গল্পঃ বুড়ো বটের আত্মকথা ।। এস আজাদ
ছবিঋণ - ইন্টারনেট
বুড়ো বটের আত্মকথা
__ এস আজাদ
(এক)
বয়সটা কত হলো, আমার নিজেরই মনে নেই। কবে কোন্ সহৃদয় পাখির কর্কশ চঞ্চু মমতা ভরে খুঁটে নিয়েছিল বীজ। ফসলের তরলে ভিজিয়ে রেখে প্রভেনট্রিকুলাসে জারিত করেও যখন ভাঙতে পারে না গিজার্ড তখন ই জেগে ওঠে মহীরুহের সম্ভবনা। তবে এটুকু মনে আছে, সামনের ওই দূরের সড়ক দিয়ে যাতায়াত করত ব্রিটিশ সেনারা। গোরা সেনারা বেওনেট উঁচিয়ে ছুটোছুটি করতো রাতের অন্ধকারে। সে অনেক দিনের কথা। তখন আমি সদ্য যুবক কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনে পদার্পণ করেছি মাত্র। আমার সমগ্র জীবনের অনেক কথাই আর মনে পড়ে না, বয়স হয়েছে তো, স্মৃতি ভ্রষ্টতার অসুখে আক্রান্ত, তবে সব কিছু ভুলে একেবারে যাই নি। চেষ্টা করলে কিছু কিছু এখনো মনে পড়ে। মনে পড়ে সেই বীর কিশোরের কথা যে, দেশ মাতৃকার মুক্তির স্বপ্নে বিভোর হয়ে ঘর ছেড়েছিল। ব্রিটিশ পুলিশের চোখে ধুলো দিতে সে, আমার কাঁধে আশ্রয় নিয়ে বেশ কয়েক রাত কাটিয়েছিল। গভীর রাত্রে যখন মেঘেরাও ঘুমিয়ে পড়ে, তখন আমি পরম মমতায় তার দেহ মনে বুলিয়ে দিতাম শীতল পরশ। হয়তো সে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেছে নয়তো শহীদ হয়েছে না হলে সে আবার আসতো আমার কাছে। আমি তো চলৎশক্তিহীন জড় ভরত। দিনের আঁধার আর রাতের আলোতে আমার ই চোখের সামনে ঘটে চলে কত অন্যায় অনাচার আমি চিৎকার করি ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত মন বিষিয়ে ওঠে গুমরে কেঁদে মরে।
আগে বিকালের দিকটা আমার ভালই কাটতো, কতগুলো ফুলের মতন শিশু খেলতে আসতো আমার শীতল ছায়া তলে, ঝুরি ধরে দোলা খেত আমার কাঁধে চড়ে বসতো। আমার গায়ে বুলিয়ে দিতে তাদের নরম হাতের উষ্ণ স্পর্শ। আমি পরম তৃপ্তিতে উপভোগ করতাম আদর। আজ আমার সব গেছে। তখন এই রাস্তা দিয়ে খরার সময় দু-পাঁচটা মোটর আর গরু ও ঘোড়ার গাড়ি চলতো। সে সব এখন অতীত, মুক্তকেশী অন্ধকারে চারিদিক ঢেকে দিয়ে বিষবাস্পে প্রকৃতির গলা টিপে ধরে বিরামহীন ছুটে চলেছে দুই চাকা থেকে চোদ্দো চাকার যন্ত্রদানব। প্রথম প্রথম হিসেব রাখতাম এখন আর পারিনা স্মৃতিশক্তি ও ঠিকমতো কাজ করে না। তবে মনে হয় সারা মাসে যত পাতার মৃত্যু শোক আমাকে সামলাতে হয় একদিনে তার থেকেও বেশি মোটর গাড়ি চলে এই রাস্তায়।
একদিন সকালের রোদ ঝলমলে স্বপ্নীল আলোয় দেখলাম দেশের ছেলে বুড়োদের সাথে আমার আশেপাশেও তেরাঙ্গায় রাঙা লোকজনের ভিড়। তাদের কথাবার্তা শুনে বুঝলাম দেশটা নাকি স্বাধীন হয়েছে, সেই বন্দুক উঁচিয়ে দৌড়াদৌড়ি করা গোরাদের শাসন শেষ হয়েছে। এখন আমরা স্বাধীন হয়েছি। নিজের মধ্যে কেমন যেন একটা মনে হচ্ছিল, একটু খুশি খুশি ভাব তা ঠিক ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। স্বাধীনতার মানে সেদিন না বুঝলেও আজ বুঝি। আমার পশ্চিমের মাঠটা ছিল একেবারে ফাঁকা, যতদূর চোখ যায় বিস্তীর্ণ ফাঁকা সবুজ মাঠ। সারাদিন পুব দিকে ঘটে চলা নানা কাণ্ড কারখানা দেখতে দেখতে চোখ যখন ভারী আর মনটা ক্লান্ত হয়ে আসতো, তখন ওই পশ্চিমই আমার চোখ ও মনকে দিত আরাম । আজ ক্লান্তি আছে, যন্ত্রণা আছে কিন্তু সেই আরামটা নাই।
স্বাধীন দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পশ্চিম দিকের মাঠে বন্ধ হল চাষ। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা হলো চারিদিক। চুরি হলো আমার স্বাধীনতা। আমার একটা পা আর এক পায়ের কয়েকটা আঙ্গুল উপরে দিল। আমার একটা ফুসফুস অচল হয়ে গেল, হৃদপিণ্ডটা দুর্বল হয়ে পড়ল। এখন, যখন কালবৈশাখী ঝড় ওঠে আমার মাথা ঘোরে, নিজেকে অসহায় আর দুর্বল মনে হয়। মনে হয় শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে পারবো তো? অনেক ডালপালা ছেঁটে ফেলা হলো, ধ্বংস হলো নিরীহ পাখিদের সংসার। কেউ কেউ বলল আমাকে সমূলে উৎপাটন করার কথা, কিন্তু বয়স্ক দরদী কয়েকজনের দয়ায় আমি টিকে রইলাম কোনরকমে। রিটায়ার্ড বাবা যেমন তৃতীয় শ্রেণী নাগরিকত্ব নিয়ে বেঁচে বর্তে থাকে সংসারে। তাকে কি আর থাকা বলে? এর থেকে জেলখানার কালকুঠরিও বোধ হয় ভালো। ইচ্ছে মতন হাত পা নড়ানোর সুযোগ নেই, যেদিকেই বাড়াতে যাই দুমড়ে মুচড়ে আমার দিকেই ফিরিয়ে দেয়। চওড়া রাস্তা আরও চওড়া হলো, একেবারে আমার পায়ের কাছে চলে এলো। পূর্ব দিকে যে বিচ্ছিন্ন বস্তিটা ছিল সেটা ক্রমশই ঘন হতে থাকলো। শুষ্ক মুখ মলিন বেশ উদ্ভ্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকলো ক্রমশ। পশ্চিম মাঠের ঘেরা পাঁচিলের ভিতরে নানা যন্ত্রপাতি নিয়ে বসলো কারখানা। চিমনির ঘন কালো ধোঁয়ায় আমার চোখ মুখ ঢাকা থাকতো সারাক্ষণ, মাঝে মাঝে আমি প্রবল শ্বাসকষ্টে ভুগতাম, পাতাগুলো সবুজ থেকে হলুদ হতে শুরু করল, শরীরে ক্ষয় রোগ বাসা বাঁধলো। তবুও আমি বিষ কে হজম করে নির্বিষ করার কাজ করে যাচ্ছিলাম নীরবে। কারখানা শ্রমিকরা কাজের শেষে আমার ছায়ায় এসে বসত। রাস্তায় বাস চলতে শুরু করল, সেই বাসে কারখানার শ্রমিকরা ওঠে নামে, কত লোক পাড়ি দেয় কোনো অজানা ঠিকানায়। কেউ ফিরে আসে কেউবা ফেরে না। তাতে অবশ্যই কারো বিশেষ কিছু যায় আসে না। কতক অচেনা মুখ আবার ঠিকানা হারিয়ে খুঁজে ফেরে ঠিকানা। যার যায় সে দু-চার দিন হ্যাপিত্যেস করে, তারপর আবার জনস্রোতে…! আমারই পদতলে আজো বাস থামে, কনট্রাক্টর ক্লিনার ছোকরা গুলো চেঁচায় বটতলা… বটতলা… । ওদের দৌলতে মরেও পাব অমরত্বের স্বাদ ভাবতে বেশ লাগে।
আমার গা ঘেঁসে কারখানার পাঁচিলের ধারে একটি দুটি করে বেশ কয়েকটি টিনের চালা ঘর বসলো। গ্রামের দু চারজন অল্প পুঁজির মানুষ চা পান বিড়ি থেকে নুন তেল সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে দেশী চুল্লু পর্যন্ত বেচতে শুরু করল। তাসুরেদের আড্ডায় তাসের নামে শুরু হলো জুয়া। কত লোক সর্বস্বান্ত হল। কারখানার শ্রমিক বস্তির লোকেরাই তো এই বাজারের ক্রেতা।
নরমে গরমে চলছিল বেশ, হঠাৎ একদিন সকালবেলা আচমকা শুনতে পেলাম মানছি না, মানবো না, মানতে হবে, মানতে হবে, দিতে হবে, দিতে হবে কান উচিয়ে শুনবার চেষ্টা করলাম কারখানার গেটের শ্রমিকদের জটলা। এরকম জটলা এর আগে হয়নি এমন নয়, তবে এবারে যেন জটলা জমজমাট। চারিদিকে বিষবাস্পে আমার চোখ-কান প্রায় বুঝে এসেছে, স্মৃতিশক্তি ও প্রায় ক্ষীন। তবে একটু বুদ্ধি চালাচালি করতে মনে পড়ল কাল রাত্রে কয়েকজন লোক কারখানার গেটে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করছে। এতক্ষণে পরিষ্কার হলো বিষয়টা। তারা রাতের অন্ধকারে নোটিশ টাঙ্গাতে এসেছিল, লকআউট নোটিশ। কারখানা বন্ধ। জমজমাট ভাবটা ক্রমশ কমতে শুরু করল। প্রথম প্রথম ক'দিন কারখানার গেটে চলল অবস্থান অনশন, মুহুর্মুহ শ্লোগানে জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলনের শপথ নেয়া হল। পর্বত বাস্তবে মুসিক প্রসব করল। মালিকের মনের বরফ গললো না, বন্ধ কারখানা খুললো না। ইউনিয়নের নেতার বউয়ের গলায় উঠল সীতাহার মেয়ে বিদেশে পড়তে গেল। কারখানা বস্তির ঘুপচি ঘরগুলো অপরাধ মূলক কাজের গবেষণাগার হয়ে উঠল। মাদক পাচার, চোরাচালান কারবার বেশ জমে উঠলো। জমে উঠল শরীরের ব্যবসা, চড়া মেকআপ ঘাম আর যৌনতার গন্ধে আমার চারপাশের পরিবেশটা যেন আরো বিষিয়ে উঠলো। আমার গায়ে ভিখারির সাত তালি জামার মতন নানা রঙের বিজ্ঞাপনের টুকরো চারিদিকে ঝুলে রইল।
(দুই)
বস্তির একটা মেয়ে ছবি, যাকে আমি খুব স্নেহ করতাম ছবি ওর বাবাকে দেখেনি কখনো। ওর জন্মের আগেই বাবা নামক বীর্যবান প্রাণীটি একদিন রাতের অন্ধকারে কাপুরুষের মত ওদের ছেড়ে গেছে অন্য কোনো ছবির মায়ের সন্ধানে।
ছবির মা যখন ছোট্ট শিশুটিকে নিয়ে বেঁচে থাকার অন্য কোন উপায় করতে না পেরে নিজেকে বিক্রি করতো, ছবি তখন আমার ছায়ায় খেলে বেড়াতো। দেখতে দেখতে ছবিও একদিন দেখার মত হয়ে উঠল। ছবি মনে মনে ঠাকুরকে ডাকতো যাতে মায়ের মতো অবস্থা তার না হয়। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস বটতলা বস্তির মানুষের জন্য ভগবান বোধ হয় সুখ-শান্তিটা সঙ্গে দিতে ভুলে গেছিলেন। ঠিক যেন অনেকটা নিম্ন মধ্যবিত্তের রান্নাঘরে ইলিশ রান্নায় নুন দিতে ভুলে যাওয়া। ছবি ভালবেসেছিল কালুকে। কালু, ভ্যানচালক কর্মঠ যুবক প্রতিদিন ভোরবেলা সে করিম চাচার সব্জির দোকানে সব্জি দিতে আসতো। এখান থেকে মাইল পাচেক দূরে মাখনচটি গ্রামে বাড়ি। বাড়ন্ত লাউ ডগার মতো লকলকে ছবির ভরা শরীর দেখে তারও জিহ্বা লকলক করে ওঠে। আমি নিষেধ করেছিলাম কিন্তু বাঁধভাঙ্গা যৌবনের আবেগ তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। কাউকে কিছু না বলে ছবি চুপি চুপি চলে গেল কালুর সাথে। সাত দিন পর যখন ফিরে এলো তখন শাঁখা সিঁদুরে সে এক অন্য ছবি। আর না গিয়েই বা কি করত? প্রতি রাতে খদ্দেরের সাথে শোয়া নগ্ন মায়ের চৌকির পাশে কাপড় টাঙিয়ে আর এক চৌকিতে শুয়ে দরদাম করতো।
বছর দুয়েক সব ঠিকঠাক থাকলে ও তিন বছরের মাথায় কোলে একটা পেটে একটা নিয়ে ছবি ফিরে আসে বটতলা বস্তিতে। তার গালাগালি আর সাপশাপন্ত শুনে বুঝতে পারি কালু আর একজনকে ঘরে তুলেছে। সে রসের কারবারী, ছবির আগে আরেকজনকে তাড়িয়েছে, এক নারীতে তার বেশিদিন মন টেকে না। ক'দিন একদম চুপচাপ থাকার পর একদিন আমারই হাত ধরে ঝুলে পরলো। ওহঃ! সে কি বীভৎস দৃশ্য! এমন ভয়াবহ দৃশ্য আমি আগে দেখিনি, চোখ দুটো গর্ত থেকে ঠেলে বেরিয়ে চলে এসেছে, জিভটা ঝুলে পড়েছে মা কালীর মত, পেটের টাও যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি, তাই সময়ের থেকে অনেকটা বেশি সামনের দিকে প্রসারিত হয়ে আছে পেটটা। জীবন আর মৃত্যুর মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে এক অসহায় নারীর লড়াই শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর জয়। ঝুলে পরার পর যখন ফাঁসটা গলায় পেঁচিয়ে বসতে থাকে ফুসফুসে বাতাস কমে আসতে থাকে তখন বাঁচার ইচ্ছাটা প্রবল আকার ধারণ করে। ছবিও বোধহয় বাঁচতে চেয়েছিল। হাত পা ছুড়ে আমার সাহায্য চেয়েছিল, আমি কিছু করতে পারিনি। এ দৃশ্য আমার জীবনে একটি ক্ষত সৃষ্টি করেছিল যা আজও বিদ্যমান। সারারাত জেগে থাকলাম, একটা নয় দুটি প্রাণ হত্যার পাপ কাঁধে নিয়ে। ভোরের আলোয় বিষাদের সুর বেজে উঠলো সারা বস্তি জুড়ে। নারী মাংস লোভী নর পিশাচ গুলোও হাপিত্যেস করতে থাকলো, তাদের কাছে কেন যায়নি ভেবে। হতভাগী মা টা নাতনিকে বুকে করে ছুটে এল মাথা ঠুকে ঠুকে কাঁদলো। পুলিশ এল কাঁটাছেঁড়া দেহ মর্গে দুদিন পচলো, তারপর পাড়ার ছেলেদের তোলা চাঁদায় ছবি কাঁদরের ধারে ধোঁয়া উড়িয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল। মাঝে মাঝে আমারও খুব মরে যেতে ইচ্ছা করে। আমিও যদি পারতাম ছবির মত মরে যেতে, মেয়েটা বোধ হয় মরে শান্তি পেয়েছে। আর আমি…?
_______