা ছেচে দিয়ে দেবে একটু এলাচের গুড়ো দেবে দেখবে কত সুন্দর হয়ে যায় চা টা। "
ওদিক থেকে বিনা বললে, " দশ টাকায় তোকে সব কিছু দিয়ে দেবে না? এলাচ! আদা! তবে বিস্কুটের কোয়ালিটি টা খুব ভালো ছিল। কি বলিস।"
কমলী বললো, "হ্যাঁ ঠিক বলেছো।খুব ভালো। "
জানা গেল যে রয় দাদা বিস্কুটটা এনেছেন। তাই দিয়ে চা খেয়ে চা টার মানটা একটু উপরে উঠে গেল। তাই আর কেউ উচ্চবাচ্য করল না। আজ তাড়াতাড়ি হল ছেড়ে দিতে হবে।
বংশীদাদা বললেন, " আমাদের আওয়াজগুলো ঠিকঠাক দর্শকরা শুনতে পাবে তো"?
ভবানন্দ দাদা বললেন, "সামনে গিয়ে কথা বলতে হবে তবে আমাদের আওয়াজটা ধরা পড়বে মাইকে। আওয়াজের কোন প্রবলেম থাকবে না আমাকেও আর চিৎকার করে কথা বলতে হবে না। "
এদিকে "আরে এটা নয় এটা নয় দিদি, অন্য একটা শাড়ি পরবো " বলে বিমলা যেই চায়ের কাপটা ধরতে যাবে পেছন থেকে কার যেন ধাক্কা খেয়ে চা তার ঘারে গর্দানে একসা করে দিল। গরম চা। সবাই রে রে করে উঠলো চাচার উপর। গোপা বললে, "আরে ওর দোষ না আমার হাত লেগেছে।" চাচাকে আর গনরোষানলে পড়তে হলো না। আর একদিন মাত্র বাকি। বুকটা দুরু দুরু সবার। ঠিকভাবে বলতে পারবে তো ডাইলোগগুলো? কমলীর ডাইলোগ লেখা কাগজটি বাড়িতে টেবিলের উপর ছিল কিন্তু সেটা ওর পুষ্যিটা নিজের কোন চিঠিপত্র ভেবে কেটে কেটে খেয়ে আধা খেয়ে আধা ফেলে আধা ছিঁড়ে কোথায় কি করেছে তা কমলী নিজেই জানে না। প্রমটারকে শুনে শুনে যতোটা পারছে বলছে।এদিকে ব্যস্ততার কারণে পার্লারে সে, যাগ গে। এখন কত কি কাজ!
সমস্ত দিনের পরিশ্রমকে জয় করে বিকেলে নাটকটি মঞ্চস্থ হলো এবং দর্শকদের ভুয়সী প্রশংসা পেল।
=========================