গল্প ।। গুলবাজ বন্ধু ।। শংকর ব্রহ্ম
গুলবাজ বন্ধু
শংকর ব্রহ্ম
পিন্টুরা কয়েকমাস আগে আমাদের পাড়ার একটা বাড়িতে ভাড়া এসেছে। মাঠে ফুটবল খেলতে গিয়ে ওর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। আমারই মতো পনেরো ষোল বছর বয়স হবে। দেখতে রোগা পাতলা ছিমছিমে চেহারা। গায়ের রঙ ফরসা। টিকালো নাক। চোখ দু'টি ভারি উজ্জ্বল। এক নজরে দেখলে ভক্তি শ্রদ্ধা জাগে তার প্রতি। আমারও জেগে ছিল। পথেরঘাটেরদেখা হলে, আমার সঙ্গে ডেকে কথা বলত সে। গল্প করত।
মাঠ থেকে খেলে ফেরার সময়, একদিন বিকেলবেলা আমি আর পিন্টু, পাড়ার কিশোর মহল পার্কে বসে গল্প করছি। পিন্টু বলল, জানিস সেদিন বোসেদের আম বাগনে আম পাড়তে গিয়ে দেখি, একটা আমগাছে পা ঝুলিয়ে বসে আছে একটা মেয়ে। আমি তাকে দেখে মোলায়েম গলায় বললাম, এই মেয়ে তুমি গাছে উঠলে কি করে?
- আমি গাছে উঠতে পারি।
- কি নাম তোমার?
- চুন্নি।
আমি তাকে ঠাট্টা করে বললাম,
- শাকচুন্নি।
সে হেসে বলল,
- হ্যাঁ।
- থাক কোথায়?
- এই গাছে।
- ওখানে বসে কি করছ?
- আম খাচ্ছি। তুমি আম খাবে?
- দাও দেখি দু'টো। পাকা দেখে দেবে।
সে দু'টো আম ডাল থেকে ছিঁড়ে, একটা একটা করে আমার দিকে ছুঁড়ে দিল। আমি দু'টো আমই ক্যাচ লুফলাম। একটা আমের খোসা ছাড়িয়ে, কামড় দিয়ে দেখলাম, কী মিষ্টি! কী মিষ্টি৷!
এতক্ষণ চুপ করে আমি শুনছিলাম। আর চুপ করে না থাকতে পেরে বললাম, গুল-গাপ্পি মারিস না পিন্টু।
- এইজন্যই তোদের বলতে চাই না।
গুল-গাপ্পি মারছে বুঝেও তার গল্প শুনতে ভাল লাগে।
- আচ্ছা, বল শুনি। আর কি বলল মেয়েটা?
- কোন মেয়েটা?
- ওই যে গাছে পা ঝুলিয়ে বসে আম খাচ্ছিল।
- ওহ্ শাকচুন্নির কথা বলছিস?
- হ্যাঁ।
- আমি আম খেতে খেতে ওকে বললাম, চলি।
- আবার আম খেতে ইচ্ছে হলে এখানে এসে আমায় ডেকো, চুন্নি বলে। আমি চলে আসব।
- তুমি তবে আমার বন্ধু হলে?
- হুম।
- আচ্ছা। টা টা বলে আমি চলে এলাম।
- আমায় একদিন নিয়ে যাবি তোর বান্ধবীর কাছে?
- কবে যাবি বল?
- কাল?
- কাল আমার সময় হবে না, বাবার সাথে পিসির বাড়ি যাব।
- বেশ তবে পর্শু।
- আগে কালকের দিনটা যাক, তারপর দেখা যাবে।
না, সে আমায় নিয়ে যায়নি।
এই গল্পটা পিন্টু খেলার মাঠের বন্ধুদের প্রায় সকলকের কাছেই বলেছে। অনেকেই শুনে তাকে আমায় নিয়ে যাবি বলায়, আজ না কাল, কাল না পর্শু, এই বলে ওদের এড়িয়ে গেছে। কাউকেই নিয়ে যায়নি। পিকলু যে গুলবাজ, তা সকলেই জানে।
আর একদিন খেলা শেষ করে আমরা মাঠে বসে গল্প করছি। আমি সাধন দীপক পিন্টু, বাবলু আরও দু'এক জন। আলোচনা হচ্ছে
কিভাবে কিশোর মহল ক্লাবকে ফুটবল টুর্নামেন্টে সামনের বছর হারিয়ে ট্রফিটা নিজেদের অগ্রণী ক্লাব নিয়ে আসতে পারব। এবার আমাদের সামান্য কৌশলগত কিছু ভুলের জন্য কিশোর মহল ক্লাব ট্রফিটা জিতে নিয়ে গেছে।
এমন সময় পিন্টু বলে উঠল, চল রাযদিঘিতে গিয়ে সকলে গা ধুয়ে আসি। খেলার সময় গায়ে এত ধূলো কাদা লাগে। খেলার পর আমাদের গা ধুয়ে বাড়ি ফিরতে হয়।
আমি শুনে বললাম, কেন মাঠের পাশের পুকুরটা কী দোষ করল?
- না কোনও দোষ করেনি। রোজই তো ওই পুকুরটায় আমরা গা ধুই। আমি সেদিন একা একা ওই রাযদিঘিতে গা ধুতে গিয়ে, বড় কদম গাছটার নীচে একটা পরিকে দেখতে পেযেছি।
- কি বলল, পরিটা? বাবলু প্রশ্ন করল।
- কোনও কথা হযনি। শুধুই দূর থেকে দেখেছি। আজ গিয়ে তার দেখা পেলে কথা বলব।
- হ্যাঁ, রোজই এসে যেন সে তোর জন্য কদম গাছের নীচে অপেক্ষা করবে? নিজেকে কৃষ্ণ ভেবেছিস?
- চল না সবাই মিলে গিয়ে দেখি, পিন্টুর জন্য পরি তো আসতেও পারে? সাধন শ্লেষের সুরে রসিকতা করে বলল।
আমি সাধনকে বললাম, পরি আসবে পিন্টুর সঙ্গে দেখা করতে, আমরা গেলে পরি দেখাই দেবে না।
- তা তুই ঠিক বলেছিস। তাহলে আমি একাই যাই। বলে সে পিন্টু উঠে দাঁড়িয়ে, একাই হনহন করে রায়দিঘির দিকে চলে গেল।
ও চলে যেতই দীপক বলল, ছেলেটা এত গণ্পবাজ।
আমরা তার কথা শুনে হা হা করে হাসতে লাগলাম।
এসব কুড়ি বছর আগের ঘটনা। আমরা কেউই ফুটবলার হইনি। বর্তমানে আমরা সকলেই কর্ম জীবনে জড়িয়ে পড়েছি। তবে সকলের সঙ্গেই মোবাইলের দৌলতে যোগাযোগ আছে। মাঝে মাঝে প্রয়োজনে কথা-বার্তা হয়। উৎসব বা বিশেষ কোনও দিনে দেখা-সক্ষাৎ হয়।
এখন আমি একজন উচ্চ-পদস্থ সরকারি কর্মচারী। দীপক সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।
সাধন ওকালতি করে কলকাতা হাইকোর্টে। বাবলু কাপড়ের ব্যবসা করে অনেক টাকা করেছে। আর পিন্টু এখন একজন স্বনামধন্য বাংলা সাহিত্যিক। বিভিন্ন সভা সমিতিতে ভাষণ দিতে যায়। আমাদের অগ্রণী ক্লাবের বাৎসরিক অনুষ্টানে একবার এসেছিল। আমার সঙ্গে দেখা হয়ে ছিল। আমি তাকে দেখে বললাম, কিরে গুলবাজ কেমন আছিস?
পিন্টু হা হা করে অমায়িক হেসে বলেছিল, তোদের মতো তো আর কোনও ভাল কাজ-বাজ পেলাম না। তাই, সেই গুল-গল্প বেচেই তো এখন কোনও রকমে খেয়ে পরে বেঁচে আছি।
আমি বললাম, আমাদের মতো শুধু খেয়ে পরে বেঁচে নয় বন্ধু। সাহিত্যিক হিসাবে তোর বেশ নাম ডাক হয়েছে।
---------------------------------
SANKAR BRAHMA.
8/1, ASHUTOSH PALLY,
P.O. - GARIA,
Kolkata - 700 084.