ধারাবাহিক উপন্যাস ।। মাধব ও মালতি (পর্ব -৫) ।। সমীরণ সরকার
0
এপ্রিল ০১, ২০২৫
মাধব ও মালতি
সমীরণ সরকার
(পাঁচ)
মানবেন্দ্র নারায়ণ ভোগী পুরুষ ।ষড়রিপুর প্রথম ও তৃতীয় রিপুটির কাছে আত্মসমর্পণ করেও নিয়মিত শরীরচর্চা ও খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে কিছু বিধি নিষেধ মেনে চলায় সাতষট্টি বছর বয়সেও তাঁকে দেখে তাঁকে পাঁচের ঘরের মাঝামাঝি বয়সের বেশি বলে মনে হয় না।
কনক নারায়ণের মা অর্থাৎ মানবেন্দ্র নারায়ণের ঠাকুরমা বিধুমুখী দেবীর ইচ্ছা পূরণ করতে মাত্র আঠারো বছর বয়সে বিয়ে হয় মানবেন্দ্র নারায়নের। তখন তাঁর স্ত্রী হৈমন্তীর বয়স ছিল মাত্র চোদ্দ বছর। হৈমন্তীর দিদিমা চন্দ্রপ্রভা ছিলেন বিধুমুখীর সই। শেষ বয়সে দুই সখী নিজেদের সম্পর্কটাকে মজবুত ও চিরস্থায়ী করার জন্য আত্মীয়তার সম্পর্কে আবদ্ধ হন। একজনের নাতি, আরেকজনের নাতনী, বিয়ের পাত্র ও পাত্রী ।
এই বিয়েতে কনক নারায়ণ বা তার স্ত্রী রত্ন মালার মত না থাকলেও বিধুমুখীর ইচ্ছেটাকে অমর্যাদা করার সাহস বা ইচ্ছা কারোরই ছিল না। তাই আঠারো বছরের মানবেন্দ্র নারায়ণের সঙ্গে চোদ্দ বছরের হৈমন্তীর বিয়ে হয়ে গেল।
হৈমন্তী রূপবতী হলেও তার শারীরিক গড়ন একটু পাতলা ধরনের ছিল। বিয়ের কিছুদিন আগে সে রজোদর্শন করলেও সে স্ত্রী- পুরষের দৈহিক সম্পর্কের ব্যাপারে ছিল অনভিজ্ঞ। তাছাড়া শারীরিক গড়নের দিক দিয়ে সে একটু রোগা থাকায় পরিপূর্ণ নারীর রূপ তখনও তার মধ্যে বিকশিত হয়নি। অথচ মানবেন্দ্র নারায়ণের চাহিদা ছিল মারাত্মক।
মাত্র ষোল বছর বয়সে সে চৌধুরী ভিলার দীর্ঘদিনের রাঁধুনী কমলাপুর গ্রামের এক পুরোহিত ব্রাহ্মণের বিধবা আশালতার ছোট মেয়ে বাল বিধবা পূর্ণিমার প্রতি আকৃষ্ট হয়। পূর্ণিমার বয়স তখন বাইশ বছর। পূর্ণিমার চাঁদের মতোই তখন সে পরিপূর্ণ। দেহের কানায় কানায় উছলে পরা যৌবন। পূর্ণিমা মায়ের সঙ্গে কাজ করতে আসতো চৌধুরী ভিলায়। একদিন হঠাৎ নজরে পড়ে মানবেন্দ্র নারায়ণের। পূর্ণিমার পূর্ণ যৌবন মানবেন্দ্র নারায়ণের মনে ঝড় তোলে। কারণে অকারণে যখন তখন চৌধুরী ভিলার রন্ধনশালায় যাতায়াত শুরু হয় মানবেন্দ্র নারায়ণের। এমনকি কখনো সখনো কমলাপুর গ্রামে আশালতার বাড়িতেও হানা দিতে শুরু করেন মানবেন্দ্র । সুযোগ পেলেই পূর্ণিমা কে জড়িয়ে ধরা, দুই হাতের বেষ্টনীতে বুকের মাঝে যুবতী পূর্ণিমা কে বন্দি করে আদর করা ইত্যাদি প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। চৌধুরী ভিলার ভবিষ্যৎ মালিক মানবেন্দ্র নারায়ণের কাছ থেকে পাওয়া এই উপহার যুবতী পূর্ণিমার মনেও ঝড় তোলে। তাই মানবেন্দ্র নারায়ণের ডাকে সাড়া দেয় সে। দুজনের দৈহিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
ব্যাপারটা একদিন নজরে আসে আশালতার। খুব ভীত হলেন তিনি।চৌধুরী ভিলার চাকরি খোওয়ানোর ভয় ছাড়াও অন্য ভয় ছিল তাঁর। চৌধুরী ভিলার বড়বাবু অর্থাৎ মানবেন্দ্র নারায়ণের বাবা কনক নারায়ণ সমাজসেবা ও রাজনীতির কাজে ব্যস্ত থাকায় সংসারের দিকে দৃষ্টি কম দিলেও,তাঁর স্ত্রী রত্না মালা খুব কড়া ধাতের মানুষ ছিলেন এবং সংসারের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ের দিকে প্রখর নজর দিতেন। আশালতা বুঝলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণের এই পূর্ণিমা প্রীতি বন্ধ করতে না পারলে ব্যাপারটা একদিন চৌধুরী ভিলার কোনো না কোনো কাজের লোকের মাধ্যমে পৌঁছে যাবে গিন্নিমার কানে। আর তাহলে কোন কঠিন শাস্তি পেতে হবে তাঁকে ও তাঁর মেয়েকে। যেমন করে হোক এটাকে বন্ধ করতেই হবে।
আশা লতা খুব ছোট বয়স থেকে দেখেছে মানবেন্দ্র নারায়ণকে। বলতে গেলে একরকম তার কোলে পিঠে বড় হয়েছে মানবেন্দ্র নারায়ন। তাই চৌধুরী ভিলার এই ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীকে সুপথে চালিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন । একদিন কমলাপুর গ্রামে কালীপুজো উপলক্ষে মানবেন্দ্র নারায়ণ যখন তাঁর বন্ধুবান্ধব নিয়ে কমলাপুরে গেছিলেন, আশালতা সুযোগ মতো তাকে নিজের বাড়িতে ডেকে নিয়ে সরাসরি বিষয়টি উত্থাপন করে মানবেন্দ্র নারায়ণকে পূর্ণিমার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করার জন্য হাতে ধরে অনুরোধ করলেন। মানবেন্দ্র কিছুতেই বুঝতে চাইলেন না। শুধু তাই নয়, তিনি পূর্ণিমাকে বিয়ে করার জন্য আশালতার অনুমতি চাইলেন। আশালতা হা হা করে উঠলেন। এমনকি মানবেন্দ্র নারায়ন কে হাতে ধরে অনুরোধ করলেন, পূর্ণিমাকে ভুলে যাওয়ার জন্য।
এই ঘটনার পরে বেশ কয়েকদিন কেটে গেলেও আশা লতা মানবেন্দ্র নারায়ণ ও তার কন্যার ঘনিষ্ঠতা কমার কোন লক্ষণ দেখতে পেলেন না।
তখন বাধ্য হয়ে তিনি পুরো ব্যাপারটা বিধুমুখীকে জানালেন। বিধুমুখী একমাত্র নাতি মানবেন্দ্র নারায়ণ কে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। কিন্তু তার এই অধঃপতনের কথা শুনে চমকে উঠলেন।
তিনি আশা লতা কে অনুরোধ করলেন, পুরো ব্যাপারটা যেন লোক জানা জানি না হয়। বিধুমুখী মানবেন্দ্র নারায়ণকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর পিত্রালয় মেদিনীপুরে বেড়াতে গেলেন।
(চলবে)