গল্প ।। ডায়েরির পাতা ।। সুনীপা শী
0
মে ০১, ২০২৫
ডায়েরির পাতা
সুনীপা শী
ত্রয়ী এই প্রথম তার মায়ের হয়ে পরিবারের দাদু, ঠাম্মী ও বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে কথা বলল।
ত্রিশটা বছর ধরে মা তার নিজের সংসারের মানুষদের ভালোবেসে মুখ বুঝে সব অন্যায় সহ্য করে গেছে।মায়ের প্রতি অন্যায় দেখে ত্রয়ী আর মুখ বুঝে থাকল না । যে দিন দাদু,ঠাম্মী আর বাবাকে বলল মাকে নিয়ে মার্দাস ডে- তে দুই দিনের জন্য দীঘা ঘুরতে যাবে সেই দিনই মুখ খুলল।
ঠাম্মী- তোর মাকে নিয়ে ঘুরতে গেলে, সংসারের এতো কাজ করবে কে?
বাবা- সকালবেলা অফিসের রান্না তোর ঠাম্মীর তো বয়স হয়েছে।
দাদু- মেয়ে হয়ে চাকরি করছ বলে , তোমার মাকে নিয়ে তুমি ঘুরতে যাবে এটা আমি বরদাস্ত করব না।
শেষে মা বলল- থাক না ত্রয়ী, শুধু শুধু কেন অশান্তি বাড়াছিস?
আমার মতন মেয়ে মানুষের ঘুরাঘুরি মানায় না । চার দেয়ালের মধ্যে থেকে সংসারের কাজ করায় মানায়। তুই বরং তোর বন্ধুদের সাথে যা।
ত্রয়ী- কতবার তো বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়েছি । কখন তোমায় কি জোর করেছি ? এবার যে আমার বন্ধুদের সাথে তাদের মায়েরা যাচ্ছে দীঘায় গিয়ে মার্দাস-ডে পালন করবে। তোমাকে না নিয়ে কিছুতেই যাব না ।
দাদু- বাবা কে বলল -দেখেছিস খোকা তোর মেয়ের সাহস দিন দিন কেমন বেড়ে যাচ্ছে।
ঠাম্মী- ঠিকই বলেছ তুমি । দু'পয়সা ইনকাম করছে বলে ভেবেছে ওর কথা আমরা সবাই শুনব । এ সবই ওর মায়ের শিক্ষাতে হচ্ছে ।
ত্রয়ী- একটু ভুল বললে ঠাম্মী। মা আমাকে কিছুই বলেনি । আসলে বড় হয়েছি তো ঠিক ভুল টা বিচার করতে পারি।বলছিলে না এবার থেকে আমার কথা তোমাদের শুনতে হবে ।তেমন ভাগ্য বোধয় আমার হয় নি ।বরং এবার থেকে আমার কথা মা শুনবে।
বাবা- রেগে গিয়ে ত্রয়ী বলে ডেকে ,চাকরি করো বলে কি ঠাম্মী র সাথে এই ভাবে কথা বলতে পারিস না। ভুলে যাস না তুই সবার ছোট। ছোট ছোটো র মতন কথা বলিস।
ত্রয়ী র মা- চুপ কর না মা আর কথা বারাস না ঘরে ।ঠাম্মী, দাদু ,বাবার দিকে তাকিয়ে হাত জর করে ত্রয়ীর হয়ে আমি ক্ষমা চাই ছি।
ত্রয়ী- না মা না আর ঐ মানুষ দের কাছে হাত জোর করবে না ।দিনের পর দিন তুমি চুপ করে থাকতে পার ।কিন্তু আমি আর চুপ করে থাকব না ।
ত্রিশ টা বছর তুমি তো মুখ বুজে সব সহ্য করে গেছ ,এই সংসারের জন্য।এই সংসারের মানুষ দের জন্য। আর কত ,কত দিন তুমি চুপ করে থাকবে?
ত্রয়ী র মা - চুপ কর না মা ।
ত্রয়ী- বলতে দাও মা বলতে দাও। রাতের পর রাত চোখের জল ফেলে গেছ।"বাবার দিকে তাকিয়ে ",যে মানুষ টা তোমাকে ভালোবেসে ত্রিশ টা বছর তোমার সাথে সংসার করছে ,সেই মানুষ টার কষ্ট কোন দিন তুমি বঝনি।
"দাদু,ঠাম্মী " যে মেয়ে টিকে তোমরা ঘরের বৌ করে এনেছ ,
মায়ের কাঁধে হাত দিয়ে ,এই মেয়েটি ,ও এক দিন নিজের ঘর ছেড়ে বাবা ,মা আপন জনেদের ছেড়ে অ পরিচিত তোমাদের কে নিজের বাবা, মা মনে করে আপন করে নিয়েছে ।তোমরা আমার এই মা কে কোন দিন আপন করে নিতে পারনি। শুধু মাত্র মায়ে রা গরীব ছিল বলে ।
শুনেছি মায়ের বিয়ের আগে এই বাড়িতে একটি কাজের মেয়ে ছিল? মা আসার দুই মাস পরে তাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়।
দাদু ঠাম্মী তোমরা বাবার বিয়ে দিয়ে ঘরে কি বৌ- মা এনেছিলে না কাজের মেয়ে এনেছিলে?
ঠাম্মী- দেখ ,দেখ খোকা তোর মেয়ে কি বলছে।তোর বৌ -কে আমি কাজের মেয়ে করে রেখেছি।
দাদু- নিশ্চয়ই তুমি এ -সব বলেছ বৌ মা।
ত্রয়ী র মা- না বাবা আপনারা বিশ্বাস করুন আমি ত্রয়ী কে এ সব কথা কখন-ই বলিনি।
ত্রয়ী - মা এমন কথা আমাকে কোন দিন ই বলেনি।শুধু এই কথা নয় আমি আরো অনেক কথা জানি।
বাবা- আর কি জানিস তুই, বল এখুনি বল।
ত্রয়ী- আচ্ছা বাবা মা তো তোমাকে ভালোবাসে।তুমি মাকে কখন ভালো বেসেছ?
বাবা- তুই কি বলতে চাইছিস, তোর মাকে আমি কোন দিন ভালোবাসি নি।
ত্রয়ী- ভালো বাসুনি যে তা নয়।প্রকৃত যদি ভালোবাসতেক তাহলে রাতের পর রাত যখন মা তোমার জন্য না খেয়ে বসে থাকত তখন তুমি অফিস থেকে এসে নিজে ই খেয়ে নিতেক ।মাকে কখনও বলেছ তুমি খেয়েছ কি? শুধু তাই নয় দাদু,ঠাম্মী তোমরা যখন এক সাথে খেতে বসতেক মাকে কখনও বলছ ঠাম্মী- বৌ মা তুমি ও ভাত টা বেরে না ও।
ঠাম্মী- কি মিথ্যা, কি মিথ্যা। কেন বৌমা তোমাকে কত দিন বলেছি না এক সাথে খেয়ে না ও।
ত্রয়ী- জানি ঠাম্মী তুমি মাঝে মধ্যে মাকে এক সাথে খেয়ে নেবার জন্য বলতেক। ঠাম্মী তুমি প্রতি দিন রান্নার আগে মেপে মেপে চাল দিতেক ।কিন্তু কোন দিন জিজ্ঞেস করেছিলে ভাতের হাঁড়িতে ভাত আছে কি ? কিংবা কড়াতে তরকারি আছে কি ? কোন দিন তুমি জিজ্ঞেস করুনি ঠাম্মী। মাসের অর্ধেক দিন হাঁড়ি র তলায় পরে থাকা ভাত ,কড়া ই ছানা তরকারি দিয়ে আর্ধ পেটা খেয়ে জল খেয়ে পেট ভরাত আমার মা ।
ঠাম্মী- সংসারে থাকতে গেলে মাঝে মধ্যে একটু আর্ধু কম হয় তা বলে তুমি এই সব কথা তোমার মেয়ের কাছে বলে আমাদের নিন্দে করছ।
দাদু- ছি ,ছি বৌ মা।
ত্রয়ী র মা - আপনারা বিশ্বাস করুন এ সব কথা আমি ত্রয়ী কে বলিনি।
বাবা- রেগে গিয়ে, মিথ্যা কথা একদম বলনা তুমি না বললে ও এসব কথা জানল কি করে।
ত্রয়ী- মায়ের কোন কষ্টের কথা আমাকে বলেনি।তবু ও মায়ের সব কষ্টের কথা আমি জানি।
আচ্ছা ঠাম্মী তোমার শরীর খারাপ হলে কষ্ট হয় ।আর মায়ের শরীর খারাপ হলে বলতেক সংসার করতে হলে একটু আধটু শরীর খারাপ হয়।তা বলে কাজ ফেলে রাখলে করবে কে?
শুধু শরীর খারাপ নয় ,বছরে দু একটা শাড়ি কিনতে গেয়ে একটু দামী শাড়ি পছন্দ হলে ,এতো দামী শাড়ি নিতে হবে না ।
জানত বাবা,মা দিনের পর দিন সব কষ্ট সহ্য করেছে ।মুখ ফুটে তোমার কাছে বললে তুমি উত্তর এক টা ই দিতেক ।মা আর তোমার ব্যাপার ।এই সব ম্যেয়েলি ব্যাপারে আমাকে থাকতে বলনা ।অনেক রাত হয়েছে শোবে এস,বলে নিজের ইচ্ছা টা পুরণ করতেক।মায়ের কষ্ট টা বুঝতে না।
জানতো মায়ের কষ্টের কোন কথা ই আমাকে কোন দিন বলেনি ।মা তুমি নিশ্চয় এতক্ষনে বুঝে গেছ এত কথা আমি জানলাম কি করে ? বাবার দিকে তাকিয়ে তুমি রাতে ঘুমিয়ে পরার পর ,সাদা ডায়েরির পাতার উপর মায়ের চোখের জল পরত।কা উ কে বলতে না পারা কথা ,মনের কষ্ট সব ই ডায়েরির পাতা তে লিখত ,তাতে মায়ের কিছু টা কষ্ট দূর হত।
দাদু- ছি ,ছি বৌ মা সংসারের সমস্ত ঘটনা তুমি ডায়েরির মধ্যে লিখে রেখছ? তুমি যে আমাদের অপরাধী বানালে।
ঠাম্মী- ও এবার বুঝেছি মাঝ রাতে কেন তোদের ঘরে আলো জ্বলত ।পরের দিন যখন বৌমাকে জিজ্ঞেস করতাম বলত জল খেতে উঠেছিলাম। তাছাড়া কত বাহানা ও দিয়েছে।
বাবা- ছি,ছি তুমি সংসারের সমস্ত কথা ডায়েরির মধ্যে লিখে সবাই কে জানাতে চেয়েছিলে। আমরা কেমন মানুষ। এমন টি জানলে তোমার সাথে সংসার ই করতাম না।
ত্রয়ী- হেঁসে হেঁসে বলল উচিত কথা বলেছি তো ।
ত্রয়ী র মা - ত্রয়ী, বলে ঠাস করে চড় মারে।
ত্রয়ী- মা তুমি আমাকে চড় মেরে মুখ বন্ধ করতে পারবে না ।আজ কে আমি জর গলায় বলব এই বাড়িতে তোমার থেকে একটা কাজের মেয়ের মূল্য বেশী ছিল।
এক দিন এই বাড়িতে যে কাজের মেয়েটি ছিল তার মাসে মাহিনা ছিল ।বছরে দুটি শাড়ি ছিল ।এমন কি মাঝে মধ্যে ছুটি ও ছিল ।তুমি হলে এই সংসারের বৌ।তোমার তো নিজস্ব একটা খরচা আছে ।সখ ,আল্লাদ আছে।বাবা তোমাকে কোন দিন নিজের ইচ্ছায় তোমায় পাঁচ টা টাকা দিয়েছে? হাত পেতে চেয়েছ সাথে কই-ফেয়ৎ দিতে হয়েছে। কাজের কোন ভুল ত্রুটি হলে ঠাম্মী তোমাকে কথা শোনাতে ছাড়েনি।নিজের স্বাধীনতা বলে কিছু নেই তোমার মা ।বন্দি হয়ে আছো ত্রিশ টা বছর ধরে এই চার দেয়ালের মাঝে।ইচ্ছা থাকলে ও যেতে পারনা নিজের বাবার বাড়ি ,শুধু এই সংসারের কাজ আর কাজ। কেন মা কেন ? আর কত দিন চুপ করে থাকবে ? সংসারের সমস্ত কাজ কর তবু ও তোমার এতটুকু নাম নেই ।
অথচ তুমি এক সময় বি .এ পাস করে টি উ শান করে তুমি তোমার বাবার সংসার চালিয়েছ।সাজ গোজে নিজেকে সুন্দর করে রাখতেক।
আর এখন, সংসারের কাজ করে করে তোমার চোখের নিচে কালি পরে গেছে।বোঝা যায় না তুমি শিক্ষিত বি.এ পাস মেয়ে।এক সময় তুমি লিখেছিলে কলেজের ম্যাগাজিন এ তোমার কত কবিতা ।আজ তুমি লেখ তোমার জীবনে ঘটে যা ওয়া প্রতিদিন এর ঘটনা ।এই ডায়েরির পাতায়। সমস্ত কষ্টের কথা লেখা আছে এই ডায়েরির মধ্যে। তুমি ডায়েরির মধ্যে তোমার সমস্ত কষ্টের কথা লিখেছিলে বলে ই না আমি জানতে পেরেছি এই মানুষ গুলোর ব্যবহার কেমন।
আজ আমি চিৎকার করে বলব তোমার জন্য আমি পড়াশোনা শিখে চাকরী করছি। কিন্তু তুমি ,তুমি তো আমার থেকে ও মেধাবী ছিলে ,তুমি ও তো চাকরী করতে পারতেক ।তা না করে শুধু মাত্র গরীব ছিলে বলে নিজের সব স্বপ্ন কে এই সংসারের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়েছ। এই সংসারের মানুষ জন তোমাকে কোন দিন ও বোঝেনি।
আর নয় মা ,এই সংসার থেকে তোমাকে এবার বের হতে হবে। যারা তোমাকে কখনো বুঝল না ,প্রকৃত ভালোবাসল না তাদের কাছে আর তোমাকে রাখব না । এই ঘর থেকে বেরিয়ে দুটো দিন তুমি না যদি থাকো তহলে এই ঘরের মানুষ গুলো বুঝবে এই সংসারে তুমি কত টা মূল্য বান ছিলে ।সেই সাথে বুঝবে তোমার ও নিজস্ব ইচ্ছা বা স্বাধীনতা আছে।
দাদু ঠাম্মী আর বাবা তোমাদের সবাই কে বলছি মার্দাস ডে তে আমি আমার মাকে নিয়ে দীঘা তে যাব ।তাতে যদি এই বাড়িতে আমার ও আমার মায়ের জায়গা না হয় ,তাতে কোন অসুবিধা হবে না ।আমি যেহেতু চাকরি করি একটা ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানে আমি ও আমার মা থেকে যাব।কি মা যাবে তো আমার সাথে।
ত্রয়ী র মা - চোখে র জল মুছে মুখে হাসি নিয়ে বলল আমি যদি মরে ও যায় তাতে আমার আর কষ্ট থাকবে না ।আমার স্বপ্ন টা তোর মধ্যে দিয়ে সত্যি করেছি ।সেই সাথে এ ও বলছি এই সংসারে অন্তত তুই আমাকে বুঝলি ।
=====================