ধারাবাহিক উপন্যাস ।। মাধব ও মালতি ( পর্ব- ৬) ।। সমীরণ সরকার
0
মে ০১, ২০২৫
মাধব ও মালতি
সমীরণ সরকার
পূর্ব কথা :--- রাজপুর একটি প্রাচীন বর্ধিষ্ণু গ্রাম
ওই গ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক ইতিহাস, অনেক কাহিনী। রাজপুর বর্তমানে অনেক উন্নত হয়েছে। এখানে এখন থানা ,ব্লক অফিস ,পোস্ট অফিস, স্কুল ,হাসপাতাল ব্যাংক এ সমস্তই আছে। রাজপুরের বিখ্যাত মিষ্টির দোকান 'যশোদা মিষ্টান্ন ভান্ডার'। এই দোকানটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হরপ্রসাদ সরকার।। প্রায় পনের বছর আগে শ্রাবণ মাসের এক সোমবারে তারকেশ্বরে বাবা মহাদেবের মাথায় জল ঢালতে গিয়েছিলেন হরপ্রসাদ সরকার আর তাঁর স্ত্রী পদ্মাবতী। পদ্মাবতী প্রতিবছরই তারকেশ্বর যান। কাজেই স্থানীয় দোকানদারদের অনেকেই ছিল তাঁর পরিচিত। ওখানেই হঠাৎ তিনি একটি বছর ছয়-সাতের অনাথ ব্রাহ্মণ বালকের দেখা পান। পরিচিত দোকানদারের মুখে জানতে পারেন যে, বছরখানেক আগে ছেলেটি তার মায়ের সঙ্গে তারকেশ্বরে এসেছিল। এখানেই ছেলেটির মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান। ছেলেটি তার পরিচয় বলতে পারেনি, ঠিকানাও জানতো না।
শুধু ওর হাতে উলকি দিয়ে নাম লেখা আছে 'মাধব'। পদ্মাবতী স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলার পর মাধবকে সঙ্গে নিয়ে রাজপুরে ফিরে আসেন। সেই মাধবের বয়স এখন ২২ বছর। সে এখনো রাজপুরেই আছে। 'যশোদা মিষ্টান্ন ভান্ডার' অনেক বড় হয়েছে। হরপ্রসাদের ছেলে নবীন সরকার বর্তমান মালিক। মাধব তাকে দোকানের কাজে সবরকম সাহায্য করে। মাধব শিব ভক্ত যুবক। একদিন সকালে স্নান সেরে রাজপুরের বিখ্যাত শিব মন্দির চন্দ্রশেখর মন্দিরে শিবের মাথায় জল ঢালতে গিয়ে মন্দিরের বৃদ্ধ পুরোহিত নৃপতি চক্রবর্তী মাধবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় তাঁর তরুণী নাতনি তিস্তার।
যদিও তিনি মাধব এবং তিস্তাকে এটাও মনে করিয়ে দেন যে, বহু বছর আগে কিশোর মাধব একবার তার বালিকা নাতনি তিস্তা কে জলে ডুবে যাওয়া অবস্থা থেকে বাঁচায়।
ইংরেজ আমলে ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে বাঁকুড়াকে সদর কার্যালয় করে জঙ্গলমহল জেলা প্রতিষ্ঠিত হয় । সেই সময় ভাগ্য অন্বেষণে গঙ্গানারাযণ মিশ্র নামে এক যুবক উড়িষ্যার বালেশ্বর থেকে বাঁকুড়ায় আসেন। তিনি কাঠের ব্যবসা করে ধীরে ধীরে ধনী হয়ে ওঠেন। তাঁর পুত্র প্রতাপ নারায়ণ মিশ্র পদবী বদলে হলেন, প্রতাপ নারায়ন চৌধুরী। সাহেবদের সঙ্গে তিনি খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি শুধু ধনসম্পত্তি বাড়ালেন তাই নয়, সাহেবদের সহায়তায় জমিদার হয়ে বসলেন। প্রতাপ নারায়ণ বাঁকুড়া শহর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে দশ বিঘা জমির উপর তৈরি করেন এক বিশাল অট্টালিকা 'চৌধুরী ভিলা'। শুধু তাই নয়, তিনি সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন 'কমলাপুর' নামে একটি গ্রাম এবং 'কমলা সায়র' নামে একটি বাইশ বিঘার জলাশয়।
প্রতাপ নারায়ণের পুত্র কনক নারায়ণ রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ করেন এবং অল্প দিনের মধ্যেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তিনি আদর্শবাদী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন।
তাঁর পুত্র মানবেন্দ্র নারায়ণ তাঁর বাবার রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন রকম শিল্প এবং ব্যবসার লাইসেন্স বের করে ধন সম্পদ বৃদ্ধি করতে থাকেন । কিন্তু তাঁর কোন আদর্শ ছিল না । কনক নারায়ণ পুত্রের এই আচরণে মনকষ্টে ভুগতেন এবং মাত্র পঁয়ষট্টি বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।
মানবেন্দ্র নারায়ণ ছিলেন ভোগী পুরুষ। কিন্তু তিনি প্রৌঢ় বয়সেও যথেষ্ট শক্ত সামর্থ্য ছিলেন।
মানবেন্দ্র নারায়ণের ঠাকুমা বিধুমুখী দেবী তাঁর সই চন্দ্রপ্রভার নাতনি মাত্র চোদ্দ বছর বয়সী হৈমন্তীর সঙ্গে বিয়ে দেন তাঁর আঠারো বছরের পৌত্র মানবেন্দ্র নারায়নের। কিন্তু তার অনেক আগে মাত্র ষোল বছর বয়সে মানবেন্দ্র নারায়ণ 'চৌধুরী ভিলার' দীর্ঘদিনের রাঁধুনি আশালতার বিংশতি বর্ষীয়া বাল বিধবা সুন্দরী কন্যা পূর্ণিমার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। আশালতা মানবেন্দ্র নারায়ণকে নানা রকম ভাবে বুঝিয়ে এবং অনুরোধ করেও এই অসম এবং অনৈতিক সম্পর্ক গড়ার থেকে বিরত করতে পারেননি। শেষে নিতান্ত বাধ্য হয়ে তিনি বিধুমুখী দেবীকে সবটা জানান। বিধুমুখী মানবেন্দ্র নারায়ণকে সঙ্গে নিয়ে পিত্রালয়ে বেড়াতে যান।
ছয়
বিধুমুখী দেবী তাঁর পৌত্র মানবেন্দ্র নারায়ণকে সঙ্গে নিয়ে পিত্রালয়ে গেলেন। এর মূল উদ্দেশ্য যদিও ছিল মানবেন্দ্র নারায়ণ কে কিছুদিনের জন্য পূর্ণিমা থেকে দূরে রাখা, কিন্তু তিনি তাঁর পুত্র এবং পুত্রবধূকে সে কথা জানালেন না। বিধুমুখী দেবীর বাবা কমলা চরণ ভট্টাচার্য বহুকাল আগে পরলোকগমন করলেও তাঁর মা সুনয়নী দেবী তখনও জীবিত ছিলেন। মাকে দেখতে যাওয়ার অজুহাতে বিধুমুখী পিত্রালয়ে গেলেন।
বিধুমুখী দেবীর পিত্রালয় ছিল অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার গড়বেতায়। তখন গড়বেতা একটি প্রাচীন ও বর্ধিষ্ণু গ্রাম হিসেবে পরিচিত ছিল।
বিধুমুখী দেবীর পিত্রালয়ে তাঁর মা ছাড়াও দুই দাদা, এক ভাই এবং তাঁদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা ছিলেন। সবাই যৌথ পরিবারে বসবাস করতেন।বিধুমুখী দেবীর বড় দাদা তারাপ্রসাদ পুজার্চনা এবং পৌরহিত্যের কাজ করেন। মেজ ভাই শংকরীপ্রসাদ পারিবারিক জমি চাষাবাদের কাজ দেখাশোনা করেন। বিধুমুখী দেবীর কনিষ্ঠ ভাই অম্বিকা প্রসাদের একটি পাঠশালা ছিল। ওই পাঠশালা থেকে উপার্জন খুব বেশি না হলেও গড়বেতা গ্রামে পাঠশালার শিক্ষক হিসেবে তাঁর বেশ খাতির ছিল। বিশেষ করে তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের পিতারা তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন।
বিধুমুখী দেবী তাঁর বাপের বাড়িতে কালেভদ্রে আসতেন। সাধারণত পারিবারিক কোন উৎসব অনুষ্ঠান হলে তিনি আসতেন। তবে তিনি যখনই আসতেন পরিবারের ছোট বড় সব সদস্যদের জন্য দামি উপহার আনতেন। তাছাড়া তার বাপের বাড়ির সদস্যরা সবাই জানতেন যে, বিধুমুখী দেবীর স্বামী কনক নারায়ণ রাজনৈতিক ক্ষমতাশালী এবং ধনাঢ্য ব্যক্তি।
সেই হিসাবে পিত্রালয়ে বিধুমুখীর বেশ খাতির ছিল। তবে তিনি সাধারণত পারিবারিক কোনো উৎসব অনুষ্ঠানে যোগদান করা ছাড়া পিত্রালয়ে আসতেন না । কাজেই হঠাৎ কোনো খবর না দিয়ে ,পৌত্র মানবেন্দ্র নারায়ণকে সঙ্গে নিয়ে বিধুমুখী পিত্রালয়ে আসায় সবাই বিস্মিত হলেও, আচার-আচরণে বা কথাবার্তায় সেই ভাব কেউ প্রকাশ করল না।
এই গড়বেতা গ্রামটি বেশ প্রাচীন ও বর্ধিষ্ণু। গড়বেতার অতীত ইতিহাস আলোচনা প্রসঙ্গে শ্রী যোগেশচন্দ্র বসু মহাশয় তাঁর রচিত 'মেদিনীপুরের ইতিহাস' গ্রন্থে লিখেছেন--------
" বগড়ীর রাজাদের রাজধানী প্রথমে গড়বেতা গ্রামে ছিল,পরে তারা গোয়ালতোড় গ্রামে উহা স্থানান্তরিত করেন; এক্ষণে তাঁহাদের অধস্তন পুরুষগণ মঙ্গলাপোতা গ্রামে বাস করিতেছেন। বর্তমান সময়ে গড়বেতার পূর্ব সমৃদ্ধির বিশেষ কোনো চিহ্ন নাই।বগড়ীর অন্যতম নরপতি রাজা তেজচন্দ্র নির্মিত প্রসিদ্ধ রায়কোটা দুর্গটি কালে চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া বন গুল্মলতা সমাদৃত প্রস্তররূপে পরিণত হইয়াছে ;আর যে সকল বজ্রনিনাদ কামান দুর্গ প্রাকারোপরি সজ্জিত হইয়া শত্রু হৃদয়ে ভীতি নিক্ষেপ করিত তাহা ইংরাজ- রাজ
ঐ স্থান হইতে অপসারিত করিয়াছেন। শিলাবতী নদীর পূর্ব পার্শে গড়বেতার সেই পরিখা বেষ্টিত দুর্গ প্রাকারের ধ্বংসাবশেষ দৃষ্ট হয়। দুর্গের চারিদিকে উত্তরে লাল দরজা, পূর্বে রাউত দরজা, দক্ষিণে পেশা দরজা ও পশ্চিমে হনুমান দরজা নামে যে চারিটি সুবৃহৎ সিংহদ্বার শোভা পাইত অদ্যাপি দু এক স্থানে সেগুলির ভগ্নাবশেষ আছে।"
"পূর্বোক্ত রায়কোটা দূর্গের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত মহাশক্তি সর্বমঙ্গলা দেবীর নির্মিত মন্দিরটি গড়বেতার অন্যতম প্রাচীন কীর্তি। কিন্তু কতদিন হইল এবং কাহার দ্বারা যে উহা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল তাহা সঠিক বলা যায় না। কেউ কেউ বলেন, বগড়ীর প্রথম রাজা গজপতি সিংহ উহার প্রতিষ্ঠাতা; আবার কেহ কেহু বলেন উজ্জয়িনীপতি রাজা বিক্রমাদিত্য যখন মধ্য ভারতের শাসন দণ্ড পরিচালনা করিতেন সেই সময় জনৈক সিদ্ধ পুরুষ বগড়ীর বনপ্রদেশে এই দেবী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। রাজা বিক্রমাদিত্য দেবীর অলৌকিক শক্তির বিষয়ে লোকমুখে অবগত হইয়া গড়বেতায় সমবেত হন এবং দেবীর মন্দির মধ্যে শব -সাধনে নিরত হন। দেবী তাঁহার সাধনায় পরিতুষ্ট হইয়া তাঁহাকে তাল-বেতাল নামে অলৌকিক তেজ সম্পন্ন দুই অনুচরের উপর আধিপত্য লাভের অধিকার প্রদান করেন। রাজা আপন সফলতা প্রত্যক্ষীভূত করিবার মানসে দেবীর অনুমতিক্রমে তাল বেতালকে মন্দির দ্বার পূর্ব দিক হইতে উত্তর দিকে পরিবর্তিত করিবার আদেশ করিবা মাত্র উহা পরিবর্তিত হইয়া যায়।
জনশ্রুতি, এই কারণে সর্বমঙ্গলা দেবীর মন্দিরের দ্বার উত্তর দিকে অবস্থিত; সচরাচর কোন হিন্দু মন্দিরে এরূপ দেখা যায় না।" "সর্বমঙ্গলা মন্দিরের গঠন প্রণালী দেখিলে আশ্চর্যান্বিত হইতে হয়।। দ্বারযোগে মন্দিরের মধ্যে ত্রিশ হস্ত পরিমিত স্থান সুবিস্তীর্ণ সুড়ঙ্গ পথের ন্যায় আলোকবিরহিত পথে অতিক্রম করিয়া গেলে মন্দিরের দক্ষিণ পার্শ্বে দেবীর পাষাণ মূর্তি দেখিতে পাওয়া যায়। সে স্থলে দিবা দ্বিপ্রহরের সময়েও অন্ধকার। আলোকের সাহায্য ব্যতীত কিছুই দেখা যায় না। তথায় দিবা রজনী প্রদীপ জ্বালিত হইয়া থাকে। দেবীর বাম পার্শ্বে একটি সুরচিত পঞ্চমুন্ডি প্রস্তর আসন আছে। কিংবদন্তি, ওই আসনে উপবেশন করিয়া রাজা বিক্রমাদিত্য ও বগড়ীর রাজা গজপতি সিদ্ধ হইয়াছিলেন।"
"পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি' গ্রন্থের প্রণেতা শ্রী বিনয় ঘোষ মহাশয় মনে করেন সর্বমঙ্গলা দেবীর মন্দিরটি ষোড়শ শতাব্দীর শেষ অথবা সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে উড়িষ্যার রাজাদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। মূল মন্দিরের ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন গর্ভগৃহে ৫ ফুট উঁচু কৃষ্ণ প্রস্তরে খোদিত দশভুজা সিংহবাহিনী দুর্গা মূর্তি প্রতিষ্ঠিত আছে। ইনিই সর্বমঙ্গলা দেবী নামে খ্যাত।"
মূল মূর্তি ছাড়াও ওই মন্দিরে আরো কয়েকটি প্রস্তর মূর্তি আছে। "দুর্গার ধ্যানে সর্বমঙ্গলা দেবীর নিত্য অন্নভোগ দ্বারা পূজা এবং আশ্বিন মাসে চার দিনব্যাপী সাড়ম্বরে শারদীয়া উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।.....
এখানে উল্লেখযোগ্য যে,মহিষ বলির হাঁড়িকাঠ মন্দির প্রাঙ্গণের বাহিরে এবং ছাগল বলির হাঁড়িকাঠ মন্দির প্রাঙ্গণের মধ্যে প্রোথিত আছে।
শোনা যায়, পূর্বে সর্বমঙ্গলা দেবীর নিকট নরবলিও হইত। মন্দির প্রাঙ্গণের বাহিরে উত্তর দিকে 'পাঠগেড়িয়া' নামে একটি পুষ্করিণী আছে। পুকুরের মধ্যস্থলে একটি কুঁয়া ও পাথর নির্মিত একটি যূপকাষ্ঠ প্রোথিত আছে বলিয়া শোনা যায়।"
"বর্তমানে দেবীর পূজা- পার্বণাদি একটি ট্রাস্টি কমিটি কর্তৃক পরিচালিত হয় এবং ভট্টাচার্য, চক্রবর্তী, সিদ্ধান্ত ও চট্টোপাধ্যায় পদবীধারী ব্রাহ্মণ গন শরিকভাগে বংশ পরম্পরায় দেবীর নিত্য পূজাদি করিতেছেন।"
বিধুমুখী দেবীর বাবা কমলা চরণ ভট্টাচার্য আগে সর্বমঙ্গলা মন্দিরে পুরোহিতের কাজ করতেন। এখন ওই দায়িত্ব পালি অনুযায়ী সামলান বিধুমুখী দেবীর বড় দাদা তারাপ্রসাদ ভট্টাচার্য ।
(চলবে)
*********************************
From:-
Dr. Samiran Sarkar
Khelaghar, Lautore,
P.O : Sainthia, Dist : Birbhum.
W.B - 731234
P.O : Sainthia, Dist : Birbhum.
W.B - 731234