সমীর কুমার দত্ত
গতকাল ভোর থেকে আজুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। স্ত্রী আয়েশা গুম হয়ে যাওয়ার পর দু দুটো দিন কেটে গেলো। আজু ও গ্রামের কয়েকজন তন্নতন্ন করে গ্রাম চষে ফেলেছে কোথাও আয়েশার হদিশ করতে পারে নি। হঠাৎ করে বৌটা দিন দুপুরে চেনা রাস্তা থেকে উধাও হয়ে গেলো। যদিও সন্দেহের তীর এক দিকেই কিন্তু বলার সাহস কারোর নেই। গ্রামের সচ্ছল মাতব্বররা হলো সমাজপতি। তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে যাবার ক্ষমতা বা সাহস কোনটাই গরীব গ্রামবাসীদের নেই।
আজুর বিয়ের কদিন পর একজনের শ্যেন দৃষ্টি পড়ে আয়েশার ওপর। আয়েশা তার স্বামী আজুর জন্যে দুপুরের খাবার নিয়ে যে পথ দিয়ে ক্ষেতে যেতো, ওই পথের আশপাশে ঘুরঘুর করতো সুদখোর মহাজন ইদ্রিশ আলি মোল্লার ছেলে সাহনওয়াজ আলি মোল্লা। লেখাপড়া ভালোভাবে করেনি। তবে দেখতে সুদর্শন। সাজপোষাকে চিত্র তারকাদেরও হার মানাবে। খায় দায় ঘুরে বেড়ায় ধর্মের ষাঁড়ের মতো আর কি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মেয়েদের পিছু ধাওয়া করে বেড়ানো ওর কাজ। এতে ক্লান্ত হয়ে গেলে হাল ছেড়ে দিয়ে বাড়ি ফেরে। গায়ে পড়ে আয়েশার সঙ্গে ভাব জমাবার চেষ্টা করে। আয়েশা প্রথমটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে, পারে না। এই কারণে যে ওদের পরিবার আজু - আয়েশার বিবাহে নিমন্ত্রিত ছিলো। তাছাড়া ওর বাবা গ্রামের একজন মহাজন।
সাহনওয়াজের অভ্যাস ছিলো চকোলেট চিবানো এবং মেয়েদের সঙ্গে চকলেট দিয়ে ভাব জমানো। সেই ভাবেই সে চকোলেট দিয়ে আয়েশার সঙ্গে ভাব জমায়। হয়তো ওই চকোলেটে মাদক বা ড্রাগ মেশানো থাকতে পারে। এইভাবেই সে ধীরে ধীরে আয়েশার সঙ্গে অল্প বিস্তর ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে। আয়েশা আজুর খাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে, দু চারটে সুখ দুঃখের কথা বলে। তারপর খাওয়া হয়ে গেলে বাসন ধুয়ে আয়েশা বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। তার ফেরার পথে অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকে সাহনওয়াজ। তারা দুজনে আড়ালে আবডালে কিছুক্ষণ বাক্যালাপ করে। বাক্যালাপ ক্রমে ক্রমে প্রেমালাপে পর্যবসিত হয়, তারপর তারা নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সদ্য বিবাহিতা বেচারী নারী স্বামীর সঙ্গে প্রেমালাপের ফুরসৎ পায় না। তাই হয়তো বাইরের কোনো পুরুষের ফুটন্ত যৌবনের উষ্ণতা উপভোগ করে। ঘোর কেটে গেলে আয়েশা বলে, "না যাই, বাড়িতে অসুস্থ অন্ধ শাশুড়ি মা আসে, দেরি হইলে চিন্তা করবে।"
"আর একটু থাক না। তোমারে এ্যাতো তাড়াতাড়ি ছাইড়া দিতে মন সায় দেয় না।"—এই বলে সাহনওয়াজ তাকে থামিয়ে দেয়। আবার বেশি জোর করে না এই ভেবে যে একেবারে খেতে হলে রেখে খেতে হবে। ধীরে ধীরে খেলে তবে ও নিজেই ধরা দেবার জন্য পাগল হয়ে উঠবে।
কতোদিন রাতে তার ক্লান্ত স্বামী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লে বিছানায় জেগে জেগে সে ভেবেছে আজুকে সব কথা বলে দেবে, কিন্তু পারে না। পারে না কারণ আজু তাহলে ওর বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেবে আর তখন আজুকে ঘরে খেতে আসতে হবে। আগে শাশুড়ি মা যখন সুস্থ ছিলো, খাবার নিয়ে যেতো। এক একদিন কাজের চাপে হয়তো খেতে আসতে পারবে না। সেদিন খাওয়াই হবে না। তাছাড়া তাতে তার বিপদ বাড়বে বই কমবে না। মহাজনের সঙ্গে অশান্তিতে জড়িয়ে পড়ার ভয়ে সে মুখ খুলতে পারে নি। অতএব এ খেলা চলতেই থাকে। সাহনওয়াজ বেশ ভালো ভালো কথা বলে। তার কথাগুলো আয়েশার মনে ধরে। সে আস্তে আস্তে তার ফাঁদে পড়তে থাকে। এদৃশ্য নিত্যই চলতে থাকে। গ্রামের বেশ কয়েকজনের তা নজর এড়ায় না। পাঁচজনে আড়ালে আবডালে পাঁচ কথা বলে। কিন্তু আজুর সেদিকে কোন হুঁশ নেই।
একদিন দুপুরে আজুর কাছ থেকে বাড়ি ফেরার পথে আয়েশা বেপাত্তা হয়ে যায়। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে এলো আয়েশা ফিরলো না দেখে রোকেয়া বিবি খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। কিন্তু কি করবে সে অসুস্থ, চোখে দেখতে পায় না। তার খাওয়া দাওয়াও হয়নি। ক্ষিদে কখন ডাক দিয়ে ফিরে গেছে। ঘরের দাওয়ায় বসে কারোর যাওয়া আসার চটির শব্দ কিংবা কথাবার্তার শব্দ কানে এলে জিজ্ঞাসা করে,
"কে যাও? আমাগো আয়েশারে দ্যাখসো?" উত্তর আসে —"না" ।
সন্ধ্যের পর বাড়ি ফিরে আজু রোজকার মতো 'আয়েশা', 'আয়েশা' বলে ডাকতে থাকে। রোকেয়া বিবি বলে, "আজু আইলি? দ্যাখ না আয়েশা এহনো ঘরে ফেরে নাই।"
আজু বিস্মিত হয়ে বলে," কও কি? সে তো কহন চৈলা আইসে। গেলো কুথায়? তা তুমি আমারে একটা খবর পাঠাইলে না ক্যান?"
উত্তরে রোকেয়া বিবি বলে,"খবর দিই নাই ভাবসিলাম, এই আইয়া পড়বে। আমারে খাবার দেওনের কথা। তহন থ্যাইক্যা বইস্যা আসি। ফেরার আর নাম নাই।
—সে কি আম্মী! তুমি এহনও খাও নাই? কও কি? আমি কুথায় খুঁজি অরে এই অন্ধকারে?
এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত! মাকে কিছু খাবার দিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে পথে আয়েশার খোঁজে। আতঙ্ক পীড়িত আজু উদভ্রান্তের মতো কোন দিকে যাবে ঠিক করতে না পেরে চারিদিকে ছোটাছুটি করতে থাকে। গ্রামের দু চারজন ওকে সঙ্গ দেয়। অনেকক্ষণ পর মাথা নিচু করে ধীর গতিতে একরাশ হতাশা নিয়ে বাড়ি ফেরে।
আম্মী জিজ্ঞাসা করে,"খোঁস পাইলি?"
—না, আম্মী, কুথাও তো দ্যাখতে পাইলাম না।
অতর্কিতে এক ঝটকায় চুরমার হয়ে যাওয়ার পথে সদ্য গড়ে ওঠা তাদের দাম্পত্য জীবন।
—ইদানিং পাঁচজনে পাঁচ কথা কয়। মহাজনের পোলার সাথে ওর নাম জড়াইয়া ---------------।
আয়েশার সম্বন্ধে তার মা যা শুনেছিলো তা ছেলের কাছে ব্যক্ত করে।
—তুমি তো আমারে ই কথা কও নাই কহনো। জানলে ওরে বাইরে বের হতে দিতাম না। অ্যাহন কি করণ যায় কও।
খাওয়া দাওয়া বাড়ির নিত্য কাজকর্ম মাথায় উঠলো। দিনরাত তার মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো —ও কি তবে গোপনে শাহনওয়াজকে ভালোবাসে? তাকে বাসে না?
সর্বদা এইসব কথা ভাবতে ভাবতে সে উন্মাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সে আর নিজের মধ্যে থাকে না।
" ওর আব্বুরে খবর কর। কাউরে পাঠা, যাইয়া খবর দিক। পরের মাইয়া বলে কথা।"
আম্মী চিন্তিত হয়ে বলে।
আয়েশার আব্বুকে খবর দেওয়া হলো। আব্বু আজমল আজুকে সঙ্গে নিয়ে থানায় একটা ছবি দিয়ে এফ. আই. আর করে এলো। কিন্তু থানার বড় বাবু জানতে চাইলে তারা বিনা প্রমাণের সন্দেহের ব্যক্তিটির নাম করতে পারেনি।সাহনওয়াজের সঙ্গে তার স্ত্রীর ঘনিষ্ঠতার কথা অনেক গ্রামবাসী এখন তাকে বলছে শুনে আজু বলে, "এহন শুইন্যা লাভ কী? কিছু কী করতে পারবো? যা হবার তা হইয়্যা গ্যাসে।"
আজু ভবঘুরের মতো দুটো দিন নিরন্ন, নিদ্রাহীন হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলো স্ত্রীর খোঁজে। ভদ্রতার মুখোশ পরে ও সন্দেহের বাতাস কোন দিকে বইছে তা আঁচ করতে ইদ্রিশ আলি আজুকে সান্ত্বনা দিতে এসে বলে," কী আর করবি আজু, চিরকালের জন্য ওরে ভুইল্যা যা। তোর ওই কুলটা চরিত্রহীনা স্ত্রীর কথা ভাইব্যা করবি কী? কারোর সাথে ভাইগ্যা পড়সে। এডা ভালো লক্ষণ যে ওই চরাত্রহীনা গ্যাসে। চরিত্রহীনা মাইয়্যার সঙ্গে ঘর করণ যায় না।"
চুপ করে থেকে সব কথা শুনে আজু নিজেকে আর ঠিক রাখতে না পেরে স্বভাব বিরুদ্ধ হয়ে বলে উঠলো," কারোর সাথে না। কারোর সাথে না। এ জঘন্য কাজ আপনার পোলার! আপনার পোলাই আমার স্ত্রীরে গুম করসে।"
—মুখ সামলে কথা ক আজু। তুই কার সামনে কথা কস্ জানস্? কি প্রমাণ আছে আসে তোর কাসে? প্রমাণ ছাড়া কথা কইলে আমি তোর নামে মানহানির মামলা করবো। মামলা লড়ার ক্ষ্যামতা তোর আসে? অ্যাকে তো তোর বাস্তুভিটা আমার কাছে বন্ধক আসে। বেশি করবি তোর জমি চষার কামটুকও খাইয়্যা ফেলমু। একবার শুধু জমির মালিক রেজ্জাক মোল্লারে কইলেই হয়। তারপর তোর কর্জ শোধ দিবা কীভাবে? কর্জ না মিটাইলে সবই তো আমার হইবো। তখন ঘরের থিক্যা বের কইরা দিবা। অসুস্থ প্রায়ান্ধ আম্মীরে লইয়া থাকবি কোন চুলায়? কাজেই মুখ বন্ধ রাখ। বুঝলি? কী বুসলি?
—তুমি আমার কাম খাইয়্যা লইবা। কাম কি খাওনের জিনিস যে তুমি খাইয়্যা লইবা। অতো সোজা?
—সোজা, সোজা। রেজ্জাক মোল্লারেও আমারে দরকার কর্জ লওনের সময়।
—তুমি প্রমাণের কথা কও? প্রমাণ দিবা গেরামের লোক। অনেকেই অনেকবার দ্যাখসে আমার স্ত্রীরে আড়ালে লইয়া গিয়া গুজগুজ কইরা কথা কইতে। কথা কইতেই পারে। তবে আড়ালে আবডালে গুজগুজ কইরা কিসের কথা?
—কে দ্যাখসে তাদের নাম কর। দেখি কে দ্যাখসে। কথা তো একজন কহন যায় না। কমপক্ষে দু জন লাগে। সোরের মায়ের বড়ো গলা। গুজগুজ করসে। তাতে কী? তা তোর বিবি গুজগুজ করে কথা কহনের সুযোগ তারে দিসে তাই করসে।সেলে সোকরা, পোলাপান একটু আধটু কৌরাই থাকে। তা বলে গুম করসে! দ্যাখ তোর বিবি অন্য কাউর লগে গুজুর গুজুর কইরা তার সাথে পলাইয়া গেসে। কই আমার পোলাডা তো যায় নাই। সে তো এহ্যানেই আসে।
ইদ্রিশ আলী গ্রামের সকলকে জিঞ্জাসা করতে লাগলো, " আপনারা কেউ আমার পোলারে আজুর স্ত্রীর লগে কথা কইতে দ্যাকসেন?"
সকলে বলে,"আমরা স্বচোক্ষে দেখি নাই,শুনসি মাত্র।"
কেউ ইদ্রিশের মতো মহাজনকে চটাতে চায় না। কর্জ নিতে সকলেরই দরকার হয় ইদ্রিশকে।
—ও শুনা কথা। শুনা কথা প্রমাণ হয় নাকি? যান,ওরে কন। ও আমার পোলার নামে মিসামিসি দোষ দ্যায়।
মনে মনে ভাবতে থাকে —এ হারামজাদা কর্জ মিটাইতে পারবা না কোন দিনই। একটা ব্যবস্থা তো হইসে। আর একখান ব্যবস্থা করতে হইব যাতে বাড়ি খান বেহাত না হইয়া যায়।
যারা আজুকে বলেছিলো সাহনওয়াজের কথা, তারাই এখন পাল্টি খেয়ে আজুকে বলে,"ছাইড়া দে আজু। উয়র সঙ্গে পারবি না। তাছাড়া তোদের বাস্তুভিটা উয়র কাছে বাঁন্ধা আসে, কথাখান মাথায় রাখিস। পানিতে বাস কইরা কুম্ভীরের সঙ্গে বিবাদ করা ঠিক না। পানিতে কুম্ভীরের শক্তি বেশি।"
আব্বুকে হারিয়ে অভিভাবকহীন হয়ে নিজেকে বড়ো অসহায় লাগলো আজুর বিশেষ করে এই মুহুর্তে। আজু ওরফে আজম আলি মণ্ডল একজন ভাগ চাষী। রেজ্জাক মোল্লার এক বিঘে জমিতে ছয় আনা দশ আনা ভাগে চাষ করে। লাঙল গরু সব জমিদারের। আজুর আব্বু আলম আলি মণ্ডলও একজন ভাগ চাষী ছিলো। মধুমেহ রোগের শিকার তদুপরি হার্টের রোগী বছর দুয়েক আগে মারা যায়। ছোটবেলায় দুই অগ্রজের দ্বারা প্রতারিত ও বিতাড়িত হয়ে বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলো। এই মুর্শিদাবাদের তৎকালীন জমিদার সিদ্দিকুল্লা আলমের সহৃদয়তায় তাঁর বাড়িতে স্থান পেয়ে বড়ো হয়ে তারই আনুকূল্যে চার কাঠা জমি পেয়ে বর্তমান বাড়িখানি দাঁড় করাতে পেরেছিলো। বিনিময়ে জমিদারের জমিতে ও গৃহে উদয়াস্ত হাড় খাটুনি খেটে তাঁর দানের মূল্য চোকাতে হয়েছিলো। মা রোকেয়া বিবি অসুস্থ,তারপর চোখে ছানি পড়েছে, ভালো দেখতে পায় না। আজুকে একাই ঘর বাহির সব করতে হয়। আজুর এক বোন ছিলো নাম দিলহারা। বছর দুই আড়াই আগে পাশের গ্রামের জামাল মিঞা নামে এক ক্ষেত মজুরের সঙ্গে বিবাহ হয়েছিলো। দুঃখের বিষয় গত বছর সন্তান প্রসব করতে গিয়ে সন্তান সহ মারা যায়। মেয়ের বিয়ের জন্য আলম ইদ্রিস আলির কাছে বাড়ির দলিল বন্ধক রেখে অনেক টাকা কর্জ করেছিলো। বাবার মৃত্যুর পর সেই কর্জ আজুকেই পরিশোধ করতে হচ্ছে। মায়ের দেখাশোনা ছাড়া রান্নাবান্না আরও টুকিটাকি ঘরের কাজ সেরে জমিতে যাওয়া, বিকেল অবধি জমিতে হাড় খাটুনি খেটে সন্ধ্যের আগে ঘরে ফেরা, তারপর আবার রান্নার জোগাড়। আজু আর পেরে ওঠে না। পুরুষ মানুষ তো দুদিক সামলাতে গিয়ে হিমসিম খেতে হয়।
রোকেয়া বিবি কখনো কখনো আজুর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলে, "আজু বাছা আমার, তুই এবার একটা শাদি করে ঘর বসা। নাহলে সামাল দিতে পারবা না। আমি মরবার আগে যেন দেইখ্যা যাইতে পারি।"
—কি যে কও আম্মী। নিজেরই ভালোভাবে জোটে না, তার ওপর কর্জ কাঁন্ধে। শাদি কৈরা খায়ামু কি? পয়সা কড়ি থাকলে তো তুমার চক্ষের সানি কাটাবার ব্যবস্থা করতে পারতাম। কিন্তু মহাজনের দীর্ঘমেয়াদী কর্জ মিটাইতে মিটাইতে হাত ফাঁকা হইয়া যায়। ইদ্রিশ আলি হইলো গিয়া চশমখোর। একমাস পয়সা না পাইলে খসখস করে,কয়, "একখান কথা কান খুইল্যা শুইনা রাখ আজু,কর্জ লইয়্যা সময় মতো না মিটাইলে কর্জ আর কহনো মিলবা না। অতিরিক্ত সুদ দিতে হইব।" আর তুমি অ্যাহনি মরার কথা মুখে আনো ক্যান?
—আনি কি সাধে, যার চাল চুলা নাই, তার চলে যাওয়াই ভালো।
—তোমার দুইডাই আসে। তবে এই অলক্ষুণে কথা কেন কও আম্মী? ভালো কথা মনে করাইয়া দিসো আম্মী। ঘরের সালটা হইয়া আইসে।বর্ষার আগে ছাইয়া ফ্যালতে পারলে ভাল হইত। না হইলে বর্ষায় ভুগতে হইব। এতবড় বাড়ি মেরামত করা মুশকিল। গ্যালো বছরের কথা মনে আসে তো, দাওয়ায় পানি পড়ছিল?ছাইতে কয় কাহন খড় লাগসিল? মনে আসে?
রোকেয়া বিবি সব শোনে,সব বোঝে। মেয়ে দিলহারা তো চলে গেলো। বেঁচে গেলো। বাচ্চা রেখে মরলে আরও খারাপ হতো। অভাবের সংসারে গিয়ে পড়েছিলো, না খেতে পেয়ে এমনি মরে যেতো। তা মরে বেঁচেছে। কিন্তু তার সাত রাজার ধন এক মানিক আজু? তার তো একটা ভবিষ্যৎ আছে। আর আজু ছাড়া তাকে দেখবেই বা কে? বড় কর্তব্যপরায়ণ ছেলে বাবার দেনা শোধ করছে।, এ দায় তার নয়, তবু তাকেই দায় নিতে হবে, নইলে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে। না হলে ভেগে যেতো। আজকাল যা সব হচ্ছে। তার একটা বিয়ে দিয়ে দিলে ঘরে মন বসবে। রোকেয়া বিবি আবার এও ভাবে —বৌটা ভালো হলে হয়। সেরাম সেরাম হলে স্বামীকে নিয়ে ভেগে না পড়ে। আজকাল ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেওয়াই মুশকিল আবার না দিলেও নয়।
একদিন পাশের গ্রামের লতিফ মণ্ডল নামের এক ঘটক এলো আজুদের বাড়ি। আজু তখন জমিতে লাঙ্গল দিচ্ছিলো। ঘরে ছিলো না। বললো," কি গো মাসি আসো ক্যামন?"
রোকেয়া চোখে ভালো ঠাওর করতে পারে না। বলে,"কেডা?"
—আমারে চিনলা না মাসি। আমি হলাম গিয়া লতিফ ঘটক।। তা আস কেমন?
—আর আসি, বেঁসে আসি তবে সুখ নাই।
—কেন? হইলো কী? তোমাগো পোলা তো ভালই। তা হইলে মনে সুখ না থাহার কারণ কী?
—পোলা ভাল হইলে কি হইব? একা পেরে ওঠে না।
—ওই জন্যেই তো আইসি।
—কোন খবর টবর আসে?
—আসে বৈকি। জবর খবর।
—কস্ কী, খুইল্যা বল দিহি।
—পোলার এবার শাদি দাও।
—শাদি দাও তো, ভালো মাইয়্যা পাই কই?
—তুমি কইলে দ্যাখাইয়া দি।
—দ্যাখতে ক্যামন? দেবা থোবা কিসু?
—দ্যাখতে তো বেশ ভালই। মানাইবা বেশ। টাকাকড়ি, জিনিস পত্তর দেবা থোবা। পরিবারের অবস্থা ভালই।
—এহন তো আজু ঘরে নাই। কাল পরশু কইরা একবার আইস্। আমি কথা খান আজুর কাসে পাড়বা। জানি ও টপ কইরা রাজি হইব না। রাজি করাইতে হইব। তুই একডা কাম করতে পারস্।
—কী কও ।
—তুই ক্ষেতে গিয়া ওর সাথে দেখা করতে পারস্। কইয়া দ্যাখ, কী কয়। আল্লা তালার ইস্সা হইলে হইব।
—হ্যাঁ, তাই যাই। দেখি কইয়া।
লতিফ ক্ষেতে গিয়ে দেখে আজু জমিতে লাঙল দিচ্ছে। লতিফ হাঁক পাড়ে," আজু, এহানে একবার আয়। তোর লগে কথা আছে। বেশি সময় নিমু না।
"কী কথা?" —জমি চষতে চষতে আজু জিজ্ঞাসা করে।
—একটি বার এহ্যানে আয়।
আজু লাঙল,হাল ছেড়ে গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে লতিফের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,"কী ব্যাপার? আমার কাসে?
—তোর ঘর গেসিলাম। তর আম্মীর লগে কথা হইল।
—কী কথা
—আমার হাতে বিবাহযোগ্যা একটা মাইয়া আসে, শাদি করবি? করবি তো ক। দ্যাখাইয়া দি। দ্যাখতে শুনতে খুবই ভালো।স্বভাব চরিত্তির ভাল। দেবা থোবা। তোর তো টাকা পয়সার দরকার। আমি তো সবই জানি।রাজি থাকিস্ তো ক, কাইলি দ্যাখতে চল। শাদি পাকা কইরা দি।
—তর কি মাথা খারাপ হইসে? আমার অ্যাহন অনেক টাহার দরকার। ঘর সাইতে হইব। আম্মীর চোখের সানি কাটাইতে হইব। অনেক টাহার দরকার। অত টাহা দেবা? তুই তো কইলি মাইয়াডার সব ভাল। তা হইলে আমার মত গরীবের সাথে শাদি দিতে চায় ক্যান? কোন দোষ ত্রুটি আসে মনে হয়। আমার ঘাড়ে চাপাইবার মতলব করসস ?
—না না ওসব কিস্যু না। সব ঠিকঠাক আসে। তর টাহার দরকার, ওই জন্যই তো শাদির জন্য কইসি। চল গিয়া দেইখ্যা আসি। মাইয়্যা পসন্দ হইলে সমস্যা ও চাহিদা মত টাহার কথাটা পাড়বা। ম---নে তো হয় হইয়া যাইব। দুইডা মাইয়্যা, খরস করবা। পোলা নাই। একবার ভাইব্যা দ্যাখ, যা আসে দুই মাইয়্যাই পাইব। তহন তো তুই ধরা সোঁয়ার বাইরে। আমাকে তুই মনে রাখবা না। কাজেই ভাই, আমি পাঁস হাজার টাহার কম নিবা না।
আজু কিছুটা জোর পায় মনে। ওর মা ওকে বোঝায়। ও নিজে ভেবে চিন্তে দ্যাখে। মাইয়্যাও সুন্দর আবার টাহা- পয়সা দিবা। তাহলে এ সম্বন্ধ করা যাইতেই পারে। দিলে কর্জটা পরিশোধ করে দলিলটা হস্তগত করা যায়। এছাড়া মায়ের চোখের চিকিৎসা, বউ নিয়ে থাকতে গেলে ঘরটা ছাইতেই হবে। বিয়ে হলে একটা সন্তানাদিও হবে। বৌয়ের শখ-আহ্লাদ মেটানোর তো একটা ব্যাপার আছে, কুটুম্ব এলে তাদের আপ্যায়নের সামর্থ্য দরকার ইত্যাদি হাজারো সমস্যা। এক কথায় বিয়ে হয় না। লাখ কথা কইতে হয়। আজু আর চিন্তা করতে পারে না। এসব ভাবতে গেলে বিয়েই আর হবে না। আবার এদিকে মাকে দেখার তো লোক চাই। বিয়ে না করে সে বেশ ভালোই আছে। আবার না করলেও নয়। এসব সাত -পাঁচ ভেবে সে মনস্থির করে ফেলে, সে মেয়ে দেখতে যাবে। একপ্রকার নিমরাজি হয়ে আজু লতিফের সঙ্গে মেয়ে দেখতে যায়।
কনে দেখে খুব খুশি আজম। মেয়ের বাবা -মাও খুব খুশি হবু জামাই দেখে। তবে ভাগ চাষী তো। পরমুখাপেক্ষী। তবে পরিশ্রমী, দু -চার কাঠা জমি কিনে দিলে আর ভাগ চাষী হয়ে থাকতে হবে না। আজমল পছন্দের পরবর্তী আসল কথাটা মানে দেনা -পাওনার কথাটা উত্থাপন করলো," তা বাবা কথা কহনের জন্য তো একজন অভিভাবক লাগে,তা তুমার আম্মী তো আইতে পারবা না। তা কথা কি তুমিই কইবা?"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ ওই কইবা। ও কইলেই হইব।"—লতিফ বলে।
—তা বাবা, তোমারে কী দিতে টিতে হইব কও। তুমার তো কিসু চাওনের আসে।
ষআজম লতিফকে বলে,"আমি কী কইব। তুই তো সব জানস।কইয়া দে।"
—আমি জানি, তবে ব্যাপারটা হইল গিয়া আমার বলাটা কি ঠিক হইব।
" নিজের জন্য চাইতে লজ্জা করে। এই আর কি!"—আজম সলজ্জভাবে বলে।
"আচ্ছা ঠিক আসে চল।"—বলে লতিফ শুরু করে —" শোনেন আলি সাহেব -------------------"
আজমল মন দিয়ে লতিফের সব কথা মন দিয়ে শোনে। আজম মাঝে মাঝে সায় দিয়ে যায়।
সব কথা শুনে আজমল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, "আচ্ছা,সবই তো শোনলাম। বাড়িতে একটু আলোচনা কইরা লই। আপনে (লতিফকে)এক কাম করেন, কাইল হউক বা পরশুই হউক একবার দ্যাখা করেন।"
তারপর যথাযথ আপ্যায়নের পর আজম বাড়ি ফিরলো পথে লতিফকে ছেড়ে।
—আজু আইলি? হাত পা ধুইয়া গ্লাসে পানি ঢাকা আসে খাইয়া ল। মাইয়া দ্যাখলি? পসন্দ হইল?
—মাইয়া তো দ্যাখলাম,ভালোই।পসন্দ তো হইসে।
—কথা টথা কিসু হইল?
—যা কহনের লতিফ সবই কইসে। দিন দুই পর যাইতে কইসে।
—কি মনে হয় হইব?
—কে জানে? অত টাকার ব্যাপার। পারবা কিনা কে জানে।
—টাকার কথা কিসু কইলি?
—না, টাকার কথা কিসু কই নাই। নিজের মুখে কওন যায় না। লতিফ সমস্যার কথা সব
কইসে। হিসেবী লোক সব বুঝে। না বুঝলে কি আর যাইতে কয়।
—দেখ আল্লা তালার ইস্সা হইলে, হইয়া যাইব। হইলে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় আর কি।
দুদিন পর লতিফ দেখা করতে গেলে আজমল তাকে জানায়, সে বিয়ের খরচ, ঘর ছাওয়া ইত্যাদি বাবদ পঞ্চাশ - ষাট হাজার কি একটু বেশি দিতে পারে। আম্মীর চিকিৎসা কোন সরকারি হাসপাতালে বিনা খরচে যাতে ভালোভাবে হয় সে ব্যবস্থা সে করে দেবে কারণ তার জানাশোনা আছে সরকারি হাসপাতালের এক কর্মচারীর সঙ্গে। কিন্তু তার বাড়ির কর্জ সে মেটাতে পারবে না। তাকে নিজেকেই পরিশোধ করতে হবে। তবে মাঝেমধ্যে কোন সাহায্য লাগলে সে তা দেবে। বাড়িতে আলোচনা করে বিয়ের ব্যবস্থা পাকা হলো। খুব বেশি কিছু না করে ওই মন্দের ভালো ধূমধাম করে বিয়ে মিটলো। নতুন কনে বাড়ি এলো। নাম তার আয়েশা। গ্রামের আমন্ত্রিতরা কনে দেখে ভূয়সী প্রশংসা করলো। বিনিময়ে তাদের ভূরিভোজ দেওয়া হলো। রোকেয়া বিবি চোখে ভালো দেখতে না পাওয়ায় জন্য বৌমার রূপের প্রশংসা আমন্ত্রিতদের মুখে শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো। তবে পরের মুখের প্রশংসা শোনার জন্যেই তো এতো কিছু করা। ভালোই চলছিলো সংসার। আয়েশা ভালোই শান্তিতে ঘরকন্না করছিলো। রান্না বান্না, শাশুড়ির দেখাশোনা, স্বামীর দুপুরের খাবার পৌঁছানো,ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা ও জামাকাপড় কাচা —সবই ভালোভাবে নিপুণ হাতে চালিয়ে যাচ্ছিলো। এছাড়া সে স্বামীকে কিছুটা হলেও আর্থিক সহায়তা দেবার জন্য অবসর সময়ে সেলাই ফোঁড়াইয়ের কাজ করছিলো। আজু বলে,"আয়েশা এসব করণের কী দরকার? ঘরের সবার কাজকর্ম কইরা আবার বাইরের কাজ করণের কী দরকার? তুমি পেরে উঠবা না। তাছাড়া তোমার বিশ্রামের দরকার। দুপুরবেলা খাওন দাওনের পর একটু ঘুমাইয়া লইতে পার। না হইলে শরীর ভাইঙ্গা যাইব। অসুখে পড়বা। তহন কি হবে?" সন্ধ্যায় আজু বাড়ি ফিরলে জলের গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে আয়েশা বলে,
"তোমার একার উপর অনেক চাপ। সংসার তো আমাগো দু জনের। তাই করি।"
আজু বলে,"তুমি বড় ভাল মাইয়া।" আজু ও রোকেয়া দুজনেই খুব খুশি। আলম ও দিলহারা চলে যাবার পর তারা নতুন করে সংসারের স্বাদ পায়। আয়েশা এলো ঘর আলো করে সুখ,আনন্দ নিয়ে। সন্ধ্যায় শাশুড়ির পায়ে গরম তেল মালিশ, রাতের বেলায় স্বামীর পরিসেবা, মাথায় হাত বোলানো, সুখ দুঃখের কথা শোনা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে খুব শীঘ্রই আয়েশা আজুর সোহাগী হয়ে উঠলো। হয়ে উঠলো মনের মানুষ। আজু যখন একলা থাকে আয়েশার কথা ভাবে। এখন আর আম্মীর কথা অতটা ভাবে না। আম্মীর কথা ভাবলে তার দুঃখ হয় এমন কি কষ্টও, কিন্তু আয়েশার কথা ভাবলে সুখ অনুভূত হয়। ভাবে বিভোর হয়ে যায়। সারা জীবন দুঃখের কথা ভাবতে তার ভালো লাগে না। জন্ম থেকেই সে দারিদ্র্যের চেহারাটা দেখে আসছে। আয়েশাকে তার জীবনে এনে দিয়ে আল্লা তাকে সৌভাগ্য এনে দেসেন। আয়েশা মা হোক সে চায়, কিন্তু সে এখন বাবা হতে চায় না। মাথার ওপর অনেক দায় দায়িত্ব। এখন শুধু তারা দাম্পত্য রাত্রি যাপন করতে চায়। একজন চাইলে কী হবে। ক্লান্ত আজু শোয়ার কিছুক্ষণ পরেই নাক ডাকতে শুরু করে। আয়েশার চোখে ঘুম আসে না। সে রাতে জেগে পড়ে থাকে। ' কপালের লিখন কে করে খণ্ডন।' দুর্ভাগ্য আত্ম গোপন করে আছে। সময়েই আবির্ভূত হবে মানুষ এক মুহূর্ত আগেও তা টের পায় না। তাই ধাক্কাটা তীব্র হয়ে দেখা দেয়। সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে।
বেশ চলছিলো। হটাৎ দুর্যোগের কালো মেঘ ঘনিয়ে ওঠে। বিস্ময়করভাবে আয়েশা কোথায় হারিয়ে যায়। বেশ কিছুদিন কেটে যায়। আজু উদ্বেগে অস্থির অবস্থায় দিন কাটায়। রোকেয়ার অবস্থা তথৈবচ। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো হয় না। প্রতিবেশীদের কেউ কেউ কিছু খাবার দিয়ে যায়। রোকেয়া কখনও খায়, কখনও খায় না। তার ওপর ছেলেকে ওই মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় দেখে সে একদম ভেঙে পড়ে। চোখের জল ফেলতে ফেলতে চোখ দুটোর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়ে। চোখের সামনে এখন একটা কালো পর্দা। ছেলের এই দুরাবস্থায় তাকে চোখেও দেখতে পায় না। দুঃখ কষ্ট বড়ই বিদ্রুপাত্মক। শরীর জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। আজু বাড়িতে থাকে না। কোথায় থাকে, কি খায় কিছুই কেউ জানে না। সন্ধ্যায়
অন্ধকার নেমে এলে ঘরে এসে ঢোকে। আবার কখনো মধ্যরাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। মায়ের কোনো খোঁজখবর রাখার মানসিকতা তার নেই। আয়েশাই তার চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
একদিন রাতে রোকেয়ার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে এলো। মৃত্যু মুখে রোকেয়া বলে, "আজু,বাবা, মুখে একটু পানি দে। গলাডা শুকাইয়া যায়। আর পারি না। আল্লা, দয়া কইরা আমারে ন্যাও। আজুরে ভালো রাইখো। পানি, পা--নি, পা-----নি , পা----বলতে বলতে সব শেষ। আজু তখন ঘরে নেই। এক গণ্ডুষ জলও মুখে পড়লো না। সকালে প্রতিবেশীদের একজন রোকেয়াকে দেখতে এলো। দেখলো রোকেয়া হাঁ করে মরে পড়ে আছে। মৃত্যু হয়েছে অনেকক্ষণ আগে। কারণ শরীর শক্ত হয়ে গিয়েছে মরণ সঙ্কোচনের প্রথম ধাপ। গ্রামের লোকেরা খবর পেয়ে সব জড়ো হলো। ছেলে ছোকরারা বেরিয়ে পড়লো আজুর খোঁজ করতে। একজন দেখলো আজু একটা গাছতলায় পড়ে আছে নেশাগ্রস্ত মাতালদের মতো। সকলে ডেকে তুলে বললো, "আজু ওঠ তোর আম্মী আর নাই।" আজুকে ধরাধরি করে বাড়ি নিয়ে এলো সকলে। মায়ের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে চূপ করে বসে রইলো আজু। বয়োজ্যেষ্ঠ একজন বলতে লাগলো," আজু তুই চিৎকার কইরা একটু কাঁন্দ। তর আম্মী চিরকালের জন্য চৈলা গেসে। আর আইব না। তুই আর তোর আম্মীরে দ্যাখতে পাইবি না। চিৎকার কইরা একটু কাঁইন্দা ল।"—সকলে বলতে লাগলো। কিন্তু আজু নির্বিকার। চোখের জল সর্বদা গড়িয়ে পড়া ছাড়া আর কোন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায় নি। আসলে ছেলেটা আঘাতে আঘাতে ক্ষত -বিক্ষত হয়ে যাচ্ছিলো। তার এই মৌনতা ভঙ্গ না করলে ও বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবে চিরতরে। আয়েশার এই নীরব প্রস্থান আজুকে অনেক প্রশ্নের মুখে ঢেলে দিয়েছে। যাতে ও মাথার ঠিক রাখতে পারেনি। আয়েশা নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার প্রথম প্রথম আজু নীরবে কাঁদতে কাঁদতে নিজের মনে বলতো, " কেন আইলা আমার জীবনে? আইলা যদি আমারে কিছু না কইয়া চৈলা গেলা ক্যান ?" শক এতো তীব্র যে তার গর্ভধারিণীর কথাও ভুলিয়ে দিয়েছে। তাই তার সম্বিত ফেরানো জরুরি। সকলে মিলে নানা ভাবে চেষ্টা করেও তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরানো গেলো না। আবার হয়তো সে অনুভব করতে পারছে কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। কারণ, তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে ঠিক জন্তুর নীরব যন্ত্রণা প্রকাশের মতো। হয়তো তার মায়ের মৃত্যুই এখন সে কামনা করছে। কারণ, সে এখন বড়ো অসহায়। সে তার আম্মীকে বাঁচাতে পারবে না।
গ্রামের সকলে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান নির্বিশেষে রোকেয়াকে গ্রামের গোরস্থানে নিয়ে গিয়ে কবরস্থ করলো।তারপর যা যা করণীয় তা তারা আজুকে দিয়ে সম্পন্ন করালো। আজু অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় তাই তাই করলো। দু একজন দায়িত্ব নিলো আজুকে দেখভাল করার, তার খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করার, তার সঙ্গে শোয়ার ইত্যাদি ইত্যাদি। আজুর সঙ্গে রফিক ও রসিদ শোবে ঠিক হলো। পরদিন দেখাগেলো তারা অঘোরে ঘুমুচ্ছে, ঘুমতেই পারে কারণ সারাদিন তাদের কম ধকল কম ধকল যায় নি। কিন্তু আজু নেই। সকলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেরিয়ে পড়লো আজুকে খুঁজতে। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও তাকে পাওয়া গেলো না। তখন থানায় এফ. আই. আর করা হলো। সকলে বলতে লাগলো,"এ যে দেখি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।এ তো আজুকে কে বা কারা গুম কইরাসে, আবার খুনও কইরা থাকতে পারে। মানে আয়েশাকে যে বা যারা গুম করসে বা খুন করসে বা তারা আজুকেও গুম করসে, হয়তো বা মাইরা ফ্যালসে। এ তো রীতিমতো রহস্যের গন্ধ পাওয়া যাইতেসে।" অপর একজন বললো," আয়েশা ও আজু না ফিরলে তাই তো মানিয়া লইতে হইব যে তারা দুজনই খুন হইসে।"
ইদ্রিশ আলি এই সময় তালা চাবি হাতে নিয়ে আজুর ঘরের সামনে এসে পঞ্চায়েত প্রধান এনায়েত আলি মোল্লাকে জানালো,"দ্যাখেন প্রধান সাহেব আজুর আব্বু আলম মাইয়ার শাদির সময় আমার কাছ হইতে কর্জ লইসে বাস্তুভিটার দলিল বন্ধক রাইখ্যা। এ তো আপনারা সক্কলে জানেন। এহন আজু নাই। আমি ঘরে তালা লাগাইয়া চাবিখান আমার কাসে রাখুম।" পঞ্চায়েত প্রধান এনায়েত আলি বলেন,"এ তো আপনে করতে পারবেন না। পঞ্চায়েত এ ঘরে তালা লাগাইয়া চাবি পঞ্চায়েতের হেফাজতে রাখবা।"
—কিন্তু দলিল তো আমার কাসে। এ বাস্তুর উপর অধিকার তো আমারই।
—অধিকার আপনার ঠিকই। কিন্তু যতক্ষণ না আজু ফিইরা আইসে ততক্ষণ এ মামলার নিস্পত্তি হইব না। সময় পার হইয়া গ্যালে এ ঘর নিলামে উঠবো। আপনি আপনার টাকা সুদসহ বুঝিয়া পাইবেন। কিন্তু এডা তো ভাইব্যা দ্যাখতে হইব যে গুম হইয়া থাকিলে কে বা কারা এই গুম করার পিসনে আসে। দু দুটা গুম,খুনও হইতে পারে,তাও বের করতে হইব। আইনের হাত লম্বা। কাউরে কোনক্রমে রেহাই দেয়া যাইব না। তা সে যেই হউক। সত্য সামনে আসবই। কে বা কারা এ কাজ করসে! ইদ্রিশ আলির তালা লাগানোর তৎপরতা দেখে পঞ্চায়েত প্রধান ইদ্রিশকে শুনিয়ে কথাগুলো বললেন। স্বভাবতই ইদ্রিশ প্রধানের কথায় আশাহত হলো। মনে মনে কিছুটা ক্রোধান্বিত ও ভীত হলো। প্রধানের কথার কোন প্রতিবাদ না করে চুপ করে রইলো।
আসল ঘটনা ছিলো সবার অজানা। বেপাত্তা হওয়ার দিন আয়েশা যখন আজুর খাবার নিয়ে খামার বাড়িতে যায় তখন আজু ওখানে ছিলো না। রেজ্জাক মোল্লা জমিতে কাজ করছিলো। ওখানে পৌঁছেই আয়েশা জিজ্ঞাসা করে," ওরে দেখসি না যে। গেল কই? "
"ওরে আমি একডা কাজে পাঠাইসি। এহনই আইয়া পড়বে। তুমি এক কাজ কর, খাবার খান ঘরের মধ্যে রাইখা আইসো।"—রেজ্জাক বললো।
আয়েশা ঘরের দিকে পা বাড়ায়। দাওয়া পর্যন্ত গিয়ে সে বলে, "দিদিরে তো দেখসি না। পোলাপান সব গ্যাসে কোথায়?"
—ওই ভিতরে রাখ গিয়া। তোমার দিদিরে উয়র বাপের ঘর পাঠাইসি আজুর সাথে পোলাপান লইয়া। আজু অ্যাহনই আইয়া পড়ব। আইবার সময় হইয়া পড়সে। ভিতরে আইসো না, লজ্জা কর ক্যান?"—এই বলে রজ্জাক আয়েশার হাত ধরে ভেতরে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে। আয়েশা হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলে, এ কি করেন আপনে, আপনারে আমি বড়ো ভাইয়ের মত ইজ্জৎ করি। আপনে আমার গায়ে হাত লাগান! ছাড়েন, নইলে আমি চিৎকার কইরা লোক জড়ো করবা।
—তাতে তুমারি ইজ্জৎ নষ্ট হইব। তুমার গায়ে হাত দিসি কি অ্যামনি। অনেকদিন আগেই তুমার উপর আমার নজর পড়সে। আমি কি সাধ কইরা আমার বিবি আর পোলাপানগুলাকে আজুর সাথে বাইরে পাঠাইসি? তুমি জাননা আমার স্ত্রীর লগে আজুর একটা ইয়ে আসে। ইয়ে বোজো তো ? আমি তাই ওরে একটা সূযোগ কইরা দিলাম। আর নিজেও সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ছাড়ুম ক্যান।"
এই বলে রেজ্জাক দরজা বন্ধ করে আয়েশার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। রেজ্জাক ওর গায়ের কাপড় ধরে টানাটানি করে এই বলে,"আজ তোমারে ছাড়ুম না, কাসে যখন পাইসি।"
আয়েশা অনেক অনুনয় বিনয় করে বলে," আমি আপনার মাইয়ার মতন। আমার শ্লীলতাহানি করবেন না।"
—আরে কি কও? তুমার মাথা খারাপ হয় নাই তো? একবার কও বোন, আবার একবার কও মাইয়া। যা পার কও, ওতে আমার কিসু নাই।
কিন্তু কে কার কথা শোনে। ভিতরের পশুটা যখন জেগে ওঠে, তখন তাকে থামানো তো যায়ই না, বরং সে আবার তার কামাগ্নিকে জাগ্রত করে। জিনিসটা পেয়ে খাওয়ার থেকে কেড়ে খাওয়ার আনন্দই আলাদা। কোনক্রমে রেজ্জাক মোল্লার মতো উন্মত্ত ষাঁড়ের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করা কঠিন। বিপদকালে মস্তিষ্ক ঠিক রাখা মুশকিল। অসহায় মহিলার আত্ম রক্ষার্থে কোন কিছুর সাহায্য নিতেই হয়। আয়েশা হঠাৎ একটা কোদাল হাতের সামনে পড়ে থাকতে দেখে। অনন্যোপায় সে কোদালটি তুলে নিয়ে বলে," খবরদার! এক পাও আগাইলে মাইরা ফেলুম।"
এইবলে সে নিজের আবরু বজায় রাখতে গায়ের কাপড় ঠিকঠাক করে নিতে উদ্যত হলো। রেজ্জাক মোল্লা তার হাতের কোদাল চেপে ধরে কেড়ে নিয়ে ফেলে দেবার চেষ্টা করে। আয়েশা মনের শক্তি দিয়ে কোদাল চেপে ধরে তাকে আটকাবার চেষ্টা করে। একদিকে আত্মরক্ষাকারী অপরদিকে আক্রমণকারী এই দুয়ের মধ্যে ধস্তাধস্তিতে কোদালের উপরের অংশ আয়েশার মাথায় সজোরে আঘাত করে। কোদাল ছেড়ে দিয়ে আয়েশা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার মাথা মুখ ক্রমশ ফুলে ওঠে। যন্ত্রণায় ছট্ফট্ করতে করতে কিছুক্ষণ পর তার শরীর নিথর হয়ে যায়। ভয় পেয়ে রেজ্জাক আয়েশার নাকের কাছে হাত দিয়ে তার শ্বাস চলছে কিনা বুজতে চেষ্টা করে। না শ্বাস চলছে না। রেজ্জাক কয়েকবার আয়েশার নাম ধরে ডাকে। নড়াচড়া কিংবা উত্তর কোন কিছুই দেয় না আয়েশা। গতিক খারাপ দেখে পিছনের দরজা দিয়ে তালাচাবি হাতে নিয়ে সে বেরিয়ে গেলো সামনের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিতে,পাছে কেউ এসে পড়ে সেই ভয়ে। বাড়ির পিছনে একটা ঝোপঝাড় ছিলো, তার পাশে কিছু আদলা ইঁট পড়ে ছিলো। রেজ্জাক কোদাল দিয়ে ঝোপঝাড় কাটতে থাকে। মাটি খুঁড়ে গর্ত করে সে আয়েশার দেহটা শুইয়ে দেয়। তার ওপর মাটি চাপা দিয়ে মাটি শুদ্ধ আগাছা গুলো বসিয়ে দিয়ে তার ওপর ওই আদলা ইঁটগুলো জমা করে। তারপর সামনের তালা খুলে পিছনের দরজা বন্ধ করে, সামনের দরজায় আবার তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে এই ভয়ে যে যদি কেউ ঐ মুহুর্তে এসে পড়ে, ওর হাবভাব এবং বাড়ির অবস্থা দেখে কোন কিছু টের পেয়ে যায়। এই মুহূর্তে ও কারো মুখোমুখি হতে চায় না। এর থেকে ও সাময়িক ভাবে মুক্তি পেতে ও নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলতে তার এই বাড়ি থেকে সাময়িক ভাবে বেরিয়ে যাওয়া।
শাহনওয়াজ আয়েশাকে খাবার হাতে জমিতে যেতে দেখেছিলো। তারপর সে তার নির্দিষ্ট জায়গায় আয়েশার ফেরার জন্য অপেক্ষা করছিলো। কিন্তু আয়েশাকে সে ফিরতে দেখেনি। তার মনে প্রথমে উদ্বেগ ও পরে সন্দেহ দেখা দেয়। উদ্বেগ ও সন্দেহ ভঞ্জনের জন্য সে রেজ্জাক মোল্লার বাড়ির দিকে এগোতে থাকলো। রেজ্জাক, আজু কিংবা আয়েশা কাউকেও সে দেখতে পেলো না। জায়গাটা এমনি তে নির্জন। অথচ হাল,বলদ সবই মাঠে পড়ে। রেজ্জাক মোল্লার দরজার কড়ায় তালা ঝুলতে দেখলো। তার মনে হলো আজু, আয়েশা ও রেজ্জাক কোথাও গিয়ে থাকবে। এই ভেবে সে ফিরে এসে আজুর ঘরের দিকে পা বাড়ালো আয়েশা ফিরেছে কিনা তা জানার জন্য। কিন্তু না, আজ্জুর আম্মী কেবল দাওয়ায় বসে আছে হাপিত্যেশ করে। আয়েশা,আজু কেউ নেই। সে বাড়ি ফিরে এসে তার বাবা ইদ্রিশকে সব কথা খুলে বললো। ইদ্রিশ তাকে একটু সমঝিয়ে দিয়ে বললো," তুমি এ ব্যাপারে থাকবা না। একেই তো তোমারে লইয়া নানা লোকে নানা কথা কয়।"
মনে মনে ভাবলো ব্যাপারখানা দেখতে হচ্ছে। তিন চার দিন পর ছেলে সাহনওয়াজকে সঙ্গে নিয়ে ইদ্রিশ রেজ্জাক মোল্লার বাড়ি গিয়ে হাজির। রেজ্জাক বাড়িতেই ছিলো। এমনিতেই সে খুব টেনশনে আছে। ইদ্রিশ হাঁক পাড়লো, "রেজ্জাক বাড়ি আস নাকি?" এই মুহূর্তে তার গলা বাজের মতো শোনালো। ভয়ে রেজ্জাকের হাত পা সেঁদিয়ে যাবার উপক্রম হলো। তার হার্টবিট বেড়ে গেলো। মনে মনে বললো —ঠিক শালা শকুন গন্ধ পেয়েছে। ভাবলো —এরা কিছু ইঙ্গিত পেয়েছে হয়তো। মনে মনে বললো—ভেঙে পড়লে চলবে না। মনকে শক্ত রাখতে হবে। ভালো মানুষের মুখোশ পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললো, "কি খবর, আলিসাহেব? কি ভাগ্য আমার! এক্কেবারে পোলারে সঙ্গে লইয়া---শাদি টাদির ব্যাপার ট্যাপার আসে নাকি?
—না না, উসব কিস্যু না। আইলাম আজুরে খুঁজতে। ওরে তো ঘরে পাইলাম না। তাই ভাবলাম তুমার এহ্যানে আসে। তা তুমারে দেখে এরম লাগতাসে ক্যান?
কথার উত্তর না দিয়ে ভাবলো,
ঘরে ডেকে না বসালে খারাপ দেখায়। মহাজন বলে কথা। বললো, আরে,আসেন,আসেন। ঘরে একটু পায়ের ধূলা দ্যান।
আমার স্ত্রী আবার ঘরে নাই। একটু পানি তো খাইয়া যান।"
ইদ্রিশ ও শাহনওয়াজ তাই চাইছিলো। ইতঃস্তত করে বললো," আবার ঘরে -----তবে যখন বলসেন, চলেন একটৃ বইস্যা যাই। আপনার ঘরে কহনো আসা হয় নাই। তা আপনার স্ত্রী, পোলাপান সব গ্যাসে কুথায়?"
—ও একটু বাপের ঘর গ্যাসে পোলাপান লইয়া। অনেক দিন যায় নাই তো, তাই।
ঘরে ঢুকে শাহনওয়াজ ও ইদ্রিস সব লক্ষ্য করতে লাগলো, কিছু অসঙ্গতি চোখে পড়ে কিনা।। হঠাৎ শাহনওয়াজ খাটের পায়ার কাছে একটা নুপূর পড়ে থাকতে দেখলো,টপ করে কারোর নজরে না পড়ার মতো। এ নুপূর তার বড়ো চেনা। সে আয়েশার পায়ে দেখেছিলো। রেজ্জাকের অলক্ষ্যে ছেলে ইশারা করে নুপূরের দিকে বাপের দৃষ্টি আকর্ষণ করালো। ইদ্রিশ ছেলেকে ইশারা করে হাত দিতে নিষেধ করলো। পা দিয়ে আর একটু ভিতরের দিকে ঢুকিয়ে দিতে ইঙ্গিত করলো, যাতে কারো নজরে না পড়ে তা নিশ্চিত করতে। রেজ্জাক জল আনতে ভিতরে ঢুকলো আর সাহনওয়াজ পায়ে করে নুপূরটা আর একটু ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো।
ইদ্রিশ বলে উঠলো," তোমার ঘরের পিছনের দিকে কি আসে?" বলতে বলতে তারা এক প্রকার জোর করেই পিছনের দরজা দিয়ে বাড়ির পিছনের দিকে গেলো। রজ্জাক তাদের পিছনে যাওয়া আটকাতে পারলো না। মনে মনে বললো, "হায় হায়! সব গেলো!" নানা কথা বলে সে তাদের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরাতে চেষ্টা করলো। সবকিছু অগোছালো ব্যাপার দেখে তাদের মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে লাগলো। আধলা ইঁটের কাছে একটা কোদাল পড়ে থাকতে দেখে ইদ্রিশ বললো, " মনে হইতাসে তুমি এহন কাজ করতা ছিলে? তার কি কাজ করতা ছিলে জানতে পারি?"
"আপনে কি বলতে চান?"—রজ্জাক থতমত খেয়ে বলে।
—আমি কি বলতে চাই তুমি ঠিকই বুজঝ। না বোঝার ভান করসো। তবে শুনো আয়েশা এহ্যানে আইসিলো। আর ফিরিয়া যায় নাই। আজু ঘরে ফেরে নাই। তুমি বল উহারা কুথায়?
—উহারা কুথায় তা আমি জানুম কেমনে?
—শিগগির কইয়া ফ্যালো , না হইলে পুলিশে খবর করতে হইবো।
ইদ্রিশ বেশ মেজাজ নিয়ে বলে। পুলিশের কথা শুনে রেজ্জাক ভয় পেয়ে গেলো। ভাবলো সে বোধহয় ধরা পড়ে গেছে। কিন্তু সে বুঝতে দিলো না। বললো,
" এ তো মহা মুস্কিল। আবার পুলিশ ক্যান ? আমি করসি টা কি?"
"তুমি না কইলে লোকে আমার পোলারে সন্দেহ করে। তুমি স্বীকার করবো, না পুলিশে খবর করতে হইবো?"—ইদ্রিশ রীতিমতো চেপে ধরলো। রজ্জাক মোল্লা এবার ভেঙে পড়লো। বললো," আলি সাহেব আমি একখান বড়ো ভুল কাজ কইরা ফ্যালসি। আমারে বাঁসান। আমি আপনার গুলাম হইয়া থাকুম।"
—আরে কি কইরা ফ্যালসো কও।
সাহনওয়াজ ফোন চালু করে ভিডিও রেকর্ডিং করতে থাকে বাবার ইশারায়। রেজ্জাকের সেদিকে নজর পড়ে নি।
রজ্জাক বলতে শুরু করে,"আয়েশা বাঁইচ্যা নাই। মইরা গ্যাসে। বিশ্বাস করেন আমি ওরে মারি নাই।"
" এ কয় কি!"—ইদ্রিশ অবাক হয়ে বলে।
রেজ্জাক আবার শুরু করে,"ও আমারে মারবা বৈলা কুদাল তুলসিলো। আমি ওর হাত হইতে কাইড়া লইতে গিয়া ওর মাথায় সজোরে লাইগ্যা যায়। ও মাটির উপর পইড়া যায়। আর কুনো সাড়াশব্দ পাই নাই। ওর শ্বাস প্রশ্বাস চলতে ছিলো না। ভাবলাম মইরা গ্যাসে। এই ভাইব্যা ওরে আমি গাড় দিসি ঐহ্যানে।"(আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে।
—আরে করসো কী? তুমার মাথা খারাপ হয় নাই তো?অ্যাহন কী হইবো জানো। যাবৎ জীবন হইবো। চাই কি মৃত্যুদণ্ডও হইতে পারে। আমি বাঁচামু ক্যামনে?
ইদ্রিশ বেশ খানিকটা আশ্বস্ত হলো। আসল ব্যাপারটা হইলো গিয়া এই। তা বেশ। বাকি ব্যাপারটাও ওরে দিয়াই করাইতে হইবো। " তা আজুরে কুথায় পাঠাইসিলে?"—কৌতুহলী ইদ্রিশ জিজ্ঞাসা করলো।
—আজুরে আমার স্ত্রী সাথে পাঠাইসিলাম, ওর বাপের ঘর দিয়া আসনের লগে। ওর বিবিরে দেইখ্যা ঘরে বসাইবার চেষ্টা করতে সিলাম। ও রাইগ্যা আমার উপর কূদাল উঠাইল।প্রাণে বাঁচনের লগে আমি কুদাল খান কাইড়া লইতে চেষ্টা করতে সিলাম। আর এই ঘটনা ঘইট্যা গেলো। অ্যাহন আমি কী করবো কন।
—ভালো কথা। তুমার স্ত্রীর সাথে আজুরে পাঠাও, আজুর স্ত্রীরে লইয়া ফূর্তি করনের লগে।
—এ আপনে কি কথা কন!
—তুমারে আরও পরিষ্কার কইরা বুঝাইয়া দিতাম যদি না আমার পোলাডা এহ্যানে না রইতো। আজুর স্ত্রী তুমারে শুধু শুধু কুদাল দিয়া মারতে শুরু করলো, তুমি কিসু করো নাই। ও শুধু শুধু তোমারে মারতে শুরু করলো,ক্যান? তুমি প্লান কইরাই এসব করসো।এর ফল তো তুমারে ভুগতেই হইবো।
আজু বাঁইচ্যা থাকলে তুমার জেল হাজত, চাই কি ফাঁসি কেউ আটকাইতে পারবা না।
এসময় সাহনওয়াজ মোবাইলে ভিডিও রেকর্ডিং বন্ধ করে বাইরে অনুসন্ধান কার্য চালাতে থাকে। সেই ফাঁকে রেজ্জাক বলে, " আস্সা, আজুরে মাইরা দিলে কেমন হয়? আপনে কী বলেন?
—আমি কী কমু?আরও একটা মার্ডার করতে কমু? তুমার মাথা ফাটসে, তুমি চুন খোঁজ গিয়া। এতে আমার কী? আমি বড়জোর কথা খান পাঁসকান না কইরা,গোপন রাখতে পারি।
ইদ্রিশ পরোক্ষভাবে রেজ্জাকের মনে আজুকে হত্যা করার ভাবনার সলতেটা উস্কে দিয়ে ছেলে সাহনওয়াজকে নিয়ে রেজ্জাকের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। যেতে যেতে তার পরিকল্পনার কথা ছেলে সাহনওয়াজকে বুঝিয়ে দিলো। আজুর বর্তমান মনের যা অবস্থা যতটা না আম্মীর জন্যে তারচেয়ে বেশি আয়েশার জন্যে। আর ও কোন কাজকর্ম করতে পারবে কিনা কে বলতে পারে। এমতবস্থায় ও কর্জের টাকা আর শোধ দিতে পারবে না। আজু মরলে ওর বাস্তুভিটের একটা নিস্পত্তি হবে এবং ওর টাকা ও ফেরৎ পেয়ে যাবে। আর নিলামে খুব বেশি দর না উঠলে, সেও কিনে নিতে পারে অল্প দামে। সুদসহ আসল টাকা বাদ দিয়ে যে টাকা লাগবে তা দিয়ে বাড়িটার দখল নেবে। এবার শুধু অপেক্ষা।
সুযোগ বুঝে সময়ে সময়ে রেজ্জাক আজুকে চাষের কাজের ক্ষতি হচ্ছে বলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে তার বাড়িতে আনার চেষ্টা করতে থাকে সবার অলক্ষ্যে। লোকের চোখে ঠিক থাকার জন্যে সে বলে,"দ্যাখ আজু, তুই কাজ না করলে আমার চলবো ক্যামনে? হয় কাজ কর, না হয় ছাইরা দে, আমি লোক দেইখ্যা লই। তোর যা পাওনা গণ্ডা আসে,আইসা বুইঝ্যা লইয়া যা।" এই বলে সে একদিন সুযোগ বুঝে লোকচক্ষুর অন্তরালে আজুকে বাড়িতে নিয়ে আসে।
"আয় এহ্যানে বয়। কি খাবি ক, সরবৎ খাবি?"—এই বলে সে আজুকে ঘুমের ওষুধ মেশানো এক গেলাস সরবৎ খেতে দেয় এই বলে,"খাইয়া ল, না খাইলে গলা শুকাইয়া মরবি।" এক প্রকার জোর করে আজুকে পানীয় খাইয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই আজু অচৈতন্য হয়ে পড়লে রেজ্জাক আজুর গলায় গামছার ফাঁস দিয়ে মেরে ফেলে। তারপর আয়েশার পাশে গর্ত খুঁড়ে আজুকে শুইয়ে দিয়ে ভালো করে মাটি চাপা দিয়ে দেয় এই বলে —"যা, শাজাহান মুমতাজ পাশাপাশি শুইয়া থাক চিরদিনের জন্য। কিছুই হইলো না। দু দুইটা খুনের দায় মাথার উপর চাইপ্যা রইলো।এহন কী হয় কে জানে!"
ভালোভাবে মাটি চাপা দিয়ে ইঁট গুলো বিছিয়ে দেয়। তারপর সিমেন্ট বালি দিয়ে প্লাস্টার করে দেয়। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে—বলদগুলার জন্য এই ব্যবস্থা। মাথার উপর একটা ছাউনী দিলেই হইলো।
কাজ সমাপ্ত করে রেজ্জাক বাইরে বেরিয়ে এলো এবং ঘুরে বেড়িয়ে অবস্থার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে চেষ্টা করে। কারোর সঙ্গে দেখা হলেই নিজেকে ভালো মানুষ প্রতিপন্ন করতে বলে," এই দ্যাহেন না কী মুশকিলেই না পড়সি! আমার জমিখান আজু আটকাইয়া রাখসে। না পারলে ছাইড়া দে। সব বুঝি, তোর এহন মনের অবস্থা ভালো না। পেট তো শুনবা না। কাম না করলে চলবো? কি যে করি! পড়সি মহা ফ্যাসাদে!"
বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। ইদ্রিশের আর তর সয় না। তার টাকাগুলো আটকে আছে অনেক দিন। পাবার আশাও কম। তাই যতো তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা প্রধানের কানে তোলা যায় ততোই মঙ্গল। কিন্তু নিজে আগ বাড়িয়ে বলতে গেলে বিপদ আছে। রেজ্জাক মোল্লা কিছুতেই তার স্ত্রী, ছেলেপুলেদের এখনি ঘরে আনতে চায় না। তার স্ত্রী দিনরাতে দশবার ফোন করে। রেজ্জাক কখনো ফোন ধরে আবার কখনো ফোন ধরে না। যখন ধরে বলে,"অ্যাহন একদম আইয়ো না। আমি বলদ গুলার থাকার কাম করতাসি। অ্যাহন আইলে তুমাদের অসুবিধা হইব। অ্যাহন আইয়ো না কইয়া দিলাম। এই বলে সে তাদের আসা বন্ধ করে রেখেছে।
কিছুদিন পর ইদ্রিশের একটা সুযোগ এলো পঞ্চায়েতের কানে কথাটা তোলার। একটা দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে। পাশাপাশি কয়েকজন বলাবলি করতে লাগলো। যারাই রেজ্জাকের বাড়ির পাশ দিয়ে যাতায়াত করে তারা নাকেমুখে হাত চাপা দিয়ে যায় এবং রেজ্জাকের বাড়ির দিকে ইঙ্গিত করে। ইদ্রিশের সুবিধা হয় কথাটা প্রধানের কানে তোলার।
"সালাম আলেইকুম, প্রধান সাহেব।
—আলেইকুম সালাম।
—আইলাম একটা কথা আপনারে জানাইবার জন্য। রেজ্জাক মোল্লার বাড়ির আশেপাশে একটা দুর্গন্ধ বের হইতাসে। লোকে নাকে মুখে হাত চাপা দিয়া যাতায়াত করত্যাসে। একবার দ্যাখবেন নাকি।"
— হ্যাঁ, যাওয়া যাইতেই পারে। আপনিও চলেন, কোথায় কী গন্ধ লাগতাসে দ্যাখাইয়া দিবেন। ইদ্রিশ ভাবে প্রধানের সঙ্গে তাকে কেউ দেখলে রেজ্জাকে বলে দেবে। রেজ্জাক তখন তাকে সন্দেহ করবে। ভাববে সেই প্রধানকে নিয়ে এসেছে।
তাই সে প্রধানের কথায় আপত্তি জানিয়ে বলে," আমি যাইতে পারুম না। আমার আবার দুর্গন্ধ সহ্য হয় না। একবার নাকে যাইলে, খাওয়া দাওয়া মাথায় উঠুম। এই বলে সে এড়িয়ে যায়।
রেজ্জাক প্রায়ই ঘরে তালা ঝুলিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। রাতে চোরের মতো বাড়ি ঢোকে আবার ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যায়। কাজকর্ম সব মাথায় উঠেছে। পরের দিন সকালবেলায় প্রধান দু একজনকে সঙ্গে নিয়ে গ্রাম পরিদর্শনে বের হলো। রেজ্জাকের বাড়ির আশপাশে যেখান থেকে দুর্গন্ধটা ছড়িয়ে পড়ছে প্রধান নাকেমুখে চাপা দিয়ে বলতে লাগলো," দুর্গন্ধটা মনে হইতাসে রেজ্জাকের বাড়ি হইতেই আইতাসে। দ্যাখতাসি তো রেজ্জাক বাড়ি নাই। তালা দেওয়া। ব্যাপারটা কী রকম হইলো। কোন গরু টরু মরে নাই তো? রেজ্জাক কি ঘরে ফেরে না?" একজন বলে,"ফেরে, তবে অধিক রাতে। ভোরের আগে বের হইয়া যায়।"
"অধিক রাতে ফেরে আবার ভোরের আগে বের হইয়া যায়! ব্যাপারটা তো ঠিক লাগতাসে না। তা হইলে ওর কুনো বিপদ টিপদ হইলো? নাকি কুনো কালা ধান্দা - টান্দা করতাসে? আমাদের জানা দরকার।"—প্রধান মন্তব্য করলো।
রেজ্জাক এখনো ধরা না পড়েই ফেরারী আসামীর মতো পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সে দু একজনকে চর হিসেবে ব্যবহার করে গ্রামের খবরাখবর সংগ্রহ করে। চরেরাই গ্রাম প্রধানের গ্রাম পরি দর্শনের খবর রেজ্জাককে পাচার করে। রেজ্জাক সে রাতে আর বাড়ি ফেরে না। এদিকে গ্রামবাসীদের অভিযোগের ভিত্তিতে প্রধান পুলিশকে জানাতে বাধ্য হয়। পুলিশ আসে। পঞ্চায়েত ও গ্রামবাসীদের সমক্ষে রেজ্জাকের ঘরের তালা ভাঙে। ইদ্রিশ ও তার ছেলে পাঁচজনের সঙ্গে ঘরে ঢোকে। ঘরের দরজা খুলতেই দুর্গন্ধটা আরো প্রকট হয়। ঘর দোরের খানা তল্লাশি শুরু হয়। ইদ্রিশ ও শাহনওয়াজের মধ্যে চোখের ইশারা হয় ওই নুপূরের প্রতি পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য।
"স্যার, একটা জিনিস দ্যাখেন। একটা নুপূর পইড়া আসে ঘাটের নীচে।"—শাহনওয়াজ পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। পুলিশ নুপূরটি বাজেয়াপ্ত করে। তারপর বাড়ির পিছনের দিকে যেতেই দুর্গন্ধে আর টেকা যায় না। পুলিশ কর্তার নির্দেশে সদ্য প্লাস্টার করা চাতাল খোঁড়া শুরু হলো। আবিষ্কৃত হলো দু দুটি লাস। একটি আয়েশার এবং অপরটি আজুর। লাস দুটি মর্গে পোস্টমর্টেমের জন্যে পাঠানো হলো। সেই থেকে রেজ্জাক ফেরার। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে প্রকাশ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলে আয়েশার মৃত্যু হয়। আজুকে প্রথমে হেভি ডোজের ঘুমের ওষুধ ও পরে শ্বাসরোধ করে মারা হয়। রেজ্জাকের নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি হলো। পোস্টমর্টেম রিপোর্টের এক কপি থানায় ও আর এক কপি পঞ্চায়েতের কাছে জমা দেওয়া হলো।
ইদ্রিশ আলি তদবির করে আজুর ঘর নিলামে তোলার ব্যবস্থা করে। এ ব্যাপারে তার আর তর সইছে না। যেহেতু আজুর কোন উত্তরসুরি নেই অর্থাৎ কোন ওয়ারিশন নেই, প্রধান এই নিলাম ডাকে। গ্রামের কেউ এই ঘর নিতে রাজি হলো না। কারণ, অভিশপ্ত বাড়ি কেউ কিনতে রাজি নয় , একমাত্র ইদ্রিশ ছাড়া। ইদ্রিশের উদ্দেশ্য সুদসহ ধার দেওয়া টাকার কিছু বেশি দিয়ে বাড়িটি হাতিয়ে নেওয়ার। তাই সে সুদসহ আসল ও কুড়ি হাজার টাকা অতিরিক্ত অর্থাৎ ৬০,০০০+২০,০০০=৮০,০০০
টাকা বাড়িটির দাম দেয়। প্রধান হাঁকতে থাকেন আশি হাজার। বাদ সাধলো গ্রামের এক জোতদার লিয়াকত আলি, যে ইদ্রিশের প্রধান শত্রু। বাড়ি কেনার উদ্দেশ্য তার নেই। তার উদ্দেশ্য সুদখোর ইদ্রিশকে কমদামে বাড়িটা কিনতে না দেওয়া। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আছে ইদ্রিশ কী দাম দেয়। ইদ্রিশকে বাড় খাইয়ে দামটা বাড়িয়ে দেওয়া। ইদ্রিশ আশি হাজার দাম দিলে, লিয়াকত এক লাখ টাকা দাম হেঁকে বসে। কুড়ি হাজার দাম বেড়ে গেলে ইদ্রিশের মুখ শুকিয়ে যায়। সে ভেবে ছিলো কুড়ি হাজার টাকা দিয়ে সম্পত্তিটা কিনে নেবে। আরো বিশ হাজার টাকা বেড়ে যাওয়া তে একটু চিন্তায় পড়ে গেলো। মনে মনে ভাবলো এই হতভাগা তার পাকা ধানে মই দিতে এসেছে। কিন্তু সে হারবে না। প্রধান হাঁকলো এক লাখ। ইদ্রিশ সম্মান আর মর্যাদার কথা ভেবে হাঁক পাড়লো এক লাখ পাঁচ। প্রধান আবার হাঁকলো এক লাখ পাঁচ। লিয়াকত আর উড়লো না। অতএব লিয়াকতের জন্য ইদ্রিশকে আরও পঁচিশ হাজার অতিরিক্ত মূল্যে দিতে হলো। অর্থাৎ পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে ইদ্রিশ আজু ওরফে আজম আলি মণ্ডলের সম্পত্তি গ্রাস করে নিলো। সমস্ত টাকা পঞ্চায়েতে জমা পড়লো। যদি কখনও কোন প্রকৃত ওয়ারিশনের সন্ধান মেলে তার হাতে তুলে দেওয়া হবে ওই টাকা। রেজ্জাক মোল্লা জোড়া খুনের ফেরারী আসামি, সম্ভাব্য যাবজ্জীবন অথবা মৃত্যুদণ্ডের কথা ভেবে সে গা ঢাকা দিয়েছে। পুলিশ তার বাড়ি বাজেয়াপ্ত করেছে। আর পঞ্চায়েতকে অনুরোধ করেছে বলদ গুলোর দেখভাল করার, প্রয়োজনে পঞ্চায়েত বলদ দুটোকে কাজে লাগাতেও পারে।
========================
Samir Kumar Dutta
23/1/A, Mohanlal Bahalwala Road
P.O. Bally, Dist. Howrah 711201