
ঢোল
প্রতীক মিত্র
ঢোলটায় কি ধুলো জমেছে? কাছে গিয়ে দেখলে হয়তো ঝুলও মিলতে পারে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে বাথরুম যেতে হয়েছিল বিনুকে। জলতেষ্টাও ছিল। ফলে আধ গেলাস জলও শেষ করার পর ঘুম ঘুম ভাবটা আর ততটা যেন ছিল না। আর তখনই ওর চোখ গেল ঢোলটায়। এখন ওর বছর একুশ বয়স। কলেজে সেমিস্টার পরীক্ষার ফাঁকেই ক্যাম্পাসিং হয়ে গেছে। এই বাজারে বেশ ভালো মাইনের চাকরি মেলার পর ছোটোখাটো পার্টিও আজ হয়ে গেছে সন্ধ্যেতে।বাবা-মা-ঠাকুমা ছাড়া সেই পার্টিতে টিয়াও ছিল।ওর অস্বস্তি ছিল টিয়াকে বাড়িতে ডাকা নিয়ে। বাবা কি বলবে ইত্যাদি ইত্যাদি।তাছাড়া সম্পর্কের একটা টানাপোড়েন তো আছেই।মা-ই বললো ডাকতে তাই…যাজ্ঞে সব ভালোয় ভালোয় শেষ হওয়ার পর ঢোলটা যেই ঘরে সেই ঘরে টিয়াকে এনে ওর সব ছোটোবেলার খেলনা ইত্যাদি দেখানোর সময় টিয়াই একটু অন্তরঙ্গ হতে চাইলে বিনুই সংযম হারায়। কয়েকটা মুহূর্ত। মধুর বড় মধুর। টিয়ার গায়ের সুগন্ধ এই এখনও মাঝরাতেও নাকে লেগে আছে। টিয়ারই নাকি প্রথম চোখ গিয়েছিল ঢোলটার দিকে। ঢোলটা নাকি খুব সুন্দর !কে দিয়েছে কবে কেনা ইত্যাদি জানতে চেয়েছিল সে।রাতেও ঘুম ভেঙে বিনুর মনোযোগ তাই কি ওই ঢোলের দিকেই গেল?হুক থেকে নামানোর পর দেখলো না ধুলো পড়েনি।বরং রঙটা বেশ উজ্জ্বল আর ওজনেও ভারীও বেশ। কে দিয়েছে?কবে?সত্যিই তো ! একদমই মনে আসছে না। তাছাড়া হাতে নিতেই কেমন যেন মনে হল ঢোলটা বেজে উঠলো?না না এটা মনের ভুল।তাই বা কি করে হবে?রাত-বিরেতে কুকুরের ঘেউঘেউ ছাড়া আর তো কিছু কানে আসার নয়।তাহলে?ওর যেন খুব স্পষ্ট মনে হল কানে ঢোলের আওয়াজ। ঢোল না বাজালে বেজে ওঠে নাকি?এমন তো কখনো শোনেনি ও। জলতেষ্টাটা আবার ফিরে এলো।জল খেয়ে এসে আবার ঢোলের কাছেই ফিরে এলো সে। ঢোলটা যেন সম্মোহিত করেছে ওকে।আরে দুটো কাঠিও রাখা! কোথা থেকে এলো? বাজাবে?ভোররাত। এখন এইসব বাজালে যে লোকে পাগল বলবে, রাগ করবে এইসব ওর মাথাতেই এলো না। ঢোলটা ওকে মুগ্ধ করেছে। ছোটোবেলায় সেই সিনেমায় দেখেছিল বাঘার ঢোল। আর এখন ওর এই ঢোল। গলায় ঝুলিয়ে নিল।দিল কাঠির ঘা। বেজে উঠলো ঢোল। সে কি সুর!বিনু জানতোই না যে ওর এই গুণও আছে।প্রথমে দাঁড়িয়ে তারপর দুলে দুলে ও ঢোল বাজিয়েই চললো। মা এলো, বাবা এলো, ঘুম থেকে উঠে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এলো ঠাকুমা!নাতির একি দশা!দুলে দুলে ঢোল বাজিয়েই চলেছে না জানি সেই কখন থেকে। এ কোন অলক্ষুনে দৃশ্য!ফেলে দে ফেলে দে ওই ঢোল বিনু!ওরা চিৎকার করতে লাগলো।কিন্তু কে শোনে কার কথা।বিনু তখন শুধু ঢোলের সুরে মগ্ন। প্রতিবেশিদের কানেও ততক্ষণে গেছে বিনুর ঢোলের আওয়াজ।
মাস চারেক অতিক্রান্ত। বিনু এখনো চিকিৎসাধীন। এখনো মাঝে মাঝেই ওর মনে হচ্ছে ঢোলটা নাকি ওকে ডাকছে। বন্ধুরা দেখে গেছে।টিয়াও ফোন করেছিল।ওর আর আসা হয়নি। তাড়াতাড়ি চাকরিতে জয়েন করার ছিল। এমারজেন্সি। কোম্পানিই তাড়া দিচ্ছিল। বিনুর চাকরিটাই টিয়া পেয়েছে।আবারো ইন্টারভিউ দিয়ে। নিজের যোগ্যতায়। বিনু যে হঠাৎ করে মানসিক ভারসাম্য হারালো কি করে?হ্যাঁ একটা কোন ঢোলের বিষয় সব বন্ধুরা বলাবলি করছিলো। বিনু নাকি বিনুর বাবা-মায়ের কাছেও জানতে চেয়েছিলো ওই ঢোলটা কে আর কবে ওকে দিয়েছিল। বাড়ির লোকেরা কেউই সঠিক বলতে পারেনি। বলতে পারার কথাও নয়।কেননা ওই ঢোল ও বাড়িতে সেদিনই প্রথম ঢুকেছিল যেদিন টিয়া গিয়েছিল। যাক!সেটা তখনো কেউ জানতে পারেনি আর এখনো নয়। ওই ঢোল ঘর থেকে নাকি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।বোধ হয় পুড়িয়েও ফেলা হয়েছে।বেশ বেশ তা ভালো।বিনু জলদিই সেরে উঠুক।খালি ব্যস্ততায় টিয়ার ওকে আর দেখতে যাওয়াটা হল না। দামী চাকরি বলে কথা!
=========