Click the image to explore all Offers

মুক্তগদ্য ।। স্মৃতির পাতায় ।। সমীর কুমার দত্ত

 

স্মৃতির পাতায় 

সমীর কুমার দত্ত

             

স্বদেশের স্বাধীনতার সমতূল্য বয়সে পদার্পণ করে স্মৃতির পাতা উল্টোলে মনটা হু হু করে ওঠে। স্মৃতি বড়ো আক্ষেপের। যেদিন আমার দেশ বিদেশী বেনিয়াদের হাত থেকে মুক্তি পেলো কতো হিন্দু, মুসলমান,শিখ নির্বিশেষে মুক্তির মন্দিরের সোপান তলে প্রাণ বলিদান দিয়ে, তার কয়েকদিন পরেই আমি ভূমিষ্ঠ হলাম। অর্থাৎ স্বাধীনদেশে জন্মালাম। তখন চারিদিকে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। তার স্বাদ গ্রহণ করার বয়স তখন‌ও আমার হয়নি। তাই পরাধীনতার শৃঙ্খল কী জিনিস তা আমি জানিনা। দেশ ভাগ হয়ে ভারত পাকিস্তান ভিন্ন রাস্ট্র সৃষ্টি হলো বটে তবে হিন্দু ও মুসলিম দুটি পৃথক রাষ্ট্র হিসাবে নয়। ভারতীয় মুসলমানরা পাকিস্তানে আর ফিরে গেলো না। সংবিধান অনেক পরে তৈরি হলো।  জাতি,ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ধর্ম নিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র স্বীকৃত হলো। একসঙ্গে দেশ মাতৃকার সন্তানরা  বড়ো হয়ে উঠতে লাগলাম । জ্ঞান হবার পর থেকে ধর্মের বিভেদ বুঝিনি। একসঙ্গে বেড়ে উঠলাম, খেলাধুলো , পড়াশোনা করলাম। যত বড়ো হয়ে উঠতে লাগলাম ধর্মের বিভেদ প্রকট হয়ে উঠলো। ধর্মের বিভেদ বুঝবোই বা কী করে। ব্রিটিশের পূর্বে এ দেশ শাসিত হয়েছে বহিরাগত মুঘলদের দ্বারা। তাদের বিষয়ে ফলাও করে পড়ে তাদের সম্পর্কে জানতে চেয়েছি। তখন তো বুঝিনি গতকাল যারা আপন ছিলো,তারা আমাদের পর হয়ে যাবে। দেশ ছেড়ে তাদের চলে যেতে হবে ধর্মের ভিত্তিতে। তাহলে  তখনি করা উচিত ছিল।তাই পূর্বসূরিদের এ ভুলের মাসুল গুনতে হচ্ছে উত্তরসূরিদের। যারা দুষ্কৃতী, যারা দেশকে ধ্বংস করতে চাইছে, অবশ্যই তাদের এখানে জায়গা না হ‌ওয়াই স্বাভাবিক। সেখানে ধর্মের কোন ব্যাপার নেই। কিন্তু যেখানে হিন্দু, মুসলমান,বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান জৈন, শিখ ধর্মনিরপেক্ষভাবে সহাবস্থান করছে পরাধীন কাল থেকে তাদের কী হবে?

আমরা বহুপুরুষ ধরে পশ্চিম বঙ্গের অধিবাসী এবং হিন্দু হলেও ঘটি ,বাঙাল নয়। এপার বাংলার হিন্দুরা ঘটি আর ওপার বাংলার হিন্দুরা বাঙাল নামে পরিচিত। আমরা এপার বাংলার হিন্দু,তাই ঘটি।  এপার বাংলার হিন্দু ঘটিরা, দেশভাগের পর আসা ওপার বাংলার হিন্দু বাঙালবা , ওপার বাংলার মুসলিম সব একসঙ্গে খেলাধূলা , পড়াশোনা করেছি এপার বাংলায়। আবার উৎসব অনুষ্ঠানেও যোগ দিয়েছি। কোন‌ও ভেদাভেদ বুঝতে পারিনি। আমার এক সহপাঠী ছিলো , তার নাম রাশেদ আলী মোল্লা। সুপুরুষ ও উচ্চ মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ীর সন্তান। কিন্তু আমাদের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো। হিন্দু দের উৎসব অনুষ্ঠানে যোগ দিতো।  অর্থাৎ যেমন দুর্গা পূজোর সময় ঠাকুর দেখতে বের হতো। ঈদের সময় আমাদের নিমন্ত্রণ করতো। কিন্তু আমাদের সব সময় যাওয়া  হয়ে উঠতো না। ক্লাশে মুসলিম ছাত্রের সংখ্যা কম‌ই ছিলো। ওরা সংখ্যা লঘু ছিলো বটে তবে কোন দুই দুই ভাব ছিলো না।ওদের বেকারীর ব্যবসা ছিলো । অনেক সময় ভালো ভালো কেক নিয়ে আসতো। স্কুলে স্বাধীনতা দিবস পালন হতো। সকলেরই কিছু না কিছু দায়িত্ব থাকতো এবং তা সকলকে পালন করতে হতো। সরস্বতী পূজোর সময় স্কুলে পুষ্পাঞ্জলি দিতো। বড়ো বয়সে কী করতো জানি না। আর আমার সঙ্গে দেখা হয়নি। পরে শুনেছিলাম উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ যাত্রা করেছে।

স্কুলে কোন দুঃস্থ ছেলেদের সাহায্যার্থে ‌ওকে এগিয়ে আসতে দেখেছি। অনেক দুঃস্থ খ্রিস্টান ছেলেকেও সাহায্য করতে পিছপাও হতো না। আমি ওর মতো উচ্চ বিত্তের ন‌ই। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। কখন‌ও মন খারাপ থাকলে কিংবা চুপচাপ থাকলে রাশেদ জিজ্ঞাসা করতো," কিরে, কিছু হয়েছে? চুপ করে আছিস্ কেন? "  
আমি হয়তো বলতাম, " না, না কিছু হয়নি।"
—কিছু হলে বল আমাকে। যদি কিছু করতে পারি। তোর বিপদে আমাকে পর ভাবছিস্।
এরকম‌ই ছিলো আমাদের সম্পর্ক।  একটু আধটু কবিতা লিখতে পারতো। নজরুলকে যারা কাফের বলতো, ও তাদের দলে পড়ে না। তাই নজরুল ওর প্রিয় কবি ছিলেন। গোঁড়া মুসলমান ও ছিল না। সুকান্ত‌ও ওর প্রিয় কবি ছিলেন। পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফরের ভূমিকায়  মহা অসন্তুষ্ট রাশেদ আলী মোল্লা বলেছিল দেশের গদ্দারদের গুলি করে মারা উচিত। কারণ এরা দেশের পক্ষে ভয়ঙ্কর। ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে  যখন আমি মিরজাফরের উদ্দেশ্যে নিম্নলিখিত কবিতাটি লিখেছিলাম ও আমাকে খুব অনুপ্রাণিত করে বলেছিলো, "তোর একটা সুন্দর কবি মন আছে।তুই কবিতা চর্চা করে যা। তোর হবে।"  স্কুলজীবনে রাশেদ‌ই আমাকে কবিতা লেখার প্রেরণা জুগিয়েছিলো। সেকথা আজ‌ও আমার স্মৃতিপটে লেখা আছে।

'মিরজাফর' 

কয়েকজন কৃতঘ্ন, নাম—ধরা যাক, 'মিরজাফর'
এমনকি একটা সারমেয় জানে কৃতজ্ঞতার মানে 
মানব জনম পেয়েও তারা জানে না
তাই মানুষ একে অপরের মুখের দিকে সন্দিহান হয়ে চেয়ে থাকে 
'মিরজাফর'এখনও আছে কিনা,
আসলে 'মিরজাফর'দের মৃত্যু নেই 
‌ওরা অক্ষয় অমর, ওরা হলো রক্ত বীজের ঝাড়ের বংশ
এক একটা রক্ত বীজের ফোঁটা আপন শক্তি বৃদ্ধি করে 
এক একটা 'মিরজাফর' হয়ে জন্ম নেয় 
তাই যুগ যুগ ধরে 'মিরজাফর'রা রাজত্ব করে যায়।

মানুষ এখন মানুষকে বিশ্বাস করে না 
একটা সারমেয় ওই জায়গাটা দখল করে নেয় 
সত্যিকারের কৃতজ্ঞতার পরিচয় দেয় প্রাণ পর্যন্ত দিয়ে
 যা মানুষ পারে না,
'মিরজাফর'রা আছে বলে মানুষের জীবনে কোন নিরাপত্তা নেই
এতোটুকু সুখের জন্য তারা পারে না এমন কাজ ক‌ই
মানব জনম পেয়েও তাই তারা জন্তুর‌ও জঘন্য
তাই ইতিহাস তাদের কৃতকর্ম মুছে দিতে পারে নি কখন‌ও।।
=======================
 

Samir Kumar Dutta 
Pune, Maharashtra 


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.