গল্প ।। ছা-পোষা মানুষের ল্যাংচানো ।। রানা জামান
ছা-পোষা মানুষের ল্যাংচানো
রানা জামান
তেত্রিশ বছর সফলতার সাথে সরকারি চাকুরি শেষ করার পরে এখন অখণ্ড অবসরে নেসার আহমেদ। চাকরিতে থাকাকালে এক মূহুর্ত অবসর পাবার জন্য কত চেষ্টা করেছেন; কিন্তু হতো না-কেরানি শ্রেনিদের কখনো হয় না। ওয়াশরুমে গেলেও অফিসের কাজের চিন্তা মাথায় গিজগিজ করতো। কত ছুটি যে বাতিল হয়েছে, তাঁর হিসাব রাখলে ক্ষতিপূরণ চাওয়া যেতো কি? উহু! ছুটি বা অনুমতি না নিয়ে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে সাজা আছে- বসের বকা কিংবা বেতন কাটা হারাহারি অনুযায়ী। কিন্তু ছুটি নিয়ে অর্ধেক কাটানোর পরে বসের তলবে কর্মস্থলে চলে আসতে হলে কোনো পুরস্কার নেই, যেনো এটাই অফিসের নিয়ম। অফিসের প্রধান কর্মকর্তার এসব বিষয়ে ছাড় থাকলেও অধিনস্তদের বিশেষ করে নন-গেজেটেড কর্মচারিদের বেলায় কোনো ছাড় নেই। ভাগ্যের দোষে কয়েকবার ক্যাডার সার্ভিসে মৌখিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে শেষে এক অফিসের নিম্নমান সহকারি পদে ঢুকে বয়স রক্ষা করেন নেসার আহমেদ। এরপরে কয়েকটা ইণ্টারভিউ দিলেও অফিসার পদের চাকরি ভাগ্যে জুটে নি। একটা অতৃপ্তি নিয়ে চাকির করে গেছেন সারাজীবন। উঠতে বসতে দুই সন্তানকে এই পরামর্শই দেন: সরকারি বা বেসরকারি যে কোন চাকরি করো না কেনো, চেষ্টা করবে অফিসার পদে ঢুকতে; তাহলে জীবনটা শান্তিতে কাটাতে পারবে।
নেসার আহমেদ মাঝে মাঝে উপরে তাকান- অনেক বন্ধু, বন্ধু বলা এখন আর ঠিক না, এক সময়ের সহপাঠি অনেক উপরে, কেউ কেউ শীর্ষে; পাশে তাকান- আছে অনেক, পাশে থেকে অবসরে গেছেন; নিচে তাকান- যারা নিচে আছেন, তারা দাপ্তরিক কোনো কাজে নেই, কৃষিকাজ কিংবা মজুরি খেটে অনেকেই চলে গেছেন পরপারে, কেউ কেউ অকাল বৃদ্ধাবস্থায় জটিল রোগে ধুকছেন। এঁদের তুলনায় ভালো আছেন; তাই শুকরিয়া আদায় করেন। দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে পারতপক্ষে উপরে তাকাতে চান না।
ছা-পোষা কেরাণিদের অবসরের পরে কোথায়ও চাকরি পাবার সম্ভাবনা থাকে না। নেসার আহমেদ চেষ্টা করেছিলেন বাসায় বসে না থেকে কিছু একটা করার জন্য। কিন্তু হয় নি। খুঁটির জোর না থাকলে কোনো কালে কিছু হয় না।ওঁর কোনো খুঁটির জোর নেই; থাকলে সারাজীবন কেরানীগিরি করতে হতো না! এখানেই দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখছেন তিনি। আচ্ছা এটি কি ব্যর্থতার জীবন নয়? প্রশ্নটা নিজকেই করেন তিনি। উত্তর পাবার চেষ্টা করেন না।
নেসার আহমেদের সময় কাটছে অলসভাবে। সারাদিন বাসায় বসে টিভি দেখেন, স্ত্রীর রান্না-বান্না দেখেন; স্ত্রীর ফুটফরমাস খাটেন আর ভাবেন। ভাবনটা বেড়ে গেছে কভিডের পরে বিশ্ববাজারের অযুহাতে দেশে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকায়। ওঁর মতো সবাই বুঝতে পারছে, এগুলো দেশের ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজি। ব্যবসায়ীরা এখন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারে আছে; সেকারণে কারসাজি করে নিত্য প্রয়োজনীয় সহ সকল প্রকার জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও ওদর কিচ্ছুটি হচ্ছে না! অভাবনীয় লাভের এমন স্বর্ণসময় হাতছাড়া করছে না ওরা!
সরকার জ্বালানি, গ্যাস বিদ্যুৎ বা পানির দাম বাড়ালে ব্যবসায়ীরা রাতারাতি পণ্যের দাম অধিক মাত্রায় বাড়িয়ে লাভের কড়ি গুণে পাচার করতে থাকে বিদেশে; আর মুচি থেকে শুরু করে রিক্সাওয়ালা, বাদামবিক্রেতা, চা-বিক্রেতা সবাই দাম বাড়িয়ে মূল্য বৃদ্ধি সমন্বয় করে ফেলছে। যারা চাকরি করছে, সরকারি কিংবা বেসরকারি, তারা কিভাবে সমন্বয় করবে? কোনো উপায় নেই গোলাম হোসেন! অবসরপ্রাপ্তদের অবস্থা আরো খারাপ। এখন বাজারে গিয়ে দামাদামি করলে বিক্রেতারা বিদ্রুপ করে, কেউ কেউ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়; এখন মাছও একদরে বিক্রি হচ্ছে।
তাই বাজারে যাবার কথা শুনলেই গা কাঁপে নেসার আহমেদের। তাঁর বাজার করতে যেতে ইচ্ছে করে না। গতানুগতিক বাজার কিংবা সুপারশপে কোনোটাই ছা-পোষাদের পক্ষে নেই। নেসার আহমেদ কখনো সুপারশপে ঢুকেন না; ওখানে সকল কিছুর দাম বাইরের চেয়ে বেশ বেশি থাকে। আজও বাজারে যাবার ডাক পড়েছে। বরাবরের মতো তাকালেন নিজের দিকে। কী দেখেন নিজ গায়ে, নিজেই জানেন না। নিজের অক্ষমতা পরিমাপ করেন কি? বিলম্বে বিয়ে করায় ছেলে দুটো এখনো লেখাপড়ায় আছে। এককালীন গ্র্যাচুইটি হিসেবে পাওয়া টাকা, যা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনে রেখেছেন, ওটার লভ্যাংশ এবং প্রতিমাসে পাওয়া পেনশন দিয়ে সংসার চলছে জোড়াতালির। অবসরে আসার পরে অনেক সাধ-আহ্লাদ বাদ দিয়েছেন; দাম বাড়তে থাকায় নিত্য প্রয়োজনও কমিয়ে দিতে হচ্ছে। কমিয়ে দিয়েছেন ডাক্তারের কাছে যাওয়া। জ্বরটর হলে প্যারসিটামলে আর কপালে জলপট্টি ভরসা এখন। সবসময় প্রার্থনা করেন যেনো কারো জটিল রোগ না হয়। কারো কোনো জটিল রোগ হয়ে গেলে কিভাবে চিকিৎসা হবে, তা ভাবতে পারেন না নেসার আহমেদ।
তখন তাগিদ আসে গিন্নির, কী হলো? সাড়া দিচ্ছো না কেনো? তুমি না গেলে আমাকেই যেতে হবে বাজারে!
নেসার আহমেদ দ্রুত বলেন, না না! আমিই যাবো! আসছি!
নেসার আহমেদ টিভি বন্ধ করে ড্রয়িংরুম থেকে এলেন শয্যাকক্ষে। ফারিয়া আহমেদ বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছেন। বয়স শুধু নেসার আহমেদের বাড়ছে না, বাড়ছে ফারিয়া আহমেদেরও। কোমরের ব্যথার সাথে আর্থারাইটিস আছে। কিন্তু স্বামীর চাকরি থেকে অবসর হলেও স্ত্রীর সাংসার পরিচালনা থেকে অবসর মেলে না। মাঝে মাঝে এ কথাটা বলে থাকেন ফারিয়া আহমেদ। নেসার আহমেদ শুনে যান শুধু, কী বলবেন? কথাটা হাড়ে হাড়ে সত্য। ঠিকা কাজের মহিলা দিয়ে দুই/তিনটা কাজ করালেও রান্নাটা ফারিয়া আহমেদকেই করতে হচ্ছে।
নেসার আহমেদ বললেন, ছেলে দুটো বড় হয়েছে। মাঝে মাঝে ওদেরও বাজারে পাঠাতে পারো।
ফারিয়া আহমেদ বললেন, পরামর্শ প্রদানের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু ওদের কেনো বাজারে পাঠাতে চাই না, তা তুমি জানো।
কিন্তু ওদের বাজার করা শিখতে হবে। নাকি?
অবশ্যই শিখবে! পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক আগে।
কোন পরিস্থিতির কথা বলছো তুমি? রাজনৈতিক না অর্থনৈতিক?
রাজনৈতিক পরিস্থিতি দল বদল হলেও এমনই থাকবে! আমি অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কথা বলছি। বিশ্ববাজারের দাম কমলে দেশেও জিনিসপত্রর দাম কমবে।
নেসার আহমেদ মুচকি হেসে বললেন, সে গুড়ে বালি! বাংলাদেশে এমনটা কখনো হয় না!
তাহলে আর কী করা! কেনাকাটা কমাতে হবে, খাওয়া কমাতে হবে! আজ ছুটির দিন। দুই ছেলেই বাসায় আছে। তুমি ছোট ছেলেকে সাথে নিয়ে যেতে পারো। তবে সাবধান! বিক্রেতাদের সাথে ওকে কথা বলতে দিয়ো না।
কী কী আনতে হবে তার লিস্ট করেছো?
ওয়ারড্রবের উপর লিস্ট ও টাকা রাখা আছে।
স্বর খানিকটা উচ্চগ্রামে নিয়ে ফারিয়া আহমেদ বললেন, শিবলি, ব্যাগ নিয়া বাবার সাথে বাজারে যাও। তুমি দোকানদারের সাথে তর্কে যাবে না! দরদাম যা করার তোমার বাবা করবে।
শিবলি নিজ কক্ষ থেকে বের হয়ে ঢুকলো রান্নাঘরে। তাকের নিচে রাখা একটি ঝুড়ি থেকে দুটো ব্যাগ বের করে শয্যাকক্ষের দরজায় এসে দাঁড়ালো।
নেসার আহমেদ স্ত্রীর দিকে চেয়ে মুচকি হেসে ওয়ারড্রবের উপর থেকে বাজারের ফর্দ ও টাকাটা নিলেন। ফর্দটায় একবার চোখ বুলিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে বললেন, ফর্দে পণ্যের নাম ও পরিমাণ কমছে দিনকে দিন!
ফারিয়া আহমেদ বললেন, তাছাড়া উপায় কী! আমাকে চাকরি করতে দিলে এখন হাত টানাটানি করতে হতো না।
নেসার আহমেদ বললেন, গিন্নির চাকরি করার ভালোমন্দ দুটো দিকই আছে। এ নিয়ে বহু তর্ক হয়েছে তোমার সাথে। এখন ওটা ভেবে লাভ নেই। যা আছে তা দিয়েই সংসার চালাতে হবে আমাদের।
নেসার আহমেদ কক্ষের দরজায় এলেন। বাম হাতে ছেলের পিঠ একবার ছুঁয়ে বললেন, চলো বেটা, বাজার করে আসি।
বাসা থেকে বের হয়ে দরজা টেনে দিতেই অটোলক হয়ে গেলো। লিফ্ট নিচে। শিবলি বাটন টিপে দিলো। লিফ্ট আসছে উপরে। উপরে এসে খুলে গেলো দরজা।
দু'জন লিফটে ঢোকার পরে শিবলি বললো, মাছ কিনতে হবে বাবা?
নেসার আহমেদ বললেন, হাঁ।
আমার মাছ বাজারে যেতে ইচ্ছে করে না!
কেনো?
গায়ে মাছের পানির ছিটা আসে। নোংরা লাগে!
তাজা মাছ কিনতে হলে গায়ে মাছের ছিটানো পানি নিতে হবে! মরা মাছ কিনতে হলে সুপারশপে যাও। গায়ে পানি ছিটবে না। কিন্তু আমি কখনো সুপারশপে যাই না।
মরা মাছ কিনায় সমস্যা কী বাবা?
অনেক সময় মরা মাছ পঁচে যায়; কিন্তু বরফে থাকায় তা বুঝা যায় না। জ্যান্ত মাছ কিনেল এ সমস্যা থাকে না।
মুরগি কিনতে হবে না বাবা?
নেসার আহমেদ পুত্রের কাঁধে স্নেহের হাত রেখে বললেন, মুরগি আর মাছ খেয়েই বেঁচে আছি। মাঝে মাঝে গরুর মাংস কিনি। খাসির মাংসের যে দাম! কত বছর যাবৎ খাসির মাংস কিনি না বলতে পারবো না। তবে মাঝে মাঝে খাই।
শিবলি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, না কিনল মাঝে মাঝে কিভাবে খাচ্ছি বাবা?
আমরা মাসে এক দুইবার কাচ্চি বিরিয়ানি কিনে খাই। খাই না?
শিবলি বললো, খাই বাবা।
কাচ্চি বিরিয়ানি পাকানো হয় খাসির মাংস দিয়া। তাছাড়া কোনো বিয়েতে গেলে খাসির মাংস বেশ খাওয়া হয়।
লিফ্ট নিচে এসে দরজা খুলে গেলে পিতাপুত্র বের হয়ে হাঁটতে থাকলো। রাস্তায় ওদের মাঝে আর কোনো কথা হলো না। রাস্তাটায় কোনো ফুটপাত নেই। প্রচুর গাড়ি চলাচল করে এই রাস্তা দিয়ে। বিশেষ করে রিক্সা ও মোটরবাইক চলে আসে গায়ের উপর। তাই দু'জন খুব সাবধানে রাস্তার কিনার ঘেঁষে হেঁটে চলে এলো বাজারে। রাস্তার পাশে শাকশব্জির বাজার। ভেতরে মাছ, মাংস, মুর্গীর মহাল।
শিবলি জিজ্ঞেস করলো, আগে কী কিনবো বাবা? আগের মতোই মুর্গি?
জ্বী বাপ! মুর্গীর অর্ডার দিয়ে মাছ কিনতে যাবো। এ সময়ের মধ্যে মুর্গী বানানো হয়ে যাবে।
নেসার আহমেদ একটা নির্দিষ্ট দোকান থেকে মুর্গি কিনে থাকেন। অন্যান্য দোকানের চেয়ে ২/৪/৫ টাকা কম রাখেন ঐ দোকানদার। এই আক্রার সময়ে কোনো ক্রেতা ১/২/৫ টাকা কম দিতে পারলে বা বিক্রেতা কম নিলে ক্রেতা খুব খুশি ও সন্তুষ্ট হন। নেসার আহমেদ কোনো দোকানির-ই নাম জানেন না;কিন্তু সবসময় ঐসব দোকান থেকে দ্রব্যাদি কেনায় একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে ওর। হয়তো অধিকাংশ ক্রেতাই বিক্রেতাদের নাম জানেন না। এই ভোক্তা-বিক্রেতা সম্পর্কের কারণে কোনো কোনো বিক্রেতা ৫/১০ টাকা পর্যন্ত কম নিয়ে থাকেন। নেসার আহমেদ ঐ দোকানে আসতেই বিক্রেতা সালাম জানালেন।
নেসার আহমেদ সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আজ ব্রয়লার চলছে কত করে?
দাম শুনে নেসার আহমেদ বললেন, এক লাফে পঞ্চাশ টাকা বেড়ে গেলো! ডিমের দামও বেড়ে গেছে এভাবে।
একজন ক্রেতা এসে দোকানের সামনে রাখা কাটা মোরগ-মুর্গীরর পা, চামড়া, গিলা-কলিজার দাম জিজ্ঞেস করলেন। দামাদামি করে দশ টাকা কমিয়ে এক কেজি নিয়ে চলে গেলেন।
মুর্গী বিক্রতা বললেন, যারা আস্ত মুর্গী কিনতে পারে না, ওরাই এগুলা কিন্না নেয়। এই লোকটা সবসময় আমার দোকান থাইকা কিনে, আপনের মতো।
শিবলি জিজ্ঞেস করলো, এতো পা চামড়া গিলা-কলিজা পায় কিভাবে বাবা?
নেসার আহমেদ পাশে দুটো অর্ধেক কাটা ড্রামের পানিতে রাখা বানানো আস্ত মুর্গীগুলো দেখিয়ে বললেন, এরা হোটেল-রেস্টুরেণ্টে অনেক মুর্গী সাপ্লাই দেয়; তাছাড়া যারা মুর্গী ছিলে নেয়, তাদের চামড়া পা গিলা-কলিজা থাকে। ঐগুলো এভাবে বিক্রি করা হয়।
শিবলি বললো, আমরা ওগুলো কিনতে পারি না বাবা? গিলা কলিজা খেতে আমার খুব ভালো লাগে।
ঠিক আছে বাপ। আরেক দিন কিনবো। তার আগে তোমার মার সাথে কথা বলতে হবে।
নেসার আহমেদ বিক্রেতার দিকে তাকিয়ে মাঝারি আকারের একটি মুর্গি দিতে বললেন।
নেসার আহমেদের অর্ডার শুনে বিস্মিত হয়ে বিক্রেতা বললেন, আপনে বড় বড় দুইটা মুর্গী নিতেন। আজ একটা কিনতে চাইতাছেন, তাও আবার ছোট!
নেসার আহমেদ বললেন, কী করবো বলেন। সরকার ফুয়েল বিদ্যুৎ গ্যাস পানির দাম বাড়ালে সাথে সাথে আপনারা জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেন। আমরা, যাদের বেতন বা পেনশন ছাড়া অন্য কোনো আয় নেই, তারা আয় বাড়াতে পারে না; তাই খাওয়া কমিয়ে দিতে হচ্ছে। মুর্গির চামড়া ছিলে গিলা কলিজা পা পরিস্কার করে রাখবেন আগের মতো করে।
নেসার আহমেদ ছেলেকে সাথে করে মাছ মহালে ঢুকলেন। মুর্গি মহালের পাশেই মাছ মহাল। শিবলি কুচকে আছে নাক। এখন আর মাছ দরাদরি করে বিক্রি হচ্ছে না। সবাই একদর হাঁকাচ্ছে। ইলিশ রুই বা এ ধরনের মাছে পঞ্চাশ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে গেছে কেজি প্রতি।
একজন অতি সাধারণ মহিলা, পরনে ছেঁড়া শাড়ি, এসে একটা পুরনো থালা বাড়িয়ে ধরে বললেন, দশ ট্যাকার মরাধরা গুড়া মাছ দ্যাও বাপ! কদ্দিন মাছ খাই না।
মাছ বিক্রেতা ধমক দিয়ে বললেন, দশ ট্যাকার পঞ্চাশ ট্যাকার মাছ বেচি না! যাও!
নেসার আহমেদ ঐ মহিলাকে একবার দেখে মাছ বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলেন, মলা মাছ আড়াই শ কত?
এক শ টাকা।
আড়াই শ দেন।
আড়াই শ গ্রাম কিনে ঐ মহিলার হাতে দিলেন নেসার আহমেদ। মহিলা নেসার আহমেদের দিকে কৃতজ্ঞ চিত্তে তাকিয়ে বললেন, আল্লায় তোমারে আরো দিক।
মহিলা মাছের পোটলা হাতে চলে গেলেন সামনের দিকে।
শিবলি বাবার দিকে তাকিয়ে থাকলে নেসার আহমেদ বললেন, মহান আল্লাহ বেশি বেশি দান-খয়রাত করতে বলেছেন। নিয়ম মেনে দান-খয়রাত করলে সম্পদ কখনো কমে না।
শিবলি বললো, দান-খয়রাতের নিয়ম কী বাবা?
অন্যতম নিয়ম হলো দান করতে গিয়ে নিজে ভিক্ষুক হওয়া যাবে না!
মাছ বিক্রেতার সাথে কিছুটা দর কষাকষি করে মাঝারি আকারের তেলাপিয়া ও পাঙ্গাস কিনে তরকারি মহালে এলেন নেসার আহমেদ। সাথে শিবলি।
কাঁচা পেঁপে মিষ্টি কুমড়া ধুন্দল ও একটা লাউ কিনেন নেসার আহমেদ। বরবটি টমেটো সিম কেনো কেনে নি শিবলি জিজ্ঞেস করলে নেসার আহমেদ বললেন যে এগুলোর দাম এক শ টাকার উপরে।
তখন ঐ মহিলাকে মাটিতে পড়ে থাকা আধা পঁচা তরকারি কুড়াতে দেখে শিবলি ওকে দেখিয়ে বললো, বাবা, ঐ ভদ্রমহিলা এখানে আধা পঁচা তরকারি কুড়াচ্ছে।
নেসার আহমেদ বললেন, মাছে ফরমালিন দেয়ায় এখন আর পঁচে না, তাই এদের মতো প্রান্তিক মানুষেরা পঁচা মাছ কুড়ানোর মতো মাছ পায় না। শাকসব্জিতে ফরমালিন দিলেও পঁচে, ভেঙ্গে টুকরো হয়। আধাপঁচা ও ভাঙ্গা শাকশব্জি দোকানির ফেলে দেয়। এরা ঐগুলো কুড়ায়। কাওরান বাজারে আধাপঁচা শাকসব্জি বিক্রিও হয়। প্রান্তিক মানুষেরা ওগুলো কুড়িয়ে বিক্রি করার জন্য বসে যায়। চলো এবার শাক কিনতে যাবো।
পুঁইশাক বা পালংশাক না কিনে কেনো কলমি শাক কিনলো শিবলি জানতে চাইলে নেসার আহমেদ বললেন, সব রকমের শাকের পুষ্টিগুণ একই রকম, টেস্ট ভিন্ন হলেও। তাছাড়া এখন ফাইনান্সিয়ালি আমজনতার জন্য বৈরি অবস্থা চলছে। আমাদের মতো যাদের আয় বৃদ্ধির কোনো সুযোগ নেই, তাদের খরচ কমাতে হবে। কম কিনতে হবে, খেতে হবে কম, পরিত্যাগ করতে হবে বিলাসিতা। চল, পেঁয়াজ রসুন আলু কিনার পরে ডিম কিনে চলে যাবো বাসায়।
ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে ডিমের দাম বেড়ে গেছে ডজন প্রতি ত্রিশ টাকা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডিম বয়কটের আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। তাই ডিম কিনতে হবে অল্প। বাপ-বেটা নির্দিষ্ট দোকানে আসতেই একজন ক্রেতা এসে ফাঁটা আধা ভাঙ্গা ডিমগুলো অর্ধেক দামে কিনে নিয়ে চলে গেলেন।
শিবলি লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকলে নেসার আহমেদ বললেন, গড়ের প্রবৃদ্ধি একটা দেশের প্রকৃত প্রবৃদ্ধি না। এতে সরকার আত্মতুষ্টিতে ভোগলেও প্রকৃতপক্ষে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য প্রকটভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ডিম বিক্রেতা কিছু বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইলেন নেসার আহমেদর দিকে।
ঠিকানা:
রানা জামান
ঠিকানা: আনিলা টাওয়ার
বাড়ি#১৮-১৯; সড়ক#৩; ব্লক#আই;
বড়বাগ, মিরপুর-২;
ঢাকা-১২১৬; বাংলাদেশ
মোবাইল ফোন: +৮৮০১৭১৫৮২৬০৫৩