মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠা ও সম্মানের দিন : একুশে ফেব্রুয়ারি
পাভেল আমান
ভাষার সঙ্গে মিশে থাকে মানুষের আত্মপরিচয়। ভাষার সঙ্গে আবার জুড়ে আছে সংস্কৃতি। মাতৃভাষার কোলেপিঠে বড় হতে হতে আমরা প্রকৃতপক্ষে চিনতে শিখি ঐতিহ্যকে, চিনতে শিখি পূর্বজকে, চিনতে শিখি মাটি-মানুষের নিজস্ব সত্তাকে। ব্যক্তিমানুষই হোক আর জনগোষ্ঠীই হোক, একবার তার মাতৃভাষা কেড়ে নিলে তার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে।একটি ভাষা ও একটি জাতির জন্ম। বিশ্বে এমন নজির নেই। আ মরি বাংলা ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে লেখা শপথকে নতজানু হয়ে প্রণাম করার দিন।ভাষা শহিদদের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি সেদিন মাতৃভাষাকে মাতৃদুগ্ধের সমান মর্যাদা অর্জনের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও পায় নব প্রেরণা।বাঙালি জাতিসত্তার মূলে যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেটা নতুনভাবে পরিচর্যা পায়। বাংলা ভাষা অন্য এক মাত্রায় পৌঁছায় একুশে ফেব্রুয়ারির হাত ধরে।শুধু বাঙালি নয়, বিশ্বের প্রতিটি জাতির মাতৃভাষার মর্যাদা, স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও মানুষের মতো বাঁচার দাবির সংগ্রামের দুর্জয় অনুপ্রেরণা সৃষ্টির চির অনির্বাণ শিখার দীপ্তিতে দিগন্ত উদ্ভাসিত করেছে একুশে ফেব্রুয়ারি। একুশে ফেব্রুয়ারি এ দেশের মানুষকে শিখিয়েছে আত্মত্যাগের মন্ত্র, বাঙালিকে করেছে মহীয়ান। জাতি হিসেবে আমরা আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সমন্বয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করেছি। মহান ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে এসেছে স্বাধীনতার চেতনা। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের মনে করিয়ে দেয়মাতৃভাষার প্রতি অনিঃশেষ অহংকার পোষণের আর অন্য ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার। বাংলাভাষাকে প্রতিটি নিঃশ্বাসে বহন করতে হবে, রক্ষা করতে হবে, বিকশিত এবং ফুল্ল-কুসুমিত করে তুলতে হবে। যেকোনও আগ্রাসন যা আমার ভাষার মুখ মলিন করতে উদ্যত, তাকে রুখে দিতে হবে।
একুশে মানে মাথা নত না করা, সে কারণেই আমরা যখনই অন্ধকার শক্তির আক্রমণের শিকার হয়েছি, একুশে হয়ে উঠেছে তখন প্রতিরোধের নিশানা। ভাষার এই শক্তি ক্রমেই যেমন বেড়েছে, তেমনই যারা বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিপক্ষ তাদের নিশানাও বেড়েছে। বেড়েছে বলেই ভাষার হাত ধরে থাকা মুক্তচিন্তার উপরে হামলা, বাঙালি সংস্কৃতির উপরে হামলার ঘটনাগুলো ঘটেছে। কারণ প্রতিপক্ষ জানে, বাঙালির শেকড়ের নাম তার ভাষা আর ভাষার লড়াই, সেখানে থেকেই দৃঢ় হয়ে ওঠে এখানের সংস্কৃতির উদারতা। সে কারণেই আমরা দেখেছি পাকিস্তানিরা মুক্তিযুদ্ধের সূচনার সময়েই গুঁড়িয়ে দিয়েছে শহিদ মিনার। কিন্তু শহিদ মিনার শুধু আমাদের কাছে ইঁট সিমেন্টের অবয়ব নয়। আমাদের প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে আছে এক একটি শহিদ মিনার। সেই মিনার কখনও ভেঙে ফেলা যায় না।! তার বিনাশ নেই আছে বিকাশ।সালাম-বরকত-রফিক-জব্বার। ভাষা দিবস মানেই এই শহীদ চতুষ্টয় বাঙালি। এদের মধ্যে আবার বরকত দেহে প্রাণে দ্বিখণ্ডিত। তার স্মৃতি সৌধ এক বাংলার ঢাকাতে কিন্তু তার দেহ শুয়ে আছে আরেক বাংলার মুর্শিদাবাদে। দেশভাগ তথা বাংলাভাগের পরে বরকত ছিলেন 'ভারতীয়' ছাত্র যিনি মুর্শিদাবাদ থেকে পড়তে গেছিলেন ঢাকাতে এবং ৫২র ভাষা আন্দোলনে শহীদ হন। ফলে অখণ্ড বাংলার বাঙালীকে দেখতে হলে শুধু উগ্র কিছু মোল্লা আর গোঁড়া কিছু হিন্দু ধর্মান্ধদের দেখলে হবে না, দেখতে হবে এই বরকতদেরই। দুই বাংলার এক অভিন্ন প্রতিনিধি যেন এই বরকতই। আকাশ ভাঙা বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় বরকতের রক্তে গঙ্গা পদ্মার এপার ওপার প্লাবিত। দেহ ছাড়া প্রাণ আমরা ভাবতে পারি না । কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, বরকতের মন ওপার বাংলার ঢাকার মাটিতেই। একুশের আন্দোলন শুধুমাত্র শোকে বা জয়লাভে শেষ হয়নি, তা পরিণত হয়েছে শপথে। তাই একুশের প্রাণ যেখানে ঐতিহ্যও সেখানে – বিদ্রোহে। স্বৈরাচারী রাষ্ট্র ক্ষমতার বিরুদ্ধে আপামর জনসাধারণের বিদ্রোহ, অন্য সব দিনের চেয়ে তাই ঐতিহ্যগত ভাবে আলাদা একুশে ফেব্রুয়ারি। বাংলা নববর্ষের দিনটির চেয়েও স্বতন্ত্র একুশে – কারণ ঐ ইতিবাচক বিদ্রোহ।বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা সংগ্রাম আত্মত্যাগের পর মায়ের ভাষাকে যে ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা গেছে, এই সময়ে অতীব প্রয়োজন তার যথার্থ ও সাবলীল সম্প্রসারণ। রবি ঠাকুর লিখে গেছেন – 'ইউরোপীয় বিদ্যা ইংরাজি ভাষার জাহাজে করে এ দেশের শহরে বন্দরে আসতে পারে। কিন্তু পল্লীর আনাচে কানাচে তাকে পৌঁছে দিতে হলে দেশী ডিঙি নৌকার প্রয়োজন'। আসলেই জাগতিক সমস্ত সম্পদ হারিয়েও মানুষ পৃথিবীতে থাকবে যদি তার মাতৃভাষা সুরক্ষিত থাকে। আর যদি সেই ভাষা অবদমিত হয় তাহলে সে সবই হারাবে। মাতৃভাষার জোর এমনই।এ ভাবেই পথ বেয়ে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। ২০ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে অভূতপূর্ব এক আবেগ নিয়ে প্রথমবারের মতো মুক্ত পরিবেশে গাওয়া হয় সেই অমর সংগীত, 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।বিশ্বের পঞ্চম বহুল ব্যবহৃত ভাষা হল বাংলা । বিশ্বজুড়ে ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। এদের মধ্যে ২৬ কোটিরও বেশি বাংলা ভষাভাষির বসবাস বাংলাদেশ ও ভারতে। বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী বাকি ৪ কোটিরও বেশি মানুষ ছড়িয়ে আছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। পৃথিবীতে এমন দেশ পাওয়া যাবে না যেখানে বাংলা ভাষার ব্যবহার করা হয় না।বাংলা ভাগ হলেও দুই বাংলার ভাষা এক। একই সংস্কৃতি। একই সামাজিক আচরণ। একই মানসিকতা। একই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। দুই বাংলার, বাঙালীর আবেগ তাই সহজাত। স্বাভাবিক। সাম্প্রতিক বাংলাদেশ রাজনৈতিক পরিবর্তন হলেও এখনো আপামর বাঙালি মননে একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সেই সঙ্গে ভাষা শহীদদের লড়াই সংগ্রামী চেতনা আপসহীন মানসিকতা সর্বোপরি মাতৃভাষাকে রক্ষা ও প্রতিষ্ঠিত করার দুর্বার সাহসিকতা- জীবন উৎসর্গীকৃত প্রতিবাদ আন্দোলনকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে। সত্যি কথা বলতে আর যেন কাঁটাতারের গন্ডি পেরিয়ে দুই বাংলার পাশাপাশি সমস্ত বিশ্ববাংলায় একাকার হয়ে গেছে একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা শহীদদের জীবনাদর্শের চর্চা আলোচনা ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের মধ্যে দিয়ে।
=========================
রচনা- পাভেল আমান- হরিহরপাড়া- মুর্শিদাবাদ